হারিয়েও হারেনি সে

বিজয় (ডিসেম্বর ২০১৪)

তাপস চট্টোপাধ্যায়
বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের একটা যুবক। মস্ত বড় একটা বালি স্তূপের ওপর উপুড় হয়ে ঝুঁকে দুহাত দিয়ে কি যেন একটা করছিল। অলকেশ জানতো একে স্যান্ড আর্ট বলে।
পুরীর সমুদ্র সৈকতে তখন চাপ চাপ পর্যটকদের ভিড় ভরা কোটাল চলছে। উত্তাল ঢেউ ফুঁসছে, প্রবল গর্জনে আছড়ে পড়ছে। জনকোলাহল ভাসিয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ নিস্তব্ধ।
যুবকের এসব কিছুতেই হুঁশ নেই। কখনো বসে, আধশোয়া হয়ে, বালিতে মাখামাখি জামাকাপড়, দুটো হাতে নিষ্প্রাণ বালিতে প্রাণের সঞ্চার করছে।
অলকেশ বিভোর হয়ে দেখছে। বছর চারেকের দামাল ছেলেটা এলোমেল পা ফেলে সবার অলক্ষ্যে ঢেউয়ের খুব পৌঁছে গেছে। ভিড়ের মধ্যে কচি দুটো হাতে শরীরের সন্তলনকে বজায় রেখে টলতে টলতে জল ছুঁয়েছে। বেশ কয়েক গজ দুরে একটা প্রায় মানুষ সমান ঢেউ ফণা তুলেছে। বাকি সকলের সাথে শিশুও অসীম উত্তেজনায় দুহাত তুলে তাকে যেন আহ্বান জানাচ্ছে আর তারই কোলে এগিয়ে চলেছে।
যুবক ততক্ষণে নরম ভেজা বালির ওপরে কোন এক দেবতার প্রাণদান করে ফেলেছে। নিখুঁত হাতের সঞ্চালনে অতি ধীরে জন্ম নিচ্ছে পবিত্র দেবস্বত্তা। অলকেশ নেশাগ্রস্তের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে। হঠাৎই প্রচণ্ড একটা কোলাহলে তার সম্বিত ফেরে।
- 'ডুবে গেলে, ডুবে গেলো। বাঁচাও কে আছো বাচ্ছো বাচ্ছটাকে।'
অলকেশ দৌড়ে জলের কাছে ছুটে যায়। চারদিকে রক্তিমকে দেখতে পায় না।
বাকি পর্যটকেরা যারা এতক্ষনে স্নানে মত্ত ছিল তারাও সকলে একটু দুরে কোন কিছু দেখিয়ে চিৎকার শুরু করেছে।
অলকেশকে বেশ কিছুটা দিশাহারা মনে হয়, কিছুই করতে পারছিলনা। ঐ তো রক্তিম। পড় থেকে অনেকটা দূরে। একবার কচি হাতদুটো ওপরে তুললো, তারপরে মিলিয়ে গেল। অলকেশ একটা নিথর নিস্তব্ধতা গ্রাস করেছে। বিহ্বল দুষ্টিতে কাতর আহ্বান আর সাহায্যের প্রত্যাশা। পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই তখন অসহায়, ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।
হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে কৃষাঙ্গ লম্বা আর রোগা চেহারা, লম্বা লম্বা খালি পাদুটো ফেলে ত্বরিৎ গতিতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিপুন দক্ষতায় ঢেউ ভেঙে এগিয়ে যায় অনেকটা দুরে। এরপর অলকেশ আর কিছু মনে করতে পারে না।ভ চোখের সামনে শুধু চাপ চাপ অন্ধকার আর ঘুমে চোখদুটো বুজে আসে।
এরপর কেটচে গেছে কুড়িটা বছর। রক্তিম এখন ২৪ বছরের তরতাজা যুবক। গত বছরই অলকেশ রিটায়ার করেছে। যশোধরা নাছোরবান্দা হয়ে রক্তিমের বিয়ে দিয়েছে। অনন্যা ওর বৌ, সরকারি চাকরি করলেও খুব লক্ষিমন্ত। রক্তিমের মুখে ওর ডুবে যাওয়ার গল্প শুনেছে অনেকবার। প্রতিবছর একবার শ্বশুর শাশুড়ীর সঙ্গে পুরীতে আসে। ওদেরও একবার লোকটাকে দেখার খুব ইচ্ছে।
-'হামে চিনতে পারছিস বাঙালিবাবু? আমি আপ্পন্না, নুলিয়া। তোর লাড়কাকে হামি পানি সে বাঁচিয়েছি।'
অলকেশ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। নিজের কানে যা শুনেছে সে কি সত্যি?
সেই কৃষাঙ্গ রোগা লম্বা মানুষটা, খালি গা, খালি পা। তার দিকেই তাকিয়ে মিটমিট হাঁসছে।
- 'তুমি এতদিন কোথায় ছিলে আপ্নান্না? আমি তারপর থেকে প্রতি বছর এখানে এসে তোমায় খুঁজেছি। অনেক নুলিয়াকে বলেছি তোমার কথা। নুলিয়াপাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজেও কেউ তোমার সন্ধ্যান দিতে পারেনি।'
অনেক দিন জমে থাকা কথা একনাগাড়ে অলকেশ বলে ফেলে। কোথাও যেন একটা অপরাধবোধ আর জমে থাকা কৃতজ্ঞতা উগরে ফেলে অনেকটাই স্বস্তি আনে।
নুলিয়া আপ্পন্না অলকেশের মানসিক অবস্থা অনেকটা আন্দাজ করতে পেরে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।
- তুমহার বেটা কেমন আছে বাবু? পানির মধ্যেই হামার গলাটাকে জড়িয়ে ছিল। ওত্তাসা ছিল তখন...।
আপ্পান্না দুটো হাত একটু প্রসারিত করে আন্দাজ করার চেষ্টা করে। আলকেশ তখনও নিজের মধ্যে নেই। পুরো ঘটনাটাই কেমন যেন অলিক মনে হচ্ছিল। রক্তিমকে মৃত্যুর মুখ থেকে যে মানুষটা বাঁচিয়েছে এখন মুখোমুখ তারই সামনে সে। কৃতজ্ঞতা জানাবার মতো কিছুই মনে আসে না তার। এবার ইচ্ছে করে বুকে টেনে নিয়ে অনেক্ষণ ওর কাঁধে মাথাটা রাখে। পারে না।
- 'সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। চাকরি করে, বিয়েও হয়েছে। ওকে আমি সব বলেছি, ও তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে অনেকবারই এসেছে।'
সেই দুর্ঘটনার পরে অলকেশের একটা মাইন্ড এ্যাটাকও হয়ে যায়। দু-তিনটে মাস বেডরেস্ট। হাঁটাচলা বারন। একটু সুস্থ হলেই যশোধরা জিদ করে আরেক বার পুরী যাওয়ার জন্য। স্বামী আর ছেলে রক্তিমতে নিয়ে জগন্নাথ দর্শন। ও বিশ্বাস করে, জগন্নাথদেবেই রক্তিমকে ওর কোলে ফিরিয়েছে।
অলকেশও যাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিল। প্রতি রাতে ঐ দুঃস্বপ্ন ওকে ঘুমোতে দিত না। চোখের সামনে খালি গা, খালি পায়ে কৃষাঙ্গ সেই রোগা লম্বা লোকটা, দ্বিধাহীন ত্বরিৎ গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উত্তাল সমুদ্রে। প্রাণের পরোয়া ছিল না তার। অলকেশের জীবন্ত ঈশ্বর।
একরাশ জমে থাকা উচ্ছ্বাস আর কৃতজ্ঞতা শুধু তারই জন্য গুমরে মরছিল। সস্ত্রীক পুরী পৌঁছে অলকেশের ত্বর সয় না। সোজা সমুদ্রের ধারে চলে আসে। মাঝে প্রায় দেড়টা মাস কেটে গেছে, তবু ঠিক জায়গাটা খুঁজে বার করতে অলকেশের অসুবিধা হয় না।
সমুদ্র সৈকতটা ঠিক আগের মতই আছে। পর্যটকদের ভীড়ে ঠাসা। হাসি আর উচ্ছ্বাসে মত্ত একদল ঢেউয়ের সাথে একমনে খেলে চলেছে। কোনদিকে হুঁশ নেই, একেবারে বাধাবন্ধহীন। বাজার, দোকান, অফিস কাছারি, কোন তাড়া নেই। দেখে বেশীরভাগ বাঙালি বলেই মনে হয়। অলকেশ মনে মনে উত্তেজিত। পাড়ের একটু উঁচুতেই চায়ের দোকান বরাবর দাঁড়িয়ে আছে নুলিয়ারা। কেউ দাঁড়িয়ে প্লাস্টিকের রঙিন চেয়ার এগিয়ে দিচ্ছে। ঘণ্টায় দশ টাকা। হকারের দল সি বিচ বরাবর শাঁখ, ঝিনুক আর মুক্তোর মালা, মুক্তো, খাবার দাবার হাঁক দিচ্ছে। কেউ কেউ তাদের বাচ্চাদের উটে নয়তো ঘোড়ায় চড়িয়ে বিচে ঘোরাচ্ছে। ঢেউয়ের গর্জন আর চিৎকার চেঁচামেচিতে শান্ত সৈকত যেন প্রাণ পেয়েছে। এসব কোন কিছুতেই আগ্রহ ছিল না অলকেশের। খোলা দুষ্টিতে শুধু একটাই অবয়ব।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে নামার মুখে। অলকেশের খেয়াল ছিল না কিছুই। তির বরাবর অনেকটা চলে এসেছিল। অনেককে সময়, তারিখ, ঘটনার নানান বিবারণ দিয়েও কোন সুরাহা হল না।
নুলিয়াদের সর্দার গোপী। সত্তরের ওপর বয়স। সুঠম চেহারা, খালি গা, কালো গায়ের রং। মাথায় খুলির ওপর সাদা প্লাস্টিকের বোনা টুপি দু-দিক থেকে একটা দুটো চোয়ালের নিচে বাঁধা। টুপির সামনে কালো রঙে লেখা একটা নম্বর ১২৬।
- 'নুলিয়াকা নাম চলে না, চলে শুধু নম্বর। নম্বর বললে তবেই প্যাহেচানিয়ে যাবে।'
অলকেশ বোঝাতে চেষ্টা করে, দুর্ঘটনার সময় কিছু দেখার আগেই জ্ঞান হারিয়েছিল। গোপি বলেছিল - 'নুলিয়াকা কামই হ্যায় ডুবনেবালকো পানিসে উঠানা। রোজ রোজ কিতনা আদমিকে পানি সে উঠাই হামলোক। উনমেসে বহুত আদমি হামে বখসিস দিতে চায়। ছোট সা চিঠঠা মে নাম পাতা লিখকে দেতা ভি হ্যায়। কোলকত্তা আনে বোলতা হ্যায়। গরিব আদমি বাবু হামলোগ ধান্ধামে লাগ যাতে হেঁ।'
গোপির কথা শুনেঅলকেশ অনেকটা হতাশ হয়েছিল, অবাকও। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে বাঁচানোটা ধান্দা কেমন করে হয়? বোধায় এটাই এদের প্রফেশনাল এথিক্স।
দিনের শেষে একরাশ ব্যর্থতা নিয়ে অলকেশকে ফিরে আসতে হয়েছিল। তারপর প্রত্যেক বছর কখনো স্বস্ত্রীক, কখনও ছেলে আর বৌমাকে নিয়ে এখানে এসছে। প্রতিবারই খালি হাতে ফিরতে হয়েছে।
আজ এই আবছা আলো-আঁধারিতে বিচের ওপর কৃষাঙ্গ সেই লোকটা তারই মুখোমুখি। খালি গা, কোমরে ধুতিটা মালকোঁচা মারা, লম্বা লম্বা দুটো পা সম্পূর্ণ অনাবৃত। মাথার খুলির ওপরে নুলিয়াদের চিরাচরিত সেই টুপি। তাতে নম্বরটা অলকেশ বেশ পড়তে পারছিল। ১০১। খুব সহজভাবে কথা বলছিল। তীক্ষ্ন দুটো চোখের দুষ্টি সারল্যে ভরা।
অলকেশের অনেকটা স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল অনেক্ষণ কথা বলে ওর সঙ্গে।
- 'আপ্পান্ন, তোমার ছেলে মেয়ে আছে?'
- ‌'হ্যায়, তো। একটা লাড়কা আর একটা লড়কি। লড়কার নাম ডিল্লি আর লাড়কি পারকিল। লাড়কিটা বহুত খুবসুরত ছিল, হামি ওর সাদির রুপিয়া পয়সা রাখিয়ছিলাম। লেকিন কোই নুলিয়াকো ও সাদি করতে চায় না। নুলিয়ালোগ বহুত গরিব হ্যা না। ্পনার পসন্দে কালি সিংকে সাদী করে নেপাল চলিয়ে গেল।'
এরপরে আপান্না হঠাৎই চুপ করে যায়। গলাটা ধরে আসে। মুখের হাল্কা হাঁসিটা মিলিয়ে মিলিয়ে যায়।
- 'হারিমি কা বাচ্চা কালি সিং। সাদিকে বাদ পারকিলকো বহুত মারতা থা। খাবার খেতে ভি দিতো না। কালি সিং দুসরা সাদি ভি করলো। হামলোক মিলনেকা বহুত কোশিশ কিয়া, লেকিন টেলিফোনকা লাই কাট দিয়া থা।'
- 'তারপর?' অলকেশ শুনতে চায় বাকিটুকু।
- 'একদিন খবর আয়া পারকিল আপনা শরিরমে আগ লাগিয়ে আত্মোহত্যা করিয়াছে। এ বাত সাচ্ নেহি হ্যায় বাবু। জরুর ওহি হারামিকা বাচ্চা মোর পারকিলকো মার্ডার করেছে।'
আবছায়া আলোর মধ্যেও অলকেশ লক্ষ করে আপ্পান্ণার দুটো চোখে একবিন্দুও জল ছিল না, ছিল শুধু প্রতিহিংসার আগুন।
একটু আগেই দৈত্যর মতো একটা ঢেউ প্রবল গর্জন করে পাড়ে এসে আছড়ে পড়েছিল, এই মাত্র ওদের পা ছুঁয়ে আবার ফিরে গেল। তারপর নিশ্চুপ, পাষাণের স্তব্ধতা।
আপ্পান্না একক্ষণ নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। অলকেশ জিজ্ঞেস করে, - 'আর ডিল্লি, তোমার ছেলে?'
- 'ও বহুৎই সেয়ানা হয়েছে। উ বিচ সমুনদরমে নাও লেকে মছলি পাকাড়নে যায়। খুব ছোট ছোট মাছ ধরার অনেকগুলো ডিঙি নৌকাও। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে খুব অস্পষ্ট।'
অলকেশ ঘাড় নেড়ে আপ্পান্নাকে সায় দেয়।
- 'উ যো ডাহিনে মে আছে উসিসে হামার ডিল্লি মাছলি ধরে।' এরপরই আপ্পান্না একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসে। হঠাৎই নিজের ডান হাত দিয়ে অলকেশের বাঁ হাতটা চেপে ধরে।
- চল বাবু, তুকে হামার ডিল্লিকে দেখা করিয়ে দিবো।
অলকেশ কিছু বলার আগেই আপ্পান্না ওকে সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অলকেশ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে আসে, - কিন্তু...
- ডর লাগতা হ্যায় বাবু? নুলিয়া আপ্পান্নাসে ডর, তুর লেড়কাকে হামি পানিসে বাঁচিয়েছিলাম।
- আমি তো সাঁতার জানি না? অলকেশ আপ্পান্নাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, পারে না। সে তখন আপ্পান্নার শক্ত হাতের কবলে।
হাঁটু জলে অলকেশকে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে যেতে যেতে দমকা হেসে ওঠে, - এই সমুন্দর হামার ?খেলকা ময়দান। ইখানে সাঁতার জানিয়ে ভি কোই লাভ নেহি।
হাঁটু পেরিয়ে জল কোমর ছুঁয়েছে। তারপর বুক পেরিয়ে অলকেশের গলা বরাবর, গ্রীবার ঠিক নিচে। একটু জল ছিটকে এসে ওর জিবটাকে ভিজিয়ে দিয়েছে, বেশ নোনতা। একটু আগেও অলকেশ পায়ের তলায় শক্ত বালির স্তর অনুভব করতে পারছিল। হঠাৎই দেহটা কিছুটা শূন্যে মনে হল। একটা ঢেউ ওর ভাসমান শরীরটাকে হাল্কা দোলা দিয়ে গেল। একটা নিশ্চিন্ত সমর্পণ। ভয়টা অনেকটাই কেটে গেছে। বরং খোলা সমুদ্রের বুকে আপ্পান্নার সান্নিধ্যে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজ। কোনাকুনি আকাশটা লাল হয়েছে। বোধহয় আর কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠবে।
- 'বাবু, ডর লাগছে?' আপ্পান্না সাঁতার কাটতে কাটতে একটু মজার ছলে জিজ্ঞেস করে।
অলকেশ ঘাড়টা নাড়িয়ে না বলার ইঙ্গিত করে। অনেকগুলো ছোট, মাঝারি ঢেউকে আপ্পান্না ইতিমধ্যেই কুশলতার সাথে অলকেশকে নিয়ে ডিঙিয়ে পার করেছে। পাড় থেকে অনেকটা দুরে, যেখানে কয়েক মানুষসমান যে ঢেউটা প্রকাণ্ড ফনা তুলে ছোবল মারতে চায়। এখন তারাই ওপরে অলকেশ। মাছ ধরার ডিঙিগুলো এখন আর অস্পষ্ট নেই। দু-একটা লোককেও দেখা যাচ্ছে।
আপ্পান্না একহাতে অলকেশের সন্তলনকে বজায় রেখে অন্যহাতে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। অলকেশ ঘাড়টা একটু পিছনে ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করে, পাড়ে ইতিমধ্যই অনেকেই স্নান করেছে। মেরিন ড্রইভের গায়ে সারিসারি হোটেলগুলো। ইঞ্চিখানেকের মতো মেন হচ্ছিল।
ওরা ঢেউগুলো ইতিমধ্যেই ডিঙিয়ে এসেছে। সমুদ্র এখন নিথন নিঃস্তব্ধ। আপ্পান্না অলকেশকে নিয়ে গতি বাড়ায়। অলকেশ অনুভব করে তাকে পেঁচিয়ে ধরে থাকা আপ্পান্নারা হাতের মুঠোটা ঈষৎ কাঁপছে। হয়তো উত্তেজনায়। সব বাবার মতোই ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখবার বাসনাই কাছে এসেও কাছে পাওয়ার ব্যবস্তা।
এখন ওরা একেবারে একটা জেলে নৌকোর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। একটু এগোলেই ছোঁয়া যায়।
আপ্পান্না এখনই সাঁতার কাটা বন্ধ করে দুটো পায়ের সন্তলনে ভেসে আছে। অলকেশেরও গলা পর্যন্ত জল। শরীরটা হালকা ওঠানামা করছে। অনেকটা একরাশ তুলোর পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে যেমনটা লাগে। এখান থেকেই আপ্পান্না নিজেদের ভাষায় ডিল্লিকে হাঁক পাড়ে। এক ডাকেই কাজ হয়। একটা ডিঙি নৌকোর ছাইনি থেকে বছর কুড়ি-একুশের একটা ছেলে বেরিয়ে আসে। আপ্পান্নার মতই ছিপছিপে লম্বাটে গড়ান। ওরাই মতো কৃষাঙ্গ। নৌকোয় দাঁড়িয়ে আপ্পান্নার দিকে হাত নাড়াতে থাকে।
অলকেশকে দিখিয়ে আপ্পান্না কিছু বলে, নৌকোয় দাঁড়িয়ে ছেলেটাও জবাব দেয়। নিজেদের ভাষাতেই ওদের কথোপকথন চলে। এরপরে ফেরার পালা। একইভাবে অলকেশ আপ্পান্নার সাথে পাড়ে ওঠে। আলো ফুটেছে। অলকেশ দুরে আরেকবার দেখার চেষ্টা করে। নিজেকে এখনও স্বপ্নবিষ্ট বলেই মনে হয়।
- 'তোমাকে আমি কিছু টাকা দিতে চাই আপ্পান্না।' মেন কথাটা অলকেশ বলেই ফেলে।
আপ্পান্না মুচকি হেঁসে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যায়। অলকেশ নাছোড়বান্দা।
- 'তোমাকে কাল কোথায় পাবো?'
- 'ইসি জায়গামে এহি টাইমপর হামার ডিউটি।' আপ্পান্না আর দাঁড়ায় না। বালির ওপর দিয়ে তীর বরাবর হেঁটে যায়। অনেকটা দুরে, দৃষ্টির বাইরে।
পরদিন অলকেশ এটিএম থেকে বেশ কিছু টাকা তুলে আগের দিনের জায়গায় চলে আসে। আজ যশোধরাকেও নিয়ে এসেছে সে। রক্তিম আর বৌমাও পিছু ছাড়েনি।
হালকা আলো আঁধারিতে ওরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। ইতিমধ্যই আরো কিছু নুলিয়া এদিক ওদিকে জড়ো হয়েছে। ওদের সকলের হাতেই ফোলানো গাড়ীর টিউব।
ওদের মধ্যে থেকে দুজন এগিয়ে এসে অলকেশকে স্নান করতে যাওয়ার জন্যে ডাকে। অনেকটা সময়ও পার হয়ে গেছে। আপ্পান্নার দেখা নেই এখনও। অলকেশের সাথে সকলেরই অস্বস্তি বাড়ছিল। অলকেশ আর ধৈর্য ধরতে না পেরে একটা নুলিয়াকেই আপ্পান্নার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। ওর নম্বরটাও জানায়। ওদের মুখে সবকিছু জানতে পারে।
মেয়ের মৃত্যুর খবর আপ্পান্নাকে অনেকটা শোককুল করে তোলে। একমাত্র ছেলে ডিল্লিকে অবলম্বন করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে ভেবেছিল। তাও হয়নি। ডিল্লিদের ছোট মাছ ধরার ডিঙিটা প্রবল ঝঞ্ঝায় পড়ে সমুদ্রের ডুবে যায়। বাকিদের সাথে সেও ফিরে আসে না। পাড়ে খবর আসে। আপ্পান্না পাগরের মতো খাওয়া দাওয়া ছেড়ে সমুদ্রের ধারে অপেক্ষ করে, মাছ ধরার ডিঙিগুলো পাড়ে এলে ডিল্লির খবর জিজ্ঞেস করে। বেশ কয়েকমাস এমটা চরে।
অবশেষে একদিন ভোররাত্রে সমুদ্রে নেমে নিজেই ডিল্লিকে খুঁজতে চলে যায়। পরদিন পাড়ে ওর মৃতদেহ পড়ে থাকে। সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই অলকেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ে। গতকালের মাত্র কয়েকঘণ্টা আপ্পান্নার সঙ্গ এখনও অনুভূতিতে স্পষ্ট। সত্য আর মিথ্যের টানাপোড়েনে সেই স্মৃতিটাকে হারিয়ে ফেলতে মন সায় দেয় না। বেলা বেড়েছে। পর্যটকদের ভীড় বাড়ছে। রোজকার মতোই বাধাবন্ধনহীন ওরা ঢেউয়ের সাথে খেলেই চলেছে। একটু দুরেই নুলিয়ারা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সর্তক প্রহরায় যেন একটা অঙ্গিকার, আর নয়। আপনজনকে হারিয়ে যেতে দেবে না। অলকেশ ওদের মধ্যেই আপ্পান্নাকে খুঁজে পেয়ে মনে মেনে স্বস্তি বোধ করে।


* নুলিয়া. নুলিয়া [ nuliẏā ] বি. (প্রধানত পুরীর) সমুদ্রতীরে মত্স্যজীবী জাতিবিশেষ।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
Md. Akhteruzzaman N/A হৃদয় ছোঁয়া কথামালা খুব ভালো লেগেছে। আপনার এই লেখাটি অনেক অনেক পাঠক পড়বে এই প্রত্যাশা রাখি।
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
pathok ar paben kothay? vara kore ante hobe!!!!!!!!!!!!!
ভালো লাগেনি ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪
মাহমুদ হাসান পারভেজ অসাধারণ মানবতাপূর্ণ গল্প। আর সে সাথে প্রকৃতি আর দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা মানুষের গল্প। পছন্দের তালিকায় যোগ করলাম।
raaj banerjee daroon lekha.e rakam aro lekha chai .
জুন বেশ ভালো। অনুভূতিকে ছুঁয়ে গেলো।শুভ কামনা রইলো। আমার পাতায় নিমন্ত্রণ।
রিক্তা রিচি দারুন প্রকাশ
রুহুল আমীন রাজু N/A অনেক ভালো লাগলো ...(আমার পাতায় আমন্ত্রণ রইলো )
আখতারুজ্জামান সোহাগ আপ্পান্নার মেয়ে,ছেলে এবং সব শেষে অপ্পান্নার নিজের পরিণতি খুব খারাপ লাগল, বিষাদে ভরল মন। বিয়োগান্তক গল্প, মনে দাগ কেটে গেল। শুভকামনা লেখকের জন্য।
শামীম খান বাহ , সুন্দর গল্প উপহার দিলেন দাদা । ধন্যবাদ আর শুভকামনা ।

১৭ জুন - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ২৯ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "পদত্যাগ”
কবিতার বিষয় "পদত্যাগ”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ জুন,২০২৫