আতশবাজি

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

সোপান সিদ্ধার্থ
  • ৭১


ছুটতে ছুটতে উঁচু টিলাটার চূড়ায় উঠে গেল ইয়াসিন। এতক্ষণ ও খুব হাসছিল, কারণ বড় ভাই ওমর–কে এই প্রথম দৌড়ে হারিয়ে দিয়েছে সে। বিস্তৃত চৌকোনো মাঠটার যেখানে অনেকগুলো ছোট বড় পাথর আর অল্প কিছু ভাঙা কাঠের টুকরো পড়ে আছে ওই জায়গাটায় পৌঁছালেই সে জিতে যেতো, কিন্তু আজ হঠাৎ নতুন সাফল্যের উত্তেজনায় পুরো মাঠ পেরিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে চেনা টিলাটার কাছাকাছি আসতেই কি যেন ভেবে ওটার এবড়ো-খেবড়ো ঢাল বেয়ে একেবারে ওপরে উঠে এলো। ওর চোখমুখ এখনো খুশিতে চিক চিক করছে, কিন্তু দম নেবার জন্য ছয় বছরের ছোট্ট শরীরটা এবার একটুখানি থেমে, কোমরের দু’পাশে দু’হাত রেখে মাথাটা নিচু করে ঝুঁকে হাঁপাতে লাগলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে আর রোদে ঘেমে ওঠা চিবুক মুছতে মুছতে সে দেখল ওমর -ও ততক্ষণে ওপরে চলে এসেছে।
- “তুমি হেরে গেছ ভাইয়া!”, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ইয়াসিন
- “তুই তো একবার-ই জিতলি, এর পর দেখিস আর পারবি না”
- “দেখা যাবে! মা বলেছে, এখন আমি অনেক বড় হয়েছি। দেখো না, একটা আস্ত রুটি কেমন একাই খেয়ে শেষ করতে পারি ?”
- “হ্যাঁ হ্যাঁ— ঠিক আছে, চল্ এখন নিচে যাই। কলঘর থেকে পানি আনতে হবে, মনে আছে?”
অত্যন্ত ছটফটে ছোট ভাই ইয়াসিন এর চেয়ে বয়সে ওমর বছর আড়াই বড়। প্রায় প্রতিদিন দুপুর গড়ানোর আগে ওদের মা দু’জনকে দুটো গ্যালন আকারের প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে আধ-মাইল দূরে পাঠান পানি আনতে। ফিলিস্তিনের গাজায় শ্যাজ্ইয়া এলাকার যে অংশে ওরা থাকে, বিশুদ্ধ খাবার পানি সেখানে অপ্রতুল হওয়ায় সুপেয় পানির নির্দিষ্ট একটি উৎসস্থানে সকাল থেকেই লম্বা লাইন দিয়ে চলে প্রয়োজনীয় সংগ্রহ। কোনো কারণে একটু দেরি করে লাইনে দাঁড়ালেই পানি নিতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে যায়। তবে— আজ মনে হচ্ছে কলঘরে জমায়েত হওয়া মানুষের ভিড় অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ কম।
ভিড়ের মধ্যে ইয়েলদা চাচীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দূর থেকেই ওমর হাত নেড়ে সালাম জানাল। এখান থেকে খুব কাছে সুলেমান চাচার বাড়ি। দু’বছর আগে, ইয়াসিন-এর চার বছর বয়সে যখন ওদের বাবা ইব্রাহিম আলী নিরুদ্দেশ হন, তখন সুলেমান চাচা আর তাঁর স্ত্রী ইয়েলদা চাচীই ওমর ইয়াসিনদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ান। আর সেই থেকে সন্তানহীন প্রৌঢ় এ দম্পতি ওদের দু’জনের ভরণ-পোষণের আংশিক দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফিলিস্তিনের ছোট শহরতলিগুলোতে খোঁজ নিলে এরকম অনেক পরিবারই পাওয়া যাবে যেগুলোর প্রধান কর্তা বা কর্মক্ষম পুরুষটি হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছেন। আড়ালে অনেকে জানেন, নিরুদ্দেশ হওয়া এসব তরুন-যুবক-প্রৌঢ় পুরুষেরা হয় নেপথ্য আঞ্চলিক রাজনীতির সস্তা শিকার নয়তো একরকম নিশ্চিত অকালমৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনা জেনেও বিবেকের তাড়নায় অবশেষে নাম লিখিয়েছেন কোনো আপাতঃ নিষিদ্ধ সংগঠনের খাতায়। ভয়ংকর অন্যায় আর কদর্য অসম্মানকে কাপুরুষোচিতভাবে মেনে নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চাইতে সাহসিক মৃত্যুই কি শ্রেয়তর নয়? বন্ধুমহলে এবং পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে অনেকেরই ধারণা ইব্রাহিম আলী শহীদ হয়েছেন —যদি ও কোনো অস্পষ্ট অজানা কারণে ছোট্ট ইয়াসিনের বদ্ধমূল বিশ্বাস, তার বাবা দূ-উ-উ-রে কোনো রহস্যদ্বীপে বেড়াতে গেছেন, যেখান থেকে প্রচুর বিস্ময়কর সুন্দর উপহার নিয়ে একদিন ঠিকই তিনি বাড়ি ফিরবেন; তাঁর সাথে থাকবে হরেক রকমের ক্যান্ডি আর চকোলেট —এ ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ।



কলঘরটার কাছাকাছি আসতেই চাচী যেন কিছুটা উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন আজ তারা এতো দেরি করল কেন? শখের দৌড় প্রতিযোগিতার কথা বেমালুম চেপে গিয়ে দু’জনই ইতস্তত অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। খানিকটা সস্নেহে অথচ মৃদু শাসনের ভঙ্গিতে চাচী জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা ওমর, তোমাকে গতকাল কি বলেছিলাম ভুলে গেলে?” বয়সের তুলনায় বেশ পরিণত আর সপ্রতিভ ওমর উত্তরে বললো, “না চাচী, আজকে বিকেলের কারফিউ-র কথা মা -ও বলে দিয়েছেন”।
- “হুম্, ঠিক আছে আর দেরি করো না তাহলে। আমি তোমাদের জন্য পানির এই বোতল দুটো এর মধ্যেই ভরে রেখেছি। এগুলো নিয়ে যাও, আর খালি গ্যালনগুলো এখানে রেখে যেয়ো”
- “জ্বি আচ্ছা”
- “তোমাদের মা ভালো আছেন তো?”
- “হ্যাঁ চাচী, মা এখন অনেকটাই সুস্থ ”
- “এই যে! জনাব বিচ্ছু! এটা আপনার জন্য –”, ইয়াসিনের হাতে রঙিন মোড়কের ছোট একটা প্যাকেট দিয়ে বললেন চাচী।
- “এটার ভেতর কি আছে, চাচী ?” জানতে চাইল ইয়াসিন
- “বাড়ি গিয়ে খুলে দেখবে, এখন তোমার পকেটে রেখে দাও”।
- “জ্বি আচ্ছা।”
কৌতূহলী, অস্থির ইয়াসিন খুব চাইছিল এখনি প্যাকেটটা খুলে দেখে। কিন্তু চাচীর আদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপাততঃ ওটা সে তার হাফপ্যান্টের পকেটে রাখতে যাচ্ছে, ঠিক ঐ মুহূর্তেই কোত্থেকে দু’জন আকাশি রঙের ইউনিফর্ম পরা মহিলা টহল-পুলিশ এসে ওদের তিন জনকে দু’পাশ থেকে ঘিরে ধরল। দুই পুলিশের চোখেই কুচকুচে কালো সানগ্লাস, কাঁধে এম-ওয়ান কারবাইন বন্দুক, মুখাবয়বে অ-নারীসুলভ নির্বিকার রুক্ষতা আর ঠোঁটের কোনায় সাঁটা তীব্র তাচ্ছিল্য। এরা ইসরায়েলি মাশা’য়াজ সিকিউরিটির নারী সদস্য। ওমররা এতক্ষন খেয়াল করেনি, পাশেই কয়েক গজ দূরে দাঁড়ানো আরও জনা চারেক পুরুষ টহল-পুলিশ ওদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সিগার ফুঁকছে আর খুব আয়েশী ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে।
-“এই পিচ্চি! তোর পকেটে কি দেখি?– বের কর্!”, প্রচণ্ড ধমকের সুরে হিব্রু, আরবি মিশ্রিত ভাষায় বলল প্রথম মহিলা পুলিশ। প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় জনের স্বগতোক্তি, “বোমা-গ্রেনেড জাতীয় কিছু একটা হবে, আর কি!”
ইয়াসিনের কাছে এ ধরনের আচমকা পরিস্থিতি একেবারেই নতুন। ঘটনার আকস্মিকতায় ওর নিষ্পাপ দুরন্ত হাসি-খুশি মুখটা যেন হঠাৎ চুপসে গেছে। ইয়েলদা চাচী পুলিশদের উদ্দেশ করে বিনয়ের সাথে খুব মিনতি স্বরে বললেন, “ম্যাডাম, ওরা অনেক দূর থেকে এসেছে পানি নেয়ার জন্য, এখনি চলে যাবে, ওরা আমার নিজের ছেলের মতো, পথে খাওয়ার জন্য কিছু মটর ভাজা দিয়েছিলাম” –এক নিশ্বাসে বলে যাওয়া চাচীর কথাগুলোর প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না দিয়ে প্রথমজন এক ঝটকায় ইয়াসিনের প্যান্টের পকেট থেকে ছোট পুঁটলিটা বের করে ওটার মোড়ক টেনে ছিঁড়ে ফেলল। সাথে সাথে প্যাকেটের ভেতর থেকে সমস্ত চিনি-ভাজা মটর দানাগুলো চচ্চড় করে মাটিতে পড়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে গেল। মাটিতে গড়ানো মটরগুলোর মধ্য থেকে দ্বিতীয় পুলিশটি কিছু একটা কুড়িয়ে নিয়ে শ্লেষ হাসি মেশানো গলায় জানতে চাইল, “এটা কি?”
সবাই তাকিয়ে দেখল ওটা ছোট বাচ্চাদের একটা খেলনা ঘড়ি। আজ বিকেলে শহরে কারফিউ জারি না হ’লে সামান্য কিছু উপহার নিয়ে সন্ধ্যায় ওমরদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল সুলেমান চাচার। উপলক্ষ তেমন কিছুই নয়। ইয়াসিনের জন্মদিন। যদিও এ অঞ্চলে জন্মদিন পালনের রেয়াজ খুব একটা নেই, কিন্তু পিতৃহীন দুই শিশুর একঘেয়ে বিরান দৈনন্দিনতাকে রঙিন করার একান্ত আয়োজনটুকু ছিল চাচা-চাচীর মমত্ববোধের বহিঃপ্রকাশ। ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক অস্থিরতা তুলনামূলক থিতু থাকবে ভাবলেও গত রাতে তাঁরা জেনেছেন যে আজ বিকেলের পর থেকে ঘরের বাইরে বেরোনো যাবে না। এজন্যেই ইয়াসিনের জন্মদিন উপলক্ষে উপহার দেয়ার পরিকল্পনায় একটুখানি কাটছাঁট করতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজা শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিরতিহীন বোমাবর্ষণ চলার পর মাত্র তিন-চার দিন হলো জান্তব আক্রমণ কিছুটা থেমেছে। চর্বিতচর্বণ আর খেয়োখেয়ি রাজনীতির বহুব্যবহৃত কৈফিয়তের প্রেক্ষিতে এ হামলা চালানো হলেও এতে এর মধ্যেই শিকার হয়েছে অসংখ্য নিরপরাধ শিশু, নারী ও বৃদ্ধ। পৃথিবীর অমোঘ নিয়মই হয়তো এই — এখানে নিরপরাধীরাই বারবার নৃশংসতার বলি হবে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক কিংবা বৈশ্বিক সবক্ষেত্রেই বোধ হয় এ নিয়ম সমানভাবে প্রযোজ্য।




বিদ্রুপাত্মক নাটকীয় ঢঙে খেলনা ঘড়িটার ডায়ালে কান পেতে দ্বিতীয়জন ঝাঁঝালো মন্তব্য করল, “কি রে, পলাতক সন্ত্রাসীর বাচ্চা! এর ভেতর কোনো বোমা-টোমা নেই তো?” বলেই দুই পুলিশ খিলখিল করে হাসতে লাগল। অদূরে দাঁড়ানো নিজ দলের পুরুষ সদস্যদের সাথে এদের ঈষৎ চোখাচোখি হওয়ায় ওরাও যেন এ মন্তব্যে অলিখিত সায় দিল। এবারে অন্যজন ওমরের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করে বলল, “আরে, আরে! দেখি! তোর চেহারাটা তো একদম খুদে আত্মঘাতী বোমাবাজদের মতো রে! মাথার চুল এত বড় কেন? কালকেই মনে করে চুল ছেঁটে আসবি।” তারপর পাশের সঙ্গীর সাথে হিব্রুতে কিছু একটা আলোচনা করে, হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ত্বরিত আদেশ দিল, “যা, যা! তাড়াতাড়ি ঘরে যা, একটু পর কিন্তু আকাশে আতশবাজি ফুটবে”।

টহলদাররা চলে যাওয়ার পর ইয়েলদা চাচী দুই ভাইকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে খুব অসহায় আর কাতরভাবে বললেন, “বাবারা, তোমাদের মাকে এ ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই”। এতক্ষন ওমর অনেক কষ্টে, অনেকটা যেন দম বন্ধ অবস্থায় সমস্ত অপমান সহ্য করে চুপ করে ছিল। কিন্তু চাচীর এই বিপন্ন কণ্ঠের অনুরোধ শুনে সে আর শিশুমনের আবেগ ধরে রাখতে পারল না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। নির্দিষ্টভাবে ঠিক কি কারণে তার এই কান্না— নিরুদ্দেশ পিতার প্রতি অচেনা রূঢ় মানুষগুলোর প্রচ্ছন্ন অসম্মান, না কি নিজের অবস্থানগত অসহায়ত্ব?— ওমরের জানা নেই। তবে কারণ যাই-ই হোক, ভেতর থেকে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো ছলকে ওঠা আবেগের হঠাৎ এ উদ্গীরন-এর সাথে সে পরিচিত নয়। তাই যতই সে ঠোঁট চেপে, দুহাতের তেলো দিয়ে চোখ মুছে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি নিয়ে শিশুতোষ আবেগ যেন বার বার গলার কাছে জড়ো হয়ে পাঁকিয়ে পাঁকিয়ে উঠছে। ছোট্ট ইয়াসিন খানিকটা হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কলঘরে জমায়েত হওয়া অন্য লোকজনদের অবশ্য ওদের দিকে তাকানোর ফুরসৎ নেই, সবার মধ্যেই ঘরে ফেরার তাড়া।
সদ্য উপহার পাওয়া তুচ্ছ খেলনা ঘড়িটা ইয়াসিন চুপচাপ মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল। তারপর আস্তে, খুব নিচু স্বরে বলল, “চাচী, এটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে”। ঘড়িটা সযত্নে ইয়াসিনের বাঁ হাতের কব্জিতে পরিয়ে দিয়ে, একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে চাচী ধীরে ধীরে বললেন,
- “বাবারা, আর দেরি করো না, এবার তোমরা রওয়ানা দাও।” আর কথা না বাড়িয়ে, চাচীকে বিদায় বলে দুই ভাই পানির গ্যালনসহ বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।
পথে দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো কথা হল না; শুধু ছোট দুই জোড়া পা যেন কোনও অজানা গ্লানি ঢাকবার ব্যস্ততায় শুকনো রাস্তার ধুলো উড়িয়ে হেঁটে গেলো। নিঃশব্দে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে ওরা দেখল ওদের মা ঘরের দরজার পাশে একা দাঁড়িয়ে, ওদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন।


রাত আটটা বেজে দশ মিনিট। সময়টা জুলাই মাস এর মাঝামাঝি। ইসরায়েল -এর পশ্চিম সীমানায়, যেখান থেকে গাজা শহরতলি পরিষ্কার দৃশ্যমান, সে অংশে স্থাপিত শ্যারট শহরের একেবারে প্রান্তে কোনো এক অনুচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় গমগম করছে পঁচিশ-তিরিশ জনের একটি উৎসাহী জটলা। গত কয়েক ঘন্টা ধরে জড়ো হওয়া বিভিন্ন বয়েসী এসব লোকজনের কারো কারো হাতে পপ্-কর্ণ, কারো হাতে নানা রকম পানীয়, স্যান্ডউইচ, কারো বা ছবি তোলার জন্য দামি ব্র্যান্ডের হাই-রেজোলুশান ডিএসএলআর ক্যামেরা; অত্যুৎসাহী অনেকের হাতে আছে বাইনোকুলার। কেউ কেউ আবার একটু আরামে বসবার জন্য শখ করে সাথে এনেছে ছোট সোফা, চেয়ার ইত্যাদি। তরুণ বয়েসী প্রায় সবার হাতেই সদ্য বাজারে আসা ঝাঁ-চকচকে স্মার্টফোন।
জটলায় একটা উৎসব উৎসব আমেজ। সবাই দারুণ খুশি আর চাপা উত্তেজনা নিয়ে, সামনে বিস্তৃত গাজা উপত্যকার দিকে চোখ রেখে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে করতে কিছুক্ষণ হলো নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। তাদের অপেক্ষা অবশ্য খুব একটা দীর্ঘায়িত হলো না। হঠাৎ চারদিক আলোকিত করে, ওদের মাথার ওপর দিয়ে হুইশেল-এর মতো শব্দে উড়ে গিয়ে প্রথম বোমাটি পড়ল গাজা শহরের মাঝ-বরাবর কোনো এক জায়গায়। পড়ার পর-মুহূর্তেই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়া নীলচে, কমলা রঙের তীব্র আলোর ঝলকানি। আলোর আভাস পুরোপুরি মিলিয়ে যেতে না যেতেই প্রচণ্ড বিকট শব্দে যেন আশপাশের সমস্ত কিছু কেঁপে উঠল। আর সাথে সাথে পাহাড়ের ওপর জড়ো হওয়া লোকগুলো লাফিয়ে উঠে, চিৎকার করে, হাততালি দিয়ে, হৈ হৈ শব্দে সমস্বরে যেন আজ রাতের প্রথম ‘আতশবাজি’-কে স্বাগত জানাল। কেউ একজন অত্যাশ্চর্য হয়ে বলল, “কি বিকট শব্দ!” অনেকে এ মন্তব্যে সায় দিয়ে যোগ করল, “পাহাড়টাই তো কেঁপে উঠেছিল”। ভিড়ের মধ্যে এক তরুণ খুব আফসোস করে জানাল যে তার ক্যামেরায় ছবিটা তেমন ভালো আসেনি। তৎক্ষণাৎ একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বেশ আন্তরিকতার সাথে মনে করিয়ে দিল, “এটা তো মাত্র প্রথম আতশবাজি; একটু পর আরও অনেক ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া যাবে”। যারা ছবি তুলতে আগ্রহী নয়, তাদের কেউ কেউ বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে পরবর্তী বোমানিক্ষেপের দৃশ্য দেখার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।......


দূর থেকে নারীকণ্ঠে কেউ যেন “ওঠো, ওঠো!” বলে আমাকে ডাকছে। একবার দু’বার নয়, বেশ কয়েকবার। কণ্ঠটা ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে আর মনে হচ্ছে ওটা খুব কাছের পরিচিত কেউ। এবার শরীরে মৃদু একটা ধাক্কা দিয়ে কণ্ঠস্বরটি একদম কাছ থেকে ডাকল, “ওঠো! অফিসে যাবে না?” চমকে উঠে চোখ মেলে দেখি আমার স্ত্রী রীতু বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তখনই সম্বিৎ হলো, আমি এতক্ষণ ঘুমের মধ্যে ছিলাম। ও তাড়া দিয়ে বলল, “উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নাও, টেবিলে নাস্তা দিচ্ছি”। শুনেও যেন শুনতে পাচ্ছি না আমি— কেমন একটা ঘোরের মধ্যে— মন খারাপ করে দেওয়া স্বপ্নটার মধ্যে এখনো ডুবে আছি।

- “ক’টা বাজে?”, ঘোরের ভেতরেই আড়মোড় ভাঙতে ভাঙতে বললাম
- “পৌনে আট”, ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে রীতু উত্তর দিল
- “বলো কি!” ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যিই, প্রায় আধঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছি

ফ্রেশ হয়ে, অফিসের পোশাক পরে, আজকের সপ্তাহান্তিক মিটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছাতে গুছাতেই আরও আধঘণ্টা লেগে গেল। নাস্তার টেবিলে অমলেটের প্লেটটা টেনে নিয়ে রীতুকে বললাম বেশি কিছু খেতে পারব না, দেরি করে ফেলেছি। ও ধাঁই করে জবাব দিল, “সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ করো না, রুটিগুলো বানাতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে”। বুঝে নিলাম, কথা বাড়িয়ে অযথা বিপদে পড়ার চেয়ে চটপট খেয়ে নেয়াটাই হবে সময়োচিত পদক্ষেপ। নরম করে জিজ্ঞেস করলাম,
- “আমিন গাড়ি বের করেছে?”
- “হুম্, পাঁচ মিনিট হলো”।

তাড়াতাড়ি খাচ্ছি দেখে একটু পর রীতু কিছুটা উদ্বিগ্নভাবে বলল, “ঠিক আছে, সব শেষ করতে হবে না, বাকিটা আমি লাঞ্চ-বক্স এ দিয়ে দিচ্ছি”। আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে ছোট একটা “থ্যাঙ্ক ইউ” দিয়ে উঠে পড়লাম। বাসা থেকে বেরোনোর সময় রীতু আজকের পত্রিকাটা অফিসে যাওয়ার পথে পড়বার জন্য সাথে দিয়ে দিল।

গাড়িতে বসেই আমিনকে বললাম মৌচাক-মগবাজারের রাস্তাটা এড়িয়ে যেতে। কম করে হলেও মিনিট দশেক সময় তাতে বেঁচে যায়। ছোট গলি ছেড়ে প্রধান সড়কে গাড়ি চলতে শুরু করার পর হাতের ভাঁজ করা খবরের কাগজটা খুললাম। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার ওপরের অংশে ছাপানো একটা ছবির দিকে চোখ যেতেই আমার হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎ সশব্দে ধক্ করে উঠল— মনে হলো আমার হাত-পা-আঙুল-পুরোশরীর যেন দ্রুত ঠাণ্ডা আর অবশ হয়ে যাচ্ছে! এ আমি কি দেখছি! এও কি সম্ভব! রয়টার্সের এক ফটো-সাংবাদিকের তোলা ছবিটাতে দেখলাম, বোমার আঘাতে ধসে পড়া একটি বাড়ির সামনে নির্বাক শুন্যদৃষ্টিতে বসে থাকা একজন মা’র কোলে বালক-বয়েসী রক্তাক্ত দুটি শিশু। ছবির নিচের ক্যাপশনে ছোট করে লেখা “ফিলিস্তিনে গতকালের বোমা হামলায় আশঙ্কাজনকভাবে আহত শিশু ইয়াসিন ও ওমর-কে কোলে নিয়ে ওদের মা সাবাহ্” ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Jyotirmoy Golder শুভ কামনা আপনার জন্য ...........................
ধন্যবাদ জ্যোতির্ময়, আপনাকেও শুভেচ্ছা।
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি কাহিনী ও প্রকাশ ভজ্ঞি মানসম্মত মনে হয়েছে...অনেক ধন্যবাদ সোপান আপনাকে......
সহৃদয় মন্তব্যে প্রাণিত হলাম প্রিয় জ্যোতিদা। শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানবেন।
ওয়াহিদ মামুন লাভলু শিশু ইয়াসিন ও ওমরের বাবা হয়েছে নিরুদ্দেশ। আর তারা দু'জন হলো আশঙ্কাজনকভাবে আহত। ওদের মা সাবাহ্ এসব সহ্য করবেন কিভাবে? মূল্যবান একটি গল্প। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
প্রিয় ওয়াহিদ ভাই, সাবাহ-দের কাছে আমারও একই প্রশ্ন। ধন্যবাদ, শ্রদ্ধা ও শুভকামনা জানবেন।
গোবিন্দ বীন বেশ ভাল চমৎকার।। "আমার চলতি সংখ্যায় কবিতা গুলো পড়ার আমন্ত্রণ করে গেলাম। আশা করি আমার পাতায় আসবেন
ধন্যবাদ প্রিয় গোবিন্দ বিন, অবশ্যই আপনার লেখা পড়ব। শুভকামনা জানবেন।
মাহমুদ হাসান পারভেজ সেই চিনি ভাজা মটর দানাগুলো মাটিতে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে আমি দেখতে পেলাম। গল্পটি আমাকে ভৌগলিক সীমানা ছাড়িয়ে সেই চরম ‘বাস্তব’ জায়গাটাতে নিয়ে যায় যেখানে আমি কোনদিনও যাইনি কিন্তু পড়ার সময় সেটি কথকের মত আমারও স্বপ্ন হয়ে ওঠে শেষ পর্য়ন্ত- নোট: ৫…স্বপ্ন ভাঙার অংশে ‘প্রায় আধঘণ্টার বেশি ঘুমিয়েছি’ এখানে আধঘন্টার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। এটা কি আটঘন্টা হবে?
আপনার সহৃদয় মন্তব্যে আপ্লুত এবং প্রানিত হলাম। হ্যাঁ, ওখানে ‘আটঘণ্টা’ হবে, অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানবেন।
মাইদুল আলম সিদ্দিকী সাসপেন্স ছিল, দারুণ!
ধন্যবাদ, প্রিয় মাইদুল ।
শামীম খান দারুন অনুভব । হৃদয় ছুঁয়ে যায় । পৃথিবী বোধহয় প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে , গাজা আর পশ্চিম তীরকে ভুলতে । এখানে একটি রুটি বা এক বোতল পানির চেয়ে জীবন অনেক সস্তা । লেখার বিষয়বস্তু ভিন্ন , কিন্তু মান উঁচু । লেখকের মুন্সীয়ানা বেশ নজরে পড়ে । একরাশ শুভেচ্ছা লেখকের জন্য । ভাল থাকবেন ।
“এখানে একটি রুটি বা এক বোতল পানির চেয়ে জীবন অনেক সস্তা”— অবিশ্বাস্য মনে হলেও গাজার পরিস্থিতি সাপেক্ষে এটাই সত্য। আপনার মন্তব্য ও সহৃদয় প্রশংসায় প্রানিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ, লেখক।

২৮ সেপ্টেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪