আজকে আমাদের বাড়িতে অনেক অনেক মেহমান এসেছে। তারা আজ আমাদের বাড়িতে এসেছে মূলত আমাকে কেন্দ্র করে। আমি আমার প্রিয়জনের সান্নিধ্যে পাবো সেটা তারা আর সইতে পারছে না। মানুষ একটু সুখ পাবে সেটা অপর মানুষ সইতে পারে না। আমার বাড়িতে আসা এই আত্মীয় আর মেহমানদের মতো অপরের সুখে কাতর হওয়া মানুষ আমি এই দুনিয়াতে আর দেখিনি। তবে তারা মনে যাই লালন করুক— আমি কিন্তু প্রচন্ড সুখী। আমি তাদের চোখের বিষ হলেও অন্তত আজকে আমার এই মহেন্দ্র ক্ষণে আমাকে সম্ভাষণ জানাতে এসেছে তাতেই আমার স্বস্তি। এতেই আমার সুখ।
সবাই আমাকে ঘিরে ধরে রাখতে চাচ্ছে - সারা বাড়িময় মন মাতানো একটা মোহনীয় ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। এই দেশে চন্দন কাঠ কেউ পোড়ায় না, বাড়িতে মেহমান আসলে অথবা অন্য সময়ে চন্দন কাঠের গুড়া কেউ জ্বালায় না। চন্দন কাঠের ঘ্রাণ নেওয়া আরবের প্রচলিত নিয়ম। তবে আজকে আমাদের বাডিতে তা পোড়ানো হচ্ছে। আহা! কি এক ঘ্রাণ! আজকের ঘ্রাণটা এমন একটা ঘ্রাণ যার সুভাসে মানু্ষ ক্ষণিকের জন্য হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায়। মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে ব্যাকুল হয়ে উঠে।
দুনিয়ায় মানুষের নিয়ম কানুনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমাকে দেখতে আসা আত্মীয়,মেয়ে,মহিলা কিংবা বালিকাদের কেউ সাঁজুগুজো করেনি। আমার এই শুভ ক্ষণের উসিলায় অনেকেই বোরকা পড়েছে। আচ্ছা! আমি ভেবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না যে— ওরা হাসছে না কেন! হৈ হুল্লোড় করছে না কেন! বাড়ির ছোট ছোট বাচ্ছারা কিছিরমিছির করছে না কেন! সবার মুখে কেমন যেন এক নিস্তব্ধতা। শত কষ্টের মূহুর্ত পেরিয়ে আজকে আমার জীবনের বহু প্রতিক্ষীত এই সময়ে আমার আসাতে তারা কি অসুখী!?
পাগল বোনটা আমাকে ছুঁতে চাচ্ছে। কি অদ্ভূদ!! এতোগুলো মানুষের সামনে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছে- ও কি পাগল! তার এই অস্থীরতা দেখে আমার মনে পড়ছে বহু আগের এক স্মৃতি। তখন আমার বয়স ২২/২১ হবে। আমি আর আমার বন্ধু শফিউল এলাকার বাজারের বাস স্টেশনে হাঁটছি। হঠাৎ আমার ছোট ফুফিসহ তার পাঁচ মেয়ে আমার সামনে পড়ে। তখন তারা "আরে ভাই! তুকে কতোদিন দেখিনা" বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তারা এতো এতো মানুষের মাঝে ভুলে গেছে আমি একজন ছেলে যে অনেক বড় হয়ে গেছে। শফিউল বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে। যখন তারা চলে গেলো— শফিউল আমাকে বলে— এতো ভালোবাসা আর আদর আমি আর কোনোদিন দেখিনি।
দুনিয়াতে কাউকে ভালোবেসে আগলে রাখার মতো সুখ অন্য কিছুতেই নেই। বিচ্ছেদেই যত সব যন্ত্রণা। জীবনে অনেক কে আপন ভাবতে চেয়েছি, কাছে পেতে চেয়েছি, ভালোবাসতে চেয়েছি। কমপক্ষে বন্ধু হতে চেয়েছি কিন্তু কেউ হয়নি। আজকে আমার এই চাওয়া পূর্ণ হচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ।
এতোগুলো মানুষের ভীড়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত লাগছে। তাই গোসল করা প্রয়োজন। উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করলাম; গোসল করার সময় কেউ আমাকে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে। কেউ পানি ঢালছে আর কেউ আমাকে কাপড় পরিয়ে দিতে কাপড় হাতে নিয়ে বসে আছে। এ এক এলাহি কান্ড। গ্রাম থেকে শহরে যেন-গুঞ্জন উঠছেঃ সাইদুল করিম! সাইদুল করিম!! আজকে আমার প্রতি তাদের এই ভালোবাসায় কোনো খাঁদ দেখছি না। অজুহাতও দেখছি না। আমার দোষ ধরতে যারা ব্যস্ত থাকতো তারাও আজকে চুপ করে আছে।
আমার শিক্ষকদের অনেক কে দেখতে পাচ্ছি- আমাদের আঙ্গিনায়। যাদের পায়ের ধূলির জন্য আমার মন প্রাণ অস্থির থাকতো তারাও এসেছে। কি ভাগ্য আমার! কি এক সুন্দর দৃশ্য। আমার মনে হচ্ছে— ইহ/পরকালে ভালোবাসার চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। সবার মুখে এক অধ্যাত্মিক আভা দেখতে পাচ্ছি। সবাইকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। খুব সুন্দর করে ছেলে/পুরুষেরা কাপড় পরিধান করছে। তবে আমার ড্রেসটা সবার থেকে ভিন্ন। আমি শুভ্রতা ভালোবাসি। তাই আমার অতীব প্রিয়জনেরা আজকেও আমার জন্য সাদা ড্রেস বানিয়েছে।
যে সকাল ভাই/বোন আমার এই শুভ কাজে আসেনি তাদেরকে খুব খুব মিস করছি। আমার জন্য আমার প্রিয়তম যে একখানা প্রসাদ বানিয়েছে সেটি দেখলেই আমার আত্মীয়দের মন ভরে যেতো। তারা খুশি হতো।
সবাই অপেক্ষা করছে আমার প্রিয়তমের দেওয়া বাড়িটি আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। সবাই আমাকে আমার প্রিয়জনের দেওয়া উপহার, নতুন বাড়ির দিকে নিয়ে চললো। বাড়ি উদ্বোধনের আগে মসজিদের ইমাম সাহেব সবাইকে নিয়ে নামাজ পড়লো। কতো সুন্দর সুন্দর কথা বললো। আমি অবাক বিস্ময়ে সবার আকুতির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। একটু পরেই এই নতুন বাড়িতে আমার প্রিয়জনের সাক্ষাত পাবো। অবশ্যই সাক্ষতের আগে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে।যেন আমি তার সামনে চাঙ্গা থাকতে পারি।
বাড়িতে এসে পৌছলাম। নতুন বাড়ি। সবাই এখন খুবই ব্যস্ত কেবল আমি ছাড়া। কেউ বলছে পানি দাও। আর কেউ বলছে বাঁশের কঞ্চি দাও। আর কেউ বলছে মাটি দাও। আমি শান্ত হয়ে আছি প্রশান্তির অনুভূতিতে। আজ থেকে কোনো কোলাহল আমাকে অস্থির করতে পারবে না। কারো জন্য আমার মন কাঁদবে না। কারো অপমান আমাকে বাকহীন করতে পারবে না। কারো সামনে আমাকে আর প্রমাণ করতে হবে না- আমি ঠিক কিংবা বেঠিক।
একটু পর!! সবাই আমাকে রেখে চলে গেলো। সব্বাই। কেউ নেই এখন আমার পাশে। আমি প্রতিক্ষায় আছি কবরে!! এ যেন জাগতিক জীবনের এক চরম প্রাপ্তি। আমি ভুলে গেছি দুঃখ, বিস্বাদ, হাহাকার ও হা-হুতাশ। এখন আমি আমাকে নিয়েই ব্যস্ত- ইয়া নাফসী!! ইয়া নাফসী!!
একটু আগেই যারা আমাকে আসসালামু আলাইকুম বলে সালাম দিতো, দেখা হলে বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করতো সেই তারাই এখন আমাকে ইয়া আহলাল কুবুর বলেই সম্বোধন করবে। সে তারাই আমাকে একা রেখে চলে গেলো!
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন