পায়ে ঘুঙুর , কপালে তিলক গলেতে শীতল ও নানা রত্ন পাথরের মালা ,অঙ্গে গেরুয়া বসন আর কাঁধে ঝুলানো দোতারা নিয়ে ।গুরু সুভাব দাও আমার মনে গায়তে গায়তে কলা গাছের ভেলায় ভেসে কালি নদী পাড়ি দিয়ে অজ্ঞ বাউলের চড়ন ধূলি নিতে এলো কাঞ্চন নামের এক বাউল । অজ্ঞ গুরুর জন্য উপহার নিয়ে এলো শালুক , ভ্যাট , বিচি কলা, বড় সর কচু , কচুর লতি ও পুঁটি মাছ । লক্ষ একটিই শুদ্ধ অশুদ্ধের ভেদ ও বাউল সাধন শিখে চট জলদি গুরু হয়ে যাওয়া । তার শেষ ভরসা অজ্ঞ গুরু , সে শুনেছে অজ্ঞ গুরুর ফাটা বাঁশের মত বেসুরো কণ্ঠ কিন্তু আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্য সে গুরুর স্থান ধরে আছে । কাঞ্চনের কণ্ঠ বেশ ভালো তাই অজ্ঞ নিজের আখড়া জমজমাট করার জন্য কাঞ্চনকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করবেন এই ভরসা কাঞ্চনের আছে । কাঞ্চনের মনে সুরের জোয়ার বয়েছে – নিজে একটি পদ রচনা করে ফেলল ।
এবার আমি গুরু হবো
গুরু হওয়া ঠেকাবে কে ?
আখড়ায় এসে অজ্ঞ গুরুর বেশ ভুষা দেখে কাঞ্চনের মনটা খারাপ হয়ে গেলো । মাত্র একটি সাদা ধূতি পড়ে আছে গলে কোন মালা তো নেইই একটি কালো ডোরাও নেই । দ্বিপ্রহরে খেজুরের গুর দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে ।বয়সও পঁচিশ ছাব্বিশ হবে মাত্র । ভিটামিনের অভাবে কাকতাড়ুয়ার মত নড়বড়ে দেহের গঠন ,কিন্তু বড় বড় চুল নেই , গোঁফ নেই শ্যাম বর্ণ সব মিলিয়ে ভাবহীন এক ভাবের জগতের মানুষ সে । তাকে গুরু মানে কোন পাগলে ভেবে পাইনা কাঞ্চন ।অনেক দুর থেকে এসে ফিরে জাওয়ার চেয়ে কিছু দিন থেকে যাওয়া ভালো মনে করে কাঞ্চন অজ্ঞর চরণ ধূলি নিলো ।
অজ্ঞ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল বাবা, মাটিয়ে মিশিয়ে দাও তোমার লোভ ও দ্বিধা দ্বন্দ্ব । বেশ ভূষণ নয় মন ও দেহ হচ্ছে মূল সাধন , যতটুকু পথ ঘুরে এলে বাংলার রূপ আর কতটুকুই বা দেখলে ? অন্তর চোখে চেয়ে দেখ দেহের মাঝে পুরো পৃথিবী আছে । তোমার বিবেক হলও আসল গুরু তবু গুরু খুঁজতে আমার কাছে এলে কেন ?এলেই যদি ভালো কথা তবে - এবার আমি গুরু হবো গুরু হওয়া ঠেকাবে কে , নিরঞ্জন হবে অধম পঞ্চমতে পঞ্চপথে গায়তে গায়তে রিপুকে আলিঙ্গন করলে কেন ? সুন্দর দেহ থাকলেই কি গুরু হওয়া যায় সুন্দর মনও থাকতে হয় । বৃক্ষের দেহ চেয়ে দেখো সুমিষ্ট ফল খেয়ে দেখো কিছুটা বুঝবে বাউলের ভেদ ।
সাধন-সিদ্ধি এতো সহজ নয় ,এত সহজ নয় । আমি অজ্ঞ না হয় সাধনের পথ দেখালাম । কিন্তু সিদ্ধি তো তোমাকে অর্জন করতে হবে । তুমি যদি তোমার ঘরেই সিঁদ কাটো আমি কি হবো ছোট ?
কাঞ্চন আত্ম উপলব্ধি করেছে তার ছলছল নয়ন তাই তো বলছে ।অজ্ঞ মুচকি হেসে একতারা হাতে নিয়ে বলল কাঞ্চন একটি গান হয়ে যাক । তোমার সুরের ইন্দ্রজালে আমার মন টা হারাতে চাইছে ।
কাঞ্চন গুরু হবার আশা ত্যাগ করে বাউল শিল্পী হবার আশায় গান ধরল –
খোঁজে সপ্তস্বর্গ সপ্তপাতাল মন ,
যাতে মিলিবে রতন
খুঁজিতে খুঁজিতে যাবি মধুর বৃন্দাবন ।।
ও তুই চলে যাবি ব্রম্ভপুরী
দিয়া হিংসা নিন্দায় গলায় দড়ি,
ভয় ভাবনা তুচ্ছ করি ......
গান শুনে অজ্ঞ বলল বাহ কাঞ্চন ,চণ্ডী গোঁসাই এর পদ শুনে মুগ্ধ হলাম । তোমার কণ্ঠ বীণা বেশ ভালো ।
সুরের সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে বাউল সাধন শিখতে গিয়ে ইসলাম , হিন্দু , বৌদ্ধ নানা ধর্ম সম্পর্কে , কালের প্রবর্তন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে । স্থান ভেদে বাউলদের তিন সম্প্রদায় মুসলমান বাউল ফকির সম্প্রদায় , নবদ্বীপ সম্প্রদায় , রাঢ় সম্প্রদায় । আবার গুরু ভেদেও প্রভেদ লক্ষ করা যায় ।
যেমন কাঞ্চনের গুরু অজ্ঞর মতে বিশ্বাস ও অবিশ্বাস , গ্রহণ যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য তত্ত্বে পূর্ণ এই ধরা এখান থেকে ফুল কুড়ানোর মত করে বিবেকের দৃষ্টিতে যা গ্রহণ করা উচিৎ তা গ্রহণ করতে হবে ! সকল ধর্ম থেকে ভালো গুলো গ্রহণ খারাপ গুলো বর্জন করতে হবে । পৃথিবীর সকল ধর্মের সেরা মানব ধর্ম । মানবতার ফুল ফলে অলংকারে বাংলাকে সাজাতে হবে । সয়তান বলে পৃথিবীতে কিছু নেই আমাদের কু প্রবৃত্তি হলও শয়তান । বাউল গানের তিনটি ভিত্তি ভেঙে অবমুক্তি দিতে হবে ।সকল ধর্মে কিছু ভুল রয়েছে বাউল ও এর বাইরে নয় । বাউলদের সিদ্ধি লাভের কিছু অবান্তর পদ্ধতির বিপক্ষে অজ্ঞ গুরু ।
কাঞ্চন ও আজ জীবন সাধনায় নব্বই টি বছর অতিক্রম করে অনেক কিছু শিখে জেনে বুঝেও মনে করে কিছুই শেখেনি সে ।তার গুরু হবার বাসনার সমাপ্তি হয়েছে অনেক আগেই । অজ্ঞকে সে দেখে নতুন রূপে । অজ্ঞ সম্পর্কে কাঞ্চন মাঝে মাঝে ধারনা করে অজ্ঞ হলও পৃথিবীর গোয়াল ঘরের শান্তিকামী এক নিরীহ গরু মানবতায় যার সাধনার মূল মন্ত্র ।
তবু মাঝে মাঝে তিনি রসিকতা করে কাঞ্চন কে যাদু বিন্দুর পদও শোনান –
ধিক ধিক ধিক মন তোমারে ,বলবো কিরে ,
কাচ নিলি কাঞ্চনের দরে ।
তোমার থাকতে নয়ন , ফেলে রতন ,
যতন কর ঝুট পাথরে ।।
কোথাও দ্বন্দ্ব সংঘাত , অন্যায় অবিচারের কথা শুনলে গান ধরেন -
গেড়ে গাঙ্গেরে ক্ষ্যাপা আয় আয় আয়
হাপুর হুপুর ডুব পাড়িলে...
এবার মজা যাবে বোঝা কার্তিকের উলানির কালে।।
ক্ষান্ত দে রে ঝাঁপই খেলা শান্ত হরে ও মনভোলা।
লালন কয় আছে বেলা দেখলি নারে চক্ষু মেলে...।।
মাঝে মাঝে......
ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা কোনরাগে।
আছে হিন্দু – মুসলমান দুই ভাগে।।
ভেস্ত – স্বর্গ ফাটক সমান কার বা তা ভাল লাগে।।
এই গানটি গেয়ে বলেন শুধু দেহ ও ধর্মের বাইরে রুপকতার আশ্রয় নিলে এই পৃথিবীর সকল সমস্যার কারন খুঁজে পাওয়া যায় । বাউল গানের গভীরতা অনেক একটি গানের হাজার রকম অর্থ দাঁড়ায় ! হিন্দু মুসলমান কে রূপক ভাবে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল যদি ধরো । তাদের সকল ফল পর্যালোচনা করো কি পাবে ? যেই লাউ সেই কদু ? একটু কমবেশি দুই দলেরই কর্মীরা ভুল করে ।বিপদে পড়ে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ফকির !বুঝলে বুঝ না বুঝলে তরমুজ !হায়রে দেশ প্রেম , হায়রে ধর্ম ,নগ্ন মানবতা সবই ভানুমতীর খেলা !
প্রকৃতির রূপের সাথে সাথে তার মনেও পরিবর্তন দেখা যায় । বারো মাসে তিনি বারো রূপ ধারন করেন । অজ্ঞ বাউলের পদেই প্রকাশ পায় এখন কোন ঋতু কোন মাস । তিনি ঘরে বসে শুধু বাংলার রূপ সহ পুরো পৃথিবীর রূপ উপলব্ধি করতে পাড়েন !এমন আধ্যাত্মিক শক্তি একজন সাধক কিভাবে অর্জন করেন তা আমার জানানেই । তিনি বলেন বেহেশত এর লোভ করিনা নেই দোজখের ভয় !কিন্তু যদি তিনি দোজখে ভয় না পান তবে কেন এত সরল সাধারণ জীবন যাপন করেন ? তিনি যদি দেহে পৃথিবী খুঁজে পান তবে বাংলার মাটিতে কেন চিরনিদ্রার স্বপ্ন দেখেন ? তার একটি পদ
আমার দেশের রূপ সাগরে
ভব তরি মন মাঝি বায়
অন্তর চোখে বাংলার রূপ দেখে আর
পরান খুলে গান গায় ।
ভব রঙ্গ হলে সঙ্গ
যেন এই মাটিতে চিরোনিদ্রা হয় ।
কাঞ্চনকে যদি প্রশ্ন করি আপনি কি সাধক ,গুরু ,বাউল হতে পেড়েছেন ? মাথা নেড়ে বলে মানুষই হতে পারিনি বাউল হতে পারলাম কই , আর গুরু সেতো অনেক দুরের পথ শতবার জন্ম নিলেও অজ্ঞ রয়ে যাবো । অজ্ঞ বাউল নিজেকে কখনো গুরু মনে করেন না আমরা তাকে গুরু ভাবি তাহলে আমি কাঞ্চন কি গুরু হতে পাড়ি ? আমরা তো সব সুতো বাঁধা রঙিন ঘুড়ি নাটায় যার হাতে সেই তো আসল গুরু ।কাঞ্চন বাউল কে প্রশ্ন করলাম বাংলার রূপ সম্পর্কে কিছু বলুন । কাঞ্চন তাৎক্ষনিক পদ বানিয়ে গায়তে শুরু করলো ।
চেয়ে দেখ পদ্ম কোমল
সুরের হাওয়াও খাচ্ছে দোল ।
পাহাড় কেঁদে ঝর্ণা বয়ায়
মন পবনে ,পাল তোলা নাও ।
চন্দ্রবিন্দুর ভেদ জানিনা
বর্ণমালা কি বুঝিনা ।
আঁধারেতে আলো খুঁজি
জোনাকিদের জেলে কুপি ।
মন পাগলে খুঁজে যে রূপ
সে রূপ যে কত অপরূপ
বাংলাতেই সে রূপ আছে
খুঁজে পাবে রসিক জনা ।
বাউল নামের বেত্রাঘাত
বুকে যে বয় সুখের প্রপাত ।
পর্বত চূড়ায় মেঘ ছোঁয়া যায়
মেঘ ছুঁলেই কি মেঘ হওয়া যায় ?
বাংলার রূপ দেখবি যদি
কর দেশ প্রেমের সাধন সিদ্ধি
কাঞ্চন বলে এই বাংলার রূপ
দেখলে পরে পাগল হবিই হবি !
আমি এই পদ শোনে কাঞ্চন কে বললাম তুমি তো অজ্ঞর চেয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছো , আমার মনে হচ্ছে তুমি সিদ্ধি লাভ করেছো ?
কাঞ্চন হেসে বলে গুরু আমার এই বাংলার খোলা মাঠ আমি এই মাঠে গজিয়ে উঠা সামান্য এক দূর্বা ঘাস । আমার প্রতি ঘৃণার দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে দোতারায় একটি মেঠো সুর তুলে চলতে লাগল অচেনা পথে । এক সময় দিগন্তের শেষসীমায় সবুজে মিলিয়ে গেলো সে ।
০২ মার্চ - ২০১৪
গল্প/কবিতা:
২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪