মাঝরাতে ঘুমচোখে বারান্দা পার হয়ে টয়লেটে যাওয়ার পথেই অর্কর ঘরের ভেজানো জানলার ফাঁকদিয়ে আলো নজরে পড়ে। নেহাৎ কৌতুহলেই পুরন্দর উঁকি মেরে ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করে। অর্কর পিঠটা পুরন্দরের দিকে। সামনে ল্যাপটপে একমানে কিছু করছে। স্ক্রীনটা উঠছে নামছে। ওরই বয়সী অনেক যুবক যুবতীর ছবি, তারই মধ্যে অর্ক কিছু একটা খুঁজছে।
পরের দিন পুরন্দর ভাবে ব্যাপারটা মৃদুলার কানে তুলবে কিন্তু সাহস হয় না। আগে সময়ে অসময়ে অর্ককে দিনের ঘটনার পর। ভয় হয় যদি ব্যপারটা সারা বাড়ী রাষ্ট্র হয়ে যায়।
পুরন্দরদের সাবেকি বাড়ীর একতলাতেই আছে প্রকান্ড বাথরুম পায়খানা। বালতিতে জল আর মগ নিয়ে ভিতরে কাপড় ছাড়া। একজন ভিতরে থাকলে অন্যজনের অপেক্ষা করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। অর্ক আর মৃদুলার পিড়াপিড়িতেই পুরন্দর দোতলায় অর্কর ঘরলাগেয়া ফালি জায়গাটায় বুক সমান পাঁচিল তুলে একটা টয়লেটের ব্যবস্থা করে। রাতবিরাতে সবাই সেটা ব্যবহার করে। পাম্পের জলের একটা কলও আছে। অর্ক সেখানেই স্নান সারে।
ইদানিং অর্কর অনেকগুলো পরিবর্তন পুরন্দরের নজরে পড়েছে। বরাবরই লম্বাটে চেহারা ওর। প্রায় ৬ ফুট এর ওপর, এ বছরই কলেজো ভর্তি হয়েছে। একটা কালো গোঁফের রেখা উঠছে, চোখে একটা চশমাও ব্যবহার করে।
মৃদুলা এই নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল।
অর্ক এড়িয়ে গিয়েছিলৌ।
মৃদুলাও আজকাল একটু বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে। দোতালায় খিড়কি পুকুরের দিকের ঘরটা এখন অর্কর দখলেই, আজকাল ওর জামা কাপড় আর শোবার ঘরে রাখে না। এ কোন ও কোন বারাবর একটা দড়ি টাঙিয়ে, সেখান থেকে হাতের কাছে যা পায় নিয়ে পরে ফেলে। মাঝে মাঝে অন্ত্তদি ওর ঘর মুছে গেলে বিছানাটা ঠিকঠাক করে চাদর ঝেড়ে দেয়। এলোমেলো জামা কাপড়গুলো পরিপাটি করে টাঙিয়ে দেয়,
-মা, আমার বিছানায় কে হাত দিয়েছে?
বারান্দায় ঝুঁকে অর্ক সুর চড়ায়।
মৃদুলা নিচে রান্নাঘরে কাজ ফেলে ছুঁটে আসে। অন্ত্ততি ছাদে জামাকাপড় শুকতে দিচ্ছিল। প্রমাদ গোনে। এরপর তুলকালাম কান্ড চলে বেশ কিছুক্ষণ।
- তুই ঘরটাকে শুয়োরের খোঁয়াড় বানিয়ে রাখবি তাতে ক্ষিতি নেই, কেউ পরিক্ষাক করলেই দোষ? অর্কও দমে না, মা'য়ের মুখে মুখেই জবাব দেয়।
- বেশ করেছি, আমার ঘর আমি যেমন খুশি করে রাখবো।
- ওই ঘরে কি তোর নাম লেখা আছে?
আমি বেঁচে থাকতে এই বাড়ীতে এসব এ্যালাও করবো না।
মৃদুল ইংলিস মিডিয়ামে ম্যাট্রিক ফেল। একটুতেই রেগে গেলে মুখ ফসকে দু-একটা ইংরেজি বলে ফেলে।
পুরন্দেরর খাওয়া দাওয়া হয়ে গিয়ছিল। বারুইপুরের এই অঞ্চলটায় ফ্ল্যাট কালচার ঢুকলেও পুরন্দর এই বাড়ীতে সাবেকিয়ানাই বহাল রেখেছে। নিচের তলায় তিনটে প্রকান্ড ঘরই একটু ঘুপচি গোছের। আলো বাতাস ঢোকে না। বাড়ী লাগেয়া পুকুর বলে দেওয়ালগুলো স্যাঁতস্যাঁতে চুবালি খসা। তিনটি ঘরের মধ্যে একটা রান্নাঘর বাকীদুটো ভাঁড়ার ঘর আর পুরোন জিনিষপত্র, ভাঙা আসবাব, এক কোনায় গুলকয়লা, রঙচটা হাতলভাঙা অব্যবহৃত বাসন পত্রে ঠাসা। এবাড়ীতে মা-ঠাকুমার আমল থেকেই চলে আসছে। রান্নার গ্যাস থাকলেও মাসে গুলকয়লার একটা বরাদ্দ এবাড়ীতে বারবারের। সপ্তাহে একদিন অন্তদি পাটি পেড়ে বসে পরিপাটি করে তোলা উনুনটা নিকিয়ে রাখে।
- আসুক তোর বাবা ওপরে, এবাড়ীতে কবে থাকে সবার ঘর সেপারেট হলো এবার জানবো।
সকাল ১০টার মধ্যে রান্নাঘরের একদিকে জলছরা দিয়ে পুরন্দরের মা'এর হাতে সুতোর নক্ষা করা আসন পাতা হয়। পুরন্দন স্নান সেরে পূজোর ঘরে ঢোকে। সিঁড়িঘরের ঠিক ওপরে ছাদের দরজার মুখেই পূজোর ঘর। অনেক দেবদেবীর মূর্ত্তি প্রতিকৃতির মাঝে রিলমাধবের খাঁটী পেতলের মূর্ত্তী, চার পরুষের। প্রথমে উচ্চৈস্বরে মন্ত্রপাঠ, পরে আরতি, সাথে ঘণ্টাধ্বনি। একতলায় সকলকে সচকিত করে, অন্ত্তদি সবকাজ ফেলে আসন পাতে। পুরন্দরের জন্য বরাদ্দ কাঁসার গ্লাসে জল ডানদিকে রেখে অপেক্ষা করে। মৃদুলাও কাঁসার থালায় পুরন্দরের পছন্দের পছন্দমতো পঞ্চব্যাঙ্জন সাজাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। ঘনঘন ডাল দু-রকম ভাজা, তরকারি, দু-রকম নিরিমিশ তরকারি, শুক্তো, অম্বল, মাছের ঝোল- সম্তাহে দু-দিন, বুধ আর রবিবার খাসির মাংস, সবমিলিয়ে রাজসূয়ো আয়োজন। এসব কিছু উদরস্ত করতে পুরন্দর কে বেশ কসরত করতে হয়। মাথার উপর পাখা চললেও মৃদুলা পুরো অভ্যাসেই হাতপাখা নাড়ায়। একটু দুরে অন্তদি জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। খাওয়া শেষ করে পুরন্দর রান্নাঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে সামনের খোলা নর্দমার ওপর এঁটোহাত বাড়িয়ে দেয়। অন্তুদি মগে করে বালতি থেকে জল তুলে ধীরে ধীরে ঢেলে দেয়। পুরন্দর আঁচলা করে জল দিয়ে মুখের মধ্যে চালান করে, একটা বিকট শব্দ করে এগালে ওগালে লোপালুপি করে একসময়ে সবটাই নর্দমায় ফেলে দেয়, বালতির জল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধৌতকর্ম অব্যাহতই থাকে। আঁচানো শেষ হলে ডান হাতটা শূন্যে বাড়িয়ে দেয়, অন্তুদি তৈরি থাকে, চকিতে গামছাটা হস্তান্তর করে।
কাঁসর বাসনপত্র, কাঁসার ঘটিতে জল রাখা, কাঁসার গ্লাসে জল খাওয়া, হাত পাখা, উনুনে রান্না, ট্রানজিস্টারে গান শোনা ইত্যাদি ইত্যাদি এবাড়ীর দৈনন্দিন কর্মকান্ডে অনেক কিছুর মতোই এই গামছা ব্যবহারটাও ট্রাডিসনাল সাবেকিয়ার এক বড় অংশকে ধরে রেখেছে। এবাড়ীতে আজও তোয়ালে ব্যবহার হয় না। গামাছাও যেখানে সেখানে হলে চলবে না। খাস ধনেখালির ঠাস বুননের হাতে হবে। লম্বায় পাঁচ হাতের এক ইঞ্চিও কম হলে চলবে না।
হাত মুখ মুছতে সিঁড়িতেই মা-ছেলের বাকবিকন্ডা পুরন্দরের কানে আসে।
- বাবা, দেখছো তো, বারবার মাকে বলেছি আমার ঘরের কোন কিছুতে কেউ না হাত দেয়। বিছানায় ল্যাপটপ, চার্জার, ডঙ্গল, পেনড্রাইভ কত কি কাজের জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই কত কি ডেটা মিসিং হতে পারে, তা কে কার কথা শোনে।
সিঁড়ি টপকে বারান্দায় পা দিতেই অর্ক পুরন্দরকে সরাসরি আপিল করে। যদিও অর্কর স্বমুখে শোনা এতগুলো জিনিসের সাথে পুরন্দরের সম্যক কোন জ্ঞান নেই। অনেকটা হ জ ব র ল'র মতোই। তথাপি ভরা আদালতে সেটা প্রকাশ করা সমিচিন হবে না ভেবেই বলে,
-আঃ সকাল সকাল কি গোষ্ঠিদ্বন্ধ্ শুরু করলে বলো তো, ও যখন চায় না তখন ওর ঘরে না গেলেই হয়।
ঠারে ঠোরে পুরন্দর কথাগুলো যে তাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে সেটা মৃদুলার অসুবিধা হয় না।
- ওহ! ঘরটাকে নরক বানিয়ে রাখবে তাতে ওর দোষ নেই, পরিষ্কার করলেই আমার দোষ, ঠিক আছে আজ থেকেই অন্তদিকে বারণ করে দেবো যে, কোন ঘরেই যেন ঝাড়ু পোঁছা না করে।
হরেদোরে মৃদুলাও পঞ্চাশের চৌকাঠে পা দিয়েছে। কোন কিছুতেই বেশীক্ষণ জুজতে পারে না। তার ওপর মনোপোজের সময়, সব কথাতে বোধনের আগেই বিসর্জনের তোগজোড় শুরু করে দেয়।
পাকড়াশী পরিবারের সাবেকিয়ার ওপর অর্কর কোথাও যেন একটা বিরোধ ক্রমশই বেড়ে উঠেছিলো। পুরন্দরের মনে হয়েছিলো সেদিনের সেই কেলেঙ্কারিটা দেখার পর থেকেই তার উপর অর্কর চাপা ঘৃণা অথবা আক্রেশেরই একটা বর্হিপ্রকাশ, হবে হয়তো। একদিনঅন্তদিকে বলে যে ওর দুফুর বা রাত্রির খাবার দুতলায় ওর নিজের ঘরে দিতে। এরপর বাজার থেকে নিজেই নিজের জন্য কাঁসার থালা, বাটী, গ্লাসের বদলে টেবিলে জলের বোতল, গামছার বদলে তোয়ালে, নারকেল গাছ মার্কা কৌটোর তেলের বদলে প্লাস্টিক শিশির সুরভিত বড়ি অয়েল এমনি আরো অনেক অঘোসিত পরিবর্তন অর্ক নিজের জন্যে চালু করে নেয়।
ঘরের লাগেয়া বাথরুম, পায়খানা মা ঠাকুমার আমল থেকেই অলিখিতভাবে এ বাড়ীতে অপছন্দ। এতে নাকি ঘরের শুচিতা নষ্ট হয়। এতেও অর্ক সহমত হয় না, এক কথায় তারই পিড়াপিড়িতে পুরন্দর বাধ্য হয় দোতলায় ওর ঘরের লাগেয়া বাথরুম তৈরি করতে।
পুরন্দর টানা প্রায় পঁচিশ বছর বিল সেকসানে চাকরি করেছে। পাতি কেরানি থেকে এখন বড়বাবু, আরো পাঁচ-ছ বছর বাকী রিটায়ার হতে। এরই মধ্যে ডান হাত, বাঁহাত মিলিয়ে রোজগারপাতী ভালোই, অফিস থেকে ফিরে ভর্তি খামগুলো মৃদুলাকে নিঃশব্দে হস্তান্তর করে। আগে আগে জিজ্ঞেস করলেও ইদানিং স্রোতে গা ভাসাতেই অভ্যস্ত।
হঠাৎ করে অন্তদির দাদা মরে যায়, মেদিনিপুরের অখ্যাত গ্রামে অন্তদির বাড়ী, বদলিতে একজনকে কাজে লাগিয়ে অন্তদি ছিটি যায়। মেয়েটির নাম আলকা, মাঝবয়সী, আঁটোসাঁটো চেহারা, তিন ছেলের মা, স্বামী পঙ্গু। নিজেকে যতটা সম্ভব পুরন্দরের দৃষ্টির বাইরে রাখার চেষ্টা করতো।
ছুটির দিনগুলো, অর্ক টিউসানি আর মৃদুলা সঙ্গিসাথিদের সঙ্গে নামগানের আসরে। দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে ছায়ায় ছায়ায় পুরন্দরছাদে বেড়াচ্ছিল, হঠাৎই আলসে থেকে সোজাসোজি দোতলার বাথরুমে নজর যায়। বাথরুমের মাথাটা খোলা। সেখানে অলকা স্নানে মত্ত ছিলো, একটা সম্পুর্ণ নগ্ন, পুরুষ্ঠ শরীর সাবানে জলে মাখামাখি, মৃদুলা ছাড়া এর আগে পুরন্দর কাইকে এ অবস্থায় দেখেনি। চোখ সরাতে পারে না। ইতিমধ্যেই কখন অর্ক ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখাচোখি হতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। এরপর বেশ কয়েকটা দিন পুরন্দর একটু সঙ্কিত থাকে, কিন্তু শেষপর্যন্ত অর্ক মুখ বন্ধই রাখে।
সারকুলারটা পুরন্দরও অনেক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলো। সারবস্তুর কিছুটা বোধগম্য হলেও বাকিটা ভূপতি ভরদ্বাজই পরিষ্কার করে দেন। - এবার তো এ অফিসে আমিশের পাঠ উঠেই যাবে মনে হচ্ছে।
ভূপতি ভারদ্বাজ কমার্শিয়ারের ডেপুটি। বছর দুয়েক চাকরি আছে আর। টিফিনের পর পুরন্দরকে নিজের কেবিনে ডেকে নেয়। বেশিক্ষণ খোসগল্প চলে, পুরন্দরের ডিবে থেকে দু-তিন খিলি পান মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে থাকে। পুরন্দরের পাঠানো বিলের বাঁহাতের হিসাব বুঝে তারপর সই করে। পুরন্দরও এ ব্যপারে কোন তানচুক করে না। পাই পাই হিসেব বুঝিয়ে তারপরেই বিলগুলো উদ্ধার করে। নিজের কেবিনে ফিরে যায়।
আজ ভূপতি ভরদ্বাজকে একটু চিন্তিতই মনে হয়। দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁতে দাঁতের ফাঁক থেকে পারের কুঁচোগুলো খুঁটতে খুঁটতে কেমন যেন উদাসিন হয় যায়,
- আধুনিকীকরণ বুঝলে ভায়া তথ্যপ্রযুক্তি। সমস্ত অফিসে লাগানো হচ্ছে কম্পিউটার, সি.সি. টিভি। এখন থেকে রিজিয়ানে বসেই সাহেবরা আমাদের ওপর নজরদারি চালাবে। এবার থেকে অফিসে কোন ঠিকেদার, সাপ্লায়ার ঢুকতে পারবে না। কম্পিউটারেই বিলপাস, পেমেন্ট সাতদিনের মধ্যে করতে হবে। খাতা, পেনের কোন কাজ নেই। আমরা এবার থেকে কম্পিউটারের অধীনে থাকবো।
সকাল ১০টা থেকেই চেম্বারের সামনে দালাল, ঠিকেদার, সাপ্লায়ারদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরন্দর এর সবকাজ সমাধা করে অফিসে ঢুকতে প্রায় সাড়ে এগারোটা, ভীড় ঠেলে নিজের চেয়ারে বসে। আলমারি থেকে ঝাড়ন বার করে চয়ার টেবিলটা যথাসম্ভব পরিষ্কার করে ফেলে, তারপর ব্যাগ থেকে গামছা, টিফিন বক্স, পানের ডিবে, পেন চশমা ইত্যাদি নানান টুকিটাকি জিনিসগুলো টেবিলে সাজিয়ে রাখে। এরপর এককোনে থাকা বেশিনে মুখ চোখ ভালো করে ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছে নেয়। আলমারির তালা খুলে ফাইলের তাবড়া স্তুপকৃত করে রাখে টেবিলের একপাশে।
চেম্বরে ঢোকার মুখেই পুরন্দর বাইরের ভীড়ের মধ্যে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, সেইমতো মোটা মুরগিগুলের আগে ডাক পড়ে। প্রথমে একটু হম্বিতম্বি তারপর হাতবাড়ালেই ভরাভর্ত্তি টাকার খাম সুরসুড় করে বেরিয়ে আসে।
মালতি পুরন্দরের পিওন। ওর স্বামী ওয়ার্কশপে টার্নার ছিলো। ডিউটি করার সময় ক্রেন মাথায় পড়ে ইয়লীলা সাঙ্গ হয়। কম্পেনসেশন গ্রাউন্ডে চাকরি পেয়ে পুরন্দরের কাছেই জয়েন করে। বারো তেরো বছর এই কাজেই আছে। শুরু শুরুতে একটি জড়োভরত ছিলো। পুরর্দর চেম্বের ডাকলে এককোনে দাঁড়িয়ে থাকতো। কাপড়টা টানাটানি করে যৌবনের বিশেষ অঙ্গগুলো ঢাকার চেষ্টা করতো, পুরন্দরের ললুপ দৃষ্টি থেকে পার পেত না। টেবিল পরিষ্কার, জল দেওয়া, আলমারিতে ফাইল তোলা, ফাইল বার করা, এমন নানান অছিলায় পুরন্দর নিজের আদীম লালসা মিটিয়েই নিতো। পরে পরে অবশ্য মালতির এসব কিছু গা সওয়া হয় যায়। আজকাল কারণ অকারণেই ওর বুকের আঁচল খসে পড়ে। ছোটখাটো চটুল ইসারা, হাঁসি ঠাট্টার বদলে একটু তাড়াতাড়ি অফিস ছাড়া কিংবা একটু দেরী করে অফিসে আসা, এমনই ছোটখাটো সুযোগ সুবিধেগুলো পুরন্দরের থেকে সহজেই আদায় করতে পারে।
ভূপতি ভরদ্বাজের চেম্বার থেকে ফিরে নিজের চিয়ারে বসে পুরন্দর ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেয়ে ফেলে,
- এবারতো রিটায়ারের পর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুয়িটির কটা পয়সাই আমাদের সঞ্চয় হবে। ভূপকি ভারদ্বাজের হৃদয়বিদারক ভবিষ্যতবানী এখনও তার কানে বাজছে। এখন থেকে আসা যাওয়ার গাড়ীভাড়ার জন্যও সাতসকালে মৃদুলার সামনে হাত পাততে হবে তাকে।
পুররন্দর দিব্যদৃষ্টিতে যেন সব কিছু দেখতে পায়। অফিসটা যেন ধূ ধূ গড়ের মাঠ। হাঁসি ঠাট্টা, কোলাহল, আসা যাওয়া সব একেবারে উধাও। টেবিলে টেবিলে থাকবে কয়েকটা নরখাদক সেলুলয়েডের বাক্স। সিলভার স্ত্রীণে একটা গাড় নীলাভ আলো জ্বলবে তারপর এক এক করে পুরন্দরের দরাজে থাকা বিলের ফাইলগুলো এক নিমিষে উদরস্ত করে মিটিমিটি হাসবে আর বলবে, - পুরন্দর পাকড়াশী অনেক হলো, এবার আঙুল চোষ।
পুরন্দর ডান দিকের ড্রয়ারটা টেনে ভরাভর্তি খামগুলো কে স্পর্শ করে, একটু শিহরণ, একটা আদ্ভুত অনুভূতি। অনেকটা মালতীর গা ভর্তি যৌবনের মতো, এরপর আধরাই রয়ে যাবে। বেশ কয়েক বছর হল পুরন্দরের ছুঁক ছুঁকানিটা একটু বেড়েছে, বাস, ট্রামে রাস্তাঘাটে সুন্দরি মহিলাদের দিকে ড্যাব ড্যাব করে দেখে, নিজের বসার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সুব্রত এই অফিসে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কিংয়ে কাজ করছে। রিজিয়ন থেকে যে কোম্পানি সোজুসোজি এই কাজের বরাত পেয়েছে ও তারই সুপারভাইজার। বয়স তিরিশের কোটায়, বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, সকাল নটার মধ্যেই কাজ শুরু করে দেয়, থাকেও অনেক রাত পর্যন্ত, মধ্যমগ্রামে বাড়ী।
পুরন্দের চেম্বারের লাগেয়া একটা ফাঁকা কেবিনে আআতত বসে। এর সাথে আরো কয়েকজন মাঝবয়সী ছেলে কাজ করছে। আপাততঃ সারা দেওয়াল জুড়ে ওয়ারিংয়ের কাজ করা হচ্ছে। ছাদের ওপর এ্যাঙ্গেলের স্টাকচার করে টাওয়ার বসছে। সুব্রত মাঝে মাঝে নিজের টেবিল ছেড়ে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছে আবার ফিরে এসে নিজের ল্যাপটপে মনোযোগ দিচ্ছে। পুরন্দর সময় পেলেই ওর পাশে বসে। সুব্রত একটু অস্বস্তি বোধ করলে পুরন্দর উৎসাহ দেয়। ল্যাপটপ বন্ধ করলে স্ত্রীনে সুব্রতর সাথে এক বিবিহিতা যুবতীর অন্তরঙ্গ ছবি ভেসে ওঠে।
- আমার বৌ স্যার, মনু, মন্দাকিনী।
পুরন্দর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুব্রত ওর কৌতুহল নিরসন করে।
- কোলকাতায় তো একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট নিতে পারতে, মধ্যমগ্রাম থেকে রোজ আসা যাওয়া। পুরন্দর একটু গায়ে পড়েই উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করে।
- প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি স্যার ক-পয়সা মাইনে পাই। মা-বাবা, মাথার উপরে বিবাহযোগ্য বোন, এতেই সংসার চলে না। কোলকাতা শহরে থাকার কথা ভাবতেই পারি না,
গতরাতে অর্কর ল্যাপটপে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দেখা এবং সুব্রত ফেসবুকের তত্ত্বটা পুরন্দর কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। বন্ধু বান্ধবীদের সাথে রাত জেগে খোসগল্পের প্রয়োজনীয়তাটাও ঠিকটাক মাথায় আসছিলো না। এই গুড় তথ্যটা সুব্রতর কাছে এখনই খোলসা করা বোধায় যুক্তিযুক্ত হবে না।
হত কয়েক বছর সুগার, প্রেসারে মৃদুলা বেশ কাবু হয়ে গেছে। সব কিছুতেই একটু অনুৎসাহি, রাতে বিছানায় শুলেই নাক ডাকে, পুরন্দর একেবারেই আলাদা, নিরোগ, সুঠাম শরীর, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে বরাবরই যন্তশীল। সারাদিনে কয়েকখিলি পান ছাড়া কোন নেশাভাঙ নেই, বন্ধুদের পার্লায় পড়ে আগে দু-এক ঢোঁক মধ্যপান করতো, ইদিনিং তাও কমিয়ে দিয়েছে। মৃদুলাকে জোর করলে নানান অছিলায় এড়িয়ে যায়। অতঃপর পুরন্দর সুপ্ত বাসনাগুলোকে চেপে ঘুমিয়ে পড়ে। বছর দুএক হলো মৃদুলা দীক্ষা নিয়েছে। পাড়া বেপাড়া মিলিয়ে বেশ কয়েকজন মহিলা সেই সংঘেরই দিক্ষিত। পালাপালি করে ভিন্ন ভিন্ন বাড়ীতে নাম গানের আসর বসে। দিবানিদ্রার সময় হাতে নেই, লালপেড়ে সাদা শাড়ী পরে নাম গান শনতে বেড়িয়ে পড়া। দুপুরে টিফিনের সময় সুব্রতকে নিজের চেম্বারে ডেকে নেয় পুরন্দর। মালতি দুগ্লাস জল দিয়ে যায়, পুরন্দর পিড়াপিড়িতে দুটো লুচি আর একটা আলুরদম নিজের প্লেটে নিতে বাধ্য হয়। সবশুনে সুব্রত হেঁসেই অস্তির।
- এটা আড্ডা বা খোসগল্প নয়, স্যার একে বলে চ্যাটিং, ইন্টারনেট কানেকশন থাকলে ফেসবুকে সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো যায়। যখন তখন অনলাইনে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সহজেই কথোপকথন হয়, স্কাইপ থাকলে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তরে বসেও একে অপরকে দেখতে পায় সরাসরি। একেই বলে সোস্যালে নেটওয়ার্কিং। ঘরে বসে আপনি যা কিছু ট্যুইট করবেন, সারা পৃথিবীর লোক জানতে পাবরে তা। এরপর সুব্রত গলাটা একটু ধিমা করে বলে, - আমার আর মনুর প্রথম পরিচয়ও ফেসবুকে স্যার, ওর বাড়ী ছিলো বর্ধমানে, আমি মধ্যমগ্রামে, দুজনেই সময় বার করে প্রতিদিন সাইবার কাফেতে বসে চ্যাটিং করতাম। কথার মাঝেই সুব্রত একটু অন্যমানস্ক হয়ে পড়ে। পুরন্দর কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে, সুব্রত খেলাচ্ছলে যেন তার চোখের সামনে থেকে কালোপর্দাটা হুস করে সরিয়ে দিলো। একটা সেলুলয়েডের বাক্স, সিলভার স্ত্রীনে নীলভ আলো জ্বলে উঠলো। ইউনিভার্সাল ব্রাদারহুড, 'বিশ্বভাতৃত্ব'। বিবেকানন্দমশাই বেঁচে থাকলে তাঁকে আর কষ্ট করে হয়তো বিশ্বপরিভ্রমণ করতে হতো না। সোস্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে কত সহজেই তাঁর বানী ঘরে ঘরে পৌঁছে যেতে পারতো।
দু-একদিন সুব্রতর পিছনে দাঁড়িয়ে পুরন্দর ল্যাপটপ অন করাটা একটু রপ্ত করে নিয়েছিলো। সুযোগবুঝে অর্কর অনুপস্থিতিতে ল্যাপটপকে চালিয়েও দেয়া, তারপর অনেক কসরত করে ফেসবুকটা নজরে পড়ে না।
পরেরদিন ব্যপারটা শুনে সুব্রত হেঁসেই অস্থির। 'পাসওয়ার্ড' না জানলে স্যার আপনি অন্যের সাইটে কি করে ঢুকবেন? আগের দিন সুব্রত এই কথাটাই বলেনি। হয়তো ভুলে গিয়েছিলো কিংবা দরকার পড়েনি। কিন্তু পুরন্দরের এটা খুবই দরকার। মৃদুলা, ভূপতি ভরদ্বাজ, মালতি, অন্তদি, অলকা এদেরও আলাদা আলাদা পাসওয়র্ড থাকা জরুরী। পুরন্দরের সাথে সাথে এরা সকলেই একটা দ্বীপে আটকে আছে। চারিদিকে ঘিরে আছে দিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র। উঁচু উঁচু ঢেউয়ের মাঝে এই প্রজন্মের গুটিকতক মানুষ যেন মনের আন্নদে খেলে বেড়াচ্ছে। ওদের প্রানোচ্ছল অভিব্যক্তিতে কোন ক্লান্তি নেই, নেই কোন অবসাদ, হতাশা, দুঃখ, কিংবা দারিদ্রতা। মনে হয় যেন সীমার মাঝে অসীমে গেছে হারিয়ে। অর্ক, সুব্রত, মন্দাকিনি এরা সকলেই পুরর্দরের চেনা, শুধু এদের কাছে পৌঁছোনোর পাসওয়ার্ডটাই পুরন্দরের অজানা।