আমাদের ভালমানুষি এবং প্রত্যাশা
আমরা যখন কাউকে কিছু দেই, একটা গর্ব কাজ করে ভেতরে। যখন কারো উপকারে আসি- মনে মনে ভেবে নেই মানুষটা আমার চিরদিনের জন্য কেনা হয়ে গেল। যখন কারো জন্য কিছু করি- একটা এক্সপেক্টেশন লেভেল তৈরী হয়ে যায়।
আর তারপর যদি কোন কারণে সেই এক্সপেক্টেশন লেভেলে ধাক্কা লাগে; যার উপকার করলাম, যাকে কিছু দিলাম- যার জন্য কিছু করলাম তিনি যদি আমার প্রয়োজনে না লাগেন, কোনভাবে উপেক্ষা করেন আমরা খুব কষ্ট পাই। আমাদের আবেগ উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। আমরা ভাবি তার কৃতজ্ঞতা, তার মনোযোগ, তার সময় আমাদের পাওনা হয়ে গেছে। তিনি আমাদের তা দিতে বাধ্য। কৃতজ্ঞতা খুব ভাল একটা গুণ। আপনার মধ্যে অবশ্যই তা থাকা দরকার। কিন্তু যদি কখনো কারো কাছ থেকে আশা করেও না পান তাহলে কী করবেন?
কিছু দিয়ে যা পেলাম
বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ক্ষোভে পুড়তে থাকি। ক্ষোভ এমন এক বিষ যা আপনি নিজে খান আর ভাবেন মরে যাবে অন্যরা। দুজন অ্যাজমার রোগীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। দেখেছিলাম দুজন মানুষই প্রচণ্ড আবেগী। দেখে একটা সন্দেহ হল আরো কিছু রোগীকে স্টাডী করলাম- একই কাহিনী। প্রচন্ড আবেগ আর প্রচন্ড ক্ষোভ তাদেরকে পুড়িয়েছে জীবনের কোন না কোন সময়ে। এই মানুষগুলো ভাল মানুষ। এমন ধরনের মানুষ যারা অন্যদের উপকার করেন, অন্যের প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়েন কিন্তু পাল্টা সাড়া পান না তেমন। তারা ক্ষোভে আক্রান্ত হয়ে অন্যের বদলে নিজেরই ক্ষতি করে বসেন।
মানবিক আবেগগুলো থেকে একেক ধরণের সিক্রেশন হয় শরীরে। আবেগ এবং সিক্রেশন এক ধরণের ভারসাম্য বজায় রাখে শরীরের মধ্যে। কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সেই মাত্রারিক্ত সিক্রেশন শরীরে ভারসাম্য নষ্ট করে নানান রকম সমস্যা তৈরি করে।
বাঁচার উপায় কী? একটু ভাবুন।
যে মানুষটি আপনার পেটে ছুড়ি ধরে আপনার কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিল, তার প্রতি কিন্তু আপনার কোন প্রত্যাশা থাকে না। যে মানুষটি আপনাকে বিপদে ফেলে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে নিল তার প্রতিও আপনার কোন চাহিদা নেই। তাহলে যার জন্য আপনি নিজে যেচে কিছু করলেন তার প্রতি আপনি এত কঠোর কেন?
একটু ভাবুন, যা কিছু আমরা পৃথিবীতে দেখি তা কি আমাদের? আমাদের নিজেদের বলে সত্যি কি কিছু আছে? এই পৃথিবী আমদের অর্জিত? পৃথিবীর মাটি কি আমাদের? আমরা নিজেরাই কি আমাদের? এই দেহ, এই সুন্দর মুখশ্রী? শক্তি, সাহস, আনন্দ, উপভোগ? বিনা পয়সায় ব্যবহৃত বাতাস? পানি, মাটি, গাছপালা, ফল- কোনটা আপনার? জন্মসূত্রে আমরা যা কিছু পেয়েছি, যা কিছু পাইনি, যা কিছু পাব, যা কিছু চেয়েও পাব না, যা কিছু না চেয়েও পেয়ে যাব- তার কিছুই আমাদের না। আমরা অর্জন করি, কেউ গায়ের জোরে, কেউ বাপের টাকার জোরে- এই জোরগুলোও আমাদের না।
ধরুন আপনার মেধা দিয়ে আপনি যা অর্জন করলেন এক অর্থে তাও কিন্তু জোর করে আদায়ের অন্য নাম। যার শক্তি আছে সে গায়ের জোরে কেড়ে নেয়- আপনি মেধার জোর ব্যবহার করে কেড়ে নিলেন। সুতরাং আপনার অর্জিত প্রতিটি সম্পদেই অন্যদের ভাগ আছে। আপনি স্বেচ্ছায়ই যদি দিলেন তাহলে বিনিময় প্রার্থনা কেন?
তবে কী আপনার দান ব্যর্থ হবে। বিনিময়ে কিছুই পাবেন না?
না। আপনি যদি স্রস্টায় বিশ্বাসী হোন তবে তো কথাই নেই। আপনার ভাল কাজের বিনিময় তিনিই দেবেন- এ বিশ্বাস যদি না থাকে তাহলে আপনি বিশ্বাসী নন। আপনার ঈমানে গুরুতর সমস্যা আছে। আর আপনি যদি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হোন। স্রস্টার মত পুরনো ধ্যান ধারণা আপনার কাছে বালখিল্য মনে হয় তাহলেও দেখবেন পৃথিবীর কিছু প্রমাণিত আইন আছে। যার একটা হল “ল অব ন্যাচারাল রিটার্ণ।”
যা কিছুই আপনি করেন তার বিনিময় পৃথিবী বা প্রকৃতি আপনাকে অবশ্যই দেবে। সে ভাল হোক বা খারাপ। সে বিনিময় নিয়ে সন্দেহগ্রস্থ হবেন না। আপনি যদি ‘ক’ কে কিছু দান করেন। তার বিনিময় আপনার ‘ক’ এর কাছ থেকেই নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। সেটা আপনি ‘খ’ কিংবা বহু দূরের ‘দ’ এর কাছ থেকেও পেতে পারেন। আর সেটা নিয়ে আপনার খুব মরিয়া হয়ে ওঠারও প্রয়োজন নেই। যা কিছু অমোঘ- তা কখনো বদলায় না। আপনার খারাপ কাজের প্রতিদানও আপনি পাবেন, ভাল কাজেরও। খারাপটাও যেমন আপনি ফেরাতে পারবেন না- ভালটাও ফিরবে না। আপনার শুধু একটু ধৈর্য চাই।
সুতরাং যে পাওনা আপনার নামে লেখা হয়ে গেছে সে জন্য ক্ষোভে আক্রান্ত হয়ে খামোখা নিজের ক্ষতি করা কেন?
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।