রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে স্মৃতিফলক ও শহীদ মিনার
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল, সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে ঘটেছিল ইতিহাসের এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড; যা 'খাপড়া ওয়ার্ড হত্যা' নামে পরিচিত। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর দ্বিতীয় প্রাচীর ঘেরা ওয়ার্ড। মানে, কারাগারের ভেতর কারাগার যাকে বলে! চতুষ্কোণাকৃতির বেশ বড়সড় ঘর। সেই ঘরে ছিল টালির ছাউনি। রাজশাহীর আঞ্চলিক ভাষায় এই ছাউনিকে বলে, 'খাপড়া'। খাপড়া ওয়ার্ডে সে সময় বন্দির সংখ্যা ছিল ৪১। তাদের মধ্যে দুজন ছাড়া অন্যরা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও কর্মী।
দ্বিজাতিতত্ত্বের 'শুভঙ্করের ফাঁকি'তে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সৃষ্টির ভেতরই নিহিত ছিল বাঙালি জাতির শোষণ-বঞ্চনা, দমন-পীড়ন, দুর্ভোগ-লাঞ্ছনার ইঙ্গিত। তাই 'ঝুটা আজাদি'র উপলব্ধি নিয়ে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ও ভূমি সংস্কার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, তেভাগা-হাজং-টঙ্ক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট কর্মীরা ছিলেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকায়। তাই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ উপনিবেশের উত্তরাধিকারী পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই প্রবলভাবে চালিয়েছে কমিউনিস্ট নিগ্রহ। দেশের কারাগারগুলোতে তখন রাজবন্দি বলতে শুধুই বামপন্থি নেতা-কর্মী।
ওই দিনে 'খাপড়া ওয়ার্ডে' অন্যায় ও অমানবিক কারাশ্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত রাজবন্দি কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের ওপর সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকারের তাবেদার জেল সুপারিন্টেনডেন্ট শ্বেতাঙ্গ এডওয়ার্ড বিল দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিরস্ত্র বন্দিদের ওপর ১৮০ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। রক্তস্রোতে ভেসে গিয়েছিল কারাগার। উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রথম মর্মান্তিক জেলহত্যায় শহীদ হন রাজশাহীর কমরেড বিজন সেন, দিনাজপুরের কম্পরাম সিং, খুলনার আনোয়ার হোসেন, রংপুরের সুধীন ধর, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ ও দেলোয়ার হোসেন এবং ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য। খাপড়া ওয়ার্ডে ওই বর্বর আক্রমণে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন ৩১ জন কমরেড। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে উপর্যুপরি লাঠিচার্জ চালানোয় অনেকেই আজীবন পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। হয়নি কোনো মামলাও। শহীদরা পাননি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। স্বাধীন বাংলাদেশ এই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে স্মৃতিফলক ও শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। সেই স্মৃতিফলকে খোদাই করা রয়েছে সাত শহীদ ও আহতদের নাম।
খাপড়া ওয়ার্ড সংগ্রামের চেতনা আমাদের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় প্রেরণা।
রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার