১
কেন কোন লেখা ভালো লাগে? মনে হয়-এই কথাটা না পড়লে প্রাণে বাঁচতাম না! কেন কিছু কথা আমাদের বদলে দেয়? রেহেলের পবিত্র বাক্যে তৃপ্ত হয়ে কেউ কেউ আমরা নেমপ্লেটে লিখি-সুখ। আবার কখনো কখনো তলিয়ে যাই-পড়ে কোন অতল বাক্য। মনে হতে পারে-এমন কী কখনো হয় নাকি? এমন কিন্তু হয়-এমন তো হয়ই! সে আমাদের কোপিং মেকানিজম (এখানে সেটা অস্বীকৃতি-মানে যা আমাদের একান্ত ভয় গুলোকে আটকে রেখে চলতে সাহায্য করে) ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে যতোই বাধা দিক! উদাহরণ হোক। ১৭৭৪ সালে জার্মান লেখক গ্যেটে বের করেন তার উপন্যাস-দা ছরো’স অফ ইয়ং ওয়ার্থার। ভালোবাসার দেবদাস থিম! যে রমণীকে ওয়ার্থার ভালোবাসতো তাকে না পেয়ে নিজের পায়ে গুলি চালিয়ে বসে। দুঃখের সেই মুহূর্তটা উপন্যাসে বেঁধে রেখে গল্পটা শেষ করা হয়। দেখা গেলো-এ উপন্যাস বের হওয়ার পর ইউরোপে আত্নহত্যা বেড়ে যায়। ডেনমার্ক ও নরওয়েতে কিছু দিনের জন্য বইটা নিষিদ্ধও থাকে! কিংবা দান্তের ডিভাইন কমেডির কাব্যের কথাই ধরি। এ বইটা চার্চে রীতিমতো বিশ্বাসীদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। কারণ-বইয়ের এক অংশের নরক সম্পর্কিত ভয়াবহ বর্ণনা। তবে প্রশ্ন হলো মানুষ কী সত্যি এভাবে প্রভাবিত হয় কিংবা হতে পারে-তাও এমন ঝাঁক ধরে? বিজ্ঞান বলছে পারে। সাইকোলজিতে এ নিয়ে পরীক্ষাও কম নয়! এখন যে প্রশ্নটা আসে সেটা হলো-শব্দ ও বাক্যের কী এমন ক্ষমতা যে এভাবে ভিতরে ঢুকে যায়। ব্যাপারটা কিভাবে ঘটে?
সে কথা লিখতে গেলে রীতিমতো ফিজিক্স নিয়ে এসে দীর্ঘ একটা বই লিখতে হবে। তাতে ঢুকবে ধর্ম, মন ও অঙ্কের হাবিজাবি অনেক কিছু! সে সময় কই? তবে এটুকু বলা যায়-বোধ, শক্তি, বাস্তবতা ও অবচেতনার এ এক খেলা। আমি বলি যাদু! ব্যাখ্যায় যাবো না কারণ আজ লিখতে চেয়েছি ছন্দ নিয়ে। দেখা যাক ঘোড়ার ডিমের ছন্দ জিনিসটা কী! ঘোড়ার ডিম বললাম কারণ যখন শিখতে চেয়েছি সবাই বলেছে ব্যাপারটা আছে কিন্তু কেউ দেখিয়ে দিতে পারে নাই! বই পুস্তক পড়ি-মনে হয় আল্লাহ মালুম! তাই আগেই বলে নিচ্ছি এ লেখা বোদ্ধাদের জন্য নয়। নহে...!
মাত্রা মাত্রা নিয়ে সবাই ভাব ধরে। তাই সেটাই আগে বলি। অক্ষর আমরা সবাই চিনি সেক্ষেত্রে অক্ষর দিয়েই মাত্রা শেখা ভালো। যারা রাগে ফুলছে তাদের বলি-আমি জনসাধারণের কথা বলছি। আর বিজ্ঞরা না হয় শিখুক তাদের মতো করেই। হ্যাঁ যতো অক্ষর ততো মাত্রা। সোজা কথায়-‘আমি’ লিখলে বলবো ২ মাত্রা কারণ অক্ষর এখানে ২টা। এখন যদি ‘তোমরা’ লিখি তবে কয় মাত্রা হবে? গুণতে জানলেই হয়-৩ মাত্রা। এইতো মাত্রার কথা! উদাহরণ-
“বুকে হাত দাও-
দেখবে একলা কি যে
যাপনের দৈত্যদানো...!”
এখানে প্রথম লাইনের মাত্রা সংখ্যা ৬, দ্বিতীয়তে ৮ আর শেষেও ৮ মাত্রা। আশা রাখি, এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক আছে। আছে তো? মূলত মাত্রা শিখতে হয় উচ্চারণ দিয়ে কিন্তু ব্যাপারটার কাঠিন্য ভয়াবহ! আপাতত আমরা এভাবেই চেষ্টা করি তারপর না হয় কান বড় হলে ওভাবে শিখবো।
এখন কথা হলো মাত্রা জিনিসটা কেন শিখলাম? কারণ এটা দিয়ে ছন্দ মাপা হয়। এই যেমন আমরা মাটিকে মাপি দৈর্ঘ্য দিয়ে, গভীরতাকে ফ্যাদম দিয়ে কিংবা ভালোবাসাকে... থুক্কু ভালোবাসা হয়তো মাপা যায় না...যায় কী?! যাইহোক, ছন্দে যাই। প্রথমে আসি অক্ষবৃত্তের ছন্দ রাজ্যে। এ আবার কেমন ধরণের ছন্দ? চারের-ছন্দ। মানে প্রতি লাইনে মাত্রা সংখ্যা নির্ধারিত হয়-৪ কিংবা ৪এর গুণিতকের সাথে ২ যোগ করে। ব্যাপারটা সোজা অন্তত কপাল কুঁচকানোর আগে উদাহরণটা তো দেখি-
“কড়ি কুড়ানোর কাল কালে কালে চলে
গড়নের গাঙে মায়া গহনে যে গলে
ভালোবাসা সখী ভুল-মিথ্যে মুগ্ধ গতি?
ভালোবাসাই ভবের শুধু ভানুমতি।”
প্রতিটি লাইনই কিন্তু ১৪ মাত্রার। না বিশ্বাস হলে গোনা শুরু করলেই তো হয়। এটা একটা অক্ষরবৃত্ত কারণ মাত্রা হলো ৪+৪+৪+২=১৪ মানে ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এরকম ৬(৪+২), ১০(৪+৪+২), ১৮(৪+৪+৪+৪+২) কিংবা যার যা ইচ্ছা সেভাবে মাত্রা সংখ্যার লাইন লিখলেই হয়। শুধু লাইন গঠনে খেয়াল রাখতে হবে-৪ কিংবা ৪এর গুণিতকের সাথে ২ এর যোগ! এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারে-মুগ্ধ শব্দটায় অক্ষর তো ৩টা ছিলো কেন ২ মাত্রা ধরলাম? হক কথা। কারণ এটাই অক্ষরবৃত্তের মূল নিয়ম। মানে যুক্তাক্ষর এক মাত্রার মূল্য পায়। সতর্কতাঃ যেহেতু উচ্চারণ দিয়ে শিখছি না তো মনে যেন রাখি-“ওয়া” শব্দটা সারাজীবনই ১ মাত্রার যদিও অক্ষর ২টি। যেমন-নাওয়া, চাওয়া এসব শব্দের মাত্রা ২ হবে। এখন অক্ষরবৃত্তের একটা মজার বৈশিষ্ট্য দিয়ে এ রাজ্যের গল্প শেষ করি। ‘বউ’ শব্দটা কয় মাত্রার? হ্যাঁ ২ মাত্রা। কিন্তু কেউ যদি ১ হিসেবেও কবিতায় লেখে তো ক্ষতি নেই কারণ উচ্চারণে বউ হয়-বৌ! তেমন ভাবে ‘কলজে’ শব্দকে চাইলেই ২ কিংবা ৩ মাত্রায় লেখা যায়। কারণ কলজে এর উচ্চারণ কিন্তু-কল্জে! এ সুবিধাকে কবিতা লিখবার সময় মনে হবে-গরমের মাঝে বৃক্ষের ছায়া, আর হ্যাঁ-কবি ক্লান্ত পথিক!
*বেঁচে থাকলে সামনে আবার লেখা যাবে। আজকে এখানেই শেষ করি। তবে যাওয়ার আগে বলে যাই-লেখাটা কেন লিখছি। কারণ গালিগালাজ! মানে অন্ত্যমিল নেই বলে অনেকেই কঠিন করে বলে-লেখায় ছন্দ নেই কেন? অথচ পড়ে যাওয়া চুলের কসম সেসব লেখায় ছন্দ থাকে! তবে যারা খোঁচাটায় লজ্জা পেলো তাদের বলি-ডাক্তার, কবি কিংবা ইঞ্জিনিয়ার সহো ১০০ জনের ৯৯ জনই ভাবে অন্ত্যমিল মানেই ছন্দ! তো ব্যাপারটায় লজ্জার কিছু নেই। লজ্জা হলো শিখতে না চেয়ে শিখে গেছি-এ ভাব ধরায়।
২
প্রথম ভাগটুকু লিখবার পড়েই যে প্রশ্নটা আগে পেয়েছি তা হলো-যদি লাইন ভাঙচুর করি মানে মাত্রা লাইন ভেদে বিভিন্ন হয় ও সেটা ৪ এর গুনিতকের সাথে ২ যোগ না হয় তখন কি হবে? সেটাকে কি অক্ষরবৃত্ত বলা যাবে? যাবে। তবে-তখন তার সাথে হয়তো অন্য একটা নামও যোগ হবে। যেমন-কোন ছেলের নাম ধরি খন্দকার নাহিদ হোসেন...তবু রুবেল নামে একটা ডাক নামও যদি তার থাকে তবে তাতে কিন্তু ছেলেটা বদলে যাবে না...কখনোই না। কেন অক্ষরবৃত্ত বলা যাবে-কিভাবে যাবে সে কথায় আসবার আগে একটু পর্ব ব্যাপারটা দেখে নেই। ভাবছিলাম এসব না বলে শর্টকাট মারবো কিন্তু ভুলে গেছিলাম জলে নামলে না ভিজে উপায় নেই! তবে যেহেতু সাঁতার জানি না-তাই গভীরে না যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে। শতহোক বাপ দাদার কৃপায় একটা জীবনই হাতে!
লঘু যতির বিভাগকে পর্ব বলে। মানে আমরা তো আর এক উচ্চারণে সম্পূর্ণ একটা লাইন বলতে পারি না যদিও নিঃশ্বাসে হয়তো পারি। তো এইসব উচ্চারণের এক একটা ভাগ কিংবা ঝোঁক থাকে। আর এই ভাগটাকেই বলে পর্ব। উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা হয়তো খোলাসা হবে-
“আগুনের/গল্পে জ্বলে/প্রণয় পা/লক
প্রিয়ক্ষণ/মানে খালি/একা এক/বক।”
দেখা যাচ্ছে লাইন দুটি উচ্চারণের কারনে ৪ মাত্রায় ভাগ ভাগ হয়ে যাচ্ছে ও শেষে থাকছে ২মাত্রার যোগ করা অংশটুকু। আর এটাই পর্ব। তবে শেষের ২ মাত্রাকে বলা হয় ভাঙা পর্ব। আবার পর্বের ছোট অংশকে বলে পর্বাঙ্গ। এখানে-‘গল্প, জ্বলে...’ প্রভৃতি শব্দগুলো হলো পর্বাঙ্গ। তবে কবিতা কিন্তু আমরা এভাবে পড়ি না। তাই এই ভাগটুকু আর একটু বড় কিন্তু করা যায়। আর সেভাবে মনে রাখলেই ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে-
“আগুনের গল্পে জ্বলে/প্রণয় পালক
প্রিয়ক্ষণ মানে খালি/একা এক বক।”
তো অক্ষরবৃত্তের ১৪ মাত্রার লাইনগুলিকে এভাবেই (৮+৬) সাধারণত ভাঙা হয়। মানে এক অংশে ৮ আর অন্য অংশে ৬ মাত্রা। টোটাল ১৪ মাত্রা। এই ১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের সুন্দর একটা ডাক নাম হলো-পয়ার। এখন যে প্রশ্নটা মাথায় খোঁচানোর কথা সেটা হলো লাইন বড় হলে কি এভাবে পর্বে ভাঙা যাবে না? যাবে। যেমন ১৮ মাত্রার লাইন হলে ভাঙবো ৮+১০ করে। আবার এই ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তকেও অন্য একটা নামে ডাকা যায় আর তা হলো-মহা পয়ার। আহা, কতো নাম কতো ভাঙচুর! কিন্তু কথা হলো এভাবে লাইন ভাঙাটা কেন শিখলাম আর পর্ব ব্যাপারটা বুঝেই বা কী লাভ হলো? বলছি। এটুকু না জানলে কবিতা লিখতে ও পড়তে অসুবিধা হয়ে যেতো। কারণ শত হোক গল্প ও কবিতাকে আবেগ আলাদা করে না...করে তার টেকনিক। আর এটা যেসব কবিরা ছন্দ মানে না তাদের ক্ষেত্রেও সত্য। বড় তিক্ত এক সত্য। যদিও পাঠকের ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই যে ছন্দ জানতেই হবে। যেমন-ছবি আঁকার নিয়ম কানুন না জানলেও ছবি দেখে সুন্দরের বোধটা কিন্তু আমরা জনসাধারণ টের পাই! পাই কিন্তু। তো ছন্দে কবিতা লিখতে হলে আসল টেকনিকটা কি? জোড়ের পাশে জোড় শব্দ ও বিজোড়ের পাশে বিজোড় শব্দ রাখলেই হলো। আর ব্যাপারটা গুছিয়ে জানানোর জন্য আমরা দত্ত পরিবারের এক জাদুকরকে একটা ধন্যবাদ দিতেই পারি। সে যাদুকরের নাম হলো-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা-এভাবে না লিখলে যে সমস্যা হবে সেটা হলো মাত্রা হয়তো অনেক সময় ঠিকঠাক থাকবে কিন্তু পর্ব ভেঙে যাবে বেশিরভাগ সময়ই শব্দের মাঝখানে। যা কোনভাবেই কাছে টানার যোগ্য না। কারণ ভাঙা ভাঙা শব্দে যেখানে ভাঙচুর লেখাই দায় সেখানে কেউ কবিতা লিখবে কেমনে?! আর সেক্ষেত্রে পড়ার নিয়মটাও কী কে জানে...! এখন যে প্রশ্নটার কথা এ অংশের শুরুতে বলেছিলাম তার উত্তরটা বলি। অক্ষরবৃত্ত হওয়ার জন্য লাইনের মাত্রার সমতা সংখ্যা প্রধান বিষয় না। তো মাত্রা লাইন ভেদে ইচ্ছামতো হলেও কোন সমস্যা নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যুক্তবর্ণ যেন সবসময়ই এক মাত্রা ধরা হয়। আর আধুনিক কবিরা এ স্বাধীনতা এখন ইচ্ছামতো নেয়। কারণ কবিদের বড্ড ভাঙচুর প্রিয়! তবে এমন কবিতাকে মুক্তক অক্ষরবৃত্ত নামে ডাকলেই বেচারা খুশি হয় আর তাতে ঝামেলাটাও কমে। কারণ তরী নামের কোন মানবীকে কেউ ভুল করে পরী ডাকলে মাইড় খাওয়ার একটা সম্ভাবনা কিন্তু থাকেই যদি সে মানবী গলে যেয়ে নরম না হয়!
৩
এবারের ছন্দ রাজ্যের নাম মাত্রাবৃত্ত। নিয়মকানুন সব অক্ষরবৃত্তের মতোই শুধু মূল পার্থক্য হলো-যুক্ত বর্ণ ভেঙে পড়তে হবে। মানে এইবার ‘মুগ্ধ’ শব্দকে ৩ মাত্রাই ধরতে হবে। ২ মাত্রা ধরার আর কোন সুযোগ নেই। এছাড়া অক্ষরবৃত্তে পর্ব হয় সাধারণত ৮ বা ১০ মাত্রায়। মুক্তক হলে হয়তো অন্য মাপেও হয়। কিন্তু মাত্রাবৃত্তে ব্যাপারটা একদম ফিক্সড। পর্ব হতে পারবে-৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ মাত্রায়। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই ও এক কবিতায় যে কোন একটা মাত্রাতেই শুধু পর্ব বাঁধা যাবে। একই কবিতার বিভিন্ন লাইনকে ভিন্ন ভিন্ন পর্বে বাঁধাইের অনুমতি মাত্রাবৃত্তে নেই। মানে খিচুড়ি সব জাগায় উপাদেয় নয় আর কি! উদাহরণ-
“ক্ষরণ ছুঁয়ে রাত যে কিনি
ভীষণ ঝড়ে কাল প্রহরে
এই যে আমি ক্লাউন ঠোঁটে
কিচ্ছা গাঁথি বাদুড় রাতে
কোন পরাণে সূচ বেঁধে না?
এমন ব্যথা...
কেউ বোঝে না-কেউ বোঝে না।”
উপরের লাইনগুলি ৫ মাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা যদিও প্রতি পঙক্তিতে মাত্রা সংখ্যা সমান নয়। কারো বুঝতে অসুবিধা হলে প্রতি ৫ সংখ্যা পরপর একটা করে “/” চিহ্ন বসিয়ে নিলেই ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। জানি এখন প্রশ্ন আসবে যেহেতু যুক্ত বর্ণকে দুই মাত্রা ধরতে হবে তো এখানে ‘ক্লাউন’ শব্দটা ৪ মাত্রার না হয়ে কেন ৩ মাত্রার হলো? উচ্চারণ দিয়ে শিখছি না বলেই এই ঝামেলা! তাই আর একটা ছোট নিয়ম এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবেঃ মাত্রাবৃত্ত ছন্দে শব্দের মধ্যে কিংবা শেষে অবস্থিত যুক্তাক্ষর শুধু ২ মাত্রার মূল্য পাবে যদি না সেই যুক্তাক্ষরের ঠিক আগের বর্ণটি হস্ বর্ণ না হয়। কিন্তু শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর থাকলে ১ মাত্রাই ধরবো। আর ‘ক্লাউন’ শব্দের যুক্তাক্ষর প্রথমে বলেই ৩ মাত্রা ধরছি। এছাড়া কবিতায় ‘কিচ্ছা’ শব্দটাকে কিন্তু ৩ মাত্রাই ধরা হয়েছে মাত্রাবৃত্তের নিয়ম মনে রেখে। তাছাড়া ‘ঐ, ঔ’ অক্ষরদুটি মাত্রাবৃত্তে পুরাই অক্ষরবৃত্তের উল্টা মানে ২ মাত্রাই ধরতে হবে-সে শব্দের প্রথমে বসলেও। তবে যেসব শব্দের প্রথমে যুক্তাক্ষর ও তার পাশেই যুক্ত-ব্যঞ্জন থাকবে সেসব শব্দের ক্ষেত্রে ১ মাত্রা সবসময় কমে যাবে। যেমন-সৈন্য শব্দটা ৪ মাত্রার হওয়ার কথা কারণ প্রথমে ‘ঐ কার’ ও তার সাথে আছে-‘য ফলা’। কিন্তু হচ্ছে ৩ মাত্রা উপরের নিয়মটার জন্য। এভাবে-দৈন্য, চৈত্র, মৈত্রী, বৌদ্ধ, ঔদ্ধত্য প্রভৃতি শব্দেও একটা করে মাত্রা কমে যাবে। এই তো মাত্রাবৃত্তের গল্প।
৪
এখন শুধু বাকি আছে ছন্দের শেষ রাজ্য-স্বরবৃত্তের কথা। আর সেটা অক্ষর দিয়ে শিখবার কোন উপায়ই নেই। হায়, নেই! আমাদের এখন জানা লাগবে সিলেবল। জিনিসটা হলো-একবারের চেষ্টায় একটি শব্দের যতোটুকু আমরা উচ্চারণ করতে পারি ঠিক ততোটুকু ধ্বনি। যেমন-‘আকাশ’ শব্দের মাত্রা ২ কারণ সিলেবল এখানে ২টি-‘আ’ ও ‘কাশ’। তেমনি ভাবে ‘ভুল’ শব্দটা হবে ১ মাত্রার। আবার ‘তোমরা’ বললে হবে ২ মাত্রা। কারণ সিলেবল হলো-‘তোম’ ও ‘রা’ শুধু এইটুকু। আশা রাখি বোঝা গেছে। আর স্বরবৃত্তে মাত্রা এভাবেই হিসাব করতে হয়। অক্ষরবৃত্তের চেয়ে যেমন মাত্রাবৃত্তের পর্বে-মাত্রার স্বাধীনতা কম ঠিক তেমনি স্বরবৃত্তে আরো কম। এখানে সবসময়ই পর্ব আগায় ৪ মাত্রা করে। তবে কোথাও কোথাও দু’এক ক্ষেত্রে ৩ ও ৫ মাত্রার স্বাধীনতাও নেওয়া হয়। নিজে এখনো অক্ষম বলে উদাহরণ হিসেবে ঠাকুর সাহেবের কাছ থেকেই দুটো লাইন ধার করি-
কালো? তা সে/যতোই কালো/ হোক
দেখেছি তার/ কালো হরিণ/ চোখ।
এখানে মাত্রা বিন্যাস-৪+৪+১ করে। আর পর্ব হলো ৩টি যার শেষটা হলো ১ মাত্রার ভাঙা পর্ব। তবে বাকি দুই ধারার ছন্দের মতোই স্বরবৃত্তের পঙক্তিতেও ইচ্ছামতো পর্ব করা যায় ও মুক্তকে লেখা যায়।
৫
জানি এতোক্ষণে বেশিরভাগই পাঠকই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিছে-গদ্য কবিতার উপর কোন কথা নেই! হায়, হায়রে হায়! কিন্তু এ বিষয়ে বলবার আগে একটু উপরের ৩ ছন্দের শুরুটা দেখে আসি। ব্যাপারটা না বলে এ লেখাটা শেষ করলে বুকে একটা খচখচ থেকেই যাবে! আমি এক কথায় বলে যাবো তবে আগ্রহীদের জন্য ইতিহাসের বই তো আছেই। কিন্তু শুরুটা বলতে গেলে যে প্রশ্নটা আগে সামনে আসে তা হলো-বাংলা সাহিত্যের প্রধান ৪ কবির নাম কী? জানি প্রশ্নটা শুনেই সবার ঢাকঢোল বাজানো শুরু হয়ে গেছে কারণ পছন্দ ব্যাপারটা একদমই আপেক্ষিক। ভাগ্যিস আপেক্ষিক না হলে দেখা যেতো সুন্দর শুধু নিজের বউই! যাকগে, উত্তরটা এরকম-মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশ। এদের মাঝে মাইকেল বাংলা কবিতা তথা সাহিত্য চর্চা করেছেন ১৫ বছর, রবীন্দ্রনাথ ৬৫ বছর, নজরুল ২৩ বছর ও জীবনানন্দ ৪০ বছর! তো কার কী অবদান? মাইকেলের আগে অক্ষরবৃত্ত ছিল বিচ্ছিরি রকমের এক খাঁচা! মানে এর আগে (প্রায় ৮০০ বছর) তা ছিলো একদাঁড়ি ও দুইদাঁড়ি নির্ভর পয়ার। এক কিংবা দুই লাইনে থেমে থেমে মনের ভাব প্রকাশ করার মজা হয়তো একমাত্র বিষ খাবার সাথেই তুলনীয়! তো মাইকেল এখানে একটা বিপ্লব এনে দিলেন-তিনি যতি লাইনে লাইনে না দিয়ে ইচ্ছামতো বসানোর স্বাধীনতা নিলেন (মানে সৃষ্টি হলো অমিত্রাক্ষর ছন্দের) ও বাংলা সাহিত্য প্রবেশ করলো আধুনিক যুগে। হ্যাঁ, তাকে ডাকা হয় আধুনিক বাংলা কবিতার জনক হিসেবে। তিনি মুক্তক নিয়েও কাজ করেছেন আর তার পরে তাকে আরো অর্থবহ করেছেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ যেখান থেকে গৈরিশ ছন্দের উদ্ভব। যদিও মুক্তক প্রবর্তকের স্বীকৃতি রবীন্দ্রনাথের কাঁধে তবে শুরুটা তাদেরই। এছাড়া সনেট ও মহাকাব্য বাংলা সাহিত্যে মাইকেলেরই সৃষ্টি। এখন রবীন্দ্রনাথের কথা-তিনি জনক হলেন মাত্রাবৃত্ত ছন্দের। সময় ১৮৮৭ সালের বৈশাখ মাস-আর কবিতার নাম-ভুল ভাঙা। নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য যুতমতো একটা নাম! তারপর এ ধরনের কবিতাগুলো নিয়ে ১৮৯০ সালে তিনি সুন্দর একটা ভূমিকা দিয়ে বলে কয়ে বের করলেন ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থ। বলতেই হচ্ছে ব্যাপারটার জন্য বুকে অনেক সাহস লাগে। আর রবীন্দ্রনাথই প্রথম (বলাকা কাব্যগ্রন্থ-১৯১৬ এ) মুক্তকের সফল প্রয়োগ দেখিয়েছিলেন অক্ষরবৃত্ত ও স্বরবৃত্তে। কিন্তু তখন পর্যন্ত মাত্রাবৃত্ত মুক্তক কেউ লেখেনি। এ কাজটা কে আগে করলো? ২২ বছরের এক তরুণ যদিও তার হাবিলদারের চাকরিটা তখনো ছিলো কি না আমি মনে করতে পারছি না। যাইহোক, সে তরুণের নাম ছিলো-কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিতাটি ছিলো-বিদ্রোহী। সময় ১৯২১, মাস ডিসেম্বর। দেখা যাচ্ছে-শীতের সময়ই আগুনের কবিতা বেশি জন্মে! ঘটনা কী?! পরে কবিতাটি তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা-য় দ্বিতীয় কবিতা হিসেবে গ্রন্থিত হয়। তবে রবীন্দ্রনাথও মাত্রাবৃত্ত মুক্তকে লিখেছেন কিন্তু সেটা নজরুলের অনেক পরে...রীতিমতো ১৫ বছর। আর জীবনানন্দ দাশ সাহসের যে কাজটা করেছিলেন এবং তা বাংলা সাহিত্যে প্রথম সেটা হলো-সনেটে কাঁচি চালানো! মানে সেই সব সনেটের পঙক্তিগুলোয় মাত্রা সংখ্যা সমান ছিলো না। কাব্যগ্রন্থের নাম-রূপসী বাংলা ও রচনাকাল-১৯৩২ সাল। যদিও এ কাব্যগ্রন্থ বের হয় কবির মৃত্যুর পর। আর না...ইতিহাস এখানেই শেষ করি কারণ এ লেখার আয়তন কেউ একবার ভুল করে দেখে ফেললে না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি!
৬
লেখা শেষ করবো ভেবেছি গদ্যছন্দে একটু চোখ রেখে। তো ভাবনা স্বার্থক করি! গদ্য কবিতা জিনিসটা কী-এ প্রশ্নে উত্তরের অভাব হওয়ার কথা না। কারণ আমাদের সবারই একটা নিজস্ব সংজ্ঞা আছে ও তার আলোকে আমরা ছন্দ কবিতাকেও রীতিমতো গদ্যকবিতা বলে উড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি এবং কথাটা উল্টো করেও সত্য! এর কতো নাম-মিশ্রছন্দ, মুক্তছন্দ, গদ্যছন্দ, বয়ান, ফরাসিতে ভার্স লিবর কিংবা আক্ষরিক ইংরেজি অনুবাদে ফ্রি ভার্স কিংবা সে যাই হোক! তাই নামকে পাত্তা না দিয়ে আমি শুধু প্যাঁচের জায়গাটা একটু গুছিয়ে বলে যাই। আর সংজ্ঞা বানানোর ক্ষমতা তো সবার আছেই! গদ্য কবিতায় ঝামেলা আসে তার দুই রকমের ভাগ নিয়ে। একটার নাম গদ্যছন্দ ও অন্যটার নাম-মুক্তছন্দ কিংবা মিশ্রছন্দ। গদ্যছন্দ হলো-ওয়াল্ট হুইটম্যান প্রবর্তিত একটা ধারা যেখানে গদ্য কবিতার কুশলতা হচ্ছে-পুনরাবৃত্তি(শব্দ ও বাক্যের সাথে সাথে চিন্তারও!), পর-পর উল্লেখ, মহাকাব্যিক গীতলতা, গাদ্যিকতা ইত্যাদি...যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়-বিরতি ও গতির এক ছন্দ। তবে এই আবহ মানে ছন্দটা ইচ্ছামতো গ্রহণ করা যায় এক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই মানে ব্যাপারটা স্বাধীন। আর কোন গদ্য কবিতায় সে ছন্দটা এসেছে কি না তা কবিতার স্বার্থকতাই প্রমাণ করে শুধু খেয়াল রাখতে হবে-ভালো বক্তব্যই কবিতা নয়! এমন অনেক গদ্য ইদানিং চোখে পরে যা কবিতার মতো লেখা হলেও-বক্তব্যটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু কাব্যগুন খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সে চমকপ্রদ বক্তব্যগুলি সরাসরি গদ্য কিংবা প্রবন্ধ আকারে লিখলেই তো হয়! নাকি কোথাও মানা আছে কে জানে...! তো এ ধারায় রবীন্দ্রনাথ সহ ৩০এর প্রায় সব কবিগণই লিখেছেন আর তার পরের কবিরা তো লিখেছেই কিংবা এখনো লিখছেন। আর মুক্তছন্দ হলো গদ্য কবিতার সেই রূপ যেইখানে একই কবিতায় বিভিন্ন রকম ছন্দের কারুকাজ আছে। মানে কবিতার কোথাও হয়তো অক্ষরবৃত্ত, কোথাও আবার মাত্রা কিংবা স্বরবৃত্ত। তবে তা প্যারায় প্যারায় নয় লাইনে লাইনে হতে হবে এবং ব্যাপারটা যে এক্সিডেন্টলি আসেনি সেটা কবিকে বুঝিয়েও দিতে হবে! আর এটাই মূলত ফরাসি ভাষায় ভার্স লিবরের মানে। যে মানেটা বুঝতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই ভুল হয়েছিলো। মানে একবার তাকে প্রশ্ন করায়-বলেছিলেন যে তিনি অনেক ভার্স লিবর লিখেছেন। আসলে তিনি ফরাসিদের ভার্স লিবর লেখেননি...লিখেছিলেন হুইটম্যানের ভার্স লিবর! সে যাইহোক, বাংলা সাহিত্যে এই মুক্তছন্দ কিংবা মিশ্রছন্দ(এই নামটাই ভালো কারণ অর্থের সাথে মানায় বেশি!) প্রথম লিখেন অমিয় চক্রবর্তী। সময় ১৯৩৮ ও কবিতা গ্রন্থের নাম-খসড়া। আর এ কবিতাগ্রন্থও(মানে মিশ্রছন্দ ধারার কবিতা) রবীন্দ্রনাথের মতো বলে কয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে এনেছেন। তবে অনেক বড় কবি আবার গদ্যকবিতা লেখেনই নাই! যেমন-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিত লাল কিংবা জসীমউদ্দীন। আর নজরুল তার লেখালেখির শেষদিকে একটা মাত্র গদ্যকবিতাই লিখেছিলেন। যদিও ‘কবির মুক্তি (আধুনিকী)’ নামে সেই কবিতাটি ছিলো গদ্যকবিতাকে ব্যঙ্গ করে একটা লেখা যা পড়লে অনেকেরই গদ্যকবিতা লিখবার ইচ্ছা মরেও যেতে পারে! যাইহোক, গদ্যকবিতার সূচনা হয়েছিলো বাংলা সাহিত্যে বিশের দশকে। চোখ কপালে উঠলেও বলতে হচ্ছে-পুরনো চামচেই নতুন জীবনটাকে তুলে চলি-আমি ও আমরা! লেখা শুরু করেছিলাম কিভাবে শব্দ আমাদের মনকে বদলে দেয় সে বিষয়টাকে ইঙ্গিত দিয়ে। ভাবছি সে প্রসঙ্গে আর কিছু না বলে শুধু একটা ডেমো দিয়েই লেখা শেষ করবো! আর সেজন্য প্রিয় এক কবির কাছ থেকেই চারটা লাইন ধার করলাম। পাঠকরা শুধু যেন খেয়াল করে-জোড়ের পাশে জোড় ও বিজোড়ের সাথে বিজোড় শব্দ গাঁথার জাদু ও সেই সাথে একটু কষ্ট করে যেন মনে রাখে লুই আরাগেঁর সেই বিখ্যাত উক্তি-“কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস।” ডেমো-
“চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বথের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা একা;
যে জীবন ফড়িঙয়ের, দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা
এই জেনে।”
*ঈদের ছুটি না পেলে এ লেখা জীবনেও শেষ করতে পারতাম না। তো একটা ধন্যবাদ ছুটি কিংবা ঈদকে না দিয়ে কোন উপায়ই নেই! আর লিখতে যেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝিম মেরে থাকাটাতেও আমার কাছের মানুষেরা অভ্যস্ত হয়েছে দেখে বড়ই ভালো লাগছে যদিও মা’র খেতে ডাকবার ও ঘুমাতে বলবার অভ্যাস কিংবা ভালোবাসাটা ছিলোই! আর একটা স্বীকারোক্তি-প্রথম অংশ শেষ করবার সময় বলেছিলাম বিষয়টা নিয়ে লিখছি কারণ গালিগালাজ...আসলে কথাটা মিথ্যে। সেটা শুধু মজা করাবার জন্যই বলা। এ বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে-যারা কবিতা ভালোবাসে কিংবা লিখতে চায় তাদের কথা ভেবে। তো রাতজাগা, ক্লান্তি ও দুর্বল চোখদুটি নিয়ে মনিটরে চেয়ে থাকবার পৌনঃপুনিক কষ্টটা স্বার্থক হবে যদি লেখাটা কারো উপকারে লাগে কিংবা ভালোবাসায় একটু সিক্ত হয়। আপাতত সবার কাছ থেকে বিদায় রইলো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী নয়।।