জেলগেটে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। মাতব্বর গোছের কয়েক জনের হাতে কাগজ ও জড়ির মালা। কিছুক্ষণের মধ্যে বীরদর্পে বেরিয়ে আসে সে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। জড়ির মালায় তার চন্দ্রবদন কুরবানির গরুকেও যেন হার মানায়।
বহুদিন পর ভূড়িভোজ সেরে মখমলের বিছানায় গা এলিয়ে দেয় জয়নাল। এসির হিমেল পরশে হারিয়ে যায় গভীর নিদ্রায়। শেষরাতে স্বপ্নরা এসে উঁকি দেয়। মরুভূমির তপ্ত বালুকায় দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই সে ছোটে—কেবল ছোটে। হঠাৎ হোচট খেয়ে মুখ থুবরে পড়ে যায়। ঘুম ভাঙার পরও নড়তে পারে না। কংক্রিটের স্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে। অন্ধকারে নিজের শরীর পর্যন্ত দেখতে পায় না সে। জোরে চিৎকার করতে গিয়ে পাঁজরের হাঁড়টা চিন চিন করে ওঠে। এ বাড়িটি তো অনেক খরচ করে মজবুত ভাবে বানিয়েছে। অথচ কীভাবে ধ্বসে পড়ল! জয়নাল একথা ভাবে আর কাতরাতে থাকে। এমন সময় কোথা থেকে যেন আবছা আলোর মাঝে কাদের ছায়া দেখতে পায়। খুব চেনা লাগে ওদের। হ্যাঁ তাই তো? এদেরই তো দেখেছিল জেলগেটে। এরাই তো ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছিল ওকে। -এই তোমরা কারা? -আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার। বলে ভিড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে আসে। আমি ময়না। আপনার ভবনের গার্মেন্সেই তো কাজ করতাম। -দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? আমাকে এখান থেকে বের কর। -তা কী করে হয়? আমিও তো ঠিক এভাবে চাপা পড়ে কয়েক দিন বেঁচে ছিলাম। -বেঁচে ছিলাম মানে? -কয়েক দিন পর অসহ্য যন্ত্রণায় মৃত্যু হয়েছে আমার। বলতে বলতে বিকট শব্দে হাসতে থাকে। সে হাসিতে জয়নালের বুকে কাঁপন ধরে। আবছা আলোয় ময়নার ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া অস্থিমজ্জা দেখে গলা শুকিয়ে কাগজের মতন খসখস করতে থাকে। -পানি! পানি! বলে হাহাকার করে ওঠে জয়লাল। -এখানে পানি পাবেন কোথায়? তৃষ্ণায় নিজের মূত্র পর্যন্ত খেয়েছি। তিনদিন পর তাও শুকিয়ে গেছে। বলতে বলতে রতন নামের সতেরো আঠারো বছরের এক তরুণ এগিয়ে এসে নীল চোয়ায় জয়নালের মুখে। -এ কী দিলে আমার মুখে। ওয়াক, ওয়াক। বলে যেন নাড়িভূড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। আর কোন সাড়াশব্দ শোনা যায় না। এভাবে কদিন কাটে হিসেব মেলাতে পারে না জয়নাল। ক্লান্ত ও আহত দেহটা পাথরের মতন ভারি হয়ে ওঠে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত এবং ডান হাতটা আটকা পড়ে আছে দেয়ালের নিচে। একটা লোহার রড এসে বিঁধে গেছে পাঁজরের এক পাশে। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। ক্ষুধা তৃষ্ণা এবং আলো বাতাসের অভাবে মৃত্যু কামনা করতে থাকে। -উহু। এত তাড়াতাড়ি মরে গেলে তো চলবে না। বলে দুজন তরুণ-তরুণী এসে জয়নালকে প্রচণ্ড বেগে ঝাঁকাতে থাকে। -দূর হও। দূর হও। -আমাদের তো দূর করেই দিয়েছেন। একেবারে ওপাড়ে। অনেক আশা ছিল,আমরা বিয়ে করে সুখের সংসার গড়বো। তা আর হল না। বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল ওদের। এই বীভৎস রূপ দেখে জয়নালের হৃৎপিণ্ড জবাই করা পশুর মতন কাঁপতে থাকে। আর চারদিকে অগণিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। -ওই তো, ঐ আমার মা! তুমি আমার ছবি হাতে কী খুঁজছো মা? -আহারে বাবা সোহাগ কাঁদিসনে। এমন করে কাঁদলে মায়ের তো সহ্য হয় নারে বাপ। -আমার পোয়াতি স্ত্রীর কী হবে! মাত্র কয়েক মাস আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছে। -বাবা,তুমি চিন্তা কর না। বেতন পেয়েই পুতুলের জন্য বই কিনে আনব। আমার ছোট্ট বোনটি লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। তুমি দেখ বাবা। আ-আ। এই দিকে-এই দিকে। বাঁচাও-বাঁচাও। না-না। ও-হো। ও-হো। উ-হু। উ-হু। হা-আ-হা--- ওরা সবাই আবার জয়নালকে সংবর্ধনা দেবার জন্য এগিয়ে আসে। জেলগেটে যারা জড়ির মালা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। কারো মাথা নেই,কারো চোখের মণি বেরিয়ে এসেছে। কারো বা চামড়া ওঠা রক্তাক্ত পেশী। শ্মশাণ ঘাটের মতন মরাপোড়ার কটু গন্ধ। ওদের সকলের হাতে লোহার রডের তৈরি মালা। সেই মালা পরিয়ে দেয় জয়নালের গলায়। মালার ভারে পঁচন ধরা শরীর ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। তবু জয়নালের প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়ে না। হায়রে মৃত্যু তুমি কত সহজ—আর কত কঠিন! আর বড় বেশি সত্য।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
এই বীভৎস রূপ দেখে জয়নালের হৃৎপিণ্ড জবাই করা পশুর মতন কাঁপতে থাকে। আর চারদিকে অগণিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। ------ অত্যন্ত দক্ষ হাতের লেখা
অসাধারন একটি গল্প !! নিরন্তর শুভেচ্ছা জানবেন ।
Azaha Sultan
অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার মতো ভূত বোধহয় পৃথিবীতে নেই....ভূতেরা যদি শাস্তি দিত তা হলে অপরাধী বলে শব্দ অভিধানে বোধহয় পাওয়া যেত না.....বিজ্ঞানিরা ভূতের অস্তিত্ব কেন খুঁজে পেল না জানি না...তবে কোরআনে ত জ্বিনভূতের বয়ান আছে--তাই জ্বিনভূতের অস্তিত্ব অবশ্য আছে....জ্বিনভূতেরা ইনসানের ক্ষতি করতে পারে অনায়াসে--তবে অপরাধীদের কেন করে না জানি না.....আপনার গল্পের রূপ চমৎকার......আমি সময় একদম পাই না তাই আসতে পারি না। আগে প্রচুর সময় এখানে দিতাম, বর্তমানে নেই বললে চলে.....আপনাদের পথ শুভ হোক--কামনা করি.....
ধন্যবাাদ।বিজ্ঞানীরা অনেক ক্ষেত্রেই স্ববিরোধী মতামত প্রকাশ করে থাকেন। তাঁরা ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না।আবাার তাঁরাই বলেন--মানুুষের পক্ষে এমন কিছুু কল্পনা করা অসম্ভব,যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। তবে পবিত্র কোরআনে ভূতের কথা সম্ভবত নেই--জ্বীনের কথা অনেকবার এসেছে। এমনকি জ্বীন নিয়ে একটি সুরাও রয়েছে। আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যে অনুপপ্রাণিত হলাম। শুভকামনা।
জ্বিন-পরী-ভূত-প্রেত এগুলো একই প্রকৃতির জিনিস.....তাই পরীর কথাও বোধহয় কোরআনে উল্লেখ নেই.....আমার জানা মতে--আগে নারীদের কথাও ছিল না--কয়েকজন মহিলা মা আয়েশা (র) কাছে কথাটা ব্যক্ত করলে পরে সূরা নিসা এবং নারীদের কথা নাযিল হয়......ধন্যবাদ
ওয়াহিদ মামুন লাভলু
কেউ কারো প্রতি অবিচার করলে এভাবেই সে শাস্তি পায়। ভুক্তভোগীরা মারা গিয়েও এভাবে ফিরে এসে শাস্তি দেয়। আপনি খুব চমৎকারভাবে শিক্ষনীয় একটা গল্প তুলে ধরেছেন। খুব ভাল লাগলো। শ্রদ্ধা জানবেন।
মাহমুদ হাসান পারভেজ
লেখাটা ক’দিন আগেই পড়েছিলাম অফ লাইনে থাকতে; রানা প্লাজা বা এইসব দিনের চমৎকার একটি প্লট- এই বিষয়ের উপর আরো কয়েকটি ছোট গল্প অামার পড়া হয়েছিল; তবে ভৌতিক সংস্করণে এটাই প্রথম পড়া। বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটি অনেক মহৎ নিঃসন্দেহ। আপনার গল্পে সংলাপগুলো কিন্তু খুব শক্তিশালী। ধন্যবাদ - মানবতার এই গল্পটি তুলে আনার জন্য। শুভকামনা।
আপনার নিরীক্ষাধর্মী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। রানা প্লাজার ওই ঘটনার পর থেকে মন খুব অশান্ত ছিল। নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হয়েছে। কত মানুষ উদ্ধার কাজ করেছে,রক্ত দিয়েছে,প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন করেছে। কিন্তু আমি কিছুই করিনি--কেবল মর্ম বেদনায় অনেক গল্পের প্লট সাজিয়েছি। এত কষ্ট কী কোন গল্প দিয়ে বোঝানো যায়?''কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে/কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।''---এ কারণেই এমন প্লট বেছে নেয়া।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।