মহাখালি রেল ক্রসিং থেকে তেজগাঁও রেলস্টেশন। সময় দুপুর বারোটা। কাঠ ফাটা রোদ্দুরে রেলপথ ধরে হেটে চলেছে আসিফ। সঙ্গী রাসেল। বাচাল হিসেবে যার অফিসে দারুন সুখ্যাতি! সাধারণত যাদের মুখ বেশি চলে, কাজের ক্ষেত্রে তাদেরকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায় না। তবে রাসেলের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কথার সাথে সাথে তার হাতও সমান তালে চলে। ক্যামেরাম্যান সে। শুধু ক্যামেরাম্যানই না, বলা যায় দৈনিক আজকাল-এর একমাত্র যোগ্য শুটার। নির্ভুল এবং বেশ শৈল্পিক ছবি তোলার জন্য তার কাজের চাপও বেশি। সেই তুলনায় সম্মানী মধ্যমমানের হলেও ছেলেটা এই অফিসের মাটি কামড়ে পড়ে আছে। কারণ......নাবিলা। এই পত্রিকারই একজন সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। মেয়েটার হাতে একটা অদৃশ্য দড়ি আছে যেন, যার অপর প্রান্ত “রসু মিয়া”র গলায় বাঁধা!
সাই সাই করে একটা ট্রেন চলে গেল পাশ দিয়ে। চারপাশে ধুলো ছড়িয়ে পড়ল। তীব্র রোদ আর গরমে ঘর্মসিক্ত দেহ দুটোয় পড়ে গেল ধুলোর আস্তর। গাল দিয়ে উঠল আসিফ। আজকাল তার মাথা উনুনের মতই উত্তপ্ত থাকে। অল্প সুযোগেই তার মুখ খারাপ হতে বেশি সময় লাগে না। সম্ভবত সময় অনুসারে ইন্ক্রিমেন্ট ততটা না বাড়াতে ইদানীং তার মেজাজের এই অবস্থা। খুক খুক করে কেশে পকেট থেকে রুমাল বের করল রাসেল।
- কি কাজ দিল বস এইটা! হুদাই এমন একটা জায়গায় পাঠাইলো। যত্তসব আজাইরা চিন্তা। আজকাল কি পাবলিক এইগুলা খায় নাকি! আর এতই যদি দরকার.........তো এত খাটা খাটনি না কইরা নেট থেইকা ছাপায়া দিলেই তো অয়। কিংবা ঐ “মালু” (সাথে সাথে জিহ্বায় কামড় দিয়ে).........মানে কিরণরে দিলেও তো হইত। পোলাটা ভাল কল্পনা করতে পারে, হেয় একটা ছাতার মাথা লিখলেই কি কাম হইয়া যাইতো না? কারো বাপের সাধ্য নাই, ঐটার ভুল ধরে!
রেল লাইনে এক দলা থুতু ছিটাল আসিফ। মুখের বালি আর রাসেলের কথা, দুটোই তার মেজাজ আরো খারাপ করে দিয়েছে। তার মনের অবস্থা অনেকটা রাসেলের মত হলেও কাজের সময় সে অন্য কিছু ভাবতে নারাজ।
দাঁড়িয়ে পড়ল সে। চোখ তুলে তাকালো সামনের দিকে। রোদের উত্তাপে রেল লাইনের আশেপাশের পাথরগুলো থেকে যেন ধোঁয়া উঠছে। রাস্তার দু’পাশে বস্তি। ততটা বিস্তৃত নয়। উপরের দিকে তাকালে বস্তির ঠিক পেছনে পাঁচতলা ছ’তলা বাড়িও চোখে পড়ে। রেল লাইনের ধারে কোন কোন জায়গাতে শহরের ফেলনা কাগজ স্তুপাকারে বেধেঁ রাখা হয়েছে। আসিফের চোখ আটকে গেল সেখানে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ঝোলা হাতে কয়েকজন টোকাইয়ের ছবি, যারা কিনা ব্যস্ত কোন ডাস্টবিন থেকে কাগজ তুলতে।
-রসু......চা খাবা?
বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ভুরুর ঘাম ফেলতে ফেলতে জিজ্ঞেস করল আসিফ। কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়ে রাসেল আশেপাশে তাকিয়ে একটি টংয়ের দোকান দেখতে পেল। খালি.........এক দোকানি ছাড়া আর কেউ নেই। কেরোসিনের তাপে সেখানে চা ফুটছে। এরপর যা সহজেই চোখে পড়ে, তা হল ছাদবিহীন দোকানের তিনটি বয়াম। বয়ামের তলানিতে বিস্কুট আর কেক। আর তার পাশেই কয়েক প্যাকেট সিগারেট। এই হচ্ছে পুরো সম্পত্তি। ষাটোর্ধ দোকানির জামা আর শরীরের অবস্থা চা বিক্রির জন্য খুব একটা উপযুক্ত মনে হল না রাসেলের কাছে। রুচি চলে গেল। সেটা প্রকাশ না করেই বলে উঠল,
-বস্......এই গরমে চা!............না বস্, আমি খামু না।
-(কিছুক্ষন চুপ থেকে) আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার খেতে হবে না। চল......ঐ দোকানটাতে যেয়ে বসি। আর সামনে আগাবো না। সামনে বিল্ডিং-এর সংখ্যা বেশি। আরেকটু এগোলে এই সেট আপটা আর পাবো না।
দোকানে বসে পড়ল রাসেল। কাধেঁর ব্যাগটা টুলের উপর নামিয়ে ডিএসএলআর-টা বের করে ফোকাসিং করতে লাগল। ইদানীং ক্যামেরা হাতে নিলেই তার হাত কাঁপছে.........তার হিসেবে একটু বেশিই বলা যায়। কিন্তু কেন কাপঁছে, সে কারণটা উদ্ধার করতে পারছে না। শত সহস্র শংকা নিয়ে কিছুদিন আগে বিষয়টা নাবিলাকে জানিয়েছিল। তারই পীড়াপীড়িতে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বলেছে, শারীরিক কোন সমস্যা নেই। বিষয়টা পুরোটাই মানসিক। শারীরিক হোক আর মানসিক হোক, একজন “ক্যামেরাজীবী”র হস্তকম্পন যে মোটেই পজেটিভ কিছু হতে পারে না, তা বোঝার বয়স ও বুদ্ধি অবশ্যই রাসেলের আছে; যা দিনে দিনে তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে।
ফোকাসিং করতে করতে তার নজর পড়ল আসিফের দিকে। ঘোলা একটি মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে পানি নিয়ে সে এখন মুখ ধুতে ব্যস্ত। মেপে মেপে পানি খরচ করছে। হয়ত এই জায়গায় পানি পাওয়াটা বেশ ঝামেলার, ভাবল রাসেল।
ক্যামেরার মুখ আরেকটু ডানে ঘোরাতেই দেখল, দোকানি তার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে চেয়ে আছে। ক্লিক করল রাসেল। হেসে উঠল বৃদ্ধ.........সাথে সাথে তার ভাঙ্গা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। ছবিটা একবার দেখে রাসেল ক্যামেরার স্ক্রিনটা তুলে ধরল দোকানির চোখের সামনে। তা দেখেই দোকানির হাসি আরো চওড়া হয়ে গেল।
-চাচা! চা দিয়েন তো একটা!
পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলে উঠল আসিফ। তাকালো রাসেলের দিকে। এরপর বলে উঠল,
-তুমি তো সিগারেট খাও।
রাসেল যেন লজ্জা পেল কথাটা শুনে। তার সাথে আসিফের কিছুটা মানসিক দূরত্ব আছে, এ ব্যাপারটা আসিফ বুঝতে পারে। বয়সে এবং কাজে দু’দিক দিয়েই সে সিনিয়র। তবে এ যুগে প্রফেশনাল লাইফে ঢোকার পর সব সমান। দুরত্ব থাকলেই বরং কাজ আদায় হয় না। যেটা এমন প্রফেশানে একজন সুপিরিয়র হিসেবে তার মোটেই কাম্য নয়।
আরেকবার বলার পর “ধন্যবাদ” সূচক একটা হাসি দিয়ে রাসেল তার মোবাইল প্যান্টের পকেট থেকে একটা বেনসনের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরালো। ইতিমধ্যে দোকানদার চা দিয়ে দিয়েছে। চা হাতে নিয়ে আসিফ দোকানীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
-পুলিশ কি রেইড টেইড দিচ্ছে নাকি, চাচা? ফাঁকা ফাঁকা লাগে কেন্? গত সপ্তাহে তো এই অবস্থা দেখি নাই!
-(ঘর্মাক্ত দোকানি চোখ পিট পিট করে তার দিকে তাকিয়ে) এই হময় আইছিলেন? দুফুইরা বেলা দ হগল বালাই ফাহা থাহে। লুকেরা কামে বাইর অয় দ। তয়......হুদা মাইয়া লুকেরা আছে মনে অয় ............
রাসেল উঠে গেল তার ক্যামেরা নিয়ে। কাঠফাটা রোদ্দুরে একের পর এক ছবি তুলতে লাগল চারপাশের। বস্তির আবছা অন্ধকারময় ঘরগুলো থেকে বিভিন্ন বয়সের মহিলারা তাকে দেখছে। আর সদ্য কৈশোরে আসা মেয়েগুলো চেয়ে আছে কিছুটা আড়াল থেকে। আসিফ আর দোকানিও তার দিকে চেয়ে রইল।
-আম্নেরা কি সাম্বাদিক?
-জ্বী......সাংবাদিক।
-তা এনো কি কামে আইসেন আফনেরা?
-আসলে চাচা.........আমার এখানে মাঝে মাঝেই আসা হয়। এই দিক দিয়ে, ঐ যে সামনের নাখালপাড়াটা আছে না.........ঐখানে যাওয়া হয়। তো ভাবলাম, এতদিন ধরে এইদিক দিয়ে যাতায়াত করি.........পত্রিকাতেও কাজ করছি অনেক দিন ধরে.........কিছু করি আপনাদের জন্য।
-অঅঅঅঅ.........(কিছুক্ষণ চুপ থেকে) টেহা দিবেন?
প্রশ্নটায় কিছুটা ধাক্কা খেলো আসিফ। তবে খুব স্বল্পসময়ের জন্য। অভাবী একজন মানুষ, সাহায্য বলতে অর্থ বুঝবে এটাই স্বাভাবিক।
-টাকা??? (হেসে)............জ্বি না চাচা। আমি রিপোর্ট করব.........এই জায়গা নিয়ে.........আপনাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা সবার সামনে তুলে ধরব। যাতে সরকার ও বড় বড় মানুষেরা আপনাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে।
-ওওও......(আশাহত হল যেন)।.........রিফোট করবেন......রিফোট করলে সরকার জানব, নাইলে জানত না?
বিরক্তি চলে এলো আসিফের। বুড়ো বেশি কথা বলছে। কথাবার্তার নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতে নেয়া উচিত। অনেক কাজ বাকি আছে। অন্তত এখানে থাকা একটি পরিবারের সাথে তার কথা বলতে হবে। জানতে হবে তাদের সম্পর্কে............যত বেশি জানা সম্ভব।
চায়ে চুমুক দিয়ে মাথাটা এগিয়ে দিল সে দোকানীর দিকে,
-শোনেন চাচা। প্রত্যেকটা বিষয়েরই একটা মাধ্যম লাগে। আমরা হলাম এক ধরনের মাধ্যম। বুঝতে পেরেছেন?
বলেই থেমে গেল আসিফ। কিন্তু, দোকানী তখনও চেয়ে আছে তার দিকে, যেন আরও কিছু শুনতে চায়। অবশেষে আসিফের কাছ থেকে আর কোন সারা শব্দ না পেয়ে, কাছেই রাখা একটি ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খিলাল করতে লাগল।
ভাবনায় হারিয়ে গেল আসিফ। একজন সাংবাদিকের কাজ কি?.........শুধু কি তথ্য যোগার করে সবার সামনে রসালোভাবে উপস্থাপন করা?......আর যদি এটাই একমাত্র কাজ হয়, তাহলেও ক’জন সততার সহিত তার দায়িত্ব পালন করে?
এ দেশ চালায় আজব এক প্রাণী! যে প্রাণীর মুখ বিশাল বড় হলেও, কান দুটো অতিব ক্ষুদ্র। এ কারনে সে অনেক কিছুই শুনতে পায় না। যতটুকু শুনতে পায়, সেটাও এই সাংবাদিকদেরই কাজ। শোনার পর, সে তার স্থবির কোমড় নাড়াবে কি নাড়াবে না......সেটা তার বিষয়। তবে তার কান পর্যন্ত পৌছে দেয়ার কাজটা যে খুব সহজ, তা কিন্তু নয়। কারন, প্রানীটি সর্বভূক!......সহজ শুধুমাত্র তাদের জন্য যারা এই প্রফেশানটাকে ব্যবসা(!) হিসেবে নেয়।
-অঅঅই জাহাঙ্গীর! অঅঅইই......এনো আয়!
হাক দিল দোকানী। ঘোর ভেঙ্গে আসিফ দোকানী যেদিকে তাকিয়ে আছে, ঠিক সেদিকে তাকালো। একটি বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে রেল লাইনের উপরে.........বেশ খানিকটা দূরেই। পাঁচ কি বড়জোর ছয় বছর বয়স হবে। খালি গায়ে। নোংরা একটা হাফ প্যান্ট পরনে। তার কালো চামড়ার ঘাম, তীব্র রোদে চিক্চিক্ করছে। কাঁধে ঝোলানো প্লাস্টিকের ব্যাগ, যদিও তার তুলনায় কিছুটা বড় দেখাচ্ছে.........তারপরও, তাকে দেখে মনে হচ্ছে না এটাতে সে অভ্যস্ত না।
রোদের উজ্জ্বলতায় সয়ে যাওয়া চোখ দুটোর উপর হাত রেখে সে দেখার চেষ্টা করল তাকে কে ডাকে। দেখার সাথে সাথেই একটা হাসি দিয়ে সে ছুট লাগালো দোকানের দিকে। আসিফের চা খাওয়া শেষ। কাপটা রাখতে রাখতে সে দোকানীকে বলল,
-কে এটা?
-ওওই......আম্গো লগের ঘরেই থাহে। বাফ্ নাই.........নাই মানি মরে নাই। গেসে গা আরেকটা বিয়া কইরা। মায়ে বাড়িত বাড়িত কাম করে, আর হেয় কাগুজ টুহায়।............আমারে “দাদা” কইয়া ডাহে।
দৌড়াতে দৌড়াতে জাহাঙ্গীর “সাহেব” চলে এলো দোকানে। এখনও হাসছে সে। তার উপরের পাটির সামনের দুটি দাতঁ নেই। পড়ে গেছে, মাড়ির ঠিক কাছাকাছি উঁকি দিচ্ছে নতুনগুলি।
-দাদা......ডাহেন কেরে?
-তর মায়ে দ আইজ হাইঞ্জালায় আইব। তরে নাহি কয় নাই?
-অঅঅ.........এইডার লেইগা ডাকসেন!
আসিফ স্পষ্ট দেখতে পেল, ছেলেটার কালো মুখ আরও কালো হয়ে গেছে। আসলে তার দাদা অধিকাংশ সময় তাকে ডেকে কেক কিংবা রুটি দেয়। যদিও যে অবস্থায় দেয়, ঐ অবস্থাতে কেককে আর কেক বলা যায় না। কিন্তু, জাহাঙ্গীরের কাছে সেটাই যেন অমৃত মনে হয়। বুঝতে পেরেছে, আজ বোধ হয় তার কপালে আর কেক নেই! বয়ামের তলানিতে যেগুলো পড়ে আছে, সেগুলোও প্রায় নতুন মনে হচ্ছে। নাহ্! আজ আর তার কপালে নেই.........সে নিশ্চিত হয়ে গেছে।
-কি রে কনো চাইয়া রইসস্?......(জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি অনুসরণ করে) অঅঅঅ......না সোনার চান! এডি দেওন যাইতো না আইজ......এই ল......লজেঞ্জুস খাইতে খাইতে বাড়িত যা!
জাহাঙ্গীরের মধ্যে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সে শুধুমাত্র তার জায়গায় দাঁড়িয়ে এক পা থেকে আর এক পায়ে ভর বদল করতে লাগল, আর অদ্ভূতভাবে অঙ্গভঙ্গী করে হাসতে লাগল। আসিফের হাসি চলে এলো, তবে হাসিটা মুখে ছড়িয়ে দিতে দিল না।
-কিরে.........গেলি না এহনো?(বলে উঠল বৃদ্ধ)
হাসি থেমে গেল জাহাঙ্গীরের। কাঁধের ঐ ব্যাগটা আরো ভালো ভাবে কাঁধে নিয়ে মুখ ভার করে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। আসিফ তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পথে। কি মনে হতেই হুট করে ডেকে উঠল পেছন থেকে।
-এই পিচ্চি!......এদিকে আয়!
থেমে গেল সে। তাকিয়ে রইল সানগ্লাস পড়া লোকটার দিকে।
-আয় এদিকে।(হাত নেড়ে কাছে আসতে বলল আসিফ)
কিছুটা দ্বিধা নিয়ে আবার দোকানের কাছে আসল সে।
-তোর ব্যাগে কি?
-কাগজ।
-বেচস কই?
-আমি দ বেঁচি না......এক চাচা রে দেই। হেয় টেহা দেয়।
-এক ব্যাগে কত পাস?
-জানি না।............(কিছুক্ষণ থেমে) আমারে টেহা দেয় না, আমার মায়েরে দেয়।
-ওওওও.........
কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রাখল ছেলেটা......বেশ অস্থিরমতি। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারছে না। দোকানের ছাউনি ছিল এককালে, তার প্রমানস্বরূপ যে বাঁশ পোতা আছে মাটিতে.........সেটাকে নাড়ানোর সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে এখন। চরম বিরক্ত দোকানির শত বাঁধাতেও তাকে থামানো যাচ্ছে না। উল্টো হাসতে লাগল সে ফোকলা দাঁতে। অবশেষে দোকানী “তর মায়ে আইয়া লউক......হেরে কমু তর জাউরামির কতা।” টাইপের একটা ডায়লগ দিয়ে সেই ম্যাচের কাঠি দিয়ে দাঁত খিলালে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
-তোর দেশের বাড়ি কই রে?
-(থেমে গিয়ে) জানি না!
বলেই আবার বাঁশের হেস্ত নেস্ত করা শুরু করে দিল।
-কেক খাবি?
থেমে গেল দাপাদাপি। চোখ মুখ উল্টে “হ” বলেই আবার সে তার কর্মে লিপ্ত হলো।
-কয়টা খাবি?
-(আঙ্গুল গুনে) এক ডা......দুই ডা.........তিন ডা.........হহ্......তিন ডা খামু।
-আর কি খাবি?
-কলা খামু।
-কয়টা?
-এক ডা......
-শুধু একটা!
-হ।
-আর কি খাবি?
-আর কিছু খামু না।
-পোলাও খাবি......মুরগির মাংস দিয়া?
-কেক খামু।
কথার মাঝখানেই দোকানী তার গায়ে খিলালটা ছুড়ে মারল। গায়ে না লাগাতে তার দাপাদাপির আনন্দ যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল।
-তোর দেশের বাড়ি কই?
-মেঘনার হেফারে।
-ওই খানে কি করতি?
-কিছু না।
-সাতার পারস?
-হ্......হাতর কেডা না ফারে!
-আমি তো সাতার জানি না.........শিখাবি আমারে?
-(ফোক্লা দাঁত বের করে) না!
-(মুখ ভার করে) কেন?
-আমার ইচ্ছা!
আসিফের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ কষ্ট পেয়েছে। তাই দেখে ফোক্লা মানবের ফোক্লা দাঁত আরও বেরিয়ে পড়ল।
-(অভিমানের সুরে) আচ্ছা ঠিক আছে! শেখাইস না.........কত লোক আছে আমার! তাদের কাছেই আমি শিখে নেব......যা বলতে ছিলাম, তোর বাপে কি করত জানি বলছিলি?
-ক্ষেতের কাম।
-তো শহরে আইসস কেন?
-বাফে কইসে......শহরে আইলে আম্গো অনেক টেহা অইব।
-অঅঅ.........
চুপ হয়ে গেল আসিফ। অদ্ভূতভাবে খেয়াল করল, তার কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেছে। এমন প্রফেশানে যারা আছে, তাদের ইমোশন জিনিসটা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
ছেলেটির কাছ থেকে আর কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না আসিফের। বাকিটা অনুমান করা খুব সহজ এবং ছেলেটির ভবিষ্যত্ কি রকম হতে পারে, তাও অনেকটাই অনুমান করা যায়। জীবন তো আর কোন সিনেমা নয়, রাতারাতি বদলে যাবে।
রাসেল চলে এসেছিল বেশ কিছুক্ষন আগেই। আসিফের পাশে বসে আরেকটি সিগারেট পোড়াতে পোড়াতে তার তোলা ছবিগুলো দেখছিল। জাহাঙ্গীরের বাঁশ নিয়ে দাপাদাপি এখনও থামে নি। এর সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে, বারবার “কেক খাব” “কেক খাব” বলাটা।
উঠে দাড়ালো আসিফ। ফোক্লা মানবকে বলল,
-চল্.........তোকে কেক খাওয়াই! এখানে তো তোর কলা নাই.........সামনে চল।
রাসেলও উঠে পড়ল। বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল তারা। ফোকলা মানব পেছন দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল দোকানীকে, চেয়ে আছে তার দিকে। ভেঙচি কেটে দিল একবার। বৃদ্ধ হেসে উঠল।
আসিফ হাটছে। তার সাথে হাসিমুখে হেটে যাচ্ছে ছোট্ট শিশুটি। কাঁধে ব্যাগ........... ঘর্মাক্ত শরীরে, ধুলোমাখা সেই প্যান্ট পড়ে। তাদের এই পথটা হয়ত ক্ষুদ্র, কিন্তু এই সময়টুকু কি মুল্যহীন?
কিছুটা পেছনে পড়ে গেছে রাসেল। এতে বরং তার বেশ ভালই হল। দেখতে পেল, একই দেশের ভিন্ন দুটি সমাজের প্রতিনিধিদের, হেটে যাচ্ছে রেল লাইনের দুটি পাশ দিয়ে। লোভ সামলাতে পারল না সে। ক্যামেরা তুলে বেশ কয়েকবার ক্লিক করল।