নাগপুরের সারস্বত সভা লাইব্রেরির সামনে আজ ভীষন ভীড়- গাড়ির লাইন পড়ে গেছে বেঙ্গলি এসোসিএসন, রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে আজ রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে.' ঝাপ্সা (যাদের বাঙ্গালীত্ব ঝাপ্সা হয়ে এসেছে) এবং হচ্ছে' (যারা কথায় কথায় হচ্ছে বলে) বাঙ্গালীরা তাঁদের প্রতিভাশালী গায়ক গায়িকাদের নিয়ে পৌছচ্ছেন আসর সাজাতে.
খবর কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে, আমি অতি উত্সাহী মা, ভাবলাম- আমার কিশোরী কন্যা তো ভাল গান গায়, ওকে তৈরি করলে হয়...হিন্দী গান ছাড়া কিছুই গায় না, এই সুবাদে দু-চারটে রবি ঠাকুরের গান শিখবে, আফটার অল বাঙ্গালীর মেয়ে! খুঁজতে খুঁজতে দু- চারটে ক্যাসেট বেরলো. মেয়েরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই চালিয়ে দিলাম. হাই তুলতে তুলতে ছোট কন্যা বোলল, 'এক্খুনি তো ঘুম ভাঙ্গলো মা'... রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনলে ওর নাকি ঘুম পায়. আমিও হাল ছাড়ার পাত্র নই, বাড়িতে রাবীন্দ্রিক আবহাওয়া তৈরি করার ধুম পড়ে গেল. রবীন্দ্র রচনাবলী বার করলাম, 'কাবুলীওয়ালা' শোনাব. বড়ো মেয়ে গল্প পাগল- শরত্ চন্দ্র,
রবীন্দ্রনাথ, নবনিতা সবই শুনতে ভালোবাসে. ওরা দুজনেই বাংলা পড়তে পারে, নিজেরাই শিখেছে, লিখতে ঠিকমত পারেনা. স্কুলে তিনটে ভাষা শিখতে হয় বলে আর চাপ দিতে চাইনি. গল্প আমিই পড়ে শোনাই, নিজে পড়ে ও নাকি আনন্দ পায়না. ছুটকিকে বললাম, 'আয় আজ তুই ও শোন, দেখ কি সুন্দর গল্প.' খানিকখন চুপচাপ থাকার পর সে বলল,
কি যে জার্মান বল্ছ, কিছুই বুজছি না'...এই মেয়েকে দিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাওয়ানো...জস্ট নেক্স্ট টূ ইম্পসিব্ল!!
অনেক তুসিয়ে ভুসিয়ে তাকে রাজী করানো হল. গান হিন্দিতে লিখে দিলাম, সাধনা চলতে থাক্ল, আমি মা আমার কানে তো ভালই লাগ্ল...অবশেষে এল সেই 'ডি ডে', 29 প্রিল-রবিবার. ছোট বড় নানা বয়েসের ছেলে মেয়েরা স্টেজে চড়ে নানা রকম সুরে ও তালে রবীন্দ্র সঙ্গীত শোনাতে লাগল. ''এসো স্যামলো সুন্দর' হিন্দীর 'স' এর উচ্চারণে. 'এবার শখি শোনার মৃগো,' সব অতিরিক্ত 'শ' এর প্রাধান্যে বা 'আয় তবে সহচড়ি হাতে হাতে ধডি ধডি, নাচিবি ঘিডি ঘিডি...' শুনতে শুনতে ভয়ে, উত্তেজনায় বিবশ হয়ে পড়েছিলাম, পাশ থেকে কে যেন বলল, 'ওই তো এবারে তোমার মেয়ে গাইবে', ভগবানের নাম জপতে লাগলাম. সঠিক সুরে ও
তালে 'আজি এ আনন্দ সন্ধ্যায়' গেয়ে তিনি মঞ্চ থেকে নেমে এলেন.
বিচারক মন্ডলীর একজন আদর করে কাছে ডাকলেন, 'বলতে পার কী রাগে গাইলে?' অসম্ভব আত্মবিশ্বাসের সাথে, মুখে অনাবিল হাসি ফুটিয়ে সে বলল, 'হ্যা...ভৈরবী. তার নিদারুন' অনিচ্ছা সত্বেও প্রত্যেক রবিবারে তাকে যে গানের স্কুলে পাঠান হয়, সেখানে তখন ভৈরবী রাগিণী শেখান হচ্ছিল. বিচারক মশাই আত্মবিশ্বাসের অভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন.
কাছে আসার পর আমি বললাম, 'সন্ধেবেলার গান গাইলি, ভৈরবী কি রে?' সে বলল, 'তা আমি কি জানি !' সত্যিই রাগ রাগিণী জানার বয়েস তখন তার ছিলনা.
ফল ঘোষিত হল, প্রথম স্থান পেল আমারই মেয়ে, তার গর্বিত বাবার মুখে হাসি আর ধরেনা.
25 বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে প্রথম স্থানাধিকারীকে পুরস্কার বিতরণী সভাতে আবার গাইতে হবে, কিন্তু অন্য কোন গান. 'আবার একটা গান!' মেয়ের প্রবল উত্সাহী বাবা কিনে আনলেন প্রসুন মুখারজির গাওয়া গানের ক্যাসেট.
রবি বাবুর, প্রসুন বাবুর এবং অবশ্যই আমাদের অসীম ভাগ্য, সেই ক্যাসেটের কিছু গান গায়িকার পছন্দ হল.
এবারে আর আমাকে কষ্ট করতে হলনা, সে নিজে নিজেই তৈরি করল 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম...'
আমরা দুই গর্বিত অভিভাবক, প্রথম স্থানাধিকারী কন্যা সহ পৌছলাম.... সে গান গাইবার পরে,অসীম সাহসী সে...ই বিচারক মহাশয়, নাগপুরের বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়ক শ্রী তির্থন্কর বসু তাকে আবার কাছে ডাকলেন. ভয়ে ভয়ে কান পেতে রইলাম, 'খুব ভালো গেয়েছ, কার কাছে শেখ?' কোন উত্তর নেই. 'কার গান শুনতে ভাল লাগে?'
উত্তর- 'প্রসেনজিত.' ভদ্রলোকের মুখের অবস্থা অবর্ণনীয়, আমার মুখের হাঁ ও বন্ধ হতে চায়না, সে আবার কে?
বড়ো মেয়ে এক্সপ্লেন করল...'প্রসুন মুখার্জি.' বসু মশাই বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে বললেন, 'কণিকা বানার্জির গান শুনবে.'
আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি. প্রতিবারই রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সে ভাগ নেয়, অবশ্য সাবধানে থাকতে হয়, যাতে রাগ, তাল ইত্যাদি সম্মন্ধে সে ওয়াকিবহাল থাকে. 5 বছর একটানা প্রথম স্থান অধিকার করার জন্যে তাকে একটি বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে.
রবীন্দ্রনাথ জয়ী হয়েছেন, বছরে অন্তত একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখছে, আমাদের মত প্রবাসী বাঙ্গালীদের ছেলে মেয়েরা.
বিশেষ ধন্যবাদ- নাগপুরের বেঙ্গলি এসোসিএশন কে.