মাঝে মাঝে স্রষ্টার কাছে অভিযোগ জানায় মায়া। কখনো মনে মনে, কখনো বিড়বিড় করে, কখনো আবার প্রার্থনার সময়। ঘুরে ফিরে সেই একই বহুল প্রচলিত আক্ষেপ—হে আল্লাহ্! কেন এ মানব সৃষ্টি? কত শত ফিরিস্তা রোবোটের মতন তোমার সেবায় রত। তবু কেন এই আত্মঘাতী প্রজাতি সৃষ্টি? পরক্ষণেই তওবা করে। ভাবে বিধাতা অকারণে কিছুই করেননি। আমি অবোধ-অজ্ঞানী তাই তাঁর লীলা বুঝি না। সে তো আমারই ব্যর্থতা। তবে কেনই বা অকারণ অভিযোগ?
এরপর বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক নিয়মেই কাটে মায়ার। কিন্তু তওবা ভুলে গিয়ে আবারও একই সেই অভিযোগ। কি আর করবে সে। আশেপাশে এমন সব ঘটনা ঘটে যার সঙ্গে ওর আত্মা অজান্তেই জড়িয়ে যায়। কেবল মনে হয়, আমি যদি সে হতাম! তবে কেমন কষ্ট হতো আমার!
বন্ধুকে হত্যা করে কংকালের ব্যবসা-স্ত্রীর গায়ে আগুন-প্রেমিকাকে হত্যা-স্বামীকে গুম-পরকীয়া কিংবা দ্বিতীয় বিয়ের বলি সন্তান-ইমাম সাহেবের ধর্ষণ-অ্যাসিড নিক্ষেপ-পোশাক কারখানায় আগুন-ভবন ধ্বস-বাসে আগুন-লঞ্চ ডুবি-স্কুল শিক্ষার্থীদের গুলি করে ধর্ম রক্ষা-নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যুকূপে পড়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন মানব-সৃষ্ট দুর্ঘটনা ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ওর আত্মাকে করে ক্ষত-বিক্ষত। তাই তো স্রষ্টার দরবারে এত আকুতি।
আর ভালো লাগে না। তাই মায়া একদিন চুপি চুপি ডাক্তারের কাছে যায়। --স্যার, এমন ওষুধ দেন যাতে অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যায়। --কেন? --আমি এসব থেকে মুক্তি চাই। --কষ্টের অনুভূতি না থাকলে তো আনন্দের অনুভব থেকেও বঞ্চিত হবেন। --আচ্ছা, তাহলে অপারেশন করে মস্তিষ্কের কেবল কষ্টের অংশটা বাদ দিয়ে দিন। ডাক্তার সাহেবের চেহারায় কিছুটা বিরক্তির ভাব ফুটে ওঠে। --মনে হচ্ছে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না। কিছু ওষুধ দিচ্ছি। একমাস পরে দেখা করবেন। মায়া কোন জবাব না দিয়ে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়।
ওষুধ কেনা হলেও খাওয়া আর হয়ে ওঠে না। তবে ওর ভাবনার গতিপথ একটু ভিন্ন আঙ্গিকে প্রবাহিত হয়। ও ভাবে, কত সুন্দর এ পৃথিবী! আরও সুন্দর জীবন! আমরা মানুষরা ইচ্ছে করে এত কষ্টের জন্ম দেই। তবে তো আমরাই দায়ী—স্রষ্টা নির্দোষ।
এই ভাবনা মায়াকে করে তোলে আরও বিচলিত। এতদিন তবু স্রষ্টার ওপর কিছুটা দায় গছিয়ে ভালোই ছিল। অন্তত মাথাটা হালকা লাগত। কেবল নানান দুর্ঘটনা শুনে দম বন্ধ বন্ধ মনে হতো, কান ও ঘাড় বেয়ে আগুনের হল্কা বেরুতো, মাঝে মাঝে বমি হতো। আজকাল মাথাটা বেশ ভারী লাগে—অগভীর ঘুমে দুঃস্বপ্নরা তাড়িয়ে ফেরে।
কাউকে নিজের অবস্থা বোঝাতে পারে না মায়া। এমনকি আপনজনদেরও নয়। কেউ কেউ ওকে নিয়ে হাসে। কেউবা কিছুটা সহানুভূতি জানায়। কিন্তু ওর মর্ম বেদনা জানে কেবল অন্তর্জামী। তাই তাঁর কাছেই ছিল সব নালিশ। কিন্তু যখন থেকে উপলব্ধি করল, স্রষ্টা নির্দোষ—তখন কেবল নিজের প্রতিই ক্ষোভ জন্মে।
নিজের নামের প্রতিও বিরক্ত হয়। এই ‘মায়া’ নামের জন্যেই কী এমন হলো? নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলে। নাহয় কোথাকার কে মরল, কার গায়ে আগুন লাগল, কে কোথায় পড়ল—এসব নিয়ে ওর এত বাজে কেন? একেবারে আত্মায় গিয়ে ঘা মারে? সবাই কত স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিচ্ছে। তাই ও নিজেকে একেবারে আড়াল করতে চায়। কখনও খুব বেশি কথা বলে। আবার একেবারেই চুপ। আত্মার আদালতে বিচার সভা বসায় মায়া। সেখানে নিজই বাদি-বিবাদি। নিজেই বিচারপতি-উকিল। নিজেই সব অপরাধের রায় দেয়: --যে অ্যাসিড মেরেছে তাকে অ্যাসিডে ঝলসে ছেড়ে দাও। --ধর্ষকের শিশ্ন কর্তন করা হোক। --মন্ত্রীসহ দোষীদের ২৫৭ফুট গর্তে ফেলা হোক। উদ্যোমী তরুণদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হোক। --খাদ্য-ওষুধে ভেজালকারীদের ফরমালিন-কার্বাইড খাওয়ানো হোক। --দায়ীকে অগ্নিদগ্ধ করা হোক। --ভবন মালিককে ভবনের নিচে চাপা দেয়া হোক। …….এরপর অর্ডার। অর্ডার। আর হাতুড়ির শব্দ ছাড়া বিচার কক্ষে আর কিছু শুনতে পাওয়া যায় না।
মায়ার আত্মার আদালতে কেবল মৃত্যুদণ্ড নেই। সেটা একমাত্র জীবনদাতা স্রষ্টার হাতে ন্যাস্ত করে ও চলে যায় সকল ভবযন্ত্রণাকে বিদায় জানিয়ে…
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি
ও ভাবে, কত সুন্দর এ পৃথিবী! আরও সুন্দর জীবন! আমরা মানুষরা ইচ্ছে করে এত কষ্টের জন্ম দেই। তবে তো আমরাই দায়ী—স্রষ্টা নির্দোষ। ....// ভালো....মানষিক প্রশান্তির অলিক যন্ত্রনা .....
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
সমাজের নানান অনাচারকে গল্পের মাধ্যমে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। মায়া চরিত্রটা একজন পারফেক্ট মানুষের প্রতিক। সে সমাজের অনাচার, অবিচার সহ্য করতে পারে না। খুব ভাল লাগল। শ্রদ্ধা জানবেন।
ধন্যবাদ। বইমেলায় এবারে আমার একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ পাবে আশাকরি। এজন্য এ সংখ্যায় এ পর্যন্ত কারো লেখা পড়ার সুযোগ হয়নি। আগামী সপ্তাহে পড়ব । বইমেলায় অগ্রিম আমন্ত্রণ। ভালো থাকবেন। শুভকামনা রইল।
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন
সমব্যাথি ছাড়া কেউ এভাবে বিচলিত হতে পারে না। শুনেছি ইরানে এসিড নিক্ষেপকারীর গায়ে সম পরিমান এসিড ঢেলে সাজা দেওয়া হয় (বা হোত) কিন্তু এখানে সাজা দেবে কে? এদেশে সাজা দেওয়ার জন্য কাউকে ক্ষমতায় বসালে সে হয়তো...। ভাল লিখেছেন।শুভেচ্ছা রইল।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।