ঝকঝকে সাদা কাপে ঘোর কৃষ্ণবর্ণের কফি, অসাধারণ সুবাস। কফিতে চুমুক দেয়ার আগে নাকের কাছে নিলেই মন সতেজ হয়ে যায়।
অনিমা কফিতে চুমুক দিলো। ডার্ক রোস্ট বীনের কফি, নিখাদ স্বাদে বানানো হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বাসায় বসে এই কফির স্বাদ নেয়া যাবে অনিমা কল্পনাও করেনি। ও যেই ড্রইংরুমে বসে আছে সেটা দেখার মতো। চারদিকে দেশীয় ঐতিহ্য আর শিল্পের শান্ত স্নিগ্ধ ছোঁয়া। বেতের সোফা, দেয়ালে হালকা রঙ, ছোট ছোট টবে রাখা ঘরোয়া গাছ আর ফুল। সোফার কুশন থেকে নিয়ে দেয়ালের পেইন্টিং, মেঝের মাদুর, মাটির ডেকোরেশন পিস আর ডিভাইডারের নকশী কাঁথার সবটা জুড়ে বাংলাদেশ। এসবের মাঝে কফির স্বাদ একেবারেই একটা ভিন্নতা ... তবুও অনিমার ভালো লাগছে।
এই বাসায় অনিমার আসার কথা না, কিন্তু ওকে আসতে হয়েছে। এটা আকরামের বাসা। আকরামের সাথে অনিমার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। অনিমার ধারণা ওর বাবা ইরফান হাবিব বেশ আগে থেকেই এই পরিকল্পনা করছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী অনিমাকে দেশে বেড়াতে আসতে বলা হয়েছে। আকরামের সাথে প্রথম দেখা করানো হয়েছে একটা শপিং মলে, আর তার দুদিন পর আরেকবার দেখা করানো হয়েছে একটা রেস্টুরেন্টে। অনিমা সেখানেই বিয়ের জন্য না করে দিয়েছিলো। কিন্তু বাবার অনুরোধে আজকে আকরামের বাসায় আসতে হয়েছে।
বিয়ে নিয়ে অনিমার এখন কোনো ভাবনা নেই। বাংলাদেশের ছেলেকে বিয়ে করা তো সম্ভবই না। কেভিনের সাথে অনিমার ডিভোর্স হয়েছে সাত বছর আগে। চার বছরের সেই সংসারে কেভিনের সাথে অনিমার একমাত্র ছেলে এ্যারন। ছেলেটাকে নিয়ে অনিমা ভালোই আছে। নতুন করে ঘর-সংসার করার কোনো ইচ্ছেই ওর হয় না। কিন্তু ইরফান হাবিব প্রায়ই বিয়ের কথা বলেন। এ্যারনের কথা তুলে ছেলেমানুষী ভঙ্গীতে বলেন, আমার একটা মাত্র নাতি, বাংলা বলে না। ঘরে একটা বাঙ্গালী ছেলে থাকলে এমন হতো না।
ইরফান হাবিবের বেশীরভাগ কথা শুনে অনিমা নীরব থাকে। ওকে নীরব দেখলে তিনি আরো উত্সাহ নিয়ে বলেন, শুনো মা, আমি বুঝলাম তোমার জীবনে একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। সেটা আল্লাহর মর্জি। এখন তুমি একটা দেশী ছেলেকে বিয়ে করো, নতুন করে সব শুরু করো।
- আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না বাবা ...
- কিন্তু এসব নিয়ে তো ভাবতে হবে মা। তোমার মা বেঁচে নাই, তাই আমাকেই এসব বলতে হবে। তোমার ভালোমন্দ আমি না দেখলে আর কে দেখবে বলো ?
- আমার ভালোমন্দ কাউকে দেখতে হবে না।
- একা একা থাকলে এমন জেদ হয় মা। তুমি জেদ করে নিজেরটাই ভাবছো, এ্যারনের ব্যাপারে ভাবছো না ... এ্যারনের একজন বাবা দরকার। বাবা ছাড়া ছেলেটা মানুষ হবে কিভাবে ? আর ওর বাবা তো ভালোমানুষ ছিলো না ... এখন দেশী সংস্কারে বড় হলে ছেলেটা মানুষ হবে। নইলে এই দেশে বড় হলে সে তার বাবার মতো অমানুষ হবে ...
কথোপকথনের এই পর্যায়ে অনিমাকে দূরে কোথাও সরে যেতে হয়। চার বছরে অনিমার জীবন আর জীবনবোধকে ভেঙেচুরে তছনছ করে চলে গেছে কেভিন। গ্র্যাড স্কুলের টপ স্টুডেন্ট, সম্ভ্রান্ত আইরিশ পরিবারের ছেলে, চমত্কার চাকরি করে। সুপুরুষ, এ্যাথলেট, শান্ত ভদ্র ব্যবহার। অনিমার সাথে মেলামেশা শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছিলো ... এরপর ভারজিনিয়ায় খুব ঘটা করে হলো ওদের বিয়ের অনুষ্ঠান। ওরা দুজন একই কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে সংসার শুরু করলো সাউথ ক্যারোলিনায়। স্বপ্নের মতো বাড়ি, ঘড়িধরা সপ্তাহের ব্যস্ততা, ছোট ছোট শখ, ইচ্ছে আর সুখের সময়।
কিন্তু এসবের মধ্যে হঠাত করেই কি যেন হয়ে গেলো। বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে কেভিন যখন তখন অনিমাকে জঘণ্য ভাষায় গালাগাল আর মারধোর করা শুরু করলো। শুরুটা হলো একদিনের সামান্য কথা কাটাকাটি থেকে। এরপর সেই অত্যাচার আর থামলো না। প্রথমদিকে অনিমা বোঝার চেষ্টা করতো। ওর মনে হতো কেভিন তর্ক পছন্দ করে না ... তাই তর্ক শুরু হলে ও নিজেই থেমে যেতো। তাতেও সেই অত্যাচার থামেনি। ঘরের ভেতরে যে কোনো কথাবার্তা শুরু হলেই কেভিনের মধ্যে কোথ্থেকে যেন একটা পশু ভর করতো। হাত-পায়ের পাশবিক অত্যাচারে মিশতো নোংরা গালাগালি, অশ্রাব্য আর চরম অপমানকর কথাবার্তা।
বিয়ের তিন বছরের মাথায় কেভিনকে ডমেস্টিক এবিউজ অপরাধের কারণে গ্রেফতার করা হলো। ওর বিরূদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগও ছিলো। অত্যাচারের সময় কেভিনের কর্কশ স্বরে বলা “ইউ ইন্ডিয়ান ফাকিং হোর, ইউ থিঙ্ক ইউ নো বেটার ? ইউ পিস অফ শীট ... ডোন্ট ফরগেট ইউ আর হেয়ার বিকজ অফ মি” এসব কথা অনিমার সাথে প্রতিবেশীরাও শুনে ফেলেছিলো। তারা পুলিশের কাছে সেই অত্যাচারের রিপোর্ট করেছিলো। অনিমা তখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট।
এরপর থেকে অনিমার জীবন এ্যারনকে নিয়েই কেটেছে। কেভিন এখন কোথায় সেটা ও জানে না, জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি। কেভিন অবশ্য হাল ছাড়েনি। জেইল থেকে বের হয়েই সে অনিমার ব্যাপারে কুত্সা রটানো শুরু করেছিলো। প্রথমে ওদের অফিসের কলিগদের কাছে, আর পরে সোশাল নেটওয়ার্কে। জঘণ্য, অশ্লীল সব মিথ্যা, বানোয়াট কথা ... ব্যক্তিগত বর্ণনা, একান্ত মুহূর্তের বিবরণ। এক পর্যায়ে অনিমা চাকরি বদল করে নিউইয়র্কে চলে গেলো, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।
এখন নিউইয়র্কের ছোট একটা এপার্টমেন্টে এ্যারন আর নিজের বাবাকে নিয়েই অনিমার জীবন। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে একটা সিঙ্গেল খাটে শুয়ে অনেক রাতই ওর নির্ঘুম কাটে। এমন একটা জীবনে নতুন করে কোনো পরিবর্তন আনতে এখন তাই ভয় হয়। সেই পরিবর্তনে বাংলাদেশের কাউকে সম্পৃক্ত করতে অনিমার আরো বেশী ভয়। ও যতোদূর জানে ডমেস্টিক আর সোশাল এবিউজ জাতীয় অপরাধ বাংলাদেশে খুবই সাধারণ ঘটনা। ঘরে ঘরে অত্যাচার হচ্ছে, যা সহ্য করা হচ্ছে নীরবে। আমেরিকার বাংলাদেশী কমিউনিটিতে হরহামেশা সোশাল হিউমিলিয়েশন হচ্ছে। ফেসবুকে গিবত, গুজব, কুত্সা, অপপ্রচার করে অপছন্দের মানুষকে হেয় করা হচ্ছে। এসবের সহজ শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মেয়েরা।
বহুদিন একা বিদেশে থাকার কারণে অনিমার মানসিকতার সাথে এখন বাংলাদেশের কারও মানসিকতার চট করে মিল হওয়াও সম্ভব না। কেভিনের সাথে অনেক মিল আর ভালোবাসার সংসারে যা ঘটেছে, তার পরে অমিল আর জোড়াতালির সংসারে কি ঘটতে পারে সেটা অনুমান করা একেবারেই কঠিন কিছু না। সেই অনুমানে ভয়ঙ্কর কোনো পরিণতির আশঙ্কাও খুব স্বাভাবিক।
আকরাম ড্রইংরুমে ঢুকে অনিমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আগের দুদিনে দেখা আকরামের সাথে এই মানুষটার সবটাতেই মিল আছে। আকরামের চেহারা বিশেষত্বহীন। শ্যামলা মুখমন্ডলে নিরাসক্ত একজোড়া চোখ, চাপা নাক আর ভাঙা চোয়াল। বেতের মতো একহাড়া গড়নের শরীর। অনিমার সামনের সোফায় বসে আকরাম বললো, কফি ভালো লেগেছে ? আপনি রেস্টুরেন্টে কালো কফি খেয়েছিলেন, তাই আমি দুধ চিনি ছাড়া কফি দিলাম।
- জ্বি, থ্যাংকস। আমি কালো কফিই খাই।
- আপনি খুব সম্ভবত এখানে আসতে চান নাই। এসে নিশ্চই বিরক্তবোধ করছেন ?
অনিমা সহজ স্বরে বললো, বিরক্ত না ... তবে আমার এখানে আসার কোনো ইচ্ছা ছিলো না। বাবার অনুরোধে আসতে হয়েছে। আমি বাবাকে বলেছি যে এই বিয়েতে আমার মত নাই। তারপরও বাবা কেন আমাকে এখানে আসতে বললেন আমি জানি না।
- তিনি মুরুব্বী মানুষ, ভেবেছিলেন ঘরের পরিবেশে আলাপ হলে আপনি হয় তো বিয়ের ব্যাপারটা আরেকবার বিবেচনা করবেন।
অনিমা খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো। এই মানুষের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে যে অনিমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তার ভালোই আগ্রহ আছে। এসব কথাবার্তা চলতে থাকলে সেই আগ্রহের কারণগুলোও বের হয়ে আসবে। সেই লাইনে কথা শুরু হলে আলোচনা দীর্ঘ হবে। এরপর সেই দীর্ঘ আলোচনা একটা ইস্যু হবে। ইরফান হাবিব তখন হয় তো বলবেন, কথাবার্তা তো হয়েছেই, বিয়ে হতে সমস্যা কোথায় ?
সেরকম কোনো সুযোগ সৃষ্টি হতে দেয়াটা ঠিক হবে না ... তার আগেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। অনিমা শান্ত স্বরে বললো, আমাকে উঠতে হবে। বাবার অনুরোধ রাখার জন্য এসেছিলাম। ঘরে বা বাইরে কোথাও আলাপ করে আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে না। সরি।
- ওহ ... জ্বি, আমি বুঝতে পেরেছি।
অনিমা একটু অস্বস্তিবোধ করলো। রেস্টুরেন্টে এই মানুষটার সাথে পনেরো-বিশ মিনিট কথা হয়েছিলো। বেশীরভাগ কথা অনিমাই বলেছে ... ওর ডিভোর্স, বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ, এসবের প্রায় সবটাই। এই মানুষটার ব্যাপারে তেমন কিছু জানা হয়নি। মানুষটাকে কথা বলার কোনো সুযোগই দেয়া হয়নি। সেটা একটা অভদ্রতা ছিলো। এখন ঝট করে উঠে চলে গেলে সেই একই অভদ্রতা হবে।
আকরামের হাবভাবে অবশ্য কোনো জড়তা নেই। অনিমা এখন উঠে চলে গেলে সে কিছু মনে করবে বলে মনে হয় না। তবুও অনিমা বললো, আমি খুব সরি ... আমি আসলে আপনাকে কথা বলতে দেই নাই। এই বিয়েতে আমার কখনোই মত ছিলো না ... তাই আপনি কি ভাবছেন আমি সেটা জানার কোনো প্রয়োজন বোধ করি নাই। সেটা ঠিক হয় নাই। আপনার কথা আমার শোনা উচিত। আমার হাতে মিনিট দশেক সময় আছে, আমি বসছি। আপনি যদি কিছু বলতে চান বলতে পারেন।
- আমার ড্রইংরুম কেমন লাগলো ?
- খুব সুন্দর। আপনার রুচি খুবই ভালো।
আকরাম মৃদু স্বরে বললো, এই ড্রইংরুমের সাজসজ্জা সালমার মায়ের করা। তিনি যেভাবে সাজিয়েছিলেন আমি সেভাবেই রেখেছি।
অনিমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, সালমা কি আপনার মেয়ে ?
- জ্বি। ও এখন স্কুলে ... বাসায় থাকলে আপনার সাথে দেখা করতো।
- সালমার মা ... তিনি কোথায় ?
- তিনি জার্মানীতে থাকেন। বিয়ে করেছেন। সেখানে সংসার নিয়ে থাকেন।
- ওহ, আচ্ছা। আপনাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিলো কবে ?
- তিন বছর আগে। তাঁর সাথে আমার আট বছরের সংসার ছিলো, কিন্তু মনের মিল ছিলো না। তিনি আমার সাথে সুখী ছিলেন না।
অনিমা কিছু বললো না। কথোপকথনের এই পর্যায়ে চুপ করে থাকা উচিত। এরপরের প্রশ্ন বা কথাবার্তা খুবই ব্যক্তিগত পর্যায়ের। যার সাথে আর পাঁচ মিনিটের কথোপকথন বাকি, তার সাথে এতো গভীরের আলোচনা করার কোনো মানে হয় না। তবে মানুষটার একটা ব্যাপার অনিমার খুবই ভালো লেগেছে। মানুষটা তার প্রাক্তন স্ত্রীকে আপনি করে সম্বোধন করছে। আট বছরের বিবাদের সংসারে নিশ্চই তাদের সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা ছিলো না। অনেক ঘৃণা থেকে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। কিন্তু এসবের পরেও মানুষটা অপরিচিত একজনের সামনে প্রাক্তন স্ত্রীকে সন্মান দিয়ে কথা বলছে। হয় তো পারিবারিক শিষ্টাচার থেকে এমন হয়েছে। অথবা মানুষটার মনটা ভালো। কেভিনও ভালো পরিবারের সন্তান ছিলো। কিন্তু পারিবারিক শিষ্টাচারের কিছুই তার মধ্যে ছিলো না।
আকরাম হালকা স্বরে বললো, আমি জানি আপনি এই বিয়েতে আগ্রহী না। কিন্তু আপনাকে আমার ভালো লেগেছে। আমি নিজেই আপনার বাবাকে অনুরোধ করেছিলাম যেন তিনি আপনাকে আজকে আমার বাসায় আসতে বলেন। আপনি কিছু মনে করবেন না।
- আমি কিছু মনে করি নাই। আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী, তাই আপনি আরেকবার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করায় কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু এতো অল্প দেখায় আপনি কেন বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে গেলেন সেটা আমি জানি না।
- আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে আপনি খুব ভালো মনের মানুষ।
- থ্যাংকস। আমাকে এখন উঠতে হবে। আপনার সাথে পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। সালমাকে আমার শুভেচ্ছা ও আদর দিবেন।
অনিমা উঠে দাঁড়ালো। ওর সাথে আকরামও উঠে দাঁড়িয়েছে। আকরাম হালকা স্বরে বললো, যদি কোনোদিন আপনার মত বদলায়, আমার কথা কি আপনি মনে করবেন ?
আকরাম শান্ত দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই প্রশ্নের উত্তর আশা করছে। অনিমা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য না। এমন প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই। অনিমা অল্প হেসে বললো, আমি ভবিষ্যত বলতে পারি না। যদি পারতাম, তাহলে আপনার সাথে আমার আজকে এই অবস্হায় এসব নিয়ে আলোচনা হতো না।
- আপনার একটা ছেলে আছে, তাই না ?
- জ্বি, ওর নাম এ্যারন।
আকরাম থেমে থেমে বললো, মায়ের আদর ছাড়া আমার মেয়েটা অনেক কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। জন্ম থেকেই সে তার মায়ের আদর পায় নাই। আপনি একজন মা ... আপনি তাকে মায়ের আদর দিতে পারবেন।
অনিমা সহজ স্বরে বললো, শুধু মেয়ের কারণে আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী ? আপনার মেয়েকে মায়ের আদর তো অনেকেই দিতে পারবে।
- আপনার মতো করে কেউ পারবে না ... জানি না কেন আমার এমন মনে হচ্ছে। আপনি খুব নরম মনের মানুষ। আপনার মধ্যে কোনো জটিলতা নাই।
- থ্যাংকস .... কিন্তু আমার পক্ষে এই বিয়েতে রাজি হওয়া সম্ভব না। তবে আপনি একজন ভালোমানুষ ... নিশ্চই আপনার ভালো বিয়ে হবে।
আকরাম কাঁপা কণ্ঠে বললো, জানি না। আপনার মতো আমারও বিয়ে নিয়ে ভয় আছে ...
- প্লিজ ... এভাবে ভেঙে পড়বেন না। ডোন্ট মেক ইট ডিফিকাল্ট ফর মি।
- অনিমা, আমি চেষ্টা করেছি যেন মা-কে নিয়ে আমার মেয়ের মনে কোনো ঘৃণা না থাকে। ওর মা আমাকে ভালোবাসেন নাই। তিনি অন্য একজনকে ভালোবাসতেন ... পরিবারের চাপে পড়ে আমাকে বিয়ে করেছিলেন। সেটা তাঁর দোষ ছিলো না। কিন্তু এসব কথা আমার মেয়ে জানে না। সে শুধু জানে তার মায়ের সাথে আমার বনিবনা হয় নাই। তার মায়ের ভালো দিক দেখানোর জন্য আমি এই সাজানো ঘরে কোনো পরিবর্তন করি নাই। তাঁর সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা আমি আমার মেয়েকে বলি নাই। কাউকে বলি নাই। কিন্তু আমার মেয়েটা এখন বড় হচ্ছে ... আমি জানি না কয়দিন আমি এভাবে তাকে বুঝাতে পারবো। আমার ভয় হয় যে এভাবে থাকতে থাকতে হয় তো আমার মেয়েটার মনে প্রেম, ভালোবাসা বা বিয়ে নিয়ে কোনো ঘৃণার জন্ম হবে ...
- আপনি ধৈর্য্য ধরেন ... সব ঠিক হয়ে যাবে।
- আপনি বিশ্বাস করেন যে সব ঠিক হয়ে যাবে ?
অনিমা সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। এই মুহূর্তে ওর মনের ভেতরে অনেকগুলো নতুন প্রশ্ন খেলা করছে। এতো প্রশ্নের মাঝে আকরামের প্রশ্ন নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আকরাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হালকা স্বরে বললো, আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে। সরি।
গাড়িতে উঠে অনিমার মনে হলো ও খুব ক্লান্ত। বাইরে চনমনে রোদ। গাড়ির ভেতরে এসির ঠান্ডা ভাব। অনিমা চোখ বন্ধ করে ক্লান্তির কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করলো। মনের ভেতরে অনেকগুলো ভাবনা জট পাকিয়ে আছে। খেয়ালগুলো ছুটোছুটি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভাবনার জটের কারণে তারা মুক্তি পাচ্ছে না। জীবনের ডাক শুনে অপমানের স্মৃতিরা কপটহাস্যে লুটোপুটি খাচ্ছে। কান্নাহাসির মিশালের এই স্যাটায়ার অনিমার অনেক নির্ঘুম রাত আর নিউইয়র্কের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের অলস সময়ের সঙ্গী। সেই স্যাটায়ারে এখন আকরামকে নিয়ে নতুন ভাবনাটা জুড়ে গেছে। এসব অনুভূতি হয় তো মনের ভেতরে প্রচ্ছন্ন অবসাদের সৃষ্টি করেছে।
ফোন বাজছে। ইরফান হাবিব ফোন করেছেন। অনিমা ফোন ধরলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ইরফান হাবিব বললেন, কেমন আছো মা ?
- ভালো না বাবা। আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
ইরফান হাবিব সহজ স্বরে বললেন, তোমার জীবনের ক্লান্তি আমার অচেনা না রে মা।
- বাবা আমি সরি ... আমি এভাবে বিয়ে করতে পারবো না। এখন আমি বাসায় ফিরছি। কালকে ভোরের ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ফিরে আসছি। বাকি কথা এসে বলবো।
- আকরামকে তোমার ভালো লাগে নাই মা ?
- আমি সেভাবে ভাবছি না বাবা ... আমার পক্ষে হয় তো কোনোদিনই সেভাবে ভাবা সম্ভব না। এসব ভাবনা আমার কষ্টকে আরো বাড়াবে ... এতো কষ্ট আমি একা একা সহ্য করতে পারবো না। আমি ফোন রেখে দেই বাবা, প্লিজ ....
- তুমি কি কাঁদছো মা ?
অনিমা কিছু বললো না, ফোন ধরে চুপচাপ কাঁদতে থাকলো। বহুদিন পর দুচোখ ভেঙে কান্না আসছে। বুক হালকা লাগছে। এই অনুভূতির সাথে অনিমার পরিচয় নেই। নিউইয়র্কের নির্ঘুম রাতগুলোতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার সময় বুকের ভেতরটায় জমাট কান্নার একটা গোঙানী থাকে। সারাদিনের অবসাদের পর সেই গোঙানী চোখ পর্যন্ত আসার শক্তি বা সাহস পায় না। রাতের একাকীত্মে শুকনো চোখে মনে মনে কাঁদা জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। ঢাকার রোদেলা দুপুরের ব্যস্ত রাস্তায় গাড়িতে বসে হঠাতই অনিমার শাপমোচন হলো। বুকের জমাট কান্না গলে দুই চোখ ভাসিয়ে দিলো।
- অনেকদিন পর তুমি কাঁদছো মা।
- হ্যাঁ বাবা, অনেকদিন পর কাঁদছি। অনেক কষ্ট নিয়ে কাঁদছি। আমি তোমার কাছে কাঁদছি বাবা ... তোমার মেয়ে তোমার কাছে কাঁদতে পারবে না ?
- অবশ্যই পারবে। কষ্ট ছাড়া তো জীবন হয় না মা। কিন্তু জমাট কষ্টের দহনের চেয়ে তরল কষ্টের কান্না নিয়ে বেঁচে থাকা অনেক স্বস্তির। আমি চাই তুমি তরল কষ্ট নিয়ে তোমার স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদো। আমি চাই তোমার স্বামী তোমাকে সন্মান করুক, ভালোবাসুক, তোমার কান্নাকে অনুভব করুক। পৃথিবীর সব বাবাই সেটা চায়।
- মা বেঁচে থাকলে তিনিও কি আমাকে এই কথাই বলতেন ?
- অবশ্যই মা ... তিনি তো আরো সুন্দর করে বলতেন। এতো সুন্দর করে বলতেন যে তুমি সেই কথা শুনে কান্নাই ভুলে যেতে।
অনিমা চোখ মুছলো। এরপর ভেজা কণ্ঠে বললো, আমি দুটা দিন পরে আসি বাবা ? তুমি কি আর দুটা দিন একা থাকতে পারবে ?
- তোমার যতোদিন ইচ্ছা তুমি দেশে থাকো মা। এখন তুমি গাড়ি ঘুরিয়ে আকরামের বাসায় যাও। ওর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলো।
অনিমা ফোন রেখে ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরাতে বললো। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। গাড়ি, রিকশা, সিএনজি, বাস, ট্রাক সব একসাথে মিলে জট পাকিয়ে আছে। এর মধ্যে কারও গন্তব্য বা দিক পরিবর্তন একেবারেই সহজ হবে না। এই জ্যামে যে-ই তেমন কিছু করতে চাচ্ছে তার উপর বাকিরা সবাই বিরক্ত হচ্ছে। তাকে হর্ণ দিচ্ছে বা কথা শোনাচ্ছে। কিন্তু এসবের পরেও অনেকেই অন্য কোনোদিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
অনিমার মনের ভেতর ভাবনার জটের মধ্যে হঠাত চন্চল হয়ে যাওয়া খেয়ালগুলো ঠিক তেমন করেই দিক বদলানোর চেষ্টায় আছে। তাদেরকে ঘিরে হাজার প্রশ্ন। তবুও খেয়ালরা আজ বেপরোয়া আচরণ করছে। চোখ ভেঙে আসা কান্নায় তারা মুক্তির ঘ্রাণ পেয়ে গেছে।
কে বলে চোখের পানির ঘ্রাণ নেই!