কবি, নারী এবং নির্জনতার গল্প

উচ্ছ্বাস (জুন ২০১৪)

ফাহিম ফয়সাল
  • 0
আলুথালু নীল শাড়ী পড়া একটি মেয়ে ছুটছে তো ছুটছেই। বিরাম নেই যেন। প্রায় বিশ বছর বয়সী এক পূর্ন-যৌবনা যুবতী। দূর নদী দিয়ে ভেসে যাওয়া পাল তোলা নৌকোর মতই সুন্দর! চোখে মুখে এক অদ্ভূত অনূভূতির ছাপ ষ্পষ্ট কিন্তু ব্যাখ্যা করা মুশকিল ! অনেকটা শরতের আকাশের মতো, আনন্দ, ভয় আর প্রশান্তির এক সুষম মিশ্রন। বনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট সর্পিল নদীটির পাশ ধরে সেই মেয়েটি এগিয়ে চললো শ্বাপদসংকুল বনের একেবারে গভীরে, কোন ভয় ডর নেই, যেন সাক্ষাৎ বনদেবী ! এক সময় মেয়েটির চলার গতি শ্লথ হয়ে এলো, তার উৎসুক দৃষ্টিকে আকর্ষন করে নিল গোলাপী রং এর এক গুচ্ছ বুনো ফুলের ঝোপ। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে ফুলগুলোর দিকে ! তার দৃষ্টি বলছে, ’কার জন্য ফুটেছে এরা এই গহীন নির্জন জঙ্গলে!’ এর পরের স্বাভাবিক দৃশ্য হতে পারতো ঐ ফুলগুলোর জীবনাবসান মেয়েটির সুন্দর কালো চুলের সৌন্দর্য বর্ধনের মহৎ উদ্দেশ্যে! কিন্তু তা হলোনা ! মেয়েটির এক জোড়া অনাবিল প্রশান্তি মাখা চোখ তাকে এগিয়ে নিয়ে চললো আরো সামনের দিকে, যেন এক দিকভ্রান্ত কিন্তু শান্ত, ভাবনাহীন প্রজাপতি ছুটছে ফুল থেকে ফুলে ! সে আজ খুবই আনন্দিত, উচ্ছসিত! বোধ জন্মাবার পর থেকে কোন দিনই এত নিঃসঙ্কচিত্তে ঘুরে বেড়ানো হয়নি তাঁর ! এর আগে এত মুগ্ধতা তাঁর উপর ভর করেনি কক্ষনো ! এই নির্জন জনমানবহীন অরন্যে নিজেকে তার অদ্ভুত লাগছে ! গোধূলীর লাল আলো ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সন্ধ্যার কালো রং এর চাঁদরে। হঠাৎ সামনে একটা আবছা মূর্তি চোখে পড়ল তাঁর, যেন অবিকল একজন মানুষ ! সে এগিয়ে গেলো। হ্যাঁ, সত্যিই তো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কাঁঠালিচাপার তলায় ! এখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকা কাঁঠালিচাপার ফুলগুলো থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে কয়েকটা তার হাতের মুঠোয়। মেয়েটা আর না এগিয়ে যেই ফিরে যাবার জন্য মুখ ঘুরিয়েছে তখনই একটা কাণি বক ডেকে উঠলো পেছনের কোন একটা গাছে আর অমনি লোকটি গতি ফিরে পেল তার দেহে ! নারী মূর্তি দেখে বলে উঠলো, ’কে ওখানে? দাঁড়ান, এই গহীন জঙ্গলে এই ভর সন্ধ্যায় আপনি কোথা থেকে এলেন? কেন এসেছেন এখানে? আপনার মনে কোন ভয় নেই!’ অনিচ্ছা স্বত্বেও মেয়েটি ভয়ে আতঙ্কে স্থির হয়ে গেলো সেই জায়াগাতেই ! যখন লোকটি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালো তখন তাঁর ভয় কিছুটা কমে গেলো। মধ্যবয়সী এক লোক কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, চোখে চশমা আর হাতে কয়েকটি কাঁঠালিচাপা ফুল, কড়া সুবাস ছড়াচ্ছে চারপাশটাকে মাতাল করে দেবার নেশায়! লোকটি বললো ’কি হলো কথা বলছেন না যে!’ মেয়েটি বললো ’আ-আ-আপনি কবি, তাইনা?’ এবার লোকটি হেসে উঠে বললো ’ঠিকই ধরেছেন! কিন্তু আপনি এই জঙ্গলে কেন, আপনার নাম কি? আর একাই বা কেন এই জঙ্গলে এসেছেন ?’ মেয়েটি বললো ’আমার নাম শঙ্কিতা। আমি পুরুষশাসিত সমাজের নিষ্পেষনের রুপে ভীত হয়ে এই অভয়ারণ্য বেছে নিয়েছি কিন্তু আপনি এখানে কেন?’ কবি উত্তরে বললেন, ’সমাজের অধঃপতন, ধর্মান্ধতা এবং সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ স্বেচ্ছায় বনবাস গ্রহন করেছি এক যুগের জন্য। আর এক মাস হলেই আমার মেয়াদ সমাপ্ত হবে কিন্তু আপনার কথায় মনে হচ্ছে মনুষ্য সমাজ আজও তেমনি আছে যেমনটি রেখে এসেছিলাম ! যাই হোক, আপনি আসাতে ভালোই হয়েছে ! অন্তত একই রকম বোধের একজন সঙ্গী পাওয়া গেলো!’ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য শঙ্কিতা বলে উঠলো ‘কি চমৎকার আজকের এই সন্ধ্যাটা এই নির্জন অরণ্যে ! সত্যিই অতুলনীয় !’ কবি বললেন, ‘চলুন আরো ভেতরে যাই, ওদিকটা আরো সুন্দর, প্রাকৃতিক টিলা আর নিবিড় গাছ পালা দিয়ে ঘেরা এক মনোরম উপত্যকা!’ এরপর দুজনই হাঁটতে হাঁটতে সেই উপত্যকায় চলে এলো।

-ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটি জায়গায় নিয়ে আসার জন্য।
-আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো, আমি প্রতিদিন এই সময়ে এখানটায় আসি।
-অনেক দিন পর আজ একজন কবির স্যান্নিধ্য পেলাম।
-আর আমি অনেক বছর পর একজন মানুষের সন্নিধ্য পেলাম। আপনি বিয়ে করেছেন ?
-না, আমি তো সবে বিশে পা দিয়েছি ! আপনি বিয়ে করেননি ?
-নাহ, সে আর হয়ে ওঠেনি। আসলে সেরকম কাউকে পাইইনি। কখনো ভালবেসেছেন
কাউকে?
-নাহ, শুনেছি পুরুষরা খুব খারাপ হয় ! আমি ওদের ঘৃণা করি। আমি বয়সে আপনার অনেক
ছোট, আপনি আমাকে তুমি সম্মোধন করতে পারেন সমস্যা নেই।
-আমিও তো পুরুষ, তাহলে যে তুমি আমার সাথে সময় কাটাচ্ছো এই নির্জন বনে ?
-আপনি তো পুরুষ না, কবি।
-তাই ! কবির ভেতরেও তো পুরুষ বাস করতে পারে ?
-জানিনা, ভেতরের পুরুষটাকে ঢেকে রাখতে পারে বলেই হয়তো তাঁরা কবি !
-ঠিক বলেছ।
-পুরুষেরা জংলী হাতীর মত, ক্ষুধা পেলেই তছনছ করে ফেলে শস্যক্ষেত, যতটা না খায় তার চেয়ে ধ্বংস করে বেশি!
-ঠিক। পুরুষ মাত্রই সুন্দরের হন্তারক! নারী যে প্রকৃতির মতো তা এই অবোধ পুরুষগুলো যে কবে বুঝতে শিখবে কে জানে ! হয়তো কখনোই শিখবেনা, আর তাই হয়তো আমার এই স্বেচ্ছানির্বাসনও শেষ হবেনা কখনো !
-এত নৈরাশ্যবাদী হয়ে উঠবেন না। দেখবেন একদিন পুরুষেরা তাদের ভুল ঠিকই শুধরে নেবে।
-তাই যেন হয় !
-দেখুন দেখুন ঐ যে টিলার উপরে কি সুন্দর ঝকঝকে এক ফালি চাঁদ উঠেছে ! কী নৈস:র্গিক দৃশ্য!
- তোমার হাসি তো এর চেয়েও নৈস:র্গিক। তুমি তো নিজেই ধারন করে আছো এক মায়াময় প্রকৃতি!
- বাড়িয়ে বলছেন! কবি হতে হলে বুঝি সবকিছুই এভাবে বাড়িয়ে, সুন্দর আর রহস্যময় করে বানিয়ে বলতে হয়?
- মোটেই না! যা সত্য তাই তো বলছি। নারী তো প্রকৃতি-ই! যে চাঁদের দিকে তাকিয়ে এত উচ্ছসিত হচ্ছো তার চেয়েও সুন্দর এক ফালি চাঁদ তো তোমার কাছেই আছে, তোমার মাঝেই আছে ভরা নদী, কাশবনে ছাওয়া নদী তীর, সুপ্ত অগ্নিগিরি, সুউচ্চ পাহাড়শ্রেণী, উপত্যকা, শান্ত সরোবর, বিস্রস্ত লতায়পাতায় জড়ানো পদ্ম...! মেঘদূত পড়া হয়নি তোমার ?
-না, পড়া হয়নি, তবে শুনেছি সেখানে কবি মেঘের বন্দনা করেছেন, নারী আর মেঘের অভেদ কল্পনারুপে! সংস্কৃত ভাষা বুঝিনা, তাই খুব ইচ্ছা করে, কেউ যদি মেঘদূত পড়ে ব্যাখ্যা করে শোনাতো আমায়!

হঠাৎ তীব্র কর্কষস্বরে ডাকতে ডাকতে একঝাঁক টিয়া তাদের মাথার কিছুটা উপর দিয়ে উড়ে গেলো, আর সেইসাথে তাদের আশেপাশের গাছগুলোতে একসাথে চিৎকার জুড়ে দিলো পাখি এবং অন্যান্য জন্তুরা, যেন আগুন লেগেছে বনে! অথবা তারা প্রতিবেশী কারো কোন বিপদের আভাস পেয়েছে, তাই চিৎকার করে সতর্ক করতে চাইলো হয়তো! সমস্ত ঘটনাটা এত কম সময়ের মধ্যে ঘটলো যে মেয়েটি এর আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে কবিকে জড়িয়ে ধরলো। কবির সমস্ত মুখমন্ডল ডুবে গেলো মেয়েটির সুবাসিত গভীর কালো চুলের সমুদ্রে। কবির অভিজ্ঞ হাতের আলিঙ্গন আর বিদ্যুতস্পর্শে মেয়েটি মোমের মত গলে যেতে থাকলো!

- কবি তার কানেকানে ফিসফিসিয়ে বললেন, ’মেঘদূত হলো মেঘের বন্দনা ! তুমি আমার কাছে অমৃতসম, এসো তোমাকে আজ ’অমৃতবন্দনা’ শেখাই ! শিখবে ?’
-হুমম... শেখাবেন আমায় ? এই বলে সে কবির কন্ঠালগ্না হলো।
কবি তাকে অমৃতবন্দনা শেখাতে লাগলেন- এই হলো পদ্মপাতা, এই তার ফুটে থাকা ফুল, এই নদী, এই কাশবন, এর নাম পুর্ণিমা, এর নাম নির্জন বন...

রাত্রী গড়িয়ে ভোরের নরম রোদের গোলাপী আভায় দেখা গেলো সেই মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে পরম প্রশান্তিতে ! আলুথালু শাড়ী, কপালের চুল ওলোট-পালোট, গলায়-ঠোঁটে বিগত ঝড়ের ধংসচিহ্ন। পাখির কলকাকলীতে শঙ্কিতা জেগে উঠলো। একে একে মনে পড়ে গেলো গত রাতের স্মৃতিগুলো! কেমন এক উচ্ছসিত ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়েছিলো তাকে কবি ! জীবনে প্রথমবার ! কিন্তু কবি কই ? কোথাও দেখা যাচ্ছেনা যে তাকে ? চোখ পড়লো অদূরে ঘনসবুজ ঘাসের উপর কয়েকটি ফুলসমেত একটি কাঁঠালিচাঁপার ছোট ডাল দিয়ে একটা শুকনো শালপাতা চাপা দিয়ে রাখা। কাছে গিয়ে মেয়েটি শালপাতাটি হাতে নিয়ে দেখলো তাতে যেন কি লেখা! মেয়েটি লেখাগুলো পড়লো কয়েকবার, আর ধরে রাখতে পারলোনা নিজেকে, তাঁর চোখ বেয়ে নেমে এলো জলের ধারা, মুখে এক রহস্যময় শ্লেষমিশ্রিত অদ্ভুত হাসি। মেয়েটির হাতে ধরা শুকনো শালপাতায় নীল রঙের কালিতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা – “নারী সাধনার পথে বাধা, বন্ধনে কবিত্ব হয়না ! তাই চললাম...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
ওয়াহিদ মামুন লাভলু নারী সাধনার পথে বাধা, বন্ধনে কবিত্ব হয়না ! চমৎকার লিখেছেন। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
প্রজ্ঞা মৌসুমী প্রথমেতো মনে হয়েছিল কবিরা বুঝি অতিমানব। অমৃতবন্দনার কালে অথবা নামহীন মেয়ের চোখের জলে বুঝলাম তাহারা তাহারাই রহিয়া গেল। আমার প্রায়ই মনে হয় চোখের জলের দাম দিতে শিখলেই সে প্রকৃত ধার্মিক হয়, বিপ্লবী হয়, একজন কবি হয়। প্রকৃতির কাব্যিক বর্ণনা ভালো লেগেছে; অনেক শব্দ/ উপমা সমৃদ্ধ গল্প। শুভ কামনা
এফ, আই , জুয়েল # গভীর ভাবনার অনেক সুন্দর একটি গল্প ।।

০৫ মে - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ৪ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪