নীল চাদরে ঢাকা

রাত (মে ২০১৪)

কামাল আহমেদ
  • ১০
পাত্রপক্ষ এসে শিমুকে দেখে গেছে।বলে গেছে মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে।খুব শিঘ্ররই তারা বিয়ের দিনক্ষণ জানিয়ে দেবেন।কিনত্দু শিমুর এবিয়েতে মত নেই,তাই সে মাকে গিয়ে বলল,তোমরা সবাই এখনই ক্যান আমার বিয়ে দেবার জন্য উইঠা পড়ে লাগছ?

রহিমা মেয়ের কথা শুনে অবাক হলেন।বললেন,সেকিরে কথা!মেয়ে বড় হইলে মেয়ের বিয়ে দেয়া বাবামার কর্তব্য,উইঠা পড়ে লাগা বলছিস ক্যান?
আমি কি তোমাদের কাছে অনেক বড় হয়া গেছি নাকি বেশি হয়া গেছি যে তোমরা এখনই আমারে বিদায় করতে চাইছ?
তোর সমস্যাটা কি?
সমস্যা কিছুনা।আমি এখন বিয়ে করব না। আমি এখন পড়ব।
পড়বি পড়,তাতে সমস্যা কি,বিয়ের পর কি ল্যাখাপড়া করা যায়না নাকি?এ্যা?আমিতো তোর বাবার সাখে বিয়ের পরই মেট্টিক পাস করলাম।
আহা মা বুঝতেছনা ক্যান?তোমাদের সময় আর আমাদের সময় আলাদা।তাছাড়া আমার আরো সমস্যা আছে।একটা জিনিস জোর কইরা আমার উপরে চাপায়া পারনা, মা?

শিমু চড়া গলায় কথা বলছে।রহিমা ভেতরে উতলা হলেন।শিমু বলল,আমার কি ব্যক্তিস্বাধীণতা বলতে কিছু থাকতে পারেনা,নাকি?
তোর সেই ব্যক্তিস্বাধীণতাটা কি খুইলা বল আমারে।
শিমু মাথা নিচু করে বলল,মা আমি একটি ছেলেকে পছন্দ করি। আমি ওরে কথা দিছি মা।
রহিমা মেয়ের কথা শুনে আতকে উঠে দাতে জিভ কাটলেন।বললেন,চুপ,চুপ এই কথা আর বলিস না তোর বাপ শুনতে পাইলে একদম মাইরা ফেলবেন।
শিমু কাদো গলায় বলল,তুমি একটু বাবাকে বোঝাও মা।তোমরা এমুন কইরা একটা জিনিস আমার উপরে চাপায়া দিতে পারনা মা।
রহিমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে চুলে বিলি কেটে বললেন,তুই আমারে আগে বলস নাই ক্যান?এখন অস্থীর হইসনা দেখি কি করা যায়।

রাতের বেলা শোয়ার সময় স্বামীর কাছে কথাটা পাড়লেন রহিমা।বললেন,অনুমতি পাইলে একখানা কথা বলতাম্
আনোয়ার হোসেন সত্দ্্রীর দিকে মিটমিট করে তাকালেন।বললেন,১০খানা কথা বলার অনুমতি দিলাম।
কথাটা কিনত্দু সিরিয়াস শুইনা কিন্তু রাগতে পারবা না।বিবেচনা কইরা দেখবা।
আচ্ছা ঠিক আছে বল।
শিমুর এবিয়েতে মত নাই।
মত নাই মানে কি?
মত নেই মানে ও এখন পড়ালেখা করতে চাইতেছে।
পড়ালেখাতো করবেই।বিয়ের পর কি পড়া লেখা করা যায়না,নাকি?
তারপরও মেয়েটার মন তুমি বুঝবা না?
আনোয়ার হোসেন বিরক্ত হলেন,মন কি বুঝব এ্যা?অযথা ঘ্যানর ঘ্যানর করতেছ।তুমি চাওনা মেয়ের ভাল যায়গায় বিয়ে হউক,মেয়ে সুখে থাকুক।
চাইতো।
তাহলে বোঝনা কেন?আরে সবসময় কি এমন ভাল সম্বন্ধ হাতে পাওয়া যায়নাকি,এ্যা?
রহিমা চুপসে গেলেন।ৰণিক থেমে আনোয়ার হোসেন আবার বললেন,আর শোন মেয়েরা বিয়ের সময় এমন একটু আধটু করেই এ নিয়া ব্যসত্দ হইবার কিছু নাই,চিনত্দার ও কিছু নাই।তুমি আমারে আর একটা পান দাওতো,তারপর মেয়েটারে পাঠায়া দাও দেখি কি হইছে।
আনোয়ার হোসেন বালিশে হেলান দিয়ে ডান পায়ের উপরে বাম পা তুলে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে পান চিবুতে লাগলেন।কিছুৰণ পরে শিমু এসে বিনিত ভঙ্গিতে দাড়াল তার সামনে।আনোয়ার হোসেন হাত দিয়ে ইশারা করে বসতে বললেন পাসে।শিমু বসল। আনোয়ার হোসেন বললেন,কি বলেছিস তোর মাকে?
বাবা একটা সমস্যা হইছে।
শিমু সব ঘটনা তার বাবার কাছে খুলে বলল।সব শুনে আনোয়ার হোসেন বললেন ঠিক আছে তুই ছেলেটাকে নিয়া আস আমার কাছে।কথা বলে দেখি যদি তোকে গ্্রহন করার মত যোগ্যতা ওর থাকে তাহলে অবশ্যই তোর কথা মেনে নেব।
শিমু যেন হাফ ছেড়ে বাচল,ঠিক আছে বাবা।
আমি দু এক দিনের মধ্যেই ওর সাথে কথা বলতে চাই।
থ্যাঙ্ক ইউ বাবা।
ওকে এখন যাও ঘুমাও গিয়ে।
শিমু প্রফুল্ল মনে চলে গেল।

রমনা পার্ক।পরের দিন সকাল ১০টা।বকুলের জন্য অপেৰা করছিল শিমু।বকুল এলে শিমু বলল,কখন আসতে বলছি?
১০টায়।
এখন কয়টা বাজে?
১০.৩০।
দেরি করলা কেন?
স্যরি।
স্যরি বইলা পার পাইবা না।
কি হইছে এমন করতাছ কেন?
হইব আবার কি,গুড নিউজ আছে একটা তাই এমন করতাছি।
গুড নিউজ, কি গুড নিউজ বল?
তার আগে চল বসি ওখানটায়।
দুজনে গিয়ে বসল একটা গাছের নিচে।
শিমু বলল,আমাকে ভুলে যাও।
বকুল বোকার মত তাকাল ওর চোখের দিকে, তারপর সহজ গলায় বলল,আচ্ছা যাও ভুলে যাব।
দ্যাখ আমি কিনত্দু সিরিয়াসলি বলতাছি।
আমিওতো সিরিয়াসলিই নিতাছি।
ভালবাসনা আমাকে?
বাসিতো।
তাহলে আপত্তি করতাছনা কেন?
আপত্তি করতাছিনা এজন্য যে তুমি সত্য বলতাছনা…
বকুলের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শিমু বলল, না বকুল সত্তি আমাকে ভুলে যেতে হবে তোমার।কাল এসে আমাকে দেখে গ্যাছে।বাবা ওদের সাথে কথা এক প্রকার পাকাপাকিই করে ফেলেছেন।ছেলে সৌদি ফেরত এখন ব্যাবসা করছে।
বকুল এতৰণে সিরিয়াস হল,বল কি দেখে একদম কথাও পাকাপাকি হয়ে গিয়াছে।তুমি কিছু বল নাই?
কি বলার আছে আমার?
কিচ্ছু বলার নাই?
বাবাকে বলছি।
কি বলছ?
বলছি তোমার কথা।বাবা বলছেন তোমারে দেখা করতে।
বকুল চমকে উঠল বলল,তোমার বাবার সঙ্গে এখন দেখা করব আমি?
হ্যা,তুমি!
মাথা খারাপ নাকি তোমার?
তাহলে তুমি কি করতে চাও?
বকুল পাল্টা প্রশ্ন করল,তুমি কি করতে চাও?
শিমু বিরক্তভরা কন্ঠে বলল,আমাকে জিঞ্জাসা করতেছ ক্যান?করবা তো তুমি,তুমি যা করবা তাতেই আমি রাজি আছি।
বকুল বোকার মত শিমুর দিকে তাকিয়ে রইল।শিমু মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খুড়তে খুড়তে ধরা গলায় বলল,যদি বুকে সাহস থাকে তাহলে কিছু করে দেখাও।আর যদি না থাকে তাহলে এই মুহুর্তে চইলা যাও আর কখনো সামনে আইসো না।শুধু মনে রাইখো কোন এক অবুঝ মেয়ে ভালবাসতো এক কবিকে।
কিছুৰণ দুজনেই চুপচাপ রইল।কেউ কোন কথা বলল না।রমনা পার্কের বেনচিতে বসে আছে দুজন।গাছের পাতা ভেদ করে ছাড়া ছাড়া সূর্যেও আলো এসে পড়েছে শিমুর মুখে।কয়েকটা দুষ্ট চুল এসে পড়েছে কপালের উপর।মৃদু বাতাসে সেগুলো খেলা করছে।হাত দিয়ে সে দুষ্ট চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিতে ভুলে গেছে শিমু।কৃষ্নচুড়া,কামরাঙার ডালে কাক,শালিক,টুনটুনির কোলাহল।লেকের পানিতে টোকাই ছেলেরা বারবার লাফিয়ে পড়ে সাতরাচ্্েছ।পিছনে পার্কের বাইরের রাসত্দা দিয়ে প্যাপু শব্দ করে গাড়ী আসা যাওয়া করতেছে।ওরা যেখানে বসেছে তার আসে পাসে আরও কয়েকটা জুটি বসে আছে।আস পাস দিয়ে কত লোকজন আসা যাওয়া করতেছে কিনত্দু এই মুহুর্তে ওরা কিছুই লৰ করছে না,বাইরের কোন কিছুই ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না।ওরা এখন চলে গেছে ভিন্ন এক জগতে।
এভাবে বসে এক ঘন্টা পার করে দিল ওরা।এক সময় বকুল লৰ করল শিমু কাদছে।নীরব কান্না।ধীর গতিতে গাল বেয়ে অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়ছে।শিমুকে দেখে বকুলের নিজেরও কান্না পেল।বসা থেকে দাড়িয়ে বকুল শিমুর সামনে গিয়ে ওর নিচু মুখ উচু করে ধরল।দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রম্ন মুছে দিল।তখনি বাধ না মানা বন্যার পানির মত অশ্রম্ন গড়িয়ে পড়তে লাগল শিমুর চোখ থেকে।বকুল শিমুকে জড়িয়ে ধরল।বকুলের বুকের মধ্যে মাথা গুজে শিমু ফিসফিসিয়ে বলল,আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা বকুল পিস্নজ তুমি কিছু একটা কর।
শিমুর মানসিক অবস্থা কল্পনা করে পৃথিবীর আর সব কিছু ভুলে গেল বকুল।শিমু ছাড়া,প্রেম ছাড়া,ভালবাসা ছাড়া পৃথিবীতে আরও কিছু আছে এটা তার মনে হলনা।সে মরিয়া হয়ে উঠল যে করেই হোক ভালবাসাকে জয় করতেই হবে।এইমুহুর্তে তার কাছে মনে হল ভালবাসার জন্য পৃথিবীর আর সব কিছু সে ত্যাগ করতে পারবে।
বকুল বলল,প্লিজ লক্ষী তুমি থাম।এমন অবুঝ হয়োনা।আমি কালই আসতেছি তোমাদের বাসায়।কথা বলব আমি।যে করেই হোক তোমাকে আমার করবই।
আত্মবিশ্বাস আর বলিষ্টতার ছাপ বকুলের চোখে মুখে স্পষ্ট হল।তা দেখে শিমু স্বসত্দির নি:শ্বাস ফেলল।

বিকেলবেলা বাসায় ফিরে এসে বকুল দেখতে পেল তালাবন্ধ রম্নমের সামনে মেঝচাচা বসে আছেন।বকুলকে দেখেই তিনি উঠে দাড়ালেন।বললেন,তোর মোবাইল বন্ধ ক্যান?সেই দুপুর থেকে ট্রাই করতাছি।
মোবাইল হারায়া গ্যাছে।
কোথায় হারিয়েছে, কিভাবে হারিয়েছে সে কথা জিঞ্জেস না করেই তিনি বললেন, চল।
জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল বকুল।
বাড়ি যেতে হইব এখনই।
বুকের ভেতরটা কেমন ধক করে উঠল বকুলের।বলল,ক্যান কি হয়াছে,এখনই যাইতে হইব ক্যান?
কিযে হয়াছে সেইটাতো আমিও জানিনারে বাপ।
চাচার কথা এবং বলার ভঙ্গির মধ্যে কেমন একটা বিপদের গন্ধ খুজে পেল বকুল।ওর চোখে জল চলে এল।চেপে ধরল চাচার হাত।কি হইছে খুইলা কন আমারে।
চাচা বকুলের কাধের উপরে সানত্দনার হাত রাখলেন।বললেন,তেমন কিছু হয়নাইকা।তুই ঘাবড়াইসনারে বাপ।আগে বারিত যাই তারপর দেখি কি হইছে।
ক্যান কি হইছে?বললে কি হয় আমারে?
কালু শেখ আর মুখ খুললেন না।সেদিন রাত বারটার দিকে তিনি বকুলকে নিয়ে বাড়ি এসে পৌছলেন।
হ্যাজাক লাইটের উজ্জল আলোতে আলোকিত হয়ে আছে বাড়ির উঠান।সেই আলোতে বকুল দেখতে পেল মানুষের সমাগম।পাচ ছয়জন করে দলে বিভক্ত হয়ে নীরব গুন্জন করছে।বাড়ির গাছপালাগুলোও কেমন ঝিম মেরে রয়েছে।
পূবপাসে তিনটি তেতুলের গাছ।উত্তরে একপায়ে দাড়িয়ে থাকা নারকেল ও সুপারির গাছ।বকুল অন্যসময়ে দেখেছে তেতুল গাছে পাতাদের নেচে উঠতে।নারকেল পাতাদের ছন্দে ছন্দে দুলে উঠতে।সে দোল খাওয়া ঘন হলে কি সুন্দর ফর ফর আওয়াজ হত।এসব দৃশ্য বকুল একা একা বসে কতদিন দেখেছে।কিনত্দু আজ এরা সবাই নিশ্চুপ কেন?
পূবকোনে তেতুলতলে লাস গোরোস্থানে নেবার খাটিয়া।উঠোনের মাঝখানে একটি বিছনার উপর মশারি খাটানো।সবুর মোলস্না কচকো সাবানের প্যাকেট খুলছেন।কেউ দুজন ধরাধরি করে এক পাতিল গরম জল এনে রাখল।বকুল ধীরেধীরে এগিয়ে গেল।দৃষ্টিপাত করল মশারির ভেতর শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে।লালু শেখ।যে মানুষটা বাঘের মত তেজী ও বদমেজাজি অথচ বকুলের বাবা।কিনত্দু লোকটা এভাবে এখানে শুয়ে আছে কেন?আর সবুর মোলস্নাই বা এমন কচকো সাবান আর গরম জল নিয়ে রেডি হয়েছেন কেন?সবুর মোলস্নাতো কেবল মানুষ মরে গেলেই শেষ গোস দিতে আসেন।তবে কি বকুলের বাবাটা আজ মরে গেছে।আর এজন্য এমন চুপচাপ শুয়ে আছে।যে বাবাকে বকুল জ্ঞান হওয়া অবধি একদিনের জন্যও ভালবাসতে পারে নাই সে বাবার জন্য সাত সাগরের নোনা জল তার চোখে এসে ভর করল।হাটু গেড়ে বসল বাবার শিওরে দুহাত মাটির উপরে ভর করে নির্বাক চেয়ে রইল নীথর মুখপানে।আর বাধ না মানা অশ্রম্নগুলো বড় বড় ফোটায় রম্নপানত্দরিত হয়ে মুক্তি পেতে লাগল।
কোন ফাকে যেন রুকু আর মুকুলটা ওর পাসে এসে দাড়িয়েছে।ওরা হেচকি তুলে তুলে সুর করে কাদছে।একবার ডানহাতে একবার বামহাতে পালা করে চোখ মুছছে।ডবডবে দৃষ্টিতে ওদের দিকে মুখ ফেরাল বকুল।সবচে ছোট যে ভাইটা মুকুল ওকে বুকে জড়িয়ে ধরল।তাতে ওর কান্না আরও বেড়ে গেল।ধরা গলায় বকুল বলল,কান্দিসনারে ভাই, কান্দিসনা।
ভাইয়া আমাদের বাবা মইরা গেছে তাইনা ভাইয়া?
নারে ভাই না বাবা মরে নাই বাবা ঘুমাইছে।
তাইলে উঠানের মধ্যে ঘুমাইছে ক্যান?আগেতো কোনদিন উঠানের মধ্যে ঘুমায় নাই।
এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারলনা বকুল।শুধু বলল,চুপ থাক ভাই চুপ থাক।কিন্তু চুপ থাকতে চাইলেই কি আর চুপ থাকা যায়,যায়না।কিন্তু কি করার আছে?এ নিষ্ঠুর সত্যতো মেনে নিতেই হবে।বোনটাকেও কাছে টেনে আনল সে।দুটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।নিজে কাদছে অথচ ওদেরকে বলল,কান্দিস না তোরা কান্দিস না।
ওরা কান্না থামাল না।নীরবে বকুলের বুকে মাথা রেখে কাদতে লাগলো।ঘরের পিছনে নারকেল এবং সুপারি গাছের উপর দিয়ে যে আকাশটা দেখা যায় সে আকাশের দিকে চেয়ে রইল বকুল।আকাশের বিশলতার কথা চিনত্দা করতে লাগল।কত বিশাল আকাশ।তার বুকে ঠাই নিয়ে বিসত্দর তারকারাজী।একেকটা তারা নাকি পৃথিবীর চাইতেও কয়েক লাখগুন বড়।এত বড় বড় তারকারাজী আকাশ তার বুকে ঠাই দিয়েছে।বকুল মনে মনে বলল,হে আলস্নাহ তুমি আমার বুকটাকে ঐ আকাশের মত বিশাল করে দাও,যেন আমি আমার এই বুকে আমার এই অসাহায় ভাই,বোন এবং আমার মাকে স্থান দিতে পারি।তুমি আমাকে শক্তি দাও আলস্নাহ, তুমি আমাকে শক্তি দাও আলস্নাহ।আমি আমার এ জীবনে আর কিছুই চাইনা।
সবুর মোলস্না লালু শেখকে গোসল করাচ্ছেন।একটু পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে মসজীদ প্রাঙ্গণে।সেখানে জানাজা হবে।তারপর খালের ওপারের বাশবাগানের পারিবারিক গোরস্থানে তার বাবার পাসে তাকে চীর নিদ্রায় শায়িত করা হবে।বকুলের মনে হল, ইস কি কঠীণ!আচ্ছা সত্য এত নিষ্ঠুর কেন?কি নির্মমতায় ভরা মানুষের জীবন।যে মানুষটা সকালেও শুয়ে ছিলেন তার ঘরে,কত মানুষজন ছিল তার পাসে অথচ আজ সে শুয়ে থাকবে সাড়ে তিন হাত মাটির অন্ধকার কবরে।
কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে কবরের মাঝখানে শুইয়ে দেবে,বাশের চাটাই আর কলাপাতার ছাউনি দিয়ে দোচালা ঘরের মত মাটি উচু করে দিবে।কিছুৰণ দাড়িয়ে দোয়া দুরম্নদ পড়বে সবাই।এক সময় কেউ আর থাকবে না ওখানে।থাকবে শুধু বাশবাগান।রাত নিশুথে যে বাশবাগানে রাত জাগা পাখির ধ্বনি।হয়তো পরের দিন বকুলরা যাবে তার বাবর কবরের পাসে।কিছুৰণ দাড়িয়ে দোয়া দুরুদ পড়বে,প্রার্থনা জানাবে তারপর দীর্ঘশ্বাস নামের ছোট্ট একটা
শ্বাস ফেলে চলে আসবে।এভাবে একদিন দুইদিন এক সপ্তাহ তারপর হয়তো মানুষটাকে তারা ভুলে যাবেনা,কিন্তু আগের মত কওে আর মনেও রাখতে পারবে না।বকুল মনেমনে বলল,সত্যিই কি আমরা ভুলে যাব আমাদেও বাবাকে!
এমনইতো হয়!
এমনইতো দেখেছে সে তার দাদাজানের বেলায়।
কালুশেখের শীতল স্পর্শে উঠে দাড়াল বকুল।পরম নির্ভরতায় পিঠ চাপড়ে কালুশেখ বললেন,শক্ত হ বাপ,শক্ত হ।তোর বাপ আমার ভাইনা?আমার কি কষ্ট হইতাছে না?কিনত্দু কি করবি বল?আলস্নার বিধানতো মাইনা লইতেই হইবো।তার বিধান কনডানোর কোন উপায় নাই।সবচে বড় কথা হল তোর উপর এখন অনেক দায়িত্ব।কাজেই তোর এখন ভাঙ্গা পরলে চলবনা।তোওে এখন শক্ত হতে হইব,পাথরের মতন শক্ত।
চাচার মুখের দিকে নিসত্দব্ধ হয়ে চেয়ে রইল বকুল।
কালুশেখ বললেন,চল ঘরে চল, তোর মার কাছে যাই,তার অবস্থাও এখন ভালনা।একচোট কেদে কেটে মূর্ছা গেছেন।তুইতো আইসা অব্দি এইখানেই বইসা রইলি তার কাছেও তোর যাওয়া দরকার।

কমলা চৌকিতে শুয়ে আছেন।তার পাসে চিনত্দিত বসে আছেন বকুলের চাচী।পাসের বাড়ির জমিলা ফুফু।কমলা এক দৃষ্টিতে ঘরের চৌকাঠের দিকে তাকিয়ে আছেন।দৃষ্টি নড়ছে না।বকুল কাছে গিয়ে বসল।তবু তিনি দৃষ্টি নড়ালেন না।অল্প শোকে পাথর অধিক শোকে কাতর।হয়তো এখন তার অবস্থা ঐপাথরের মত।পাথরের গায়ে হাত রাখলে পাথর যেমন অনুভব করতে পারেনা তেমনি বকুল তার কপালে হাত রাখলে তিনিও অনুভব করতে পারলেন না।
বকুল অস্ফুট স্বরে বলল,মা!মা!
কমলার চোখের দৃষ্টি নড়ল না।যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন সেভাবেই তাকিয়ে রইলেন।শুধু বড় বড় অশ্রু ফোটাগুলো দুচোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
যে স্বামীর সংসারে কমলা এক ফোটা সুখের দেখা পাননি কোনদিন,আজ সে স্বামীর মৃত্যুতে তার কি দশা।একথা ভেবে বকুলের মনটা শ্রদ্ধায় ভরে উঠল তার প্রতি।মনে মনে বলল,বাবাকে হারিয়েছি তোমাকেও যদি হারাতে হয় তাহলে আমি বাচব না মা,মা এটুকু তুমি বোঝ মা।
কালু শেখ বকুলকে ইশরা করে ডাকলেন আয়।
লালুশেখকে খাটিয়ায় করে বয়ে নিয়ে চলল সবাই।বকুলের বুকটা ভেঙ্গে যেতে লাগল।এবাড়িতে মানুষটার কত আধিপত্য ছিল এতদিন।কত শাসন আর ভালবাসায় ভওে রাখতেন সবাইকে।অথচ আজ তিনি চলে যাচ্ছেন।জন্মের মত যাচ্ছেন।আর কোনদিন ফিরে আসবেন না।কিনত্দু বকুলের মনে হল তিনি ফিরে আসবেন।কি ভাবছে বকুল এসব।এসব ভাবা ঠিক না এতে মুর্দারের কষ্ট হয়।সব ভাবনাকে দুরে ঠেলে বকুল সবার সাথে তাল মিলিয়ে পড়তে লাগল কলেমা শাহাদাত,আস্হাদু আলস্না ইলাহা……
সমাধীকার্য সমাপ্ত করে সবাই যখন চলে আসবে তখন বকুল শুনতে পেল তার বাবর গলা।
থমকে দাড়াল বকুল।
চলে যাচ্ছিস বাপ।
হু হু করে কেদে ফেলল বকুল।
আবারো স্পষ্ট শুনতে পেল,তোর মা এবং ভাই বোনদের দেখিস বাপ।
বকুল অস্ফুট স্বরে বলল, দেখব বাবা তুমি আমাকে দোয়া কর।
কালুশেখ বকুলকে জড়িয়ে ধরলেন,চলে আয় বাপ চলে আয়।
বকুল যখনি চলে আসতে উদ্যত হয় তখনি তার বাবার গলা শুনতে পায়,আমারে একলা রাইখা চলে যাচ্ছিস বাপ।
বকুল আবারো ঝরঝর করে কেদে ফেলল,না বাবা আমি কোথাও যাবনা আমি তোমার কাছেই থাকব।
কালুশেখ বললেন,চল।
লালুশেখের গায়েবী কন্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়ে বকুলের কানে বাজল,বকুল!বকুল!
বকুল বলল,বাব!বাবা!

লালুশেখ মারা যাবার তিনদিন পর্যনত্দ কমলা ওভাবেই পড়ে রইলেন।না বিছানা ছেড়ে উঠলেন,না কোন কথা বললেন,না কিছু খেলেন।রুকুটার অবস্থাও তাই।কোনও কথা বলেনা।কোথাও যায়না।শুধু ঘরে বসে কোরান মাজীদ পড়ে।পড়া শেষ হলে কোরান মাজীদ বন্ধ করে একপাসে রেখে মোনাজাত করে।অনেকৰণ ধরে মোনাজাত করে ও।
যতৰণ হাত উচু করে ধরে রাখে ততক্ষণই কাদে।খেজুর রসের মত টপটপ ফোটায় ওর চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
মুকুলের অবস্থা ভিন্ন।ও দিব্যি আছে খাচ্ছে দাচ্ছে স্কুলে যাচ্ছে।যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব।কিনত্দু পড়া শোনায় মন আছে।
বাবার অবর্তমানে সংসারের সব দায়ীত্ব এসে পড়ল বকুলের উপর। এখনও নিজের পড়াশোনা শেষ হয়নাই।সংসারে সবার ভরনপোষণ তার উপর ছোট দুভাইবোনের পড়াশোনর খরচ।কোথা তেকে আসবে এসব।অতি দ্রুত চিনত্দার অথৈ সাগরে পড়ে গেল বকুল।মানুষ অভাবে পড়লে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়।ন্যায় অন্যয়ের তোয়াক্কা নাকওে সে তখন শুধু অভাব হতে মুক্ত হতে চায়।
শিমুর সাথে দেখা করা এখন বকুলের জুরুরী।কথা ছিল তার বাবার সাথে দেখা করবে।কিনত্দু এই জুরুরী কাজটাকে এখন তার কাছে মোটেও জুরুরী মনে হলনা তার কাছে।এখন তার সবচে বেশি প্রয়জন হল একটা চাকরী।ইচ্ছে করেই বকুল শিমুর কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখল।আর শিমু শত চেষ্টা করেও বকুলের কোন সন্ধান বের করতে পারলনা।

তাদের বাড়িটা পড়েছে গ্রাম আর শহরের মাঝামাঝি অবস্থানে।গ্রামের সবুজ বনবনানি ঘেরা,ছায়াঢাকা,পাখিডাকা পরিবেশ যেমন আছে তেমনি আছে নগরজীবনের সব সুযোগ সুবিধা।এখনো একটা বাড়ি থেকে আর একটা বাড়ির দূরত্ব আছে ।বাড়ির সামনে পিছে আছে বিভিন্ন ফল ফলাদির গাছ । সারা বছরই আছে কোন না কোন জাতের ফল ।কিন্তু যেভাবে শহরায়ন চলছে হয়তো এ পরিবেশ আর বেশিদিন আর বজায় থাকবে না।আর শোনা যাবেনা ঘুঘু,টুনটুনি,দোয়েল প্রভৃতি পাখির কোলাহল।গাড়ির ঘোতঘোতানি আর প্যাপু শব্দে পাখির ডাক ম্লান হয়ে যাবে।
ডশমু নিজেওতো কতকিছু বদলে যেতে দেখল।দেখতে দেখতে ওদের বসত বাড়ির আসে পাসে কত ঘর,বাড়ি দোকানপাট গড়ে উঠল।এইতো সেদিনকার কথা,ওরা যখন প্রথম এই বাড়িতে এসে উঠল তখন কি আর আসে পাসে একটা বাড়িও ছিল?ছিল না।পূর্ব দিকে মেইন রোড দিয়ে ঢোকার সময় দু তিনটা বাড়ি তার পর ওদের বাড়ি।আর বাকি যায়গাতো ছিল শুধু ধান ৰেত আর ধানৰেত।ঐ ধান ৰেতের ভিতর দিনের বেলায় শেয়াল লুকিয়ে থাকত।আর সন্ধে হলেই হুক্কাহুয়া ডাকে পুরো এলাকা মাথায় তুলে রাখত।
বিকেল হলেই শিমু উঠত তাদেও একতলা বাড়ির ছাদে।তাকিয়ে থাকত সবুজ বিসত্দৃত ধান ৰেতের দিকে।মৃদু বাতাসে ধান ৰেতের পাতারা পদ্মানদীর ঢেউয়ের মত দুলে দুলে উঠত।আর ৰেতের উপর দিয়ে কিককিড়িত কিককিড়িত ডেকে ডেকে কালো রংয়ের ফেচা পাখি ধানপাতা দোল খাওয়ার তাল রেখে উড়ে বেড়াত আর পোকা মাকড় ধরে খেত।মাঝে মাঝে শিমুর মনে হত সেও যদি এমন ফেচা পাখি হত তাহলে এমন উড়ে বেড়াতে পারত।এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে পাখির কিককিড়িত কিককিড়িত ডাক শুনতে শুনতে সে আনমনা হয়ে যেত,তার মনটা পাখির মত উড়ে যেত, কোথায় যেন হারিয়ে যেত।কার কথা যেন ভাবতো কাকে যেন ভাবতো।
অনেকদিন বসা হয়না ওভাবে।
আজ বিকেল বেলা ছাদের উপওে উঠে পশ্চিম কোনে বসে আছে সে।বহুদিন আগে চৈত্র মাসের এক বিকেলে বসে সে চাষীদের ধান কাটা দেখছিল।ধান কেটে আটি বেধে মাথায় করে গায়ের দিকে নিয়ে যাবার দৃশ্য।কিনত্দু আজ আর ধান কাটার সে দৃশ্য নাই।সামনে একটি বাড়ি নির্মান হছ্ছে।রাজমিস্ত্রিরা কাজ করছে। ইট ভাংগা মেশিনে ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাটর ঘ্যাটর শব্দ করে ইট ভাংগা হছ্ছে।কানে তালা লেগে যায় এমন বিকট শব্দ।
শিমুর মন ভাল নেই।তার মনে হছ্চে ঐ ইট ভাংগা মেশিনের মত ঐরকম একটা যন্ত্র তার বুকের ভেতর চলছে। ন ঘ্যাট ঘ্যাট ঘ্যাটর ঘ্যাটর শব্দ কওে তার বুকের ভেতরটা ভেংগে চ্থড়ে দলামুচড়ি হয়ে যাচ্ছে।সে কিছুতে ভাবতে পারছেনা বকুল তার সাথে এমন করতে পারে।কি প্রয়োজন ছিল তার?কি পেল সে?বা কি পাবে সে শিমুকে এতটা কষ্ট দিয়ে।আচ্ছা না হয় অনেক কিছু পাবে বা পেতে পারে।কিন্তু এতটা চাতুরি করার কি প্রয়জন ছিল?সে আগেই বলত যে এ সম্ভব নয়।তাহলে আর যাই হত অনত্দত তার বাবা মার কাছে তাকে ছোট হতে হত না।

গতকাল রাতে আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন,কোথায়রে ছেলেটাকে নিয়া আসলিনা,আমার কাছে।

শিমুর মুখে কোন কথা ছিল না।নিশ্চুপ দেখে আনোয়ার হোসেন আবার বলেছিলেন,কি হইল কথা বলছিসনা ক্যান?
শিমু অপরাধীর মত মাথা নীচু করে বলেছিল,বাবা মনে হয় কোন সমস্যা হইছে।কয়দিন ধইরা ওর মোবইলটাও বন্ধ রাখছে।
ওরে আর পাওয়া যাইবে নারে মা।তুই বড় বোকা।ও তোরে ধোকা দিয়াছে।না হইলে মোবাইল বন্ধ রাখব ক্যান।
শিমু কোনও কথা বলছিলনা।আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, ওসব ভুলে যা।প্রেম, ভালবাসা বলতে কিছু নাই বুঝলি সব ক্ষণিকের মোহ।তোর এখন মোহ পিরিয়ড চলছে।মোহ কেটে গেলে দেখবি সব ঠিক।তুই আমার একমাত্র মেয়ে আমি তোর ভাল চাই।পাগলামি বাদ দিয়া যা বলি মেনে নে জীবনে সুখী হবি।

কাল রাতে বলা বাবর কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলল শিমু।সে তার বাবার কথাই মেনে নেবে যে করেই হোক সে বকুলকে ভুলবে।

অতপর তার বাবার পছন্দের ছেলের সঙ্গেই তার বিয়ে হল।

এসব আরও কয়েক বছর আগের কথা।স্বামীর সংসারে গিয়ে শিমু সব কিছু পেয়েছে,কিন্তু বকুলের জন্য বুকের গভীরে সূক্ষ,চিনচিনে একটা ব্যথা বোধ রয়েই গেছে।

আর বকুল?পড়াশোনা শেষ করে ভাল চাকরী পেয়েছে।মা ভাই বোন নিয়ে সুখেই দিন কাটাছ্চে।কিন্তু পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো সে কখনো ভুলতে পারেনি।যখন তখন তাকে চেফপ ধরে ভাবনা বিলাস।একা হলেই সিনেমার দৃশ্যের মত একের পর এক ঘটনাগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।শিমুকে ভালবেসেছিল,এখনও বাসে।কিন্তু শিমুর চোখে সে এখন অপরাধী।এরচে কষ্টের আর কি আছে?কষ্ট হোক আর যা হোক ভাবতে বড় ভাল লাগে তার।আজও ভাবছিল।কমলার কন্ঠস্বরে তার কল্পনা ভঙ্গ হল।

তোর স্বভাবটা আর বদলাল না।
কমলা কাথার আড়াল থেকে বকুলের মুখাবয়ব উম্মুক্ত করলেন।কোমল হাতে ওর ললাট স্পর্শ করলেন।বললেন অসুক টসুক বাধাসনাইতো আবার?
বকুল একদৃষ্টে চেয়ে রইল কমলার মুখের দিকে।মনে মনে বলল, তোমার মতন মমতাময়ীর হাত যার ললাট স্পর্শ করে তার তো কোন অসুখ হইতে পারেনা আর হইলেও তা এখন সাইরা গেছে।
কিরে অমন চাইয়া রইলি ক্যা?এ্যা তোর কি ক্ষিদা লাগনো নাকি?তোর মতন এমুন আর একটা পোল দেখাদি আমারে যে এমুন ঈদের দিনেও কাথা মুরাদা ঘরের মধ্যে শুইয়া থাকে।যাইয়া দ্যাকগা আইজকা মাইনষে কত আনন্দ ফূর্তি করতাছে ঘুইরা বেরাইতাছে।আরে ওট ওট আমার তো আরো কাজ কর্ম আছে নাকিরে?
তোমার কাজ কর্ম সারোগা মা আমি পরে খামু।
না,না বাপু এখন আর পরে পরে করলে চলব না।
কমলা বকুলকে টেনে তুলে ফেললেন।কলপার গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল বকুল।কমলা ভাত বেড়ে হাত পাখা নিয়ে বসলেন পাসে।বসে বসে ছেলের খাওয়া দেখতে লাগলেন।গরম ভাত তরকারি ঠান্ডা করতে পাখা নিয়ে ব্যস্ত হলেন।

বকুল বলল,পাখা রাখ তো মা।
ক্যান?
এইটা আমার ভাল্লাগেনা আমি কি মুরুব্বি যে আমারে বাতাস করতে হইব।
তাইলে কি করমু?
তুমিও তো এখনও খাও নাই।বসনা একটা থালা লয়ে আমার পাসে।
তুই খা তার পর আমি খামু।
আগে যখন রান্ধন ঘরে বইসা আধ রান্ধা তরকারিদা ভাত খাইতাম তখনতো আমার সামনে এমুন পাখা লয়া বইসা থাকতানা।খাওয়ার সময় এমুন চায়া থাকতা না,এখন কেন চায়া থাক মা?
আগে তো কাছে থাকতি,নাকি?তখন তোরে সব সময় কাছে পাইতাম।আর এখনতো তোরে সব সময় কাছে পাইনারে বাপ,এজন্য এমুন চায়া থাকি।আমার এই কথা তুই এখন বুজবিনারে বাপ।তয় একদিন হয়তো ঠিকই বুজবি হয়তো সেইদিন আমি থাকব না।প্রত্যেকদিন যখন ভাত খাইতে বসি তখন তোর কথা মনে হয়রে বাপ।মনে হয় এইযে আমি খাইতাছি আমার বকুল কি খাইছে,না খায় নাই?
কমলার চোখ জলে ভারা ক্রান্ত হল।আর একটু হলেই হয়ত ফোটা গুলো টপটপ করে পড়তে শুরু করবে।এটা আড়াল করার জন্য তিনি উঠে দাড়িয়ে মিসেফেটে কি খুজতে লাগলেন।বকুল যেন না দেখে এমন ভাবে চোখও মুছলেন একবার।
মায়ের চোখের জল,এই একটা জিনিস বকুলকে সর্বদা পিড়িত করে।তার মা‌‌ টা না কেমন জানি,কিছু হলেই কেদে কেটে একসার হয়।মায়ের চোখে পানি দেখলে বকুলের কাছে পৃথিবী আর সব কিছু মেকি হয়ে যায়।মায়ের চোখের পানিই হৃদয়ে বড় ব্যথা হয়ে ধরা দেয়।

খাবার মুখ দিয়ে যাচ্ছেনা বকুলের।কিছু বলবে গলাও ধরে এসেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে কমলা আবার বসলেন বকুলের সামনে।
খাসনা ক্যানরে বাপ?
খাওয়াতো শ্যাষ।
তুই এমুন ক্যানরে বাপ?
বকুল কোন কথা বলল না নীরবে থালা চেটে চেটে খেতে লাগল।
কমলা এবার অন্য কথা পাড়লেন।এইবার কিন্তু তুই আর না করতে পারবি না। মাইয়া আমি একখান ঠিক কইরা রাখছি।কত,আমি কার কথা বলতাছি?
বকুল লজ্জিত ভঙ্গীতে তাকাল মায়ের দিকে।
কথা বলছে না দেখে কমল আবার বললেন,কিরে কথা কসনা ক্যান?
আহা!মা সময় তো আরো আছে ।
না বাপু আমি তোর আর কোন কথা শুনতে চাইনা।আর তোর যদি কোন পছন্দ ত, থাকে সেটাও বল।

বর্ষাকাল।
বকুলদের ঘরের ধার ঘেষে খালটা গিয়ে পড়েছে বড় নদীতে। পূর্বে মিরজারচর বাওর আর পশ্চিমে নদী। নদীর নাম বীলপদ্মা। মিরজারচর নিচু অঞ্চল। বর্ষাকালে এখানকার বেশিরভাগ যায়গাই পানির নীচে থাকে।পদ্মা নদী থেকে শিবচর হয়ে হরহর করে পানির স্রোত আসে এদিকে। তখন এই খালটা জ্যান্ত হয়ে ওঠে। শুকনো মউসুমে চৈত্র ফাল্গুন মাসে যেখানে এক হাটু জলও থাকেনা সেখানে বর্ষা মউসুমে ১৫/২০ ফুট উচু হয়ে ক্ষীপ্র গতীতে ছুটে চলে পানি। এত পানি কোথা থেকে আসে কোথায় যায়। ভারী অবাক।

বিকেল বেলা।
ঘরের পিছনে সে খালের পাড়ে একটা হাতল ওয়ালা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আসে বকুল।বসে বসে তীব্র গতীতে ছুটে চলা পানি দেখছে। ওপারে বিশাল একটা মেঘশিরিষের গাছ। গাছের বড় বড় শাখাগুলো খালের প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে দিয়েছে।দেখে মনে হয় গাছটার পুরো খালটাকেই ঢেকে দেবার ইচ্ছা। সেই গাছে লম্বা ঠোঠের মাছরাঙা পাখি বসে আছে।ক্রিক ক্রিক ডাকছে আর লেজ নাচাচ্ছে। পাসেই একটা পানিবলক গাছ। প্রায় বেশির ভাগই পানি গ্রাস করে নিয়েছে। মাথায় কয়েকটা ডালা জেগে রয়েছে মাত্র। স্রোতের তোড়ে ভেসে আসা কিছু কচুপানা আটকা পড়েছে সেখানে। সেখানেই মাথা ডুবিয়ে কয়েকটা হাস শামুক খুজছে। আর মাথা তুলে গজ গজ করে খাচ্ছে। এই শামুক খেয়েই তো হাসের শরীরে মাংস হয়,ডিম পাড়ে। সেই ডিম মাংস মানুষ খায়। এক অর্থে শামুক খাওয়া । ব্যাপারটা ভেবে গা ঘিন ঘিন করে উঠল বকুলের।

সূর্য ঢাকা পঢ়েছে বড় বড় গাছের আড়ালে। মেঘ শিরিষের ডাল থেকে মাছরাঙা পাখিটা ফুরুত করে ঝাপিয়ে পনির উপর আবার গিয়ে বসল আগের যায়গায়। পাখিটার মুখের মধ্যে একটা রুপালি রংয়ের বাশপাতা মাছ। মৃত্যু যন্ত্রণা কাতর মাছটা ছটফট করার ও সুযোগ পাচ্ছে না। অতচ পাখিটার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে। সমগ্র জগত জুড়ে এমনি এক আশ্চর্য নিষ্ঠুর খেলা চলছে। এক শ্রেণী আরেক শেণীকে মেরে আনন্দ পায়। প্রকৃতির এক সূক্ষ খেলা।

“দাদা।”
চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকাল বকুল। রুকুটা পিছনে দাড়িয়ে।
“আরে রুকু তুই কখন আসলি।”
“অনেকক্ষণ”
“ও……..। কথা কসনাই ক্যান এতক্ষণ।”
“কথা বইলা তোর ধ্যান নষ্ট করতে চাই নাই।”
“রুকু তুই না?”
“কি দাদা?”
“বড় ভাল।”
“হু.উ..। দেখতে হইবো না কেমন দাদার বোন আমি।”
“হু। হয়েছে । কখন আসলি?”
“এইতো এখনি। এসেই সোজা তোর কাছে। আচ্ছা দাদা কি দেখছিলি ওমন খেয়াল কইরা?”
“দেখছিলাম মাউছারাঙা কেমুন কইরা মাছ ধরে।”
“ক্যান এইটা তুই দেখসনাই আর কোনও দিন?”
“দেখছি তয় আজকার মতন এমুন খেয়াল কইরা দেখা হয়নাই। তাই এমুন চাইয়া রইছিলাম।”
“আমি তোর পেছনে আইসা যখন দাড়াইলাম তুই টের পাইলিনা তখন আমার কি মনে হইছিল জানস?”
“কী?”
“সাধু। সাধু সন্নাসিরা যেমুন এক ধ্যানে বইসা ধ্যান করেনা।”
“দুর। সাধুদের তো বড় বড় চুল দাড়ি থাকে আমার তা কই?”
“আহা! তুই হইলি গিয়া ডিজিটাল সাধু। চুল দাড়ি ঐসব কিছুনা মনটা হইল আসল।”
“তার মানে তুই আমারে ঐসব বড় বড় মাণুষের কাতারে ফেলতে চাইতেছিস,না?”
“ফেলতে চাইতেছি কিরে! তুইতো সত্যই একজন বড় মাপের মানুষ। অন্তত আমার কাছে। তুই আমার দাদা। তোর আছে রাজার মনের মত একটা মন। এইটা কয়জনের থাকে বল?”
“রুকু!”
“হ, দাদা তুই মনে করছস তোরে আমি বুঝিনা,না? তোরে আমি চিনি নাই,না? না দাদা তুই এই রুকুরে এতটা স্বর্থপর ভাবিসনা।শুধু আমাদের কথা ভাইবা ভাইবা শেষ পর্যন্ত তোর তো কিছুই হইল না। ঐটুকু বয়সেই ঢাকা চইলা গেলি।হেরপর বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরলি।”
“নারে রুকু তুই ভুল বলতাছস। প্রত্যেকটা মানুষ তার নিজের কথা,আত্মশান্তির কথা যতটা ভাবে অন্যের কথা ততটা কখনই ভাবেনা।আমিও আমার নিজের কথাই ভাবছি।”
“সেইটাও আমি জানিরে দাদা।বাবার উপরে অভিমান হইছিল তো।আর অভিমান হওয়াটাও স্বাভাবিক। কোন ছেলে মেয়েই বড় হবার পর বাবা মার এমুন সব কান্ড কারখানা সহ্য করতে পারে না। আসলে বাবার নিজেরও কোন দোষ ছিলনারে। আমি দাদীর কাছে শুনছি।বাবার নাকি তখন বয়স হব,১৪/১৫ বছর। তখন হটাৎ বাবার হইল টাইফয়েড জ্বর।অনেক চড়াই উৎরাই কইরা বাবার জ্বর ভাল হইল ঠিকই।কিন্তু তিনি হইয়াগেলেন অন্যরকম। মেজাজ চড়া কথা বলেন জোরে জোরে। সব কিছুতে একটা অস্থির ভাব। এই জ্বর একবার হইলে তার একটা বিশেষ ক্ষতি হইবই। কারো হাত যায় কারো পা যায় কারো এক সাইড অবস হয়া যায় । বাবার গেল মেজাজের উপর দিয়া। এখন তুই বল বাবার কি দোষ ছিল? বাবা তো আর ইচ্ছা কইরা এমুন হয় নাই।”

বকুল অবাক হয়ে রুকুর দিকে চেয়ে রইল।কথা বলতে বলতে কখন যে রুকু বকুলের সামনের জল চৌকিটাতে এসে বসেছে সে খেয়াল নাই। ও কে দেখে বকুলের মনে হল, অনেকদিন কথা বলেনা রুকু। কথা বলতে বড় ভাল লাগছে ওর। কথাগুলো আর ভিতরে ধরে রাখতে পারছে না। বড় কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা ওর ভিতরে এত কথা জমল কি করে? ওর শশুর বাড়ির লোকজন কি ওর সঙ্গে কথা বলেনা?

একসাথে এত কথা আর কখনো বলা হয়নাই দুজনের। আজ রুকুকে বড় অচেনা লাগছে বকুলের কাছে।

রুকু বকুলের ৫ বছরের ছোট। বকুলের পরে আর একটা মরা ভাই হয়েছিল তারপর রুকু।

ছোট বেলায় দারুন প্রানবন্ত ছিল রুকু।সারাবেলা ছোটাছুটি করত।আর বকুলের সঙ্গে প্রায় সময় ঝগড়া লেগেই থাকত।কত মারত্ ওকে বকুল। তারপর রুকুই এসে প্রথম কথা বলত,”আয় দাদা মায় ডাকতাছে ভাত খাবি না?”
“আমি না একটু আগে তোরে মারলাম?”
“মারলে মারছস আমি কিছু মনে করি নাই,তুই আমার দাদা না!”

তুই,তুই করে ডাকাটা বকুলই ওকে শিখিয়েছে।তুই,তুই করে দাদা বলে ডাকলে বড় ভাললাগে বকুলের। মুকুলটাও ওভাবেই ডাকে।

কিন্তু ওদের বাবা মারা যাবার পরে রুকুটা কেমন জানি পাল্টে গেল।আগের মত সেই চঞ্চলতা নাই। বেশি কথা বলেনা,কেমন গম্ভীর হয়ে থাকে। বিশেষ প্রয়জন ছাড়া বকুলের সঙ্গে কথাই হয়না ওর।

সে বছর রুকু মেট্টিক পাস করল। কলেজ পড়ার বড় শখ ছিল ওর। আহা! সে শখ আর পূরণ হল না। অগত্যা বিয়ের পিড়িতে বসতে হল তাকে। রুকু শশুর বাড়িতে চলে গেল। শশুর বাড়ি থেকে এসে আজ কথার খৈ ফোটচ্ছে।

বকুল এখনো চেয়ে আছে রুকুর দিকে।
রুকু বলল,”তুইওতো কমনা। বড়অভিমান তোর। বাবার কাছে পর্যন্ত ঘেষতি না। বাবা বলে ডাকতি না শেষেতো বাড়ি ছেড়েই চলে গেলি। আর এই জন্য যে বাবার মনে কি পরিমান কষ্ট ছিল তা তুই কেন,আমরা কেউই কোনদিন বুঝতে পারি নাই। আমরা সবাই মনে করতাম বাবা বুঝি এমুন কইরা শান্তি পায়। কিন্তু আমি শেষ কয়টা দিন বাবার অত্যন্ত কাছে ছিলারে। তহন বজছি এই লোকটা যে কি পরিমান মনো কষ্টে ছিলেন। তোর সম্পর্কে বাবার কেমন ধারণা ছিল জানস?”
“জানি।”
“না জানস না। আর যা জানস তা ভুল।এই পৃথিবীতে কিছুকিছু মানুষ আছে যারা ভালবাসার গভীর সমুদ্র বুকের মাঝে লালন করেন।কিন্তু সে ভালবাসার ছিটে ফোটাও কাউকে দিতে পারেন না। ভালবাসা বিলানোর প্রচন্ড ইচ্ছা থাকা স্বত্ত
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
আফরান মোল্লা ভালো লেগেছে অনেক।আমি গল্প-কবিতায় নতুন।প্লিজ কেউ আমাকে সাহায্য করবেন?
Gazi Nishad ভালোলাগা রইলো অনেক। আমন্ত্রণ রইলো আমার কবিতায়।

০৫ জানুয়ারী - ২০১৪ গল্প/কবিতা: ২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪