ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে অশোক কুমার সিদ্ধান্ত নিলেন আজকেই সিরাজগঞ্জ যাবেন। অবশ্য কোলকাতা থেকে রওনা হবার আগে ভেবেছিলেন আজকের দিনটা ঢাকাতেই কোন এক হোটেলে থেকে যাবেন। কিন্তু এবার সিদ্ধান্ত পালটালেন। তাছাড়া যার জন্য, যে উদ্দেশ্যে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, চল্লিশ বছরের প্রতীক্ষিত সেই দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনীর অবসান ঘটানোর জন্য তার আর এক মুহূর্ত দেরীও যেন সই ছিলনা।
এয়ারপোর্টের ঝামেলা চুকিয়ে অশোক কুমার রাস্তার ধারে এসে দাঁড়ালেন। রাস্তার ওপারে ইলেকট্রিক তারের উপর একটি শালিক বসে ছিল। তিনি ভাসা ভাসা চোখে সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলেন কিভাবে যাবেন সিরাজগঞ্জ। ঢাকার কোন জায়গা থেকে কোন গাড়িটি ঠিক সিরাজগঞ্জের দিকে যায় তিনি তা মনে করতে পারলেননা। ঢাকায় তিনি একবারই এসেছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে। তখন বয়স ছিল আঠারো বছর। দুই বোন তাপসী, শঙ্করী, মা আর বাবা অনিল কুমারের সঙ্গে। সিরাজগঞ্জ থেকে লঞ্চে ভুয়াপুর। সেখান থেকে বাসে করে কমলাপুর ষ্টেশন। ঢাকায় আসা বলতে ওটুকুই। তারপর আবার ট্রেন। হেঁটে সীমানা পাড়ি দেয়া। আবার ট্রেন, বাস এভাবে কলকাতার ঘিঞ্জি শহরের চার দেয়াল। অশোক কুমারের মনে পড়ে, তারা যেদিন, কোলকাতার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন সেদিন এগিয়ে দেয়ার জন্য ঘাটপাড়ে অনেকেই উপস্থিত ছিল।
তারপর একসময় হুইসেল বাজিয়ে লঞ্চ ছেড়ে দিল। নদীর পাড়ে করুন চোখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো একটু একটু করে দুরে সরে যেতে থাকলো। সেদিন সেই মানুষগুলোর ভীড়ে অশোক কুমারের ব্যস্ত চোখ শুধু খুঁজে ফিরছিল একজনকেই। সে ছিল অবন্তি। যাকে তিনি কথা দিয়েছিলেন ফিরে আসবেন। পালিয়ে হলেও ফিরে আসবেন। কিন্তু সেদিন তিনি সেই নদীর পাড়ের মানুষগুলোর ভীরে অবন্তিকে খুঁজে পাননি। অশোক কুমার ভেবে চলেন, তিনি কি কথা রেখেছেন?
আজ এই চল্লিশ বছর পর, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, চোখে পুরু কাচের চশমা আর ঈষৎ কোচকানো গায়ের চামড়া নিয়ে, কোলকাতা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসাকে তিনি কি সেই আঠারো বছরের যুবকের ফিরে আসার সঙ্গে তুলনা করবেন? এই ফিরে আসার প্রতিশ্রুতিই কি তিনি অবন্তিকে দিয়েছিলেন? রিনরিনে হাসি আর টানা টানা চোখের সেই চঞ্চল বালিকাটি কি তার এই ফিরে আসার পথ চেয়ে বসে আছে এখনো? আজ এতদিন পর অবন্তি কি তাকে চিনতে পারবে? সে কি তাকে মনে রেখেছে? একজীবনে তো মানুষ কতকিছুই ভুলে যায়।
যে অবন্তির কোলে মাথা রেখে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেছেন ঘন্টার পর ঘন্টা। স্কুল ফাঁকি দিয়ে যে অবন্তি তার কলেজের গেটে এসে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকতো। যাকে নিয়ে তিনি যমুনার পানিতে নৌকা ভাসাতেন। সেই অবন্তি কি এই সবকিছুই ভুলে বসে থাকবে? ভোলা কি যায় কখনো? তিনি তো পারেননি। কোলকাতায় তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, টাকা পয়সা, সংসার, সুখ-শান্তি সব হয়েছে। তরপরও তিনি অবন্তি নামের পল্লী বালিকাটির স্মৃতি লালন করছেন বুকের খুব গভীরে। যতন করে।
মহাখালী থেকে অশোক কুমার সিরাজগঞ্জের যে গাড়িটিতে উঠলেন তার নাম যমুনা। ‘আহ যমুনা’ অশোক কুমার পরম তৃপ্তিতে কয়েকবার উচ্চারণ করলেন নামটি। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে যেখানে তাদের বাড়ি ছিল তার পাশ দিয়েই কলকল শব্দে বয়ে যেত যমুনা নদী। সেই নদীতে সাতরে কেটেছে তার শৈশব-কৈশর। অবন্তিকে নিয়ে কতবার নৌকা ভাসিয়েছেন যমুনার অথই জলে। ভয়ে অবন্তি তার বুকে মাথা গুঁজত। যেন এই বুক পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। যমুনার অথই জলে নৌকা ডুবলেও এই বুক কখনো ডুববে না।
অশোক কুমার বুকে হাত দিলেন। যেন অবন্তির শরীরের স্পর্শ এখনো লেগে আছে তার বুকে। তারপর হটাৎ তার বুকটা হু হু করে উঠলো। তিনি পাশের জানালার কাচ টেনে দিলেন। হু হু করে বাতাস এসে ঝাপটা মারল তার চোখে মুখে। তিনি পরম তৃপ্তিতে চোখ বুঝলেন।
কোলকাতার চল্লিশ বছরের জীবন যেন তাকে শ্বাসরোধ করে রেখেছিল। আজ নিজের দেশের বাসাতে তিনি বুক ভরে শ্বাস টানলেন। এ বাতাসে মিশে আছে অবন্তির চুলের গন্ধ, বুকের গন্ধ। অবন্তি প্রায়ই খোঁপাতে গন্ধরাজ ফুল গুঁজত। তার কাছে গেলে সেই গন্ধ এসে নাকে লাগতো। আচ্ছা অবন্তি কি এখনো খোঁপায় গন্ধরাজ ফুল গুঁজে? বাতাসে কি সেই ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়? অশোক কুমার বাতাসে ফুলের গন্ধ খুঁজে পেতে প্রাণপণে শ্বাস টানলেন।
অশোক কুমার তার সঙ্গে আনা একমাত্র ব্রিফকেসটির ঢাকনা খুলে মেলে ধরলেন। প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়, অবন্তির জন্য কেনা একটি শাড়ি ছাড়া তেমন কিছু নেই সেখানে। শাড়িটিতে তিনি আলতো হাত বোলালেন। অবন্তি একবার স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে শাড়ি পড়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে সেই অবস্থাতেই চলে এসেছিল তার কাছে। অবন্তিকে শাড়ি পড়া অবস্থায় দেখে তিনি চোখের পলক ফেলতে যেন ভুলে গিয়েছিলেন। লজ্জায় অবন্তি লাল হয়ে গিয়েছিল।
আজ এতদিন পর তিনি অবন্তির জন্য শাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। এই শাড়ি পড়ে অবন্তি তার সামনে এসে দাঁড়াবে। তিনি অপলক তাকিয়ে থাকবেন সেদিকে। অবন্তি লজ্জায় লাল হবে। সেকি তাকে চিনতে পারবে? যদি না চেনে? যদি তার দেয়া শাড়ি না নেয়? না নিক তবু তিনি দেবেন।
অশোক কুমার ব্রিফকেস হাতড়ে কাপড়ের নিচ থেকে একটি ঠিকানা বের করলেন।
শ্যামলকান্ত, গ্রাম+পোস্ট-এনায়েতপুর, জেলা- সিরাজগঞ্জ।
তার ছেলেবেলার একমাত্র বন্ধু। কলেজ পর্যন্ত একসঙ্গেই ছিলেন। দেশ ছেড়ে কোলকাতায় যাওয়ার পর বছর খানেক তার সঙ্গে চিঠি চালাচালিও হয়েছিল। তারপর হটাৎ করেই আর কোন খবর পাওয়া গেলনা। অনেক চিঠি দিয়েছিলেন তার ঠিকানায়। কিন্তু কোন উত্তর আসেনি আর। উত্তর পাননি অবন্তির কাছে লেখা চিঠিরও। কোলকাতায় যাওয়ার পর অবন্তির কাছ থেকে তিনি মাত্র একটি চিঠি পেয়েছিলেন। চল্লিশ বছর পর আজও সেই চিঠি তার কাছে রয়ে গেছে। হয়তো থাকবে আমৃত্যু। অবন্তি লিখেছিল- আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি, তুমি অবসর মত বাসিও/ আমি নিশিদিন হেথায় বসে আসি, তোমার যখন মনে পড়ে আসিও।
হ্যাঁ, আজ চল্লিশ বছর পর অশোক কুমারের অবসর হয়েছে ভালবাসার। তাইতো তিনি কোলকাতাকে পিছনে ফেলে, স্ত্রী-সন্তানদের পিছনে ফেলে চলে এসেছেন এই বাংলাদেশে। শুধু একবার এক পলক অবন্তিকে দেখার জন্য। এসেছেন অবন্তিকে দেয়া কথা রাখার জন্য। এবার তিনি ফিরে গিয়ে শান্তিতে চিতায় চড়তে পারবেন। কিন্তু অবন্তি? সে কি এখনো তার জন্য নিশিদিন পথ চেয়ে বসে আছে? সে যদি বলে, এতদিন পর এলে প্রিয়! এখন যে বড় অবেলা।
অশোক কুমার ব্রিফকেসের ঢাকনা লাগিয়ে শ্যামলকান্তের ঠিকানাটা বুক পকেটে রাখলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন প্রথমে তিনি শ্যামলকান্তের বাড়িতেই উঠবেন। যদি তাকে না পাওয়া যায় তবে বলে কয়ে কারো বাড়িতে আজকের রাতটা শুধু থাকবেন। তারপর সকালে বের হবেন অবন্তির খোঁজে। একবার, শুধু একবার অবন্তির সাথে তার দেখা করা খুবই প্রয়োজন। সামনা সামনি দাঁড়িয়ে তিনি শুধু বলতে চান, অবন্তি দেখ আমি ফিরে এসেছি। আমি আমার কথা রেখেছি!
রাতের আঁধার কেটে রিকসা এগিয়ে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস সিরাজগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে নেমে এমন এক রিকশাওয়ালাকে তিনি পেলেন। নাম সুলেমান মিয়া। বয়সে তার কাছাকাছি মনে হল। তবু গায়ে বেশ জোর। রাতের নিস্তব্ধতা দূর করতে অশোক কুমার তার সাথে কথা জুড়ে দিলেন। অশোক কুমারের নিজ গ্রাম সম্পর্কে সুলেমান মিয়া বেশ অবগত। এটা জানতে পেরে অশোক কুমার ভীষণ এক উত্তেজনা নিয়ে সুলেমান মিয়ার সঙ্গে কথা বলে চললেন। সে তার বাবা অনিলকুমারের নাম জানে। এনায়েতপুর হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তার বাবা তাও সে জানে। অশোক কুমার গ্রামের আরো অনেক খবর নিলেন সুলেমান মিয়ার কাছ থেকে। শুনলেন গ্রামের অনেক পরিবর্তনের কথা। হাই স্কুলটা যেখানে ছিল সেখানে আর নেই। সেখানে এখন বিশাল হাসপাতাল। আরো কত দালান কোঠা উঠেছে গ্রামে।
অশোক কুমার ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইলেন, আমাদের বাড়ি ছিল যেখানে সেই ভিটা? সে জায়গা কি এখনো আছে?
সোলেমান মিয়া উত্তর দিল, আরে না। কি যে কন। সেইখানে এখন সরকারী দালান হইছে না।
অশোক কুমার সোলেমান মিয়াকে বলতে যাবেন, আমাদের বাড়ির পাশে যে থাকতেন হরিনারায়ণ জ্যাঠা, তার বাড়ি? তারা এখন কোথায়? তার মেয়ে অবন্তি বালা?
কিন্তু তিনি এসব কিছুই বলতে পারলেননা। কি এক অজানা আশংকায় তার বুক কেঁপে উঠলো। যদি সুলেমান মিয়া বলে ফেলে, ওখানেও কেউ নেই আর। সরকারী দালানকোঠা উঠেছে!
অশোক কুমার আর কথা বাড়ালেন না। সোলেমান মিয়ার মুখ থেকে গ্রামের এই পরিবর্তনের কথা তার মোটেও শুনতে ইচ্ছা করলো না।
সেই রাতে যে চমকটি অশোক কুমারের জন্য অপেক্ষা করছিল, তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। সুলেমান মিয়ার সাহায্যে শেষ পর্যন্ত তিনি শ্যামল কান্তের বাড়িটি খুঁজে বের করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি যে শ্যামলকান্তকে আশা করেছিলেন এ যেন সে নয়। বয়সের ভারে বাঁক খাওয়া এক শ্যামলকান্ত। তার চেয়েও বড় কথা তার ডান পায়ের পুরোটাই নেই। মুক্তিযুদ্ধর সময় গুলি লেগেছিল। তারপর কেটে ফেলতে হয়েছে। সেই যুদ্ধের সময়েই পাক বাহিনী অনেক লোককে হত্যা করে। তারা অবন্তীদের পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। শুধু অবন্তিকে বাঁচিয়ে রাখে। হানাদাররা তাকে তুলে নিয়ে যায়। আজো তার কোন খবর মেলেনি।
জোছস্না রাতে বারান্দায় বসে শ্যামলকান্ত বন্ধুর কাছে এসব বলছিলেন। পাশেই বসেছিলেন অশোক কুমার। তিনি এই চরম সত্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো, মিথ্যে কথা। তোমরা সবাই মিথ্যে বলছ আমাকে। সবাই ছলনা করছ। কিন্তু তিনি এসব কিছুই বলতে পারলেন না। তিনি যেন কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেললেন। বুকের খুব গভীরে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভূত হল তার। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সেই ঝাপসা চোখেই তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। তাতে চাঁদের আলো পড়ে আশ্চর্য দ্যুতিময় হয়ে উঠলো। কোথা থেকে এক ঝাপটা বাতাস এসে গাছের পাতা নাড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই বাতাসে ভেসে এলো গন্ধরাজের গন্ধ।
শ্যামলকান্ত বন্ধুর দিকে তাকালেন। অশোক কুমারকে ছোট্ট শিশুর মত অসহায় মনে হল তার কাছে। দেখে তারও বুক কেঁপে উঠলো। তিনি পরম মমতায় বন্ধুর পিঠে হাত রাখলেন। আর ঠিক তখনই অশোক কুমার শিশুর মত ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পঞ্চাশোর্ধ প্রবীণের সেই কান্না জোছস্না রাতে বড়ই অদ্ভুত শোনালো।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪