ব্যাগের নীচে ব্লেড দিয়ে কাটা। ব্যাগে কিছ্ছু নেই। টাকাপয়সা, মোবাইল, এমনকি আয়না, চিরুনি, লিপস্টিক, টিসু পেপার, পানির বোতল ... কিছুই নেই !
শাম্মী বসে আছে কল্যাণপুর টু মতিঝিলের বাসে। ওর কান্না পাচ্ছে। ভয়ও লাগছে। চলন্ত বাসে ব্লেড দিয়ে ব্যাগের নীচে কেটে যে সবকিছু এভাবে চুরি করা যায় সেটা ওর ধারণায় ছিলোই না। সত্তর টাকা ছিলো, যার কিছুই এখন নেই। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে মোবাইলও নিয়ে গেছে। মোবাইলে কতো মেসেজ, নম্বর, ছবি ! সব গেছে কার না কার হাতে। যার হাতে গেছে সে এগুলো দিয়ে কি করবে কে জানে।
আটটার মধ্যে মতিঝিলে যেতে হবে। আনসার ক্যাম্প থেকে বাসে উঠার পরে অনেকটা পথ পার হয়ে গেছে। এখন বাস থেকে নেমে বাসায় গিয়ে টাকা আনার কোনো উপায় নেই। টিকেট মামাকে বললেযে কোনো জায়গায় বাস থামিয়ে শাম্মীকে নামিয়ে দেবে। আজকাল শহরের মানুষ হৃদয়হীন হয়ে গেছে। ভাই কাকা মামা ডেকেও কারও সহানুভূতি পাওয়া যায় না।
কে কখনএই ভয়ঙ্কর কাজটা করলো, কোথায় কিভাবে করলো, শাম্মী কিছুই বুঝতে পারছে না।বাসা থেকে আনসার ক্যাম্পের বাস স্ট্যান্ড দূরে না। সেই হাঁটা পথে এই চুরি করা সম্ভব না। ব্যাগ কেটে সব চুরি নিশ্চই বাসেই হয়েছে। টিকেটের টাকা দেয়ার জন্য ব্যাগে হাত দিতেই শাম্মী টের পেলো। টিকেট মামাকে না বলে উপায় নেই। শাম্মীর কথা মন দিয়ে শুনে সে বিরক্ত স্বরে বললো, বুঝলাম। ক্যাঁচাল ... এই একই ঢঙ আর কয়জন করবে ?
টিকেট মামার চোখেমুখে স্পষ্ট অবিশ্বাস আর বিরক্তি। শাম্মীর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। ও কাঁপা স্বরে বললো,ঢঙনামামা, সত্যিইআমারসবচুরিহইছে।আপনে দেখেন। ব্যাগের মধ্যে দেখেন, তলায় ব্লেড দিয়া কাটা।
- দেইখা লাভ কি ? বাড়ির থেইকাই কাটা ব্যাগ নিয়া আসছেন। এই ধান্দা অনেকেই করে। চোরের দেশ। ভাড়া দেন, নাইলে নামায়ে দিমু।
- আমি এমন কিছু করি নাই মামা। আপনে একটু দেখেন না মামা, চোর বাসেই থাকতে পারে।
টিকেট মামা কঠিন স্বরে বললো, আমি কি থানা পুলিশ যে চোর ধরমু ? যার চোর সে ধরবে। আমারেভাড়াদেন। নইলে কইলাম এক্ষণ নামায়ে দিমু !
- আমারে মতিঝিলে নামায়ে দেন মামা। মতিঝিল যাওয়া খুব দরকার। কালকে আইসা আপনার ভাড়া দিয়া দিমু। আল্লাহর কসম। সাথে টাকা থাকলে সত্যি দিতাম। আমার সব চুরি হইয়া গেছে।
টিকেট মামা ধমকের স্বরে বললো, আমারে ঝোল দিও না। চিপাচাপায় টাকা লুকাইয়া কাটা ব্যাগ দেখাইয়া এমন মিথ্যা অনেক জেনানা বলে। এইসব আমার চেনা। এই ঝোল আমি খাই না।
শাম্মীর আশেপাশে লোকজনের মধ্যে চান্চল্য দেখা যাচ্ছে। মেয়েমানুষের বিপদ দেখলে উত্সাহী লোকজনের অভাব হয় না। ওর পাশে বসা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক কঠিন স্বরে বললেন, মেয়েটার বিপদ হইছে, আর আপনে হাবিজাবি কথা বলেন কেন ? আর ওরে ধমকাধমকি করতেছেন কেন ? কেউ টাকা চুরি করলে তার কি দোষ ?
- সে আপনের কি লাগে ? এতো দরদ থাকলে আপনে টিকেটের টাকা দেন।
ছাত্র ধরণের অল্পবয়সী একটা ছেলে শাম্মীর গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। সে দৃঢ় স্বরে বললো, এই যে মামা, এতো তেজ দেখান কেন ? এইটা চোরের দেশ। রাস্তাঘাটে চুরিধারী হইলে বিপদ আপদ হবেই। মানুষ মানুষের বিপদ না বুঝলে এই দেশে কে কেমনে বাঁচবে ? এরকম বিপদ তো আপনারও হতে পারতো !
- এতো ঘন ঘন বিপদ আপদ হইলে আমরা বাস চালামু কেমনে ?
- আপনের বাস আপনে চালান। মেয়েমানুষের সাথে তেজ দেখাবেন না।এটা পাবলিক বাস। ভদ্র ব্যবহার করেন। অভদ্রতা করলে বাস বন্ধ করার ব্যবস্হা আমাদের জানা আছে। একটা ফোন করলে এক হাজার ছাত্র এসে রাস্তা বন্ধ করে দেবে। তখন কয়জনের চিপাচাপায় টাকা খুঁজবেন ?
- আরে আজব ! যার চুরি হইছে হে চুপ, আর তার সারিন্দায় গান গায়। এতো ক্ষমতা থাকলে তার ভাড়া দেন ... আমার ভাড়া দিয়া কাম। ভদ্রতা শিখান কেন ? ভদ্রতার আমার দরকার নাই। ভদ্রতা দিয়া বাস চলে না। পেটওচলেনা।
- দুইশ ক্যাপাসিটির বাসে বেআইনীভাবে চারশ লোক নিয়ে চলেন। ওভারলোডের ভাড়া খেয়ে আপনাদের পাছায় চর্বি জমে গেছে। পুটকি ভরা চর্বি নিয়ে মাস্তানী করেন ! একটা অসহায় মেয়ের ভাড়া না নিলে আপনাদের এমন কি ক্ষতি হবে ?
বাসের ভেতরে টিমটিমে কয়েকটা বাতি জ্বলছে। ভয়ের কারণে সেই আলোতে শাম্মী কারও চেহারাই দেখতে পাচ্ছে না। টিকেট মামার বিরক্তি দমেনি। সে সেই ছেলের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, খবরদার ! লেচকার দিবেন না কইলাম। তিরিশ বছর কন্ডাক্টরি করি। সব চোর বাটপার আমার চেনা। আমার ভাড়া আমারে দেন। নাইলে এইখানে বাস থামায়ে সবাইরে নামায়ে দিমু। সরকারী বাস সরকারের লোকের ইচ্ছায় চলে। কারও লেচকারে চলে না। কারও লেচকারের আমার দরকার নাই।
টিকেট মামার ধমকে কিছু একটা ছিলো। ছেলেটা আর “লেচকার” দেয়ার চেষ্টা করলো না। আশেপাশের চান্চল্যে একটু ভাটা পড়লো। কথা বললেন পাশে বসা মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। শান্ত ভঙ্গিতে বললেন, তার ভাড়া কতো বলেন। আমি দিতেছি।
- মতিঝিল পর্যন্ত আঠারো টাকা।
- আমি প্রেসক্লাব পর্যন্ত তার ভাড়া দিবো। সে প্রেসক্লাবে আমার সাথে নামবে।
শাম্মী হালকা স্বরে বললো, আমার মতিঝিল যাওয়া খুব দরকার। আটটার মধ্যে মতিঝিল যাইতে হবে। প্রেসক্লাব কই আমি চিনি না।
পাশে বসা ভদ্রলোক ওর কথা শুনলেন কি না বুঝা গেলো না। নিরাসক্তভঙ্গিতেপনেরোটাকাবেরকরেটিকেটমামারহাতেদিলেন।সেটাকানিয়েআগেরমতোইবিরক্তস্বরেবললো, দুই স্টপ পরে প্রেসক্লাব। এই মেয়েরে তার পরে যেন বাসে না দেখি।
শাম্মী যখন প্রেসক্লাবে নামলো তখন সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে গেছে। সোডিয়াম বাতির আলোতে রাস্তায় হলদে ছোপ। ওর পাশে সেই ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। গালপাট্টা সাদা দাড়ি, কোটরে বসানো চোখ গাঢ় রঙের মোটা ফ্রেমের চশমায় ঢাকা। পরনে পান্জাবী। চেহারায় পিতৃতুল্য ছাপ, অভিব্যক্তি। দেখে মনে হচ্ছে তিনি অন্য পুরুষদের মতো শাম্মীকে এখনও দেখেননি। বাস থেকে নেমে তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার নাম বদরুল আলম। তোমার নাম কি ?
- আমার নাম মল্লিকা। আসসালামুআলাইকুম।
বদরুল আলম সালামের উত্তর দিলেন না। পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমা পরিষ্কার করলেন। চশমা চোখে দিয়ে বললেন, প্রকৃত নাম বলো। নকল নাম বলার দরকার নাই। মা বাবা আকীকা দিয়া যেই নাম রাখছে, সেইটা বলো।
শাম্মী দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। সন্ধ্যার পুরুষদের একেক সময় একেক নাম বলার অভ্যেস হয়ে গেছে। এই ব্যবসায় সন্ধ্যায় কাউকে আসল নাম বলার নিয়ম নেই। কিন্তু উপকারী এই মানুষকে সেরকম বলাউচিত হয়নি। নকল নাম বলার পর এখন আসল নাম বললে তিনি সবটাই বুঝে ফেলবেন। মতিঝিলের জিন্দাবাহার হোটেলে আটটার সময় মল্লিকা হয়ে শাম্মীর পৌঁছানোর কথা। সেখানে ক্লায়েন্ট অপেক্ষা করছে। এসব কথা কাউকে বলা যায় না।কিন্তু একবার মল্লিকা নাম বলে এখন আসল নাম বললে ভদ্রলোক হয় তো সেটা বুঝে যাবেন। এই শহরে সবাই সবকিছু দ্রুত বুঝে ফেলে।
বদরুল আলম পান্জাবীর পকেট থেকে একটা কিছু বের করে শাম্মীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চোর তোমার ব্যাগ থেইকা সব নিতে পারে নাই। টাকার জন্য তুমি যখন ব্যাগ হাতাহাতি করছো, তখন এইটা পইড়া গেছিলো। আমি তুইলা যত্নে রাখছি যেন কেউ না দেখে। তোমার জিনিস, রাখো।
শাম্মী হাত বাড়িয়ে কনডমটা নিলো। ওর খুব লজ্জা লাগছে। এখন আর কিছুই লুকানো নেই। ও হালকা স্বরে বললো, আমার নাম উম্মে লাবীবা শাম্মী। আপনে আমারে শাম্মী বলতে পারেন।
- তোমার মুখ শুকনা। সামনে সার্জিকাল মার্কেটের সাথে আমার নিজের রেস্টুরেন্ট আছে। তোপখানা রোডের একটু ভিতরে মার্কেট। তুমি রেস্টুরেন্টে বইসা হাতমুখ ধোও, চা নাস্তা খাও।
- আটটার সময় মতিঝিল যাইতে হবে। কয়টা বাজে জানেন চাচা ?
বদরুল আলম সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। শাম্মীর এখন একটু স্বস্তিবোধ হচ্ছে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোক ওর কোনো ক্ষতি করবেন না। বাসের ভাড়া দেয়ার জন্য তাঁকে এখনও ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। আচরণে তাঁকে স্বল্পভাষী মনে হচ্ছে। বেশী কথা বলা পুরুষদের নিয়ে অনেক সমস্যা। স্বল্পভাষীদেরনিয়েঝামেলাকম।
শাম্মী বদরুল আলমের সাথে তোপখানা রোডের ফুটপাথে হাঁটতে থাকলো। চারপাশে প্রচণ্ড ব্যস্ততা। ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ হাঁটছে। স্রোতের মতো চলছে যানবাহন। শোরগোলের কারণে প্রায় চিত্কার করে কথা বলতে হয়। শাম্মী স্বর উঁচিয়ে বললো, কয়টা বাজে জানেন চাচা ?
বদরুল আলম কিছু বললেন না। তোপখানারোডেরএকপাশদিয়েকিছুক্ষণহেঁটেতিনিএকটাগলিতেঢুকলেন।গলিতেওভিড়।সার্জিকালমার্কেটেরপাশেএকটাখোলারেস্টুরেন্টেএসেতিনিথামলেন।রেস্টুরেন্টেরওপরেসাইনবোর্ডেলেখা“রেহনুমা হোটেল এন্ড রেস্তোরা”। সাইনবোর্ডেরএকপাশে মাছ মুরগী আর আরেক পাশে ভাতের ছবি। বাইরে বড় তাওয়ায় মোগলাই আর পুরী ভাজা হচ্ছে। তার পাশের চুলায় রাখা কড়াইতেজিলাপী বানানোতে ব্যস্তএকজন কারীগর। খাবারের গন্ধে চারপাশের বাতাস ভরপুর। শাম্মীর খিদে পাচ্ছে। দুপুরে চা রুটি কলা খাওয়ার পর আর কিছু খাওয়া হয়নি। পানির বোতল চুরি হয়ে গেছে। তাই পানিও খাওয়া হয়নি।
আটটার সময় জিন্দাবাহার হোটেলে না গেলে আজকে একটা টাকাও সাথে থাকবে না। সেরকম হলে বাসায় ফেরার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই ব্যবসায় ক্লায়েন্টরা সচরাচর টাকা নিয়ে ঝামেলা করে না। ঝামেলা করে তাদের ফাই ফরমাইশ নিয়ে। কেউ কাপড় খোলার সময় নাচতে বলে। ভাবুক ধরণের ক্লায়েন্টরা বলে গান গাইতে। কেউ আবার গান চালিয়ে বলে, “আসো, একসাথে গান শুনি”। বিছানায়এদের স্বায়ীত্বকাল কম। কারও কারও বিছানায় কিছু করার ক্ষমতাও নেই। দুই ঘন্টার বুকিং নেয়, তাই এটা সেটা করে সময় পার করে। বিয়ার খায়। শাম্মীকে খাওয়ায়। অনেকে আবার মোবাইলে বিদেশী সিনেমার কাটিং বা ছবি দেখিয়ে সেরকম করতে বলে। বিকট সব দৃশ্য। সেসব দৃশ্যের পুরুষদের মতো তারা কিছু করতে পারে না, কিন্তু শাম্মীকে ভঙ্গি করতে বলে। সেরকম ভঙ্গিতে শাম্মীর ছবি তুলে।
সেসব দৃশ্য দেখে অঙ্গভঙ্গি করতে শাম্মীর ঘেন্না লাগে। কিন্তু টাকার জন্য করতে হয়। ক্লায়েন্টের খায়েশ মতো কাজ করলে উপরি বখশিশ পাওয়া যায়। আফজাল ভাই বখশিশের খবর রাখে না। ক্লায়েন্টের দেয়া রেট থেকে সে আর্ধেক রাখে। বখশিশেরটাকারপুরোটাইশাম্মীর। আফজাল ভাইকে বখশিশের কথা বললেও সে কিছু চায় না।উদার ভঙ্গিতে বলে, তোর পরিশ্রমের টাকা, তুই রাখ। ভালো কিছু কাপড়চোপড় কিনে নে, পার্লারে যা। রঙিন রঙিন ব্রা প্যান্টি কিনবি। কাজে দিবে।
- এইটা আমার নিজের রেস্টুরেন্ট। একত্রিশ বছর ধইরা আমিই মালিক। এই মার্কেটে সবাই আমারে এক নামে চেনে। এইখানে তোমার কোনো ভয় নাই। হাতমুখ ধুইয়া যা ইচ্ছা করে খাও। টাকাপয়সার চিন্তা কইরো না।
- আমার আটটার সময় মতিঝিল যাওয়ার কথা চাচা ... আমারে একটু বলেন এইখান থেইকা মতিঝিল কেমনে যাবো ...
বদরুল আলম ধমকের স্বরে বললেন, চাচা ডাইকা আবার মতিঝিল যাইতে চাও ! তুমি কোথাও যাইবা না। খাওয়াদাওয়া করো। এরপর আমি তোমারে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্হা করবো।
- আপনে যা ভাবতেছেন সেই রকম কিছু না চাচা। মতিঝিলে আমার একটা কাজ আছে, তাই যাইতে হবে। আমারে রাস্তাটা বইলা দেন, আমি চইলা যাবো। আপনের টাকা আমি কালকে দিয়া দিবো। রেস্টুরেন্ট তো এখন চিনি ...
- আরেকটা কথা বললে একটা থাপ্পড় দিবো।একদম চুপ। এই রাত-বিরাতে তুমি কোথাও যাইবা না। খাওয়া শেষ কইরা বাড়িতে যাইবা।
শাম্মী চুপ করলো। বদরুল আলমের কথা শুনে কেন যেন চোখে পানি আসছে। ওর বাবা কুয়েতে চাকরি করতেন। ঘরে তার শাসন ছিলো না। একদিন হঠাত একটা খবরে তিনি পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। তার মৃতদেহ ঢাকা পর্যন্ত আনার কোনো ব্যবস্হা করা যায়নি।শাম্মীর বয়স তখন বারো। এরপরথেকেজীবনঅন্যরকমহয়েগেছে।সেইজীবনেকেউঅধিকারনিয়েকিছুবলেনা।কেউবলেনাআরেকটাকথা বললে থাপ্পড় দেবে।
- তোমারে দেখতে ভালো ঘরের মনে হয়। এই কাজ করো কেন ? শহরের মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরি করে। গার্মেন্টসে চাকরি করতে পারো না ?
- দিনে গার্মেন্টসে চাকরি করি চাচা। সন্ধ্যায় আফজাল ভাই বাইরে পাঠায়।
- আফজাল ভাই কে ? দালাল ?
- সে আমার গার্মেন্টসের সুপারভাইজার। তার আরো ব্যবসা আছে।
বদরুল আলম কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘস্বরে বললেন, বাড়িতে কে কে আছে ?
- মা আছে। ছোট ভাই আছে। সে দশম শ্রেণীর ছাত্র।
- তুমি পড়ালেখা করছো ?
- এসএসসি পাশ করছি চাচা। এরপর আর পড়তে পারি নাই। মা অসুস্হ। আমারে কামাই করতে হয়। সংসারে আর কোনো আয় নাই।
ওদের কাছে একজন যুবক এসে দাঁড়িয়েছে। বদরুল আলম তাকে বললেন, সাবের, এই মেয়েটার খাবারের ব্যবস্হা করো। ভাত তরকারী দাও। ফ্রেশ মাছ দিবা। আর তারে হাতমুখ ধোয়ার ব্যবস্হা দেখায়ে দাও।
সাবের শাম্মীরদিকে তাকিয়ে অমায়িক ভঙ্গিতে বললো, আসেন বইন। মহিলাদেরহাতমুখধোয়ার ব্যবস্হা পিছনে। পৃথক টয়লেটও আছে।
শাম্মী হাতমুখ ধুয়ে বাইরে এসে দেখলো রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে দুজনের জন্য খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বদরুল আলম সেখানে বসে আছেন। তাঁর সামনে ভাত তরকারী, কাঁচের জগে পানি। টেবিলেরকাছেএসেবসতেইতিনিকোমলস্বরেবললেন, বসো। আমি তোমার সাথে ভাত খাবো।
- মতিঝিল না গেলে আফজাল ভাই অত্যাচার করবে। গার্মেন্টস থেইকা আমারে বের কইরা দিবে চাচা। ভাত খাওয়ার পরে আমারে মতিঝিল যাওয়ার রাস্তা বইলা দিয়েন, আপনার মেহেরবানী হবে। আমি মতিঝিল না গেলে সে অনেক ঝামেলা করবে।
বদরুল আলম প্লেটে ভাত নিলেন। নিজের হাতে শাম্মীর প্লেটেও ভাত বেড়ে দিলেন। এরপর করলা ভাজির বাটি নিয়ে বললেন, শরীরের কারণে আমারে দুইবেলা করলা খাইতে হয়। তুমি মাছ নাও।তোমারে করলা খাইতে হবে না।
- চাচা, আমার কথাটা শুনেন ... আপনে আমার জন্য অনেক করছেন। এখন শুধু মতিঝিল যাওয়ার ব্যবস্হাটা কইরা দেন।
- মতিঝিলে কই যাইবা তুমি ? কার কাছে যাইবা ? নাম ঠিকানা আছে ? তোমার ফোন তো চুরি হইয়া গেছে ! কারে যোগাযোগ করবা আর কই যাইবা তুমি ?
শাম্মী হকচকিয়ে গেছে। আসলেই মতিঝিলের ক্লায়েন্টের কোনো নাম ঠিকানা এখন আর ওর কাছে নেই। সবকিছু মোবাইলে ছিলো। সেই মোবাইল ফিরে পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। এখন মতিঝিলে জিন্দাবাহার হোটেল খুঁজে বের করতে অনেক রাত হয়ে যাবে। শাম্মী সেখানে আগে কখনও যায়নি। হোটেল খুঁজে পেলেও ক্লায়েন্টকে পাওয়া মুশকিল। এই ব্যবসায় মুখের কথায় কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। ক্লায়েন্ট মল্লিকাকে চিনবে আফজাল ভাইয়ের টেক্সট মেসেজ দেখে। মেসেজ না দেখলে নিরাপত্তার কারণে সে মল্লিকাকে চিনতে অস্বীকৃতি জানাবে।মেসেজে আফজাল ভাই ক্লায়েন্টের নাম আর কামরা নম্বরও দিয়েছিলো। সেসব কিছুই এখন মনে নেই। মনে রাখতে হবে সেটা মাথায়ই আসেনি। শাম্মী কি আর জানতো যে হঠাত এভাবে মোবাইল চুরি হবে !
বদরুল আলম তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। শাম্মী খাওয়া শুরু করলো। সুস্বাদু খাবার। রুই মাছ চমত্কার রান্না হয়েছে। ভাতের গন্ধ অসাধারণ। এরকম খাবার মন ভালো করে দেয়। শাম্মীর মন ভালো লাগছে। ও খেতে খেতে বললো, খাবারের জন্য ধন্যবাদ চাচা।
- রিজিকের মালিক আল্লাহ। খাওয়া শেষ কইরা তার দরবারে শুকরিয়া আদায় করো। আমারে ধন্যবাদ দিও না।
- জি চাচা।
- খাবার শেষ করার পর আমি ট্যাক্সিক্যাব ডাইকা দিবো। সাবেরতোমারেনিয়াতোমার বাড়িতে যাবে। তুমি আর সন্ধ্যাবেলা কাজে বাইর হইবা না।শুধু গার্মেন্টসে কাজ করবা। ইজ্জতের কামাই আল্লাহর রহমত। গুনাহর কামাইয়ে বরকত নাই।
শাম্মী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বিষন্ন স্বরে বললো, আফজাল ভাই অত্যাচার করবে চাচা। সে আমারে গার্মেন্টসে কাজ করতে দিবে না। আমারে দিয়া গুনাহর কাজ করাবে।
- তুমি তোমার গার্মেন্টসের বড় সাহেবের সাথে কথা বলো।
- সেইটা সম্ভব না। তারে আমি চিনি না। তার সাথে কথা বলতে হইলে আফজাল ভাই মারফত যাইতে হবে। আফজাল ভাই সেইটা হইতে দিবে না।
- এইটা তো জুলুম ! সে এই জুলুম কইরা পার পায় কেমনে ? তোমরা পুলিশে অভিযোগ করো না কেন ?
শাম্মী সহজ ভঙ্গিতে বললো, এইটাই দুনিয়া চাচা। যে জুলুম করে সে জুলুমই করে। তার কোনো প্রতিকার নাই। আর থানা পুলিশ গরীবের কোনো কাজে আসে না।গরীবের উপর অত্যাচার হইলে থানা পুলিশ সমাধান দেয় না, আরো সমস্যা দেয়।
- তোমার গার্মেন্টসের নাম-ঠিকানা একটা কাগজে লিখা আমারে দিবা। আমি তোমার মালিকের সাথে কথা বলবো। এই জুলুম আমি হইতে দিবো না।
- জি চাচা দিবো। আপনে আমার জন্য এতো করবেন কেন চাচা ? আপনে তো অনেক করছেন !
বদরুল আলম কিছু বললেন না। তাঁর চোখ ভিজে আসছে। বুকের ভেতরে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। খাওয়ার পর রেস্টুরেন্টের কেউ তার হাত ধুয়ে দেয়। আজকে তিনি হাত ধোয়ার জন্য টেবিল ছেড়ে বেসিনের দিকে চলে গেলেন। মুখে পানি দিয়ে চোখের পানি ঢাকলেন। সাবের তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মুখ মুছে বললেন, সাবের, মেয়েটারে দই মিষ্টি দাও। আর তার হাত ধোয়ার ব্যবস্হা করো।
শাম্মীর জন্য ট্যাক্সিক্যাব এসেছে। সাবের তার সাথে যাবে। রেস্টুরেন্টের দরজায় দাঁড়িয়ে শাম্মী বদরুল আলমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। বদরুল আলম হালকা স্বরে বললো, সাবের তোমারে আমার ফোন নম্বর দিবে। কোনো বিপদ আপদ হইলে চাচারে ফোন করবা।
- জি চাচা, করবো।
- এই শুক্রবার জুম্মার পরে তোমার মা আর ভাইরে নিয়া আমার রেস্টুরেন্টে খাইতে আসবা। এইটা দাওয়াত। তোমার চাচীঅসুস্হ।রান্নাবান্না কইরা তিনি তোমারে খাওয়াইতে পারবেন না।তাই তোমারে দাওয়াতে আইসা রেস্টুরেন্টে খাইতে হবে।
- চাচী কোথায় থাকেন ?
- তিনি দোতালায় একটা কামরায় থাকেন। এখন নিদ্রা গেছেন। শুক্রবার তোমারে তাঁর সাথে পরিচয় করায়ে দেবো।
- জি চাচা, অবশ্যই।
বদরুল আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। এরপর শাম্মীর মাথায় হাত রেখে বললেন, আমি তোমার মালিকের সাথে কথা বলবো। কল্যাণপুরে আমার পরিচিত লোকজন আছে। আফজাল তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তোমারে একটা কাজ করতে হবে।
- বলেন চাচা, আমি করবো।
- তোমারে গুনাহর রাস্তা ত্যাগ করতে হবে। আফজাল বা কেউ যদি তোমারে সন্ধ্যা রাইতে বাইরে গিয়া গুনাহর কাজ করতে বলে, তুমি না বলবা। না বইলা আমারে ফোন কইরা জানাবা। তুমি না বললে কেউ তোমারে দিয়া কিছু করাইতে পারবে না। কেউ জোর জবরদস্তি করলে আমারে ফোন করবা। মনে রাখবা, এখন এই শহরে তোমার চাচা আছে।
শাম্মী কিছু বললো না। এখন কিছু বললে ও কেঁদে ফেলবে।
ট্যাক্সিক্যাব চলে যাওয়ার পরও বদরুল আলম কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর চোখ ভেজা। তিন বছর ধরে তাঁর সতেরো বছর বয়সী মেয়ে রেহনুমা নিঁখোজ। বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলো। আর ফেরেনি। সিনেমা হলের বাইরে অজস্র মানুষের ভিড়ে একটা মাইক্রোবাস এসে হঠাত করেই তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। প্রথমে অপহরণ ধারণা করা হলেও মুক্তিপণের জন্য কেউ যোগাযোগ করেনি। ঘটনার তিনদিনের মাথায় পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছিলো। সেই তদন্ত তিন বছর ধরে চলছে। কিন্তু রেহনুমা কোথায় সেটা কেউই বলতে পারে না।
থানা পুলিশ, এমনকি স্হানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ বা গুন্ডাদের অনুরোধ করেও রেহনুমার কোনো খোঁজ মেলেনি। সন্ধ্যা সাতটার সময় লোকারণ্য ঢাকা শহরের স্রোত থেকে জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে একদল পিশাচ উধাও করে দিয়েছে। রেহনুমার বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী কেউই কিছু জানে না। অনেক ভেবেও বদরুল আলম এর কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি। এইতিনবছরেএমনকোনোমুহূর্তনেইযখনরেহনুমারশোকেতাঁরমনভারীহয়েথাকেনি।কিন্তুবুকেরএইজগদ্দলপাথরমনেহয়আরসরবেনা।
তাঁর স্ত্রী আফিয়া তিন বছর ধরে অসুস্হ, অপ্রকৃতস্হ। সে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে। তার স্মৃতিভ্রম হয়েছে। বদরুল আলমের ধারণা স্মতিভ্রমের কারণে আফিয়ার বুকে এখন আর কোনো জগদ্দল পাথরের ভার নেই। তার সাথে দেখা করতে গেলেসে সহজ স্বরে বলে, রেহনুমা খাইছে ? অসুখের কারণে আমি মেয়েটার দেখাশোনা করতেপারতেছি না। তার খাওয়াদাওয়ার একটু খোঁজ রাইখেন। আহ্লাদী তো, কেউ আদর কইরা না খাওয়াইলে সে খায় না।
বদরুল আলম চোখ মুছলেন।রেহনুমাকে হারানোর মতো তিনি আফিয়াকেও হারিয়ে ফেলেছেন। আফিয়ার অবস্হা দেখে তাঁর খুব কষ্ট হয়। তাঁর নিজের স্মৃতিতে রেহনুমা আছে। তাই তিনি মাঝে মাঝে কাঁদতে পারেন। বেচারী আফিয়া সেটাও পারে না।
শাম্মীর মতো কাউকে দেখলে আফিয়াখুব খুশি হয়। হাসিমুখে বলে, শুনেন, এই মেয়েটারে একটু মুখে তুইলা ভাত খাওয়ায়ে দিবেন ? এই মেয়েটা রেহনুমার মতো লক্ষী। দেখেন, ঠিক তার মতো কইরাই হাসতেছে। মাশাআল্লাহ !