অশরীরী

ভৌতিক (নভেম্বর ২০১৪)

আল মামুন খান
  • ৪৩
  • ৩৩
  • ৫৬
একটা সময় ছিল, যখন ভূতের গল্প শোনার আগ্রহে মনটা আঁকুপাঁকু করত।
সোবহান মামা ছিলেন দারুন গল্প বলিয়ে। শীতের রাতে নানাবাড়ির বারান্দায় খাটের উপরে সকল মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরা গোল হয়ে মামাকে ঘিরে থাকতাম। ধীরে ধীরে গল্প তার ক্লাইম্যাক্সে চলে আসত... আমরাও ভয়ে কাটা দিয়ে উঠা শরীর নিয়ে সবাই যতটুকু পারি মামার কাছাকাছি!
ওহ ! এক সময় ছিল তখন !
আজ মামাও নেই। সেই গল্পও নেই। নেই হৃদয়ের সেই অনুভূতিগুলোও।

এরপর সময়ের সাথে সাথে ইচ্ছেগুলোও দিক পরিবর্তন করতে থাকে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। গল্প তখন শোনার থেকে পড়তে ভালো লাগে। বিভিন্ন ধরণের লিখা পড়ে চলেছি। রম্য রচনা, প্রেমের গল্প, সাইন্স ফিকশন। তবে এগুলোর ভিড়ে ভূত বা ভৌতিক গল্পগুলো একেবারেই হারিয়ে গেলো না। 'হরর ফিল্ম' নামে ভিডিও'র কল্যানে সেই ছেলেবেলার শিহরণ তুলে দেয়া নষ্টালজিক অনুভূতি একটু অন্যভাবে, অন্য রূপে আমার হৃদয়ের অন্ধকারের বন্ধ খাঁচায় বাস করছিল।

কিন্তু আমার এই ৪৩ বছরের জীবনে আমি কি কখনো ভূত বা এই জাতীয় অশরীরী কিছু দেখেছি?
আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি একই সাথে হ্যা এবং না দুটোই বলব। না বলব, কারণ আমি যে অর্থে ভূত সবাই ভাবে, তা মোটেও দেখি নাই। আর হ্যা বলব এই কারনে, আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। আজ এই যে লিখতে বসেছি, আমার অবচেতন মনের কোথায় যেন সেই ভয়ংকর অনুভূতিটুকু আমাকে সেই সময়ের 'ফিলিংটা' এনে দিচ্ছে।

একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসাবে আমি ভূত বা প্রেতাত্মা বিশ্বাস করতে পারি না। আমার আজন্ম লালিত সংষ্কার এবং শিক্ষা আমাকে বাঁধা দেয়। তবে জীন বলে একটি জাতি আছে, যারা সময় সুযোগ পেলে মানুষকে ভয় দেখাতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু এদের সাথেও আমার কখনো দেখা হয় নাই।

আমার গ্রামের বাড়ি প্রত্যন্ত একটি এলাকায়। যেখানে কিছুদিন আগেও বাঁশের সাঁকো ছিল, স্থানীয় ভাষায় যাকে 'চার' বলা হয়। তবে সেখানে আমার এক চাচা ছাড়া আর কোনো আত্মীয় ছিলেন না। আমরা বেশ আগে থেকেই খুলনাতে 'সেটেল্ড' হয়েছিলাম। গ্রামের বাড়িতে চাচা চাচীকে নিয়ে বাস করে আসছিলেন। আব্বা প্রায়ই গিয়ে দেখা করে আসলেও আমি এস এস সি পরীক্ষার পড়ে সেই যে একবার গিয়েছিলাম, এরপরে আর যাওয়া হয়ে উঠে নাই। নাগরিক জীবনে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, নিজের নাড়ির সাথে সম্পর্ক বিহীন এক সম্পর্কহীনের জীবনযাপন করছিলাম।

তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হলে থাকি। একদিন খবর পেলাম চাচার অবস্থা খুবই সিরিয়াস। আব্বা ফোন করে বললেন, ওনারা সবাই খুলনা থেকে রওয়ানা হয়ে গেছেন। আমি যেন এখুনি রওয়ানা হই। আমাকে যেতে হবে সেই বরগুনার বেতাগী উপজেলায়। তখন সকাল দশটা বাজে। আমার একাউন্টে বেশ কিছু টাকা জমা ছিল। বিপদে আপদে কাজে লাগবে বিধায় আব্বাই পাঠিয়েছিলেন। সব টাকা তুলে নিলাম।

বটতলী রেল স্টেশন থেকে মেঘনা এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন রয়েছে। বিকেল পাঁচটায় চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কিন্তু ততোক্ষণ অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হল না। বি,আর,টি,সি বাস স্ট্যান্ড থেকে বাসে করে চাদপুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ছ'ঘন্টা লাগলো চাঁদপুর পৌঁছাতে। এরপর বরগুনা গামী একটি লঞ্চে কেবিন না পেলেও ডেকে শুয়ে বসে রওয়ানা হলাম। তখন আজকের মত মোবাইলের যুগ না। সময় ১৯৯৩ ইং সাল। চাচার অবস্থা জানার জন্য মনটা উদগ্রীব হয়ে থাকলেও কিছু করার ছিল না।

তখন শীতকাল। শীতের পোষাকে নিজেকে ভালোমত জড়িয়ে নেবার পরও লঞ্চে বেশ ঠান্ডা লাগছিল। মূল ঠান্ডাটা ধাতব ডেকের থেকেই আসছিল। আমি ভাবছিলাম কিভাবে পথ চিনে বাড়িতে পৌঁছাব। বেশ আগে গিয়েছিলাম। তাও আব্বার সাথে। এখন কি সেভাবে চিনে যেতে পারব? আর নিজের দাদা বাড়ি যদি মানুষকে জিজ্ঞেস করে যেতে হয়, এর থেকে লজ্জাকর আর কি হতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে আর লঞ্চের একটানা গুমগুম শব্দের ভিতরে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।

প্রচন্ড ঠান্ডা এবং মানুষজনের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গল। মনে করলাম লঞ্চ বরগুনা ঘাটে এসেছে। হাতঘড়ির ডায়ালে সময় দেখতে গিয়ে অবাক হলাম। সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে। কিন্তু লঞ্চ থেমে আছে কেন বুঝলাম না। লঞ্চেই জেনেছি, সাধারণত এগারোটার আগে বরগুনা ঘাটে পৌঁছায় না কখনো। বাহিরে প্রচন্ড কুয়াশা। কিনারে রেলিংয়ের কাছে গেলাম। শক্ত ত্রিপল সরিয়ে বাহিরে তাকিয়ে শুধু ধুঁয়া ধুঁয়া কুয়াশায় ঢাকা চারদিক দেখতে পেলাম।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের লঞ্চটি চরে আটকে গেছে।
সবাই উৎকণ্ঠায় অধীর। কিন্তু কি করার আছে। এই ঠান্ডায় এবং কুয়াশার ভিতরে এই মুহুর্তে আসলে করারও কিছুই নেই। এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেল। দুপুরের দিকে একই লাইনের অন্য একটি লঞ্চ সাহায্যের জন্য আসে। অনেক কষ্ট করে আমাদের লঞ্চটিকে চর থেকে উদ্ধার করা হয়।

রাত আটটায় বরগুনা লঞ্চ ঘাটে প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থায় নেমে এলাম। শরীর ও মন-দুই-ই আর চলছিল না। কিন্তু যেতে হবে এখনো অনেক দূর। জেলা শহর থেকে উপজেলায়, সেখান থেকে আমার গ্রামও কম দূরে নয়। কিন্তু ইতোমধ্যে রাত হয়ে গেছে। বেতাগী যাবার শেষ বাসও চলে গেছে স্ট্যান্ডে গিয়ে জানলাম। এখন ভরসা মটর সাইকেল। একজনকে পেলাম, কিন্তু তাকে যাওয়া-আসার ভাড়া দিতে হবে। আর সে শুধু উপজেলা পর্যন্ত-ই নামিয়ে দিতে রাজী হল। অগত্যা রাজী হতেই হল। ভাঙ্গা-চুরা, যায়গায় যায়গায় পীচ উঠা রাস্তায় প্রচন্ড কুয়াশার ভিতরে দুরন্ত গতিতে মটরবাইকের পিছনে বসে ভাবছিলাম বাড়ির অন্যদের কথা। চাচার কথা। সবাই আমার জন্য এতোক্ষণ চিন্তায় অধীর হয়ে আছে নিশ্চয়ই। দু’পাশের গাছপালাগুলো দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে... বাতাসের ঝাপ্টায় দু;চোখ বুজে আছে... মাংকি ক্যাপ পড়ে নিয়েছি, তারপরও বেশ শীত লাগছে। মটরবাইকের চালক আধা ঘন্টার ভিতরেই উপজেলায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। চালককে আরো কিছু টাকার লোভ দেখালেও সে আমার গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত যেতে কোনোভাবেই রাজী হল না।

কি আর করা, এইটুকু পথ পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। রাত ন’টা বেজে গেছে। শীতের রাত- বিদ্যুতবিহীন গ্রামের মানুষ সেই সন্ধ্যাবেলায়ই ঘুমিয়ে পরে। আর এখন তো সবাই এক ঘুম দিয়েও ফেলেছে মনে হয়। আমি এর আগে আব্বার সাথে এসেছি এখানে। তাও দিনের বেলা। আমাদের গ্রামের পথটি যে রাস্তা দিয়ে ঢুকেছে, সেখানে একটি নতুন কালভার্ট ছিল মনে পড়ল। বড় খালের বিপরীত দিক দিয়ে খালের একটি শাখা গ্রামের দিকে চলে গেছে। কালভার্টটি সেই শাখা খালের উপরেই।

মাটির পথটি ধরে সামনের দিকে আগাতে থাকি। বাড়ি আর মিনিট বিশেক দূরত্বের। তাই একটু জোরেই পা চালাতে শুরু করলাম। মিনিট পনের হাঁটার পরে কেমন যেন লাগল। পথ এরকম অচেনা লাগছে কেন? আমাদের বাড়ি খাঁ-বাড়ি নামে পরিচিত। এর আগে রয়েছে হাওলাদার বাড়ি। সেখানে একটি মাদ্রাসা রয়েছে। আর আমাদের বাড়ির ঠিক আগেই একটি প্রাইমারী স্কুল। কিন্তু এই রাস্তায় এসে সে দু’টির একটিও চোখে পড়ল না। আরো দশ মিনিট হেঁটে রাস্তাটির শেষ সীমায় পৌঁছুলাম মনে হল। এখানেও একটি খাল এলাকাটিকে দু’ভাগে ভাগ করে মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সেখানেও একটি কালভার্ট। কালভার্টের একটু আগেই একটি মুদী দোকান। সেখানে বাইরে একটি বেঞ্চ দেখে বিশ্রামের জন্য বসলাম। দোকানের ভিতরে মানুষ রয়েছে বুঝলাম। কারণ বাইরে থেকে কোনো তালা দেয়া নেই। আর ভিতরে মানুষের কাশির এবং নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পেলাম। লোকটিকে ডাকব কিনা ভাবলাম। এভাবে আন্দাজে ঘুরে মরার কোনো মানেই হয় না। আবার নিজের বাড়ি খুজে পাচ্ছি না, হাস্যকর এই কথাটি-ই বা কিভাবে বলব ভেবে লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রয়োজন কোনো আইন মানে না বলে একটি কথা আছে। তাই দোকানের ঝাঁপে হাত দিয়ে মৃদু নক করলাম। কোনো সাড়া না পেয়ে এবারে একটু জোরেই আঘাত করলাম। ভিতর থেকে ঘুম জড়িত একটি কন্ঠ জিজ্ঞেস করল, ‘ কেডা?’ উত্তরে ‘আমি’ বলা ছাড়া আর কি-ই বা উত্তর দেবার আছে। কিন্তু সাধারণ ভদ্রতা হল, এই ক্ষেত্রে নিজের নাম বলতে হয়। দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন আসাতে এবারে নিজের নাম বললাম। একই সাথে দোকানের এক পাশের ফোঁকর সদৃশ দরোজা দিয়ে একজন বৃদ্ধ বের হয়ে এলেন। হাতে একটি ব্যাটারিচালিত টর্চলাইট। অভদ্রের মত আমার মুখের ওপরে সেটি জ্বালালেন। একমুহুর্তের জন্য অন্ধ হবার অনুভূতি অনুভব করলাম। একটু রেগেও গেলাম। কিছু একটা খারাপ কথা মুখ দিয়ে বেরও হতে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি কোন পরিস্থিতিতে রয়েছে সেই ভাবনা আমাকে এটি বলা থেকে নিবৃত্ত করল।

বৃদ্ধ লাইটটি নিচের দিকে নামিয়ে আমাকে আবারো জিজ্ঞেস করলেন,
‘কেডা আমনে?
নিজের নাম বললাম। আমার সমস্যার কথাও জানালাম। নিজের বাড়ী যেতে পারছিনা শুনে একটু আফসোস করলেন। আমাদের মত শহুরে মানুষ কিভাবে নিজেদের নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরগাছায় পরিণত হচ্ছি, তিনি নিজের গ্রাম্য ভাষায় সেরকমই কিছু আমাকে বললেন। আমাদের কোন বাড়ি জেনে নিয়ে বললেন, আমি অন্য গ্রামে চলে এসেছি। পথ ভুল হয়েছে সেই প্রথম কালভার্টের কাছ থেকেই। এখন আবার উল্টো পথে যেতে হবে আরো প্রায় ঘন্টাখানিক। পথে একটি শ্মশান পার হতে হবে এটাও জানালেন। এরপরে আরো একটি বাঁশের চার (সাঁকো) পার হয়েই আমাদের গ্রামের পথ পড়বে। ভালোভাবে তার কাছ থেকে পথের দিশা জেনে নিলাম এবার।

মুদি দোকান থেকে বিস্কিট এবং কলা কিনে খেলাম। পানি খেয়ে এক প্যাকেট সিগ্রেট (আমার ব্র্যান্ডের পেলাম না) এবং ম্যাচ নিয়ে বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবারো পথে নামলাম। অচেনা পথ... শীতের রাত। আমার কাছে কোন লাইট নেই। অন্ধকারে পথ চলছি। একটু একটু গা ছমছম করছে। সিগ্রেট জ্বালালাম। সিগ্রেটের মাথার আলোয় অচেনা এক পথ ধরে নিজের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি।

মাটির রাস্তাটির দু’পাশে গাছের সারি। আমি যেদিকে যাচ্ছি, পথের বামে একটি সরু খাল রাস্তার সাথে সমান্তরালে এগিয়ে চলেছে। তবে কোনো স্রোত নেই। কারণ নদীর সাথে বড় খালটি যেখানে এসে মিশেছে। সেখানে বাঁধ দেয়া। এই মওশুমে অবশ্য বাঁধ কেটে পানি নিয়ে আসা হয়। কাজ শেষে আবারো বন্ধ করা দেয়া হয় সংযোগ মুখটি।

পথে দু’একটি বাড়ি পড়েছে। তবে সেগুলো মূল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। একটা বাঁক পার হলাম। এবং চমকে উঠলাম। কোথা থেকে একটি বিড়াল আমার পায়ের সামনে এসে পড়ল। ওর নরম শরীরকে মাড়িয়ে যাবার অনুভূতি পেলাম। একই সাথে বিড়ালটির চীৎকার আমার সারা শরীরের পশমকে দাঁড় করিয়ে দিল। নিমিষে বিড়ালটি অন্ধকারে হারিয়ে গেল। আমি আমার হৃদস্পন্দন নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছিলাম। একটু দাঁড়ালাম। চারপাশ গাঢ় কুয়াশায় ঢেকে আছে। আকাশও মেঘে ঢাকা মনে হল। মেঘ নাকি অমাবশ্যার সময় চলছে বুঝলাম না। তবে আকাশে চাঁদের উপস্থিতি নেই। সামনে আরো কয়েক পা এগিয়ে পাশের একটি গাছের উপর থেকে অরণ্যাচারি এক নাম না জানা পাখি বেশ শব্দ করেই ডালপালা নাড়িয়ে উড়ে চলে গেলো। আবারো ভিতরে ভিতরে একটু ফ্রিজ হয়ে গেলাম। ক্রমেই নিজের ভিতরে নিজেকে ঘিরে ভয়ের এক ক্রমবর্ধমান অনুভূতি বেড়েই চলছিল।

ভুত-প্রেত শুধু গল্পে পড়েছিলাম। তবে জীন বলে কিছু একটা রয়েছে, বিশ্বাস করতাম। রাতের এই ভয়ংকর পরিবেশে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল আজ কিছু একটা ঘটবেই। জীন হোক কিংবা প্রেত হোক, আজ মনে হয় সামনে কিছু একটা পড়বেই। আবারো হাঁটা শুরু করলাম। ঝোপের ভিতর থেকে একটা তক্ষক ডেকে উঠল। সামনে দুটো তাল গাছ। বাবুই পাখির বেশ কয়েকটি বাসা ঝুলছে। অন্ধকারেও এক ধরণের আলো রয়েই যায়। সেই আলোতেও পরিচিত কিছু কিছু জিনিসের অবয়ব বোঝা যায়। একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। একটা ‘ডাক’ যে ঐ পরিবেশে এতটা ভয়ের অনুভূতিকে নিয়ে আসতে পারে, তা কেবলমাত্র ভুক্তভোগীই উপলব্ধি করতে পারবে। আরো একটু সামনে এগিয়ে কেমন এক অপার্থিব শব্দ শুনতে পেলাম। সারা শরীরের পশম খাড়া হয়ে গেলো। খালের নিচের দিক থেকে শব্দটি আসছিল। আমার ভিতর থেকে কে যেন বলছিল, ‘ ভুলেও ওদিকে তাকিও না, সোজা চলে যাও।‘ তারপরও কিসের এক সম্মোহনে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

হেঁটে হেঁটে কখন যে শ্মশান ঘাটের কাছে চলে এসেছি বুঝতেই পারি নাই। খালের ওপাড়েই শ্মশান। সেদিকে তাকাতেই কেমন গা ছমছমে অনুভূতিতে আপ্লুত হলাম। সিমেন্টের চারটি পিলারের ভিতর দিয়ে চারটি লোহার পাত আকাশের দিকে উচু হয়ে রয়েছে। একটি টিনের চাল দেয়া আধাপাকা অপেক্ষাগারও রয়েছে। শব্দ লক্ষ্য করে এপাড় থেকে সেদিকে তাকালাম। খালটি বেশী প্রশস্ত নয়। শ্মশানের একেবারে পাড় ঘেষে সাদা বস্ত দিয়ে জড়ানো কিছু একটা নিয়ে দুটি প্রাণীর টানাহেঁচড়া লক্ষ্য করলাম। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে মনে হল। আসলে কুয়াশা অনেক কমে গেছিল। তাই ওপাড়ের শিয়াল দুটির ‘কিছু একটা’ নিয়ে কামড়া কামড়ি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আরো একটু খালের পাড়ের দিকে নেমে গেলাম। এবার দেখলাম সাদা কাপড়ের ভিতর দিয়ে ছোট দুটি পা বের হয়ে আছে। মাথাটা কেমন যেন করে উঠল। সারা শরীর গরম হয়ে গেল। আমি হাজার চেয়েও আমার দৃষ্টিকে সেদিক থেকে ফিরাতে পারছিলাম না। তবে একটি মানব শিশুর মৃতদেহ এভাবে রাতের অন্ধকারে শিয়ালের খাদ্যে পরিণত হবে, আমার স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনায় তা এলোনা। তবে যা দেখছিলাম, তাকেও তো অস্বীকার করতে পারছিলাম না। হাড়ের সাথে দাঁতের সংঘর্ষের কর্কশ শব্দ আমার শরীর গুলিয়ে দিচ্ছিল। অনেকক্ষণ আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। এভাবে কতক্ষণ থাকতাম বলতে পারব না। যদি না আমার পিছন থেকে কারো গলা খাঁকারি দেবার শব্দ পেতাম।

আমার ধ্যান ভেঙ্গে গেল। আমি চমকে আমার পিছনে ফিরলাম। একজন হেঁটে আসছে। সাদা লম্বা ঝুলের শার্ট পরণে। নিচের দিকে অন্ধকার বেশী হওয়াতে দেখতে পেলাম না। হয়ত কালো প্যান্ট পড়েছে। আমার কাছে এসে লোকটি বলল-
: শিয়ালে মরা খায়। অপুর্বর পোলা। গতরাতে মারা গেল। শ্মশানের পাশেই মাটি চাপা দিছিল।
আমি কিছু না বলে লোকটির দিকে চেয়ে রইলাম। সে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: এতো রাতে আপনি এখানে কি করেন? কোন গ্রামের?
: আসলে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। রানীপুর গ্রামের।
: আচ্ছা, অনেক উলটো দিকে চলে এসেছেন দেখছি।
: হ্যা, ভুলে এসেছিলাম। আমার চাচা খুব অসুস্থ। আমি চিটাগং থেকে এসেছি।
: আপনার রানীপুর কোন বাড়ি?
: খায় গো বাড়ি। ওয়াজেদ খান আমার চাচা। চিনেন নাকি?
: হ্যা, নাম শুনেছি। ওদিকে আসলে বেশী যাওয়া হয় না। আমি সুবিদখালীর। আমাদের যাওয়া-আসা সাধারণত ঐ বড় খালের এই পাড় পর্যন্তই। আজ এক দাওয়াতে গেছিলাম। সেখান থেকেই ফিরছিলাম। পথে আপনার সাথে দেখা হয়ে গেলো।
: যাক ,আপনাকে পেয়ে ভালোই হল। অন্তত কথা বলার কাউকে পেলাম।
: চলুন আপনাকে সামনে এগিয়ে দেই। এই যায়গাটা ভালো নয়। রাত বিরাতে একা একা সব যায়গা দিয়ে চলাফেরা করা ঠিক না।

আমি ম্লান হেসে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা ধরালাম, লোকটিকেও অফার করাতে সেও একটি নিয়ে ধরালো। দুজনে ফুসফুস ভর্তি ক্যান্সারের বীজ নিয়ে অবলীলায় মুখ দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছিলাম। কুয়াশায় সেই ধুঁয়া বেশ ভারী হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল।

আরো দশ মিনিট আমরা দু’জনে নীরবে হাঁটলাম। আর কিছু দূর গেলেই একটি বাঁশের চার পড়বে। ওটা পার হলেই আমার গ্রামের সীমানা শুরু হবে। এতোক্ষণ আমি পটুয়াখালী জেলার সুবিদখালি নামক উপজেলার ভিতরে রয়েছি। ঐ সাঁকোটি পার হলেই বেতাগী উপজেলা শুরু হবে। সাকোঁটির ডান পাশে একটি পায়ে চলা পথ চলে গেছে। লোকটির বাড়ি সেদিকেই জানালো। সে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: ওপাড় থেকে একা একা যেতে ভয় করবে না তো?
: ভয়? কিসের ভয়?
: হ্যা, তাও অবশ্য ঠিক। ভয় কিসের? এখন বিজ্ঞানের যুগ। এখন কি আর ঐ ভুত-প্রেতের যুগ আছে?

আমি একটু হাসলাম। কিন্তু লোকটির চাহনি কেমন যেন লাগল। সে আমার আরো কাছে এগিয়ে এলো। আমি একটু শিউরে উঠলাম। লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
: আপনারা শহরের মানুষ। কারেন্টের ভিতরে থাকেন। আচ্ছা, আমি যদি বলি, আমার পা দুইটা উলটো, আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
এবারে আমি একটু থমকে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম-
: তা কি করে হয়?
সে আমার কাঁধে দু’হাত রেখে বলল-
: আপনি নিজের চোখেই দেখুন না।

আমি লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে এবারে তাকে ভালো করে দেখলাম। তার মুখে বসন্তের দাগ। সারা মুখ ভর্তি সেই দাগে। তার চোখের দিকে তাকালাম একপলক। ওর চোখের মনিতে যেন আগুন জ্বলে উঠল। এবার লোকটির পায়ের দিকে তাকালাম। ঠিক সেই সময়ে আকাশে চাঁদকে ঢেকে রাখা মেঘগুলো বাতাসের ভেলায় চড়ে সরে যেতেই চারদিক আলোকিত হয়ে গেল। সেই আলোয় আমি দেখলাম লোকটির পায়ের পাতাদুটি উল্টো দিকে। আর গোড়ালি সামনের দিকে। আমার কাছে কেমন অবাস্তব লাগল। লোকটি হাহ হা করে হাসতে লাগলো। আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। আমি চেতনা হারালাম। ঐ লোকটির হায়েনার মত হাসির শব্দই ছিল আমার চেতনায় সর্বশেষ অনুভূতি।

সেদিন রাতেই আমাকে আমাদের লোকজন খুঁজে পেল। তবে আমার জ্ঞান ফিরলো সেই ভোরে। সারারাত আমাকে নিয়ে সবার সে কি টেনশন। তবে ভোরবেলা আমার জ্ঞান ফিরলে সবাই আমাকে ঘিরে ধরল কি হয়েছিল জানতে। আর আমি কেন উল্টো দিক দিয়ে বাড়ির দিকে আসছিলাম, তাও জানতে চাইল। তবে আমি সবার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে, নিজে একটি প্রশ্নের উত্তর মিলাচ্ছিলাম। আমার প্যান্টের পকেটে মানিব্যাগ যেরকম ছিল, সেভাবেই এখনো রয়েছে। ভিতরে পাঁচ শো’র কিছু বেশী টাকা যেভাবে ছিল, সেভাবেই আছে। কিন্তু প্যান্টের লাইনিঙের ভিতরের চোরা পকেটে যে দশ হাজার টাকা ছিল, তা গেলো কই? আমাকে আমার বাড়ির চাচাতো ভাইয়েরা বেহুঁশ অবস্থায় পেয়েছে। তাদের সাথে আমার ছোট ভাইও তখন ছিল, তাই আমার টাকাগুলো তাদের কারো নেবার প্রশ্নই আসে না।

তবে ভুত বা অশরীরী’র জীবনধারণের জন্য টাকার প্রয়োজন হয়, সেটা তো জানতাম না! ঐ লোকটি কে ছিল? পরেরদিন অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করেও আমি জানতে পারি নাই। মুখে বসন্তের দাগওয়ালা সেই মানুষটিকে আশেপাশের গ্রামের কেউই কখনো দেখে নাই জানালো। তবে লোকটি কে ছিল? আসলেই কি সে কোনো মানুষ ছিল? নাকি মানুষের বেশে কোনো এক অশরীরী আত্মা? তবে আমার টাকাগুলোর কি হয়েছিল?

এই প্রশ্নগুলো আমাকে এখনো ভিতরে ভিতরে বিব্রত করে। আমি যখনই আমার স্মৃতির ভেলায় চড়ে সেই রাতের ঐ সময়গুলোতে ফিরে যাই, আমার ভিতরে এক ধরণের মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ভয় এবং যুক্তির মিশেলে আমার চেতনায় এক অজানা অনুভূতি এসে ভর করে। কায়াহীন এক অজানা জগতের কিছু একটা আমাদের এই বস্তুজগতের ভিতরে এসে বোধ-বুদ্ধির বাহিরে এমন কিছু অনুভূতি রেখে গেল, যা আজো আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে রয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও হয়ত রয়ে যাবে।
ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এ বি এম হারুন খুব সুন্দর লিখেছেন।
সিরাজুল ইসলাম একটানা পড়ে গেলাম। পড়তে পড়তে ককহ্নো দমবন্ধ অনুভূতিতে শিহরিত হয়েছি... অনেক ভালো লিখেছেন গল্পটি। ঝরঝরে ভাষার প্রাঞ্জলতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। Keep it up
রেজওয়ানা রহমান অসাধারন লিখেছেন। ভালো লাগল।
রায়হান শরীফ মানুষকে বনের বাঘে নয়, মনের বাঘেই খায় বেশী। ভুত বলতে কিছুই নেই, সেই সত্যটিই গল্পে মূর্ত হয়েছে। ভালো লিখেছেন। শুভকামনা রইলো গল্পকার।
শাহেদ সিদ্দিকী ভালো লিখেছেন। শুভকামনা রইলো।
চান মিয়া ভুত বলতে কিছু নাই। সব আমাদের মনের এক বিশেষ আবেগপ্রবন অবস্থায় একধরণের হ্যালুসিনেশন। বাস্তবধর্মী সাবলীল গল্পটি অনেক ভালো লাগল। শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় লেখক।
রোজি আরেফিন আসলেই ভয় পেলাম গল্পটি পড়ে। বিশেষ করে শ্মশান ঘাটের যায়গায় এবং কুয়াশা ভেদ করে ঐ লোকটির উদয় হবার সময়টিতে। শুভকামনা রইলো।
শিরিন সুলতানা ভয়ের বর্ণনাটা আসলেই ভালো হয়েছে। ভয় পেয়ে গেছিলাম।
মোস্তফা সোহেল চাচা জানের কি হল তা কিন্তু আর জানা হল না।গল্পের ফিনিসিংয়ে চাচার অবস্থাটা জানিয়ে দিলে ভাল হত।
অনেক ধন্যবাদ। ভূতের ভয়ে আমি এবং আমার দেরী দেখে সবাই আসলে কেমন এক ঘোরের ভিতরে ছিল। চাচাজান সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন।
রুমানা আফরোজ অনেক ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ।

২৫ সেপ্টেম্বর - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৩০ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪