দোতলায় উঠার জন্য সিঁড়িতে পা রাখবো হঠাৎ চোখে পড়লো যে নীচে ভাঁজ করা পাঁচশত টাকার নোট রয়েছে। তুলে দেখলাম যে ছয়টা পাঁচশত টাকার নোট। এখন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে। পলাশী মোড় থেকে হলের টিভি রুমের ভিতর দিয়ে পশ্চিম দিকে এসে দোতলার দক্ষিণ-পশ্চিম কর্নারের দিকের রুমে ফিরছি।
যার টাকা তার কাছে টাকা ফেরত দেওয়া যায় কিভাবে? ফিরিয়ে না দিলে তো মৃত্যুর পরও তার কাছে হয়তো দায়ী থেকে যাবো। এ ধরণের বিষয়ের জন্য যেদিন পাকরাও করা হবে সেদিন তো পার পাওয়ার কোন উপায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কারো হারিয়ে যাওয়া কোন জিনিস পাওয়া গেলে দেখেছি যে হল গেটে নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে জিনিসের মালিককে উপযুক্ত প্রমাণ সহ জিনিসটি ফেরত নিয়ে যেতে বলা হয়। কিন্তু টাকার ব্যাপারে তো নোটিশ দেওয়া যাবে না।
রুমের সামনের প্রশস্ত বারান্দার রেলিং-এর সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলাম যে কি করা যায়?
এমন সময় বাথরুমের কাছে বারান্দায় টর্চ লাইটের আলো নিয়ে উত্তর দিক থেকে একজনকে হেঁটে এদিকে আসতে দেখে কপাল কুঁচকে গেল আমার। হলে তো কাউকে তেমন টর্চ জ্বালাতে দেখা যায় না! বাথরুম পেরিয়ে মোড় ঘুরে পূর্বে আমার দিকে এগিয়ে এল সে। দেখলাম অপরিচিত একজন বারান্দার দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজছে।
এতক্ষণ যে বিষয়টা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম তার ফয়সালা এত সহজেই হয়ে গেল! কিন্তু ঐ টাকা যে তারই তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি তার পিছন পিছন চললাম।
সে হলের গেট পার হয়ে বারান্দা ধরে পশ্চিম দিকে অনেক দূর ক্যান্টিনের কাছে চলে গেল। তারপর ক্যান্টিনের সামনের মাঠের মধ্যে নেমে এল। দূর্বা ঘাসের উপরে খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো।
এবার নিশ্চিত হলাম যে তার কিছু হারিয়েছে। তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, আপনি কি কিছু খুঁজছেন?
সে বললো, হ্যাঁ, আমার টাকা হারিয়েছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কত টাকা?
সে বললো, তিন হাজার টাকা।
আমি জানতে চাইলাম, কত টাকার এবং কতগুলো নোট ছিল?
সে বললো, ছয়টা পাঁচশত টাকার নোট।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় হারিয়েছে?
সে বললো, এদিক থেকে দোতলায় পশ্চিমের একটা রুমে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় হারিয়েছে তা বলতে পারছি না।
হেসে বললাম, টাকাটা আমি দোতলায় উঠার সিঁড়ির কাছে পেয়েছি।
সে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো, আপনি পেয়েছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
পকেট থেকে ঐ টাকা বের করলাম। সে টাকার দিকে তাকালো। আমি তার হাতে তা দিলাম।
সে খুব খুশী হয়ে বললো, আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। আজই বাড়ি থেকে এসেছি। টাকাটা না পেলে খুব সমস্যা হত আমার। আল্লাহ্ই আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি আমার বড় ধরণের উপকার করলেন। ভাই, চলুন। আপনাকে কিছু খাওয়াবো।
আমি বললাম, খাবো, তবে আজ নয়। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সে পলাশী মোড়ের দোকানের দিকে ইঙ্গিত করে বললো, প্লিজ, এখনই চলুন না।
আমি বললাম, আমি এখন আমার বোনের বাসায় যাবো, ভাই। ঠিক আছে, আরেকদিন খাবো।
আমার ভাগ্নে শাতিলদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বেশিরভাগ সময় আমি ওখানে গিয়ে খেয়ে আসি।
পশ্চিম পার্শ্বের জহুরুল হক হলের ভিতর দিয়ে স্যার এ. এফ. রহমান হলের সামনে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির উল্টো পাশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলক্ষেতের নিকটবর্তী আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। এখানে এক অফিসারের বাসায় আমার একমাত্র বোন এবং একমাত্র ভাগ্নে সাব-লেট থাকে।
দেখলাম, একজন শাড়ি পরিহিতা মহিলা আর সালোয়ার কামিজ পরিহিতা একজন যুবতী মেয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। দুইজনের মাথায়ই ঘোমটা দেওয়া। মেয়েটি স্লিম ফিগারের কিন্তু তার স্বাস্থ্য ভালো এবং বেশ লম্বা। এত ফর্শা যে এখানে রাতের সামান্য অন্ধকারের মধ্যেও তার মুখটাকে একটা আলোর দলার মত মনে হলো। সেই আলোয় আমার চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল।
শাতিল ঢাকা কলেজে এইচ. এস. সি. ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সে ক্লাস নাইনে পড়াকালীন দুলাভাই হার্ট এটাক করে মারা গেছেন। পাবনা শহরে তাদের বাড়ি। দুইজন এক জায়গায় থাকলে তারা মানসিক দিক দিয়ে একটু কম কষ্টে থাকবে বলে তাদেরকে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে দেওয়া হয়েছে। রান্না ঘরের পাশের একটা ছোট রুমে তারা থাকে।
ওখান থেকে এসে জহুরুল হক হলের লন্ড্রির কাছে গেলাম। আমার এম. কম. পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তাই ওখানকার একটা রুমে ভাড়া দিয়ে থাকার জায়গা ঠিক করেছি। আগামীকাল জিনিসপত্র নিয়ে ওখানে চলে আসার ব্যাপারে কথা বললাম।
পরদিন সকালে ওখানে উঠে গেলাম।
দুপুরে আপার ওখানে যেতে আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখলাম যে কালো বোরখা পরিহিতা এক মেয়ে বাইরের দিকে যাচ্ছে। পায়ে সুন্দর স্যান্ডাল। মুখ ঢাকা। শুধু চোখ দুটো অনাবৃত। পাশ কাটানোর সময় তার দিকে তাকাতেই দেখলাম সেও আমার দিকে তাকিয়েছে। তার বোকা হরিণ চোখ খুব সুন্দর। তার উচ্চতা এবং গায়ের রং দেখে মনে প্রশ্ন জাগলো যে গতকাল রাতে যাকে দেখেছিলাম সে নয় তো? আমি পিছন দিকে তাকিয়ে তার হাঁটার ধরণটা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম যে সেই।
বাসায় গেলে আপা বললেন, তোর বায়োডাটাটা দিস তো।
আমি বললাম, কেন?
আপা বললেন, চাকরির জন্য আমার কলেজ জীবনের এক বন্ধুর কাছে দিব। সে একটা প্রতিষ্ঠানের জি. এম.।
আমি এখনও বাবার পাঠানো টাকায়ই চলছি। ভার্সিটিতে ভর্তির পরই তিনি হাই স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। তখন থেকেই তিনি চিঠিতে জানিয়ে আসছেন “আমার কিন্তু এখন আর চাকরি নেই”। তাই বাবাকে টাকা পাঠানোর হাত থেকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন।
বায়োডাটা দিলাম। কয়েকদিন পর আপা আমাকে একটা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ এর মিরপুর এগার নাম্বারের ঠিকানা দিয়ে আমাকে সেখানে যেতে বললেন।
মিরপুর এগার নাম্বারে পৌঁছে পূর্বদিকে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার দক্ষিণ পাশে বিশ তলা বিশাল ভবনটা চোখে পড়লো। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। কারণ কাছে বেশি টাকা নেই।
এক শিশু মেয়ে কচি হাত বাড়িয়ে বললো, স্যার, সকাল থেকে এ পর্যন্ত কিছু খাইনি। কয়টা টাকা দিবেন?
মায়া ভরা মুখ। ঘাড় সমান এলোমেলো চুল। বয়স ছয়/সাত বছর হবে। মেয়েটার সাথে বছর চারেক বয়সের এক ছেলেও আছে। সেও যেন বলছে, হ্যাঁ স্যার দেন, না বলবেন না। খুব খিদে পেয়েছে।
দুই মাসুম ছেলে-মেয়ে হয়তো ভাই-বোন। ভাবলাম, এদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত মাড়িয়ে চাকরির চেষ্টায় এগিয়ে গেলে চাকরিটা তো আল্লাহ্ আমাকে দান নাও করতে পারেন। কারণ আল্লাহ্ তো বিষয়টা দেখছেন। পকেটে যে টাকা ছিল তা মেয়েটার হাতে দিলাম। ওদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
ভবনটাতে পৌঁছার পর পিয়ন আমাকে এক জায়গায় বসতে দিল। অনেক সময় অপেক্ষা করার পর এক লোকের কাছে নিয়ে গেল। শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, কম্পিউটার জানি কিনা ইত্যাদি তিনি জিজ্ঞেস করলেন। মার্চেন্ডাইজিং, প্রোডাকশন, প্রশাসন এগুলোর মধ্যে কোন সাইড আমার পছন্দ সেটাও জেনে নিলেন। লিখিত পরীক্ষা এবং কম্পিউটার পরীক্ষা নেওয়া হলো। তারপর বলা হলো যে কয়েকদিন পর ফলাফল জানানো হবে।
বাইরে বের হতেই বুকের ভিতরে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। পকেটে তো টাকা নেই! শার্ট আর প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগলাম যে কিছু টাকা থাকতেও তো পারে! কিন্তু দেখলাম কয়েকটা এক টাকার কয়েন আছে মাত্র। হাঁটা শুরু করলাম।
এগার নাম্বার বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখলাম গুলিস্তানমুখী কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। শেষের দিকের গাড়িগুলি প্রায় খালি। কিন্তু আমার পকেটও তো খালি। গাড়িতে উঠলে ভাড়া দিতে না পারলে তো অপমানিত হতে হবে।
রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম। হাঁটতে শুরু করলাম। একসময় মিরপুর দশ নাম্বার গোল চক্কর পৌঁছে গেলাম। রাস্তা পার হয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম।
আগারগাঁওয়ের কাছাকাছি গিয়ে একটু অন্যদিকে তাকিয়েছি হঠাৎ সামান্য উঁচু হয়ে থাকা একটা ইটের সাথে বাম পায়ে শক্ত হোঁচট খেলাম। সামনের দিকে ঝুঁকে চার/পাঁচ কদম এগিয়ে গেলাম। রাস্তায় উপুড় হয়ে বুকে, মুখে আঘাত লাগতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারলাম। কিন্তু বুড়ো আঙ্গুলের নখের কাছে খুব ব্যথা অনুভুত হলো। সেইসাথে দেখলাম বাম পায়ের স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেছে। জুতা জোড়া বেশি পুরনো হয়ে যাওয়ায় স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই বের হয়েছিলাম।
লজ্জা লাগলেও ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম। একজন জুতা মেরামতকারীকে দেখলাম। সে জানালো যে সেলাই করলে পাঁচ টাকা আর কাঁটা মারলে দুই টাকা লাগবে। পকেট থেকে কয়েনগুলো বের করলাম। এক টাকার পাঁচটা কয়েন। লোকটাকে কাঁটা মারতে বললাম।
প্রায় বিকেল হয়ে গেছে। পেটের মধ্যে খিদেয় মোচড় দিয়ে উঠলো। একটা চায়ের স্টলে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেলাম। তারপর তিন টাকা দিয়ে এক কাপ চা খেলাম। আবার হাঁটা শুরু করলাম। এক দমে ফার্মগেট পৌঁছুলাম। তারপর কাওরান বাজার, সোনারগাঁও হোটেল হয়ে শাহবাগ গেলাম। আজিজ সুপার মার্কেটের ওখান দিয়ে কাঁটাবন হয়ে আপার বাসার দিকে গেলাম।
রাস্তায় কেউ ঘোরাঘুরি করছে, কেউ বা বসে গল্প করছে। হঠাৎ সেই মেয়েকে একটা গ্রুপের মধ্যে বসে থাকতে দেখলাম। তাকে দেখে মিরপুর এগার নাম্বার থেকে হেঁটে আসার কষ্টটা ভুলে গেলাম। সেখানে আপাও আছেন। তার মানে ঐ মেয়ের সাথে আপার আলাপও হয়? খুব রোমাঞ্চিত হলাম। লজ্জা লাগায় আপার সাথে কথা না বলেই আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
আপা বাসার চাবি এগিয়ে ধরে বললেন, বাসায় তালা দেওয়া আছে, চাবি নিয়ে যা, আমি আসছি।
তিন দিন পর আপা জানালেন যে এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে জুনিয়র মার্চেন্ডাইজার পদে জয়েন করতে বলা হয়েছে। আমি দেরী না করে পরদিনই জয়েন করলাম।
এক ছুটির দিন বিকালে আপার বাসায় যাওয়ার সময় দেখলাম আমার ভালো লাগা যুবতী হাঁটাহাঁটি করছে। মাথায় ওড়না। পিছনে ওড়নার ভিতরে বড় খোঁপা। সে ধীরে ধীরে হাঁটছে। কিন্তু হাঁটার সময় ঢেউয়ের মত সুন্দর ছন্দ শোভা পাচ্ছে।
একদিন আপার কাছ থেকে জেনে নিলাম যে তার নাম সুমাইয়া। আপার বাসার সামনের বিল্ডিং-এ তারা থাকে। ইডেন কলেজ থেকে অনার্স পরীক্ষা দিয়েছে। তার বাবা সেকশন অফিসার পদে চাকরি করেন। তারা দুই বোন দুই ভাই। সুমাইয়া-ই সবার বড়।
যখন টিএসসি, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, কিংবা নিঊ মার্কেটে ঘুরতে যাই তখন মনে হয় সে যদি আমার পাশে থাকতো তবে খুব শান্তি পেতাম। যখন পাবনায় বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠি তখন মনে হয় সে যদি আমার সাথে থাকতো তবে ভ্রমণটা চার ঘণ্টার না হয়ে চার মিনিটেই শেষ হয়ে যেত। মনে হয় তার মত সুন্দর মেয়েকে যদি আমাদের বাড়িতে স্থায়ীভাবে নিয়ে যেতে পারতাম তবে সবাই বলতো আমি একটা কাজের কাজ করেছি, আমাদের বাড়ির প্রতিটি মাটি কণা তার স্পর্শে ধন্য হয়ে যেত। ভাবলাম, সুমাইয়ার খোঁজ হয়তো বিয়ে করার বয়সী কোন ছেলে জানেই না। জানলে সে অন্যের হয়ে যেত।
তাই দেরী না করে আপাকে সুমাইয়ার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে অনুরোধ করলাম। একদিন সন্ধ্যার পর তিনি তাদের বাসায় গেলেন। আমি খুব উত্তেজনার মাঝে অপেক্ষায় রইলাম যে তারা আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে আমার উপায় কি হবে?
আপা ফিরে এলে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, খবর কি?
তিনি বললেন, সুমাইয়ার মা বলেছে, আপনার ভাই তো ভালো ছেলে। সুমাইয়ার বাবার সাথে কথা বলে আপনাদেরকে জানাবো।
আমি ভাবলাম, যাক, প্রস্তাব ফিরিয়ে তো দেয়নি!
আপার বাসায় যাতায়াতের সময় সুমাইয়াদের বাসার জানালা দিয়ে দেখা যায়। সুমাইয়াকে বিয়ে করতে চাই, এ কথা তো সুমাইয়ার কানে এতক্ষণ পৌঁছে গেছে। এটা ভেবে চলে আসার সময় লজ্জায় পা এবং শরীরের মধ্যে কাঁপুনি অনুভব করলাম।
প্রতিদিন রাতে আশায় বুক বেঁধে আপাকে জিজ্ঞেস করি, তারা কি কিছু জানিয়েছে?
আপা বলেন, না, জানায় নি।
আমি চুপচাপ দুশ্চিন্তার মাঝে বের হয়ে আসি। সিগারেট পানের অভ্যাস না থাকা সত্ত্বেও নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির ওখানকার দোকান থেকে সিগারেট কিনে পলাশী মোড়ের দিকের রাস্তায় ফুটপাত ধরে সোডিয়াম লাইটের নীচে নির্জনতায় হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানি আর দুশ্চিন্তা করি যে তারা যদি প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়!
প্রায় এক মাস পর অফিসে থাকাকালীন আপা ফোন করে বললেন, আজ সুমাইয়ার মা আমাদের বাসায় এসে জানিয়ে গেছেন যে মাস্টার্স পাশ করার পর তিনি তার মেয়ের বিয়ের কথা ভাববেন।
আপা আবার বললেন, দুঃখ করিস না। এর চেয়েও ভালো মেয়ে আমরা খুঁজে বের করবো।
সুমাইয়ার বাবা-মাকে খুব নির্দয় মনে হলো। আর সুমাইয়াকে নিষ্ঠুর লাগলো।
লজ্জায়, অপমানে আপার বাসায় কয়েকদিন গেলাম না। সপ্তাহ খানেক পর আপা আমার রুমে এলেন। অনেক বুঝিয়ে বাসায় যেতে বললেন।
যাতে সুমাইয়ার চোখে পড়তে না হয় সে জন্যে একদিন সন্ধ্যারও অনেকক্ষণ পর আপার বাসায় রওনা হলাম। আবাসিক এলাকার গেট দিয়ে ঢুকে চোরের মত মাথা নীচু করে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম সুমাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই চমকে উঠলাম। তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় সে বললো, একটু দাঁড়ান।
এই প্রথম সুমাইয়ার কন্ঠ শুনলাম। ওর কন্ঠ যে এত আকর্ষণীয় তা আমি কল্পনাও করি নি। ওর চেয়েও অনেক কম বয়সী মেয়েদের মত ওর কন্ঠ। সেই টানে আমি প্রায় দাঁড়িয়ে পড়েছি এমন সময় মনে পড়লো যে আমার ভালোবাসার মূল্য সে তো দেয় নি। কাজেই তার কথা শোনার আমার কি প্রয়োজন? তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম। তার পায়ের শব্দে বুঝলাম আমার পিছু পিছু কিছুটা পথ সে এল। আমি লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলাম। তারপর বুঝলাম সে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
বাসায় গিয়ে এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করলাম। যে আমার ভালোবাসাকে পায়ে দলেছে তাকে কিছুটা হতাশ করতে পেরেছি। মানে, সে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি পাত্তা দেই নি।
দুই দিন পর রাতে দেখলাম, সে রাস্তা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার সোজাসুজি হতেই সে উড়ে আসার মত দৌড়ে আমার কাছে এসে বললো, আপনার কাছে আমার খুব জরুরী প্রয়োজন আছে। প্লিজ, আমার কথাটা শুনুন।
আমি দাঁড়ালাম। সে আমার দিকে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি এটা?
সে বললো, আপনার কাছে লেখা আমার একটা চিঠি।
আমার ভিতরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। আমি চিঠিটা নিলাম।
দ্রুত খেয়ে আপার বাসা থেকে বের হয়ে রুমে চলে এলাম। তারপর কাঁপা হাতে চিঠির ভাঁজ খুললাম।
সুমাইয়া লিখেছেঃ
ভাইয়া,
ইদানিং আপনার দেখা তেমন পাওয়া যায় না। জানি, আপনি আমাদের উপর খুব মাইন্ড করেছেন। হয়তো ভেবেছেন যে আমরা অহংকারী, আপনাকে আমার উপযুক্ত মনে করি নি। আপনার ভুল ধারণা পাল্টানোর জন্য এই চিঠি লেখার অতীব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।
আমি রাজী না বলে বাবা-মা আমাকে রাজী করার চেষ্টায় ছিলেন। তাই ফলাফল জানাতে বিলম্ব হয়েছিল। আপনি আবার ভাববেন না যে আপনি আমার কাছে পছন্দনীয় নন। আসলে রাজী না হওয়ার অন্য কারণ আছে।
আমি ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হওয়ার পর একজন যুবক আমাদের বিল্ডিং-এ এসেছিল। একদিন বাইরে থেকে রিক্সা নিয়ে এসে খুচরা টাকা না থাকায় বিপত্তিতে পড়েছিলাম। তখন ওখান দিয়ে সে যাচ্ছিলো। আমার আপত্তি সত্ত্বেও সে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছিল। জেনেছিলাম, তার নাম রাশেদ। বাবা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দুবাই থাকেন। বাড়ি ঝিনাইদহ। সে ঢাকা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে। বোনের বাসায় এসেছে। তার দুলাভাই অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন।
এক সময় সে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। বলে যে ভবিষ্যতে আমাকে নিয়ে সে ঘর বাঁধতে চায়। তাকে ভালো মানুষই মনে হয়েছিল। তাই রাজী হয়েছিলাম।
সে আমাকে নিউ মার্কেটের পিছনে তার বন্ধুর মেসে কিংবা অন্য জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইলে আমি না গেলে সে দূরে সরে যেতে পারে আশঙ্কায় আপত্তি করতাম না।
এক সময় একটা বিষয় টের পেয়ে আমার আত্মা কেঁপে উঠেছিল। রাশেদ আমাকে নিয়ে এক ক্লিনিকে যেতে চেয়েছিল। অন্যথায় সে আমাকে বিয়ে করবে না বলেছিল। ওর কথা মত কাজ করেছিলাম।
বাবা-মা এই সম্পর্কের কথা জানতে পারলেন। তারা রক্ষণশীল হলেও সম্পর্ক মেনে নিলেন। কিন্তু ওভাবে চললে মানুষ খারাপ বলবে বলে বিয়ের সিন্ধান্ত নিয়েছিলেন।
বাবা-মা রাশেদের বোনের বাসায় গিয়েছিলেন কথা বলতে। তার দুলাভাই যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ ছিল, রাশেদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশ থাকেন। অন্যদিকে আমার দাদা ছিলেন সামান্য একজন পিয়ন। বর্তমানে আমাদের কোন বাড়িই নেই। এ রকম পরিবারে রাশেদের বাবা ছেলেকে বিয়ে করাতে রাজী হবেন না। লজ্জায়, ঘৃণায় ভেবেছিলাম নিজেকে শেষ করে দেব। কিন্তু বাবা-মা ও ছোট ভাই-বোনরা কষ্ট পাবে এবং আত্মহত্যা মহাপাপ ভেবে তা পারি নি।
এরপর কয়েক জায়গা থেকে আমার বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু একজন পুরুষ বউ হিসাবে একজন নিষ্পাপ মেয়েকেই পেতে চায়। তাই আমি যদি কারো বউ হই তবে একজন নিষ্পাপ বউ পাওয়া থেকে তাকে বঞ্চিত করা হবে। এত বড় প্রতারণা কিভাবে করি বলুন! বাবা-মাকে বলেছি যে পড়াশোনা শেষ না করে বিয়ে করবো না। এরপর বলবো যে চাকরি না পেলে বিয়ে করবো না। কিন্তু তারপর কি বলবো তা নিজেই জানি না।
আপনি আমার অতীত জানলে আমাকে ঘৃণা করবেন। তখন যে দুঃখ পাবেন তা দেখে নিদারূণ কষ্ট পাবো। কিন্তু সেই কষ্টের চেয়ে একা থাকার কষ্ট ভালো। আদরের ভাই-বোনদের যে দিন বিয়ের সময় হবে সে দিন আমার জন্য তাদের বিয়ে আটকে থাকবে। আমি তাদের পথের কাঁটা হবো। তখন যে কি করবো তা নিয়ে খূব দুর্ভাবনা হয়।
আপনার সুখী ভবিষ্যৎ জীবন কামনায়-
সুমাইয়া
লোক ঠকানোটা যেখানে মানুষের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজের জীবনকে সুন্দর করার জন্য প্রতারণা ও চালাকি করাটাই বাহবা কুড়ানোর মত কাজ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেখানে এক দুষ্টু ভ্রমর একটি ফুলের উপরে একদিন বসার সুযোগ পেয়েছিল বলে এভাবে অভিমানে একদিন ফুলটি শুকিয়ে মাটিতে ঝরে পড়বে?
কারো পাপ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ্ই তাকে ধ্বংস করে দেন। কাজেই আল্লাহ্ যখন সুমাইয়াকে ধ্বংস করে দেন নি এবং সুমাইয়াও নিজেকে ঘৃণিত ভাবে তখন পৃথিবীর সব মানব-মানবী তাকে খারাপ মেয়ে মনে করলেও আমি মনে করি যে সে এক নিষ্পাপ মেয়ে।
কয়েকদিন সুমাইয়ার দেখা পেলাম না।
একদিন একটু তাড়াতাড়ি করে আপার বাসায় রওনা হলাম। গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখলাম সুমাইয়া। সে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। আমি বললাম, শুনুন।
সে কিছু না বলে আগাতে লাগলো।
আমি বললাম, আপনার ডাকে আমি সেদিন দাঁড়িয়েছিলাম। আর আপনি আমার কথা শুনবেন না?
এবার সে দাঁড়ালো।
আমি বললাম, আপনার সাথে আমার খুব দরকারি কথা আছে। অনুরোধ করছি, আগামীকাল বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাছে প্লিজ আসবেন।
সে ওড়নায় মুখ ঢেকেই বললো, আসবো। কিন্তু আপনি আমার বড় বলে আমাকে আপনি করে বলতে পারবেন না।
সে সময় দিতে রাজী হওয়ায় খুব খুশী হয়ে বললাম, তাহলে কি বলবো?
সে বললো, আপনি ছাড়া আর যা আছে তাই বলবেন।
আমি বললাম, বলবো।
পরদিন পাঁচটার দিকে শহীদ মিনারের ওখানে গিয়ে দেখলাম, সুমাইয়া পশ্চিম পাশে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে কালো বোরখা পরেছে। মাথায় খয়েরী রং-এর ওড়না। দুই হাত বুক ও পেটের মাঝখানে আটকানো।
চুপচাপ কিছু মুহূর্ত কেটে গেল। তারপর সুমাইয়াকে বললাম, আমার মন থেকে তোমার স্থানচ্যুতি ঘটেনি। বরং তোমার অবস্থান আরো সুদৃঢ় হয়েছে।
সুমাইয়া বললো, কিন্তু আমার অজড় সত্ত্বা আমার জড় ও জৈবিক অস্তিত্বকে ঘৃণা করে। আপনার ডাকে আমার দ্বিতীয় ও শেষ সত্ত্বা সাড়া দিতে চাইলেও বিবেকের সায় পাচ্ছি না।
আমি বললাম, তোমাকে ছাড়া জীবনের পথ অতিক্রম করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
সুমাইয়া বললো, হীনমন্যতার কারণে আপনার সহযাত্রী হয়ে চলতে গিয়ে আমার গতি শ্লথ হয়ে যাবে। শেষে আমি আপনার বাড়তি বোঝাস্বরূপ হবো।
আমি বললাম, আমার উষ্ণতা দিয়ে তোমার হীনমন্যতাকে বাষ্পাকারে উড়িয়ে দেব।
সুমাইয়া বললো, সেই বাষ্প যদি আপনার নিশ্বাসের সাথে ঢুকে আপনার মনেও ঘৃণার জন্ম দেয়?
আমি হাত নেড়ে জোড় দিয়ে বললাম, কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমার মন যে কল্পনা করেছে তা বাস্তব রূপ না পেলে আমার অস্থির মন শান্ত হচ্ছে না তো!
সুমাইয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর বললো, ঠিক আছে, কল্পনার বাস্তব রূপায়নে আমি চেষ্টা করবো, কথা দিচ্ছি। কিন্তু আমাকে কয়েকটা দিন সময় দিতে হবে। এবার হলো তো?
আমি বললাম, না হয় নি। আমার সাথে তুমি যদি যাও তাহলে হবে।
সুমাইয়া অবাক হয়ে বললো, কোথায়?
আমি বললাম, এই ধরো, এখান থেকে রিক্সায় উঠবো। তারপর দোয়েল চত্বর হয়ে শিশু পার্ক অতিক্রম করে শাহবাগ ও কাঁটাবন হয়ে নীলক্ষেত পর্যন্ত।
সে ছলছলে চোখে শুকনো হাসি হেসে বললো, আচ্ছা, যাচ্ছি।
আমরা রিক্সায় উঠলাম। সুমাইয়ার শরীর থেকে প্রসাধনীর গন্ধ আমার নাকে এল। আমি তার দিকে তাকালাম। সে মন মরা হয়ে বসে আছে দেখে অবাক হলাম।
নীলক্ষেতের কাছে গিয়ে আমি রিক্সা থেকে নামলাম। বিদায় নেওয়ার সময় সে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে রিক্সা নিয়ে দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুদিন পর আপা বললেন, সুমাইয়াকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি প্রচণ্ডভাবে আশ্চর্য হয়ে বললাম, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে?
আপা বললেন, গত শুক্রবারে সে গাজীপুরে টাকশালে চাকরির জন্য লিখিত পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। তারপর আর ফিরে আসে নি।
আমি গাজীপুর গেলাম। অনেক চেষ্টা করে জানতে পারলাম যে সুমাইয়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু এর বেশী কিছু জানতে পারলাম না।
সুমাইয়াকে কি আর খুঁজে পাবো না? সে তো আমাকে বলেছিল, কল্পনার বাস্তব রূপায়নে আমি চেষ্টা করবো, কথা দিচ্ছি।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।