এক.
হাজীগঞ্জ উপজেলা থেকে বলাখাল হয়ে সাপের মতো একেবেঁকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে নারায়ণপুর পর্যন্ত। ওই রাস্তার প্রায় ওপরেই রামপুর গ্রামে একটি বাজার অবস্থিত। সেই বাজারটির নাম রামপুর বাজার। রামপুর বাজারের সবচেয়ে বড় দোকানটা হচ্ছে আনোয়ার বেপারীর। আর আনোয়ার বেপারীর পিতার নাম গণি মিয়া।
ছেলে আনোয়ার ব্যবসা করে অনেক টাকার মালিক হয়েছে। অথচ গণি মিয়া অসহায় একজন পিতা। প্রায় সময়ই উপোষ করে কাটান তিনি। অথচ ধনী সন্তানটি তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আর তাকালেই বা কি? গণি মিয়া কি তার ছেলের পাপের এই অর্থ দিয়ে নিজের উদরপূর্তি করবেন? না, তিনি ক্ষুধার জ্বালায় মরে গেলেও ছেলের ওই পাপের অর্থ গ্রহণ করে নিজকে কখনোই কলুষিত করবেন না। কারণ গণি মিয়ারা মরে, তবুও ভাঙ্গে না।
গণি মিয়ার প্রথম স্ত্রী আনোয়ারের মাতা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মৃত্যুবরণ করে। সে এক করুণ কাহিনী। পাক হানাদার বাহিনী একাত্তর সালের মে মাসে ওই গ্রামটিতে যে বর্বরোচিত আক্রমণ চালায়, তার শিকার হয় বেশিরভাগ অবলা নারী। পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর আল-বদর বাহিনী স্থানীয় বাচ্চু রাজাকারসহ ওই গ্রামে এসে প্রত্যেক ঘরের দরজায় এসে অস্ত্র হাতে দাঁড়ায়। এরপর প্রথমেই নির্বিচারে খুন করে গ্রামের শক্ত-সামর্থ্যবান পুরুষদের। গণি মিয়া সেদিন ঘরে ছিলো না। সতের-আঠার বছর বয়সী সন্তান আনোয়ারকে নিয়ে গিয়েছিলো হাজীগঞ্জ বাজারে পুরনো বই বিক্রির ব্যবসায়। সেজন্যে তারা যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলো সে। ফিরে এসে দেখে পুরো গ্রামটিতে লাশ আর লাশ। রক্তে যেনো গঙ্গাসাগর বইছে।
সে ফিরে এসে জানতে পারে, বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর বাচ্চু রাজাকার প্রথমে হিন্দু সুন্দরী নারীদের সম্ভ্রম নিয়ে খেলছিলো। এক সময় তারা গণি মিয়াদের বাড়িতে আসে। ওই বাড়িতে তিনটি পরিবার বাস করতো। দুটো হিন্দু পরিবার, আর গণি মিয়াদের পরিবার। রাজাকার বাচ্চু পাকিস্তানী বাহিনীকে নিয়ে প্রথমে গণিমিয়াদের পার্শ্ববর্তী হিন্দু পরিবার শ্যাম নারায়ণ মাস্টারের ঘরে প্রবেশ করে। ওই ঘরের সদ্য বিবাহিতা সুন্দরী রূপসী বধূ উজ্জ্বল রাণীকে বাইরে টেনে আনে হিড়হিড় করে। এরপর খোলা আকাশের নিচেই চলে তাদের পাশবিক তাণ্ডব। এ অবস্থা সইতে না পেরে গণি মিয়ার স্ত্রী ময়না বানু মানবিক সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। কিন্তু পাকবাহিনীর দোসররা তাকেও ছাড়েনি। রাজাকার বাচ্চু তাকে ইজ্জত লুটে নির্মমভাবে চাকু দিয়ে খুন করে। রক্তে ভেসে যায় সমস্ত উঠোন। তারপর তারা উজ্জ্বল রাণীকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় অজানা কোনো স্থানে। সেই উজ্জ্বল রাণীকে পাওয়া যায় তিনদিন পর বীভৎস মৃত অবস্থায়। তাকে দেখে তখন আর চেনার উপায় নেই এই রমণী কতো সুন্দরী ছিলো এক সময়। পাকবাহিনী তাকে ধর্ষণ শেষে তার বুকের স্তন দুটো কেটে নিয়ে গিয়েছিলো।
গণি মিয়া আনোয়ারকে নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে দেখে পুরো বাড়িটা যেনো বিধ্বস্ত। তার স্ত্রী উঠোনেই মরে পড়ে আছে গলাকাটা অবস্থায়। রক্ত সমস্ত উঠোন জুড়ে কালো হয়ে আছে। গণি মিয়া এ অবস্থা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলো যেনো। শক্ত হয় হাত দুটো, বুকে জমে ওঠে লেলিহান দাবানল। পাকিস্তানী কুত্তাদের শায়েস্তা করতেই হবে, যদি প্রয়োজন হয় জীবনও বাজি রাখবে সে।
দু'দিন পর সন্তান আনোয়ারকে তার মামা বাড়ি কুমিল্লায় রেখে গণি মিয়া চলে যায় ভারতে। সেখানে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে ট্রেনিং সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসে। এরপর হাজীগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার কলিম মিয়ার বাহিনীতে এসে যোগদান করে সে। ষোল ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বীরত্বের পরিচয় দেয়। নিজ হাতে খুন করে একটার পর একটা পাকিস্তানী রক্ত লোভী পিশাচ-হায়েনাকে। মনের তৃপ্তি মিটিয়ে ওদের পানে গুলি বর্ষণ করতো গণি মিয়া, নিজের প্রাণেরও মায়া করতো না সে। ফলে সে দুর্ধর্ষ এক মুক্তিকামী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলো।
একদিন সুযোগ আসে চরম প্রতিশোধের। কমান্ডার কলিম মিয়া খবর পান, পরদিনই নাকি নারায়ণপুর বাজারে আক্রমণ করবে রাজাকার বাচ্চু বাহিনী। তিনি গণিমিয়াকে নির্দেশ প্রদান করেন, বাচ্চু রাজাকারকে প্রতিহত করার জন্যে। সেই যুদ্ধেও বীরত্বের পরিচয় দান করে গণি মিয়া। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাচ্চু রাজাকারের বাহিনীকে পরাজিত করে বাচ্চু রাজাকারকে খুন করে তার লাশটা এনে উপহার দেন কমান্ডারকে। কমান্ডার সেই লাশটি নিয়ে হাজীগঞ্জ বাজারে টানিয়ে রাখেন। তার লাশটি শেষ পর্যন্ত ক্ষুধায় অস্থির কাকদের পেটের খোরাক হয়েছিলো। অন্য রাজাকাররা বাচ্চু রাজাকারের এই অবস্থা দেখে ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো।
এক সময় দেশ স্বাধীন হলো। অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার বাড়ির পথ ধরলো। গণি মিয়াও বিধ্বস্ত বাড়িটিতে ফিরে আসে। গ্রামের মুরব্বীদের অনুরোধে আবার বিয়ে করে গণি মিয়া। কী করবে সে, এছাড়া তো তার আর কোনো পথ খোলা ছিলো না। বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন তো দরকার।
এক সময় গণি মিয়া জানতে পারে তার সন্তান আনোয়ার মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা মামাবাড়িতে থাকাকালীন পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করে প্রচুর অর্থ আয় করেছে। কথাটা শুনে প্রথমে সে ভেবেছিলো এটা কোনো মতেই সম্ভব নয়। যার গর্ভধারিণী মাকে ওই বর্বর বাহিনী নির্মমভাবে খুন করেছিলো, তারই সন্তান কি এ ধরনের গর্হিত কাজ করতে পারে? কিন্তু না। তা-ই হয়েছিলো। আনোয়ার তা-ই করেছিলো। সে তার মায়ের চেয়ে, দেশের মানচিত্রের আব্রুর চেয়ে নিজের স্বার্থকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলো। দশ বছরের মধ্যেই ওই টাকায় আনোয়ার গ্রামে এসে বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলে। এরপর বাপের জায়গায়ই গড়ে তোলে বিরাট ইমারত। পাশেই গণি মিয়ার ভাঙ্গা ঘর। সেই ঘরেই তিনি ছোট ছোট বাচ্চাসহ খেয়ে না খেয়ে কোনোরকমে দিন গুজরান করেন।
দুই.
আজ সাত-সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো গণি মিয়া। সারা গাঁয়ে কোনো কাজকর্ম মিলেনি তার। অবশেষে দুঃখভরা মন নিয়ে বাড়ি ফিরেই গণি মিয়া দেখলো, বাচ্চাগুলো গিনিপিগের মতো হামাগুড়ি দিয়ে উঠানো কান্নাকাটি করছে সবাই সুরমিলিয়ে। সেই সাথে গিন্নি মরিয়ম বানুর তারস্বরে চিৎকার, 'কী হইব এমন সংসারে থাইক্যা। বিয়া অইলো আইজ দশ বছর। বাচ্ছা ফুটাইছে ছয়টা। কিন্তু অগো খাওনা-দাওন দিবার পারে না। ওই বুড়া নাকি এককালে মুক্তিযোদ্ধা আছিল। দেশ স্বাধীন করছে। বলি, দেশটা তো স্বাধীন করলা, মানুষগোরে মুক্তি দিলা, কিন্তু নিজে তো আমাগোরে মুক্তি দিবার পারলা না ক্ষুধার জ্বালা থাইক্যা। আইজ তিনদিন প্রায় না খাইয়া আছি। বাচ্চাগুলোরে মানুষের বাড়ি থাইক্যা দুইডা ভাত চাইয়া আইনা খাওয়াইছি। কিন্তু আমার আর কপালে খাওন জুটলো না। ক্ষুধার জ্বালায় কলিজাডা অঙ্গার হইয়া যাইতাছে।' মরিয়ম বানুর চোখের জল মাটিতে পড়ছে টপটপ করে।
বাচ্চাদের কান্নার সাথে মরিয়মের কান্নার ধ্বনি যেনো বিউগেলের করুণ রাগিনীরূপে ধরা দিলো গণি মিয়ার বুকের পাঁজরে। সেই সাথে বুকের মধ্যখানটা যেন ঝাঁঝরা হয়ে গেলো সেই বিউগেলের সুরে।
বাড়ির অদূরে থেকেই গণি মিয়া বাচ্চাদের চিৎকার আর মরিয়ম বিবির কথাবার্তা শুনছিলো। থমকে দাঁড়ালো সে। ভাবতে লাগলো, হঁ্যা, মরিয়মের কথাই ঠিক। দেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেক মানুষ মুক্তি পেয়েছে বর্বরতা থেকে, নিষ্পেষণ-লাঞ্ছনা থেকে। কিন্তু গণি মিয়ার সংসারের ক্ষুধার জ্বালার লাঞ্ছনা আজও দূর হলো না।
গণি মিয়া দেশ স্বাধীনের পর সরকার থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছিলো। সেই টাকায় সে একটি চায়ের দোকান খোলে। কিন্তু বছরখানেক যেতে না যেতেই সে পড়ে এক কঠিন বিমারে। সে বিমারে তার দোকান, হাতের টাকা-পয়সা সব চলে যায়। কোনোরকম সুস্থ হয় সে। কিন্তু তারপরই শুরু হয় তার কঠিন জীবন। সংসারে ক্রমে ক্রমে আসে ছয়টি সন্তান। একটি ছেলে নাম-বাদল, মেয়ে পাঁচটি। তাদের নাম- জুঁই, চম্পা, বেলী, গোলাপী, হাসনাহেনা। এদেরকে সে না পেরেছে পড়ালেখা করাতে, না পেরেছে ঠিকমতো পেটের খোরাক জোটাতে। ফলে সংসারে লেগে আছে এক মহা-অশান্তি।
আর মাত্র কয়েকদিন পর ঈদ। ছেলেমেয়েরা বায়না ধরেছে সবার জন্যে ক্রয় করতে হবে ঈদের নতুন জামা-কাপড়। কিন্তু গণি মিয়ার ঘরে আজ তো খাবার চালই নেই; তিনদিন ধরেই প্রায় উপোস কাটছে। কীভাবে বাচ্চাদের জন্যে ঈদের বাজার করবে সে?
গণি মিয়া আর সামনে এগোয় না, রাস্তার পাশেই বসে পড়ে স্থানুর মতো। ভাবে, ঈদ তো ধনীদের জন্যে সুখের বার্তা নিয়ে আসে, আর গরিবের জন্যে তা' এক করুণ হাহাকার। যদিও ধর্মে এমন কথা লেখা নেই। তবুও তাদের নসিবে লেখা আছে ঠিক হয়তো এমনই।
'নসিব' কথাটা মনে হতেই তড়াক করে মনের ভেতর একটা বিষয় জানান দিলো তার। নসিব? না! কেনো সে নসিবের ওপর ভর করে পড়ে থাকবে আজীবন? সে আস্তে আস্তে মাঠের দিকে রওনা দিলো। এ বছর বর্গা জমি চাষ করেছিলো এক বিঘা। সেই জমিতে ধান রোপণ করেছিলো। সেই ধানের ক্ষেতের পাশে যেয়ে দাঁড়ালো সে। হঠাৎ একটি ব্যাপার তার কাছে স্পষ্ট হলো, ক্ষেতের মাঝখান বরাবর কিছু ধান বেশ পুরু হয়ে বড় হয়েছে। সে পুরু ধানগুলোর কাছে গেলো। ধানগুলো একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। ভাবতে লাগলো সে, কী করা যায়? এই ধানগুলো অন্য ধানগুলোর চেয়ে এত পুরু ও বলিষ্ঠ কেনো? ভাবতে লাগলো সে। ভাবতে ভাবতে পেয়ে যায় আসল রহস্য। হঁ্যা, এই ধানগুলোই হয়তো তার জীবনকে পাল্টে দেবে। তার সংসারের ক্ষুধার জ্বালা মিটিয়ে দেবে। ভাবতে ভাবতে গণি মিয়ার দুই চোখ চকচক করে ওঠে। সে সুন্দর এক আগামীর স্বপ্ন দেখে।
তিন.
সেবার গণি মিয়াদের ঘরে ঈদের দিনেও খাবার চাল ছিলো না। প্রায় না খেয়েই ঈদের দিনটি কাটিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। কোনো যাদুর ছোঁয়া নয়, বরং গণি মিয়াদের ক্ষুধার তাড়না থেকে বেঁচে থাকার তাগিদেই, জীবনের সাথে লড়তে গিয়েই আবিষকৃত হয়েছে নতুন দিগন্ত 'গণি মিয়ার ধান।'
গণি মিয়া পুরু ধানগুলো রেখে দিয়েছিলো আলাদা করে। পরবতর্ীতে সেই ধানগুলো বপণ করে ক্ষেতে। আশ্চর্য হয়ে গণি মিয়া দেখে, সেই ধানগুলো থেকে উৎপন্ন গাছের চারা উচ্চতায় বেশ বড়, ফলনও অন্য ধানের চেয়ে অনেক বেশি। এই কথা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন ভীড় জমায় গণি মিয়ার বাড়িতে সেই ধান ক্রয় করতে। তারা গণি মিয়ার কাছ থেকে ধান ক্রয় করে ধানের জলা করে বীজ বপণ করে, এরপর শস্য ফলায়। ওই শস্য থেকে প্রচুর ধান উৎপন্ন হয়, যা অন্য ধানের চেয়ে পাঁচগুণ।
গণি মিয়া তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকার থেকে গোল্ড মেডেল পায়। তার ভাগ্য ফিরে গেছে। জমি-জমা, ঘর-বাড়ি সব হয়েছে।
চার.
গতকাল খবর পেয়েছে গণি মিয়া। তার সন্তান আনোয়ারকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে ডাকাতির অভিযোগে। সে নাকি আন্তজেলা ডাকাত দলেরও সর্দার। ভাবে এ কি করে সম্ভব? হঁ্যা সম্ভব, যে ছেলে তার মাকে বর্বর পাকিস্তানীদের হাতে লাঞ্ছিত ও খুন হবার কথা শুনেও সেই পশুদের সাথেই একাত্ম হয়ে কাজ করতে পারে তার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। একবার ভাবে থানায় গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসবে সে, শত হলেও বাপতো! কিন্তু মন সায় দেয় না। কারণ যে জানে, যে ছেলে মায়ের রক্তের সাথে, দেশমাতার ইজ্জতের সাথে বেঈমানী করতে পারে সেই ছেলের মুখদর্শন করাও যে পাপ।
না ছেলেকে দেখতে যায়নি গণি মিয়া। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোনো শক্তির মুখদর্শন করবে না মুক্তিযোদ্ধা গণি মিয়া- যদি সে মানুষটি তার সন্তানও হয়। ক্ষুধার জ্বালাকে নিজ উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে যেমনি জয় করেছে সাহসী গণি মিয়া, তেমনি যদিও বৃদ্ধ হয়েছে সে, গায়ের জোর কমে গেছে তার, তবুও মনের জোর, স্বদেশের ভালোবাসার শক্তি এতোটুকু কমেনি তার।
ঘরের দাওয়ায় বসে হুঁকো টানছে গণি মিয়া। ভেসে ওঠে তার মনে বিগত দিনগুলোর প্রতিচ্ছবি। সে ভাবতে থাকে, এমন একটা দিন ছিলো তার, যখন সে ছিলো অসহায় একজন মানুষ। মানুষের খুশি-আনন্দের ঈদের দিনেও তারা অভূক্ত থাকতো ক্ষুধার জ্বালা বুকে নিয়ে। কিন্তু আজ আর তেমনটি হচ্ছে না। কারণ, তার ধানের গোলায় আছে প্রায় দুইশ' মণ ধান। ব্যাংকেও জমেছে অনেক টাকা ধান বিক্রি করে। অভাব-অনটন নেই; গিন্নীরও হাউকাউ থেমে গেছে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করছে। একটু সামান্য সাধনা, জীবনে বেঁচে থাকার সুন্দর প্রতিচ্ছবি ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম-প্রচেষ্টায় সে লাভ করেছে অর্থ, যশঃ-খ্যাতি ও বেঁচে থাকার সুন্দর অবলম্বন।
দেশের প্রতিটি মানুষই যদি এমনভাবে কোনো না কোনোভাবে জীবন-সাধনা করতো! তাহলে পুরো দেশটায় সুখী মানুষে ভরে যেত। গরিব বলতে কেউ আর থাকতো না, থাকতো না ক্ষুধার জ্বালার হাহাকার। ঈদের দিনেও আর কেউ না খেয়ে থাকতো না। সবার চোখে ভাসতো ক্ষুধা মুক্তির আনন্দ-প্রতিচ্ছবি। ক্ষুধামুক্ত হতো দেশ, দেশের প্রতিটি মানুষ।