তিনি প্রিয় কুকুরটিকে সাথে করে হোটেল প্রবালের ডেস্ক পার হয়ে ২য়তলায় তার কামরায় চলে আসেন। কুকুরটিও তার সাথে সাথে কামরায় প্রবেশ করে বারান্দায় এসে বসে পড়ে। তিনি রেফ্রিজারেটার থেকে প্রিয় কুকুরটিকে কিছু খাদ্য বের করে তার সামনে মেলে ধরেন। কুকুরটি গোগ্রাসে খেতে শুর“ করে।
তিনি ভাবেন সামান্য একটা মাত্র কুকুর। সে তার বন্ধুকে চিনে গেছে কিন্তু আমরা আমাদের সামাজিক জীবনে ক’জন উপকারী বন্ধুকেই মূল্যায়ন করতে পারি?
পারি না।
আবার অনেক সময় নিজেদের অতল ¯^ার্থপরতার জন্যে প্রিয় মানুষদেরকে অবহেলা করি।
তার ভাবনায় মাইশা এসে ধরা দেয়। ফেরার সময় মাইশা একটি চিরকুট লিখে তার হাতে দিয়েছিলো। তিনি তা বের করে দেখেন তাতে মাইশা লিখেছে, ‘যদি কখনো মনে পড়ে তাহলে আমাদের হোটেলের ল্যান্ডফোনে একটু কল করবেন।’
তিনি হাসেন। তিনি জানেন এ পথ তার নয়। জীবনটা এতো ছেলেখেলা নয়। জীবনের রঙিন পথে হাঁটতে গিয়ে তিনি অনেক হোঁচট খেয়েছেন, বার বার মানুষ তাকে ¯^ার্থপরতার মূলা দেখিয়েছে, তিনি আপনজনদের কাছ থেকে পেয়েছেন দুঃখ-কষ্ট আর সীমাহীন প্রতারণা।
মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে যখোন খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকে মানুষ পায় দুর্ব্যবহার আর লাঞ্ছনা। এসব কিছুকে ছাড়িয়ে মানুষ যখোন নিজের প্রকৃত কর্মে নিবিষ্ট হতে পারে আর অসাধ্য সাধন করতে পারে তখোন আর বাহবার অভাব হয় না।
তিনি বাহবা কুড়াতে চান না। বাহবা তার কাম্য নয়। তিনি তার জীবনকে তুর“পের তাস ভাবেন না। বরং তিনি জীবনকে বাজিয়ে দেখতে চান। কখন, কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় ¯^ার্থপরতার এই সময়কে তিনি পর্যবে¶ণ করতে চান।
মানুষ যখোন চূড়াš— ¯^ার্থপর হয় তখোন সে তার মুখোশ খুলে প্রকৃত রূপটি অন্যের কাছে নিজের অজাšে—ই মেলে ধরে। মানুষের গতি-প্রকৃতি এবং মনের অবস্থা তখোন একটি হিংস্র জানোয়ারের মতো প্রকাশ পেতে থাকে।
মিজানুর রহমান এসব দেখে আসছেন সেই জীবন ও যৌবনের শুর“ থেকেই। তাই তিনি জীবনের এসব লোভ, প্রলোভন আর কানামাছির মতো ভোঁ ভোঁ ওয়ালাদের কাহিনীকে তেমন একটা আমলে নেন না।
তিনি যা ভাবেন অনেক সময় তার উল্টোটি করেন সময়কে পর্যবে¶ণের জন্যে। তিনি হোটেলের রিসিপশন থেকে মাইশাকে ফোন দিলেন। মাইশা রিসিভ করে উৎফুলতায় মুগ্ধ কণ্ঠে কথা বলা শুর“ করে।
রাত প্রায় দুটো। কারো কারো জন্যে খুব গভীর রাত কিন্তু মাইশার কাছে তা’ নয়। হোটেলের একটি ক¶ে মা-বাবা ঘুমাচ্ছিল। অন্য ক¶ে শুয়ে তার ঘুম আসছিলো না। সে ভাবছিলো লোকটিকে।
মাইশা জানে এই লোকটি একটি কঠিন চিজ। মাঝে মাঝে উদ্ভট আচরণ করে। কখনও ভালোবাসার মতো করে কথা বলে, কখনো নিজকে ¯^ার্থপর হিসেবে মেলে ধরে, আবার কখনও ¯^ার্থ ত্যাগ করে নিজের জীবন বিলীন করেও অন্যের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মাইশা ভাবে লোকটির শুধু দ্বৈত চরিত্র নয়। এই লোকটির চরিত্র বুঝা দায়; বহুরূপী। কখন যে কী করে তা আগে থেকে কেউ আন্দাজই করতে পারবে না।
সে জানে লোকটি একজন লেখক। লেখকরা কেউ কেউ এমনই হয়। নিজ সম্পর্কে উদাসীন এবং প্রিয় মানুষদের সম্পর্কেও তাই। এরা বেশিরভাগ ভাবনায় নিবিষ্ট থাকে। গভীর ভাবনায় যখোন নিবিষ্ট থাকে তখোন দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও এরা বুঝতে পারে না।
একটি কথা মনে করে মাইশা হাসে। সে গুনগুনিয়ে আওড়ায়- রোম যখোন পুড়ছিলো তখোন র“মি বাঁশি বাজাচ্ছিল। কথাটি মনে করে সে হাসতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তেই তার ক¶ের ল্যান্ডফোন শব্দ করে বেজে ওঠে।
মাইশা ভাবেনি তিনি তার কাছে এভাবে ফোন দেবেন। ফোন রিসিভ করেই খুশির আবেশে কথা বলতে থাকে। তিনি জানতে চান, মাইশারা কক্সবাজারের ট্যুর শেষ করে কোথায় যাবে? মাইশা এই প্রশ্ন আশা করেনি। সে ভাবছিলো লোকটি তাকে অন্য কথা শোনাবে। কী সেই কথা?
ভালোবাসার কথা, জীবন শুর“র কথা। কিন্তু এই লোকটি অদ্ভুত। কঠিন শিলায় আবদ্ধ তার হৃদয়-মন। ভালোবাসা তার কাছে কিছুই নয়, জীবনের কঠিন কঠিন শব্দাবলী নিয়ে মুঠোভর্তি করে কাগজে প্রকাশই যেনো তার আনন্দ।
মাইশা তাকে খুব কঠিন কথা বলে, ‘আসলে আপনি আপনাকে কী ভাবেন? অনেক বুদ্ধিমান? চালাক? একজোন বিদগ্ধ পÊিত? দেখুন পৃথিবীর অধিকাংশ পÊিতরা ঘর-সংসার করেছেন, দু’চারটি বাচ্চা ফুটিয়েছেন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ভালোবেসেছেন, তাদের সুখ-দুঃখে পাশে থেকেছেন। কিন্তু আপনি এতো কঠিন মনের মানুষ কেনো? আমার কী না আছে আপনাকে উপহার দেবার মতো। আপনি এভাবে আমাকে কেনো প্রত্যাখান করছেন?
লোকটি কিছু¶ণ চুপ থাকে। দেয়ালে টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটার শব্দ হয়। একটি টিকটিকি আরেকটি টিকটিকিকে দৌড়ায়, শব্দ বাড়তে থাকে।
পৃথিবীটা এখোন নিশ্চুপ। শুধু ফোনে মাইশা ও লোকটির হার্টবিটের শব্দ শোনা যাচ্ছে। লোকটি কিছু¶ণ নীরব থেকে মাইশাকে বললেন, ‘মাইশা, প্রিয়তমা আমার। তুমি আমায় অনেক ভালোবেসেছো, অনেক কাছে টেনেছো। জীবন বাজি রেখে সমুদ্রে অবগাহন করেছো। আমিও আমার এ জীবনটাকে সমুদ্রের জলে বিসর্জন দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা যখোন হয়নি তখোন আমি একটা মহৎ কর্ম করে যেতে চাই।’
মাইশার চোখে আশার প্রদীপ জ্বলে ওঠে। সে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে আপনি আমায় নিয়ে সংসার-সীমাš— পাড়ি দিতে চান?’
লোকটি এবার হাসে। দেয়ালে দেয়ালে সে হাসির রেশ প্রতিধ্বনিত হয়।
মাইশা চুপ থাকে কিছু¶ণ। কিছুই বলে না তাকে। লোকটি হাসি শেষ করে মাইশাকে বলে, ‘দেশে যুদ্ধ শুর“ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ। আমি এই যুদ্ধে শরীক হতে চাই। জানি, তোমাকে হয়তো আর কোনোদিন আমার মনের কথা বলার সুযোগ পাবো না। কারণ আগামীকালই আমি চলে যাবো ভারতে। সেখানে যুদ্ধবিদ্যায় ট্রেনিং নিয়ে দেশমাতাকে র¶ার জন্যে লড়াই করবো পাকি¯—ানি হায়েনাদের বির“দ্ধে। এই যুদ্ধে আমার মৃত্যু হতেও পারে। আর যদি মৃত্যু না হয় তাহলে দুটো প্রাণিকে স্মরণ করবো, এক- তুমি মাইশা। আর দ্বিতীয় আমার প্রিয় কুকুরটিকে। তুমি ভালো থেকো। এই মুহূর্তে দেশকে নিয়ে ভাবনার চেয়ে আমার কাছে আর বড়ো কিছু নেই।’
এই বলে লোকটি কানেকশন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাইশা তাকে ফোন করে। কিন্তু লোকটি আর ফোন রিসিভ করেনি।
পরদিন মাইশা খুব ভোরে উঠে হোটেল প্রবালে গিয়ে জানতে পারে লোকটি রাত ৩টায় হোটেল প্রবাল ছেড়ে চলে গেছে তার প্রিয় কুকুরটিকে সঙ্গী করে। মাইশার দু’চোখ বেয়ে লোকটির জন্যে অশ্র“ধারা গড়িয়ে পড়ে।
একসময় নিজকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে সে হোটেল থেকে বের হয়ে পথ চলতে থাকে। চলতে চলতে সে ভাবে, সত্যিই তো একজন নারীর ভালোবাসার চেয়ে দেশপ্রেমের টানে যুদ্ধযাত্রা অনেক বেশি গুর“ত্ব বহন করে। তাহলে লোকটি সঠিক কাজটিই আগে করেছে।
মাইশার অš—র লোকটির জন্যে আরো ভালোবাসার টান অনুভব করে।
-
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৫২ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪