রাত্রি দ্বি প্রহর। বিছানায় শুয়ে যন্ত্রনায় ছটফট করছে তিষা। পুরো নাম রেজওয়ানা আক্তার তিষা। শিয়রের পাশে বসা মা জুবেদা খাতুন। তিষা গত দুই মাস ধরে মরন ব্যধি রোগ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। সর্ব শেষ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিও থেরাপি বিভাগে চিকিৎসার পর তাকে ফেরৎ দেওয়া হয়েছে। তিষার শরীর শুকিয়ে কংকালসার হয়ে গেছে, মাথার চুল গুলো সব পড়ে গেছে। মা গামছা ভিজিয়ে বার বার মেয়ের শরীর মুছে দিচ্ছেন। মায়ের দুচোখ দিয়ে অনবরত ফোটা ফোটা হয়ে পানি পড়ছে আর তিনি শাড়ীর আঁচল দিয়ে কিছুক্ষন পর পর নিজের চোখ দু’টি মুছে নিচ্ছেন।
তিষার এই পরিণতির জন্য সে নিজেই দায়ী। পিতা মাতার অবাধ্য এবং নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ সে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লরছে। উচ্ছাবিলাসী জীবনের আশায় এক পর্যায়ে পিতা মাতার অবাধ্য হয়েই বাড়ী ছেড়ে সে চলে গিয়েছিল। আজ এই অন্তিম সময়ে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘটনাটি মনে করে নিজেই নিজেকে ধিক্ক্ার দিচ্ছে।
তিষা সবে মাত্র নবম শ্রেণীতে উঠেছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও তাদের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সব শেষে অত্র স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের উদ্যেগে অনুষ্টিত হয় কলকাতার লেখক অম্বর রায় রচিত নাটক ‘চোর’। চোর নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র কাদু’র ভূমিকায় অভিনয় করে তিষা। সত্যি তিষার অভিনয় অসাধারন, প্রথম বারেই সে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে।এলাকায় তাকে নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে সবার মুখে মুখে তার নাম। দেখতে যেমন সুন্দরী অভিনয়ও তেমনি খুব সুন্দর।
তিষার বাবা মতিউর রহমান অভিনয়ের বিষয়টি শুনে মেয়েকে অনেক বকাঝকা করেন। এবং এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নিষেধ করেন। আর তিষার মাকে ও বলে দিয়েছেন মেয়েকে বুঝানোর জন্য।
এর পর থেকে এলাকার স্কুল কলেজ এবং ক্লাব গুলোতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা নাটক জাতীয় কোন অনুষ্ঠান হলেই তিষার ডাক পড়ত। তিষার বাবা বরাবরই এর বিরোধীতা ছিলেন। কিন্তু, তিষা তার বাবাকে না জানিয়ে এই সমস্ত অনুষ্ঠানে অংশ নিতো আর মাঝে মধ্যে তার মাকে বলে যেত। মা জুবেদা খাতুন কখনো তিষার বাবাকে বলতেন না।
এস.এস.সি পাস করার পর নেত্রকোণা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হল তিষা। জেলা সদরের কলেজ তিষাদের বাড়ী থেকে ১৮ মাইল দুরে হওয়ায় কলেজ হোষ্টেলেই থাকতে হত তিষাকে। বাড়ীতে থাকতে নাটক জাতীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তিষার বাবা অনেক বার মেয়েকে নিষেধ করেছেন কিন্তু কখনই তিষা তার বাবার কথা শুনেনি। উল্টো তিষা তার বাবাকে সব সময় বলত ‘আমি একজন বড় মাপের অভিনেত্রী হতে চাই, আজকাল কত মেয়েরাই তো সিনেমা নাটকে কাজ করে। কিন্তু তুমি আমাকে নিষেধ কর কেন‘?
কলেজ হোষ্টেলে থাকার কারনে এখন তিষাকে আর মতিউর রহমানের নিষেধাজ্ঞা শুনতে হয়না। তিষা তার ইচ্ছা মত চলাফেরা করতে পারে। ইতি মধ্য নাটক প্রশিক্ষনের জন্য সে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ভর্তি হয়েছে। এবং ’সততা নাট্য গোষ্ঠী’ নামে একটি ক্লাবে নিয়মিত নাটকের মহরা দিতে যায়। এরই মধ্যে নাটকের সাথে জড়িত জেলা সদরের অনেকের সাথে তিষার পরিচয় হয়।
জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহে জেলা সদরের একটি স্বনাম ধন্য ক্লাবের ৫০ বৎসর পুর্তি উপলক্ষে সাত দিন ব্যাপি ’রজত জয়ন্তি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকার নাম করা নাট্য গোষ্ঠী এবং স্থানীয় অনেক ক্লাব বিভিন্ন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান সহ নাটকে অংশগ্রহন করে। প্রতিদিন বিকাল ৩ঘটিকা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চলে তাদের অনুষ্ঠান। রজত জয়ন্তি অনুষ্ঠানের সমাপনী দিনে ‘অগ্নিবীণা’ থিয়েটারের ব্যানারে নেত্রকোণার স্থানীয় লেখক মনোয়ার সুলতান রচিত ‘বিলাস পুরের ফুলবানু’ মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকের কেন্দ্রিয় চরিত্র ফুলবানু’র ভূমিকায় অভিনয় করে তিষা। এ নাটকে অভিনয়ের পর জেলা সদরের সবার মুখে মুখে তিষার নাম ছড়িয়ে পড়ে।
রজত জয়ন্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা থেকে আগত নাট্য কর্মীদের অনেকের সাথেই পরিচয় হয় তিষার। আবার অনেকের সাথে হৃদতার সম্পর্কও গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে একজন ’সাইফুল আলম সুজন’। সে ’কংশ’ নাট্য থিয়েটারের পরিচালক এবং টেলিভিশনের বিভিন্ন নাটকে তাকে অভিনয় করতে দেখা যায়।
আস্তে আস্তে সুজনের সাথে তিষার সম্পর্ক আরও গাঢ় হতে থাকে। নিয়মিত মোবাইল ফোনে তিষা আর সুজনের মধ্যে যোগাযোগ হয়। এরই মধ্যে তিষার উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষা শেষ হয়। তিষা এখন তাদের বাড়ীতে অবস্থান করছে, পরিক্ষার ফল প্রকাশ হবে আরও তিন মাস পর এই দীর্ঘ সময় বাড়ীতে থাকতে তার ভাল লাগছেনা।
হঠাৎ একদিন সকালে সুজনের সাথে তিষার মোবাইল ফোনে কথা হয়
আস্সালামু আলাইকমু ভাইয়া, কেমন আছেন?
ওয়াআলাইকুম সালাম, হ্যাঁ ভাল আছি। তারপর তোমার কি অবস্থা।
আমার আর কি অবস্থা হবে? গত সপ্তাহে পরিক্ষা শেষ হল এখন বাড়ীতে বসে আছি। আর আপনার তো কোন খোঁজ খবর নেই।
আসলে মমতা টিভি’র একটা টেলিফিল্ম নিয়ে আমি খুব ঝামেলায় আছি যে কারনে তোমার সাথে গত দুই তিন সপ্তাহ যোগাযোগ করতে পারিনি। এখন বল তোমার অবস্থার কথা।
আচ্ছা ভাইয়া আমি যদি ঢাকায় আসতে চাই থাকার মত ব্যবস্থা হবে তো?
হঠাৎ করে ঢাকায় কেন?
আমার পরিক্ষার রেজাল্ট দিবে আরও তিন মাস পর, বাড়ীতে থাকতে ভাল লাগছেনা। আর আব্বুর জন্য আমি কোন কিছুই করতে পারিনা। তাই আমি আপনার এখানে চলে আসতে চাই। যদি সম্ভব হয় আপনি আমাকে অভিনয় করার সুযোগ করে দিবেন।
ঠিক আছে আংকেলের সাথে কথা বলে চলে আস। মমতা টিভি’র জন্য নতুন একটা নাটক বানাতে হবে, দেখি তোমার জন্য কিছু একটা করা যায় কি না।
ঠিক আছে ভাইয়া, রাখি তাহলে। কথাটি বলে ফোনটি কেটে দিল তিষা।
সুজন ভাইয়ের কথা শুনে তিষার ঘুম যেন হারাম হয়ে গেল। কবে সে ঢাকায় যাবে মাথায় শুধু এই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু তিষার ভয় হচ্ছে তার বাবাকে, বাবা তাকে যেতে দিবে তো? প্রথমে তিষা তার মাকে বিষয়টি বলল। কিন্তু মা শুনে মেয়েকে ঢাকায় যেতে নিষেধ করল। আর বলল ‘তোর বাবাতো নাটক পাটক করতে তোকে নিষেধ করে, আর তুই কিনা নাটক করার জন্য ঢাকায় যাবি তোর বাবা শুনলে একদম তোকে মেরেই ফেলবে’।
মায়ের কথা কিছুতেই মানবে না তিষা, সে ঢাকা যাবেই যাবে। এক পর্যায়ে বাবা মতিউর রহমানের কান পর্যন্ত কথাটি পৌঁছে গেল।
মেয়ের কথা শুনে মতিউর রহমান রাগে অগ্নি মুর্তি হয়ে গেলেন। মেয়েকে কাছে ডেকে বিস্তারিত শুনলেন এবং ঢাকা যাওয়ার ব্যপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিলেন।
মেয়েকে বললেন, তিষা তুই পাগলামী করবি না আমি কিছুতেই তোকে ঢাকায় যেতে দিব না।
না বাবা আমি ঢাকায় যাবই, তুমি আমাকে নিষেধ করিও না।
দেখ্ তিষা তুই মেয়ে মানুষ তোকে আমি একা একা ঢাকায় যেতে দিবনা। আর যে কাজে তুই যাবি সে কাজ আমাদের জন্য না, আমরা মুসলমান গান বাজনা ইসলাম ধর্মে নিষেধ।
প্লিস বাবা আমাকে ধর্মের দোহাই দিওনা। কত নামি দামি লোক এই নাটক সিনেমায় কাজ করে দেশ বিদেশে সুনাম অর্জন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে পুরস্কার লাভ করেছে। আর তোমরা কিনা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাকে ঘরে আটকিয়ে রাখতে চাও।
কি বলতে চাস তুই? ধমকের সুরে বললেন মতিউর রহমান।
না বাবা, আমার কিছুই বলার নেই। আমি সুজন ভাইকে কথা দিয়েছি তিনি মমতা টিভিতে আমার জন্য নাটকে অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তোমরা যে যাই বল আমি ঢাকা যাবই যাব।
তিষার কথা গুলো শুনে মতিউর রহমানের অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে, চোখ দুটি টলমল করছে। কিন্তু তিষা যখন বাবার মুখে মুখে তর্ক করছে তখন তিনিও তিষার প্রতি কঠোর হয়ে গেছেন।
এদিকে বাবার কথা শুনে তিষা চিন্তায় পড়ে গেল। ঢাকা যাওয়া কি আর হবেনা? সুজন ভাই মমতা টিভিতে অভিনয় করার একটা ব্যবস্থা করে দিতে চাচ্ছেন সেটাও কি তাহলে হাত ছাড়া হয়ে যাবে? না না, বাবার কথায় কান দেওয়া যাবেনা ঢাকা আমাকে যেতেই হবে। বিষয়টি নিয়ে সুজন ভাইয়ের সাথে কথা বলা দরকার, দেখি তিনি কি বলেন।
হ্যালো সুজন ভাইয়া কেমন আছেন?
জি ভালো আছি, তুমি?
আমি ভালো নেই ভাইয়া, আব্বু আমাকে ঢাকা আসতে নিষেধ করেছেন। এখন আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিনা।
আংকেল নিষেধ করছেন কেন? উনাকে একটু বুঝিয়ে বল।
আব্বুকে অনেক বুঝিয়েছি, তিনি আমাকে নাটকে অভিনয় করতে দিবেননা তাই ঢাকা আসতে নিষেধ করেছেন। এখন আপনিই বলুন ভাইয়া আমি কি করব?
সত্যি কথা বলতে কি জান, সুযোগ সব সময় আসেনা। এখন আসলে হয়তো তোমার জন্য কিছু একটা করতে পারব, তাই আমি কি বলি আংকেলকে বুঝিয়ে যে ভাবেই পার যত দ্রুত সম্ভব তুমি চলে আস।
ঠিক আছে ভাইয়া, দেখি কি করা যায়। কথাটি বলে তিষা ফোনটি রেখে দিল।
সুজন ভাইয়ের সাথে কথা বলা শেষ করে আবার তিষার মাথায় ঢাকা যাওয়ার ভূত চাপল। সে ভাবতে লাগল কি ভাবে তার বাবাকে রাজি করানো যায়, আর যদি বাবাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো সম্ভব না হয় তাহলে বাবার অবাধ্য হয়েই সে ঢাকা চলে যাবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তিষা তার মায়ের কাছে বলল, মা তোমরা যে যাই বল আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। তুমি বাবাকে বলে দিও তিনি যদি আমার প্রতি অসšুÍষ্ট হন তবুও আমার কিছুই করার নেই। এ বাড়ীতে আমার আর থাকা হবেনা। তোমরা থাক তোমাদের মান সম্মান নিয়ে, আমার জন্য তোমাদের মান সম্মান নষ্ট হোক সেটা আমি চাইনা। আর তোমাদের জন্য আমার ভবিষ্যতটাও ধুলোয় মিশে যাক সেটাও আমি চাইনা। আগামী দু’এক দিনের মধ্যে আমি ঢাকায় চলে যাব, সুজন ভাই আমার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
তিষার কথা গুলো শুনে মায়ের দু’চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসল। কিন্তু তিষাকে কিছু বলার মত ভাষা তিনি খুঁজে পেলেন না।
যে মেয়েটি এত দিন মা বাবা পাড়া প্রতিবেশী এমন কি বয়সে যারা বড় তাদের সাথে পর্যন্ত চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি আর আজ বাবার মুখে মুখে তর্ক করে, মায়ের সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছে। তাহলে সত্যি কি তিষা মা বাবার অবাধ্য হয়ে গেল। কিসের লোভে পড়ে তিষা আজ মা বাবাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে?
সারা রাত জুবেদা খাতুনের চোখে ঘুম নেই, কিভাবে তিষার মাথা থেকে ঢাকা যাওয়ার ভূতটা নামানো যায় সেই চিন্তায় তিনি অস্থির।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর সম্ভব হল না। দুদিন পর খুব ভোরে কাউকে কিছু না বলে তিষা বাড়ী ছেড়ে ঢাকা চলে গেল।
বেলা আনুমানিক ২টা। মহাখালী বাস টার্মিনালে সুজন ভাইয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে তিষা। এর আগে কখনো সে ঢাকায় আসেনি, এই প্রথম ঢাকায় আসা। বেলা সাড়ে বারোটায় তিষা বাস থেকে নেমেছে আর এখন বাজে দুপুর দুইটা কিন্তু সুজন ভাইয়ের আসার কোন নাম গন্ধও নেই। এরই মধ্যে সুজনের সাথে চার পাঁচ বার ফোনে কথাও হয়েছে, তিনি বলেছেন একটু দাঁড়াও তিষা আমি এখুনি আসছি। শেষ পর্যন্ত দুইটা বিশ মিনিটে সুজন তিষার কাছে এসে পৌঁছল। সুজনকে দেখা মাত্রই তিষা বলল
’এতক্ষনে বুঝি আপনার আসার সময় হল, সেই কখন থেকে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি’।
স্যরি তিষা, অনেক ঝামেলায় ছিলাম তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেল। তারপর রাস্তায় তোমার কোন অসুবিধা হয়নি তো। শেষ পর্যন্ত আসার জন্য আংকেল তাহলে তোমাকে অনুমতি দিলেন?
না ভাইয়া, রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আব্বু আমাকে ঢাকায় আসার জন্য অনুমতি দেননি, আমি কাউকে কিছু না বলে বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছি।
সত্যি! খুব ভালো করেছ। আসলে সত্যি কথা বলতে কি জান তিষা; মিডিয়ায় কাজ করতে হলে পারিবারিক ভাবে একটু বাঁধা বিপত্তি আসবেই। যেমন আমিও তোমার মত অনেক বাঁধার সম্মুখীন হয়েছিলাম, পরবর্তীতে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন চল বাসায় যাই।
বিগত পাঁচ দিন ধরে তিষা সুজনের বাসায় আছে। আজ মমতা টিভির পরিচালকের সাথে সাক্ষাত করার উদ্দেশ্যে তিষাকে নিয়ে বের হয়ে সুজন গুলশানের একটি অভিজাত হোটেলে যায়। প্রায় দুই ঘন্টা অপেক্ষার পর চারজন লোক আসে সুজনের কাছে। সুজন তিষার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল। ওরা সবাই ‘কংশ’ নাট্য থিয়েটারে কাজ করে, কিন্তু এদের মধ্যে মমতা টিভির পরিচালক ছিলেন না।
তিষা যখন পরিচালকের কথা জানতে চাইল তখন সুজন বলল ‘স্যার একটা মিটিংয়ে আছেন রাত দশটায় এখানে আসবেন তোমার সাথে সাক্ষাত করতে এবং স্যার আজ তোমার অভিনয় দেখবেন। জান তিষা তোমার কপালটা সত্যি অনেক ভালো, স্যার কখনো প্রথম সাক্ষাতে কারো অভিনয় দেখেন না আর মাসের পর মাস ধন্না দিয়েও কেউ স্যারের সাথে সাক্ষাত করতে পারে না‘।
কথাগুলো শেষ করে সুজন তিষাকে তার রুমে পাঠিয়ে দিল।
রাত প্রায় এগারটা বাজে এখনও স্যার আসছেন না, অধীর আগ্রহ নিয়ে তিষা অপেক্ষা করছে। হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে উঠায় তিষার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। দরজাটা খুলে দেখল সুজন ভাই।
ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি? কথাটি বলতে বলতে সুজন তিষার রুমে প্রবেশ করল।
না ভাইয়া, এখনো ঘুমাইনি। তিষা উত্তর দিল।
টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসতে বসতে সুজন তিষাকে বলল, ’স্যার আজ আসবেন না এই মাত্র আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন’। কিন্তু তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে।
কি কথা ভাইয়া।
মিডিয়ার জগত নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করব, এই জগতে তুমি তো নতুন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে মধ্য বয়স্ক একটি লোক এসে মদের বোতল ও দুইটি কাঁচের গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বাহির থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।
মিডিয়াতে কাজ করতে হলে একটু আধটু মদ খেতে হয়, মদ খাওয়ার অভ্যাস আছে তো তিষা? কতাটি বলতে বলতে বোতলের কেপটি খুলে গ্লাস দ’ুটিতে মদ ঢালতে লাগলেন সুজন।
না ভাইয়া, এসবের অভ্যাস নেই। তিষা উত্তর দেয়।
কিযে বলনা তিষা, মিডিয়ায় কাজ করতে হলে মদ টদ একটু খেতেই হয়। নেও চুমুখ একটা দিয়ে দেখ, এটা ইন্ডিয়ান কেরো কোন সমস্যা হবেনা। বলেই একটি গ্লাস বাড়িয়ে দিল তিষার দিকে।
কিন্তু বেচারি মদের গ্লাস হাতে নিতে নারাজ। শেষ পর্যন্ত সুজন ভাই জোড় করে তিষাকে মদ খাইয়ে দিল। এবং এভাবে পুরো বোতলের মদটা তিষাকে খাওয়াল, এক পর্যায়ে তিষা অচেতন হয়ে বিছানায় ঢলে পড়ল। এর পরের ঘটনা তিষা আর কিছুই বলতে পারেনি।
যখন ঘুম ভাঙ্গল সকাল আটটা। বিছানার চাদর এলোমেলো, শরীরে কোন প্রকার জামা কাপড় নেই, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে আর পুরো শরীরটা ব্যথায় ভরে গেছে। তিষার আর বুঝতে বাকী রইল না কাল রাতে তার সাথে কেমন আচরন করা হয়েছে। কান্নায় তার অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে আর ইচ্ছে করছে মরে যেতে। বিছানা ছেড়ে তাড়াতাড়ি বাথ রুমে ঢুকে গোসল করে নিল। এখন সে চিন্তায় পড়ে গেল এই মিডিয়ার জগতে থাকবে নাকি বাড়ী চলে যাবে।
হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠল। তিষা দরজাটা খুলতেই সুজন ভাই রুমে প্রবেশ করল লজ্জা, ঘৃনা আর অপমানে সুজন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে তিষার ইচ্ছে হল না। মুখ গম্ভীর করে খাটের উপর বসে পড়ল।
স্যরি তিষা, গত কাল রাতের ঘটনার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আসলে গত রাতে আমার মাথাটা একটু ধরা ছিল, কি করতে কি হয়ে গেল এর জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। তিষার দুটি হাত ধরে কথা গুলো বলল সুজন।
না ভাইয়া, আপনার কোন দোষ নেই। এটা আমার ভাগ্যে লিখা ছিল এজন্য বোধ করি আমার অদৃষ্ট আমাকে এখানে টেনে এনেছিল।
ছি তিষা, এভাবে বলনা। তুমি তো জান যে আমি তোমাকে মন থেকে পছন্দ করি। আজ না হোক দুদিন পর তো তুমি আমারই হবে। এসব মন থেকে মুছে ফেল। কথা গুলো বলতে বলতে সুজন ভাই তিষাকে জড়িয়ে ধরল।
একি করছেন ছাড়–ন আমাকে। তিষার উত্তেজিত কন্ঠস্বর।
প্লিস লক্ষিটি, আমি তো তোমারই। যা হবার হয়ে গেছে এখন চল নাস্তার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে।
আস্তে আস্তে তিষা নাটক পাড়ার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। মঞ্চ নাটকে নিয়মিত অভিনয় করলেও কোন টিভি চ্যানেলে অভিনয় করার সুয়োগ এখনও তার হয়নি। এখন আর আগের তিষা নেই; সে এক অন্য তিষা হয়ে গেছে। নিয়মিত নাটকের রিহার্সেল, পার্টিতে যাওয়া, বিলাস বহুল হোস্টেলে বন্ধু বান্ধব নিয়ে রাত কাটানো, ফেনসিডিল, মদ এমন কি ইয়াবা সহ যত প্রকারের মাদক দ্রব্য আছে সবি তার চাই।
তিষা নেশার প্রতি এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েছে যে, এক মুহুর্ত তার নেশা ছাড়া তার চলে না। প্রায় দুই বছর পর হঠাৎ একদিন তিষা বুকের বাম পাশে ব্যথা অনুভুব করল। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষুধ পত্র আনা হল, কিন্তু কোন কাজ হল না । দিন যত যাচ্ছে ব্যথাটা ততই বাড়ছে এখন পুরো পেট সহ ব্যথা করে আর কোন কিছু খাওয়া মাত্রই বমি হয়ে যায়। তিষাকে চিকিৎসার জন্য পিজি হাসপাতালে পাঠানো হল কিন্তু ডাক্তারা কোন রোগ নির্ণয় করতে পারলেন না শুধু ঔষুধ দিয়ে দিলেন। দিন দিন তিষার অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে শরীর শুকিয়ে কাট হয়ে যাচ্ছে। এবার তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হল। ওখানে অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষার পর ক্যানসার ধরা পড়ে। তার পর সুজন ভাই তিষার বাবার কাছে ফোন করে বিষয়টি জানালে। তিনি এসে রেডিও থেরাপি বিভাগে মেয়েকে ভর্তি করালেন। অনেক দিন চিকিৎসার পর উন্নতি না হওয়ায় তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়ী চলে গেলেন।
এতক্ষনে মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে এল। ছোট্ট ভাই মারুফ এসে তিষার পাশে বসল আর মা জুবেদা খাতুন ফজরের নামাজ পড়তে গেলেন।