ইট সিমেন্টে ঘেরা এই চারদেয়ালে মাঝে মাঝেই হাঁপিয়ে উঠি। পাঁজরেরনীচে অসহায় হৃদপিণ্ডটা অস্থিরতায় ইতিউতি করে। একটুখানি মুক্ত বাতাস আর সতেজ প্রকৃতির ছোঁয়া পাবার আশায় জানালার পাশে বসি। কিন্তু হায়! উঁচু উঁচু দালানগুলো ঠেকিয়ে দেয় দৃষ্টির বিস্তীর্ণতাকে। দু-তিনটা আমগাছ, কয়েকটা কলাগাছ, একটা বরই গাছ, চার-পাঁচটা নারকেল গাছ, অল্প একটু খালি জায়গায় ময়লার স্তুপের পাশে বেড়ে উঠা কিছু কচুগাছ, ব্যস আপাতত সঙ্কীর্ণদৃষ্টিতে ধরা পড়া প্রকৃতির কবরের শেষ সবুজের সারি।মৃদু বাতাসে দোলায়িত চিকন নারকেল পাতাগুলো যেন পিয়ানোয় সুর তুলছে। বোঝার ক্ষমতা না থাকলেও আমি নিশ্চিত সেই সুরে আছে বিষণ্ণতা, বেদনা আর স্বজাতি হারানোর আহাজারি। সব হারানো মানুষরা যেমন আবার নতুন আশায় ঘর বাধে ঠিক তেমনি আমগাছগুলোও মুকুলের অলঙ্কারে সজ্জিত। তবু কোথায় যেন একটা বেদনার ছাপ। আধুনিকতার অক্টোপাস আমাদের এমনভাবে জাপটে ধরেছে যে এর থেকে বাঁচার পথ প্রকৃতিকে খুন করে আমরা নিজেরাই বন্ধ করে দিয়েছি। এবার অস্তিত্বহীন মনটা ডাস্টবিনের জঞ্জালের মাঝে গড়াগড়ি খাবে আর পাঁজরের খাঁচায় বন্দি হৃদপিণ্ডটা হাঁসফাঁস করে সঙ্কুচিত হতে হতে মরে যাবে টুপ করে। কিন্তু আমি আমার সাধের মনটাকে আস্তাকুড়ে ফেলে দিতে পারবো না। বিধ্বস্ত হয়ে মরার আগে শরীরটাকে একটু সজীব, সবুজ প্রকৃতির কোমল পরশ বুলানোর তাগিদ অনুভব করছি ভীষণভাবে।
সপ্তাখানেকের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে রওনা হয়ে গেলাম খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে। অতিপরিচিত কোন দর্শনীয় স্থানে যেতে চাই না। কিছুদিন শুধু প্রকৃতির মাঝে নিরবে, নিভৃতে কাটাতে চাই। মনটাকে, শরীরটাকে বোঝাতে হবে ব্যস্ততা আর হতাশার বাইরেও যে একটা ধীর স্থির, আত্মভোলানো জগৎ আছে। রাতের গাড়িতে যেতে হবে বলে একটু খারাপ লাগলো। যেই যানবাহন থেকেই হোক না কেন, চলন্ত অবস্থায় তাড়াহুড়ায় একটু চোখবুলানো সৌন্দর্যগুলো আমাকে খুব আকর্ষণ করে। একটা অতৃপ্তি থেকে যায় মনের মধ্যে। আর সেই অতৃপ্তিটুকুই আমাকে কখনও ভ্রমনে ক্লান্ত হতে দেয় না।
যথাসময়ে বাস ছেড়ে দিলো। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। বাইরের কৃত্তিম আলোকসজ্জা দেখে চোখ দুটোকে আর কষ্ট দিতে চাই না। ভাবনার ভেলায় ভাসতে ভাসতে ঘুমের রাজ্যে চলে গেলাম একসময়। হঠাৎ একটা ঝাকুনি খেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। হতবিহ্বল চোখে এদিকওদিক তাকাতে দেখলাম আমার আশেপাশের সিটে সবাই ঘুমাচ্ছে। মোবাইলে সময় তখন ভোর ৫:১০। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরেদেখার চেষ্টা করলাম। ঘন অন্ধকারে কুয়াশার স্তর ভেদ করে গাছপালার কালো আবছা ছায়া ছাড়া প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। একটু পর সূর্যোদয় হবে বলেই কি কালো অন্ধকার শেষ মুহূর্তে প্রকৃতির কোলে জেঁকে বসেছে। জীবনে চলার পথেও তো এমনি কত অন্ধকারময়, কুয়াশাচ্ছন্ন সময় পার হতে হয়। তখন মনে হয় এখানেই বুঝি জীবনের শেষ। আর বুঝি কিছুই বাকি নেই। তারপর আশার সূর্য এসে হাত বাড়ায়, পরম মমতায় নতুন দিনের, নতুন স্বপ্নের বীজ বুনে যায়।
দিগন্তে পাহাড়ের বুকে আলোর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ফসলি জমি, ছোট ছোট টিলা ঘেরা গাছপালা, সাজানো ঘরবাড়ি, দুরের পাহাড়, সবকিছু হালকা মসলিনের কুয়াশার চাদরে ঢাকা। এরই মাঝে আলোর তীর ছিটিয়ে পাহাড়ের আড়াল থেকে একটু একটু করে সূর্য এলো নতুন দিনের ঘণ্টা বাজিয়ে। সদ্য জেগে উঠা সূর্যের নিষ্পাপ আলোর ছোঁয়া গতরাতের মনখারাপকে ধুয়ে মুছে দিয়ে গেলো।
ভোর ৬:৩০।বাস খাগড়াছড়ি পৌঁছে কিছুক্ষন বিরতি নিলো।তারপর ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়েমারিশ্যার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ওখানে আমার ছোটখালার বাসায় উঠবো। খাগড়াছড়ি পর্যন্ত কিছু দেখতে না পারার আক্ষেপটা মিলিয়ে গেলো মারিশ্যার রাস্তায় এসে। আঁকাবাঁকা উঁচুনিচু রাস্তা। একপাশে উঁচু টিলা,অন্যপাশে পাহাড়ি খাদ। মাঝখানের রাস্তাটাকে প্রশস্ত বলা যাবে না। দুটো গাড়ি কোনমতে যেতে পারবে।প্রতিটি বাঁকে নীচে তাকালেই বুক কেঁপে উঠে।নীচে,কত নীচে ছোট ছোট ঘরবাড়ি। পাহাড়ের খাঁজে জুমচাষ করা হয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে কলাগাছের সারি। দুপাশে টিলার মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়ি গাছের ডালগুলো বাসের গায়ে আঁচড় দিয়ে যেন বলতে লাগলো,“কেন ভাই আমাদের বিরক্ত করতে এলে। একটু নীরবে, নিভৃতেও কি থাকার উপায় নাই!”
নির্দিষ্ট জায়গায় আসার পর নেমে পড়লাম। বাজার থেকেরিক্সা নিয়ে বাসার দিকে যেতে যেতে একটু অবাক হলাম। বিস্তীর্ণ সমতল জায়গা জুড়ে এই এলাকা। রাস্তার দুইপাশে ফসলি জমি, কাঁচাপাকা ঘরবাড়ি। দুরের আবছা পাহাড়গুলো না দেখা গেলে বোঝাই যেতোনা কোন পাহাড়ি এলাকায় আছি। দশ মিনিটের পথ শেষে বাসায় গিয়ে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। শীতের সময় বলেই রাস্তার প্রচণ্ড ধুলায় গা চুলকাতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি গোসল সেরে নিলাম। ততক্ষনে খালু সামনের উঠানেবেশ কয়েকটা সুপারি গাছের ছায়ায় টেবিল,চেয়ার পেতে দিল। আয়েশ করে বসে চারপাশে তাকালাম। বাড়ির পাশের জমিতে মৃদু হাওয়ায় দোলায়িত ছোট ছোট ধান গাছ।একটা খালি জমিতে গোড়ালি সমান পানি,সেখানে কিছু হাঁস পানিতে হড়বড়, চড়বড় শব্দ তুলে খাবার খুঁজছে। একটু দূরে অনেকগুলো নারকেল গাছের নীচে একজন মহিলা লাকড়ি কাটছে, পাশেই আরেকজন মাটির দাওয়া লেপন করছে। এ যেন আমার সেই চেনা পরিচিত গ্রামের পরিবেশ। প্রতিটি কোনায়, প্রতিটি খাঁজে কত শান্তি,মমতা আর নির্ভরতা ছড়িয়ে আছে। প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিলাম।কতদিন পর, সত্যি অনেকদিন পর এতো সবুজের সমারোহ বা বলা যায় বাল্যস্মৃতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল।আচমকা একটা সুপারি আমার মাথায় টুপ করে পড়লো। খালামনি পেছন থেকে হেসে বলল,“বেচারা বেরসিক সুপারি,ভাবনার স্রোতে ঢিল মেরে দিলো তো ভাবুক মনের বারোটা বাজিয়ে!” আমিও হাসতে হাসতেবললাম,“কাছের সৌন্দর্য রেখে দূরের মোহে মগ্ন থাকলে ঈর্ষা করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।” এভাবে কিছুক্ষন হাসিঠাট্টা চলল। তারপর খালামনি রান্নার আয়োজন করতে চলে গেলো। পেছন পেছন আমিও গেলাম। মাটির চুলায় রান্না হচ্ছে। ধোঁয়ায় রসুই ঘরটা ভরে গেলো। সেই ধোঁয়ায় আমার শৈশব, কৈশোরের স্মৃতিগুলো ভেসে ভেসে চোখের সামনে মায়ার জাল বুনতে লাগলো। খালামনির কিছু কথা শুনছিলাম বাকিগুলো স্মৃতির জালে জড়িয়ে গেলো। ঠিক এমন করেই আম্মু রান্না করতো আর আমি পাশে বসে পড়া তৈরি করতাম। কতো শান্ত, নিবিড়, সুখময় দিন ছিল সেগুলো। কোন অস্থিরতা, অপূর্ণতা, না পাওয়ার বেদনা তো বোধ করিনি তখন। প্রকৃতির মমতার আঁচলের নীচে পরম নির্ভরতায় বড় হয়েছি। অথচ এখন কোথা থেকে এলো এতো অধীরতা, ক্ষণে ক্ষণে কেন বিচলিত হয় মন। তাহলে কি প্রকৃতির রুক্ষতা মানুষের মনেও ছাপ ফেলে যায়! ধোঁয়া হোক বা স্মৃতি মন্থনে, চোখ জ্বালা করতে লাগলো। উঠে চলে এলাম বাইরে। ক্লান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিতেই হবে।
বিকেলে সবাই মিলে বি.জি.বি. ক্যাম্পের পার্কে ঘুরতে গেলাম। কাঠের রঙ্গিন সেতু পার হয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাচ্চারা যার যার রাইড নিয়ে খেলায় মেতে উঠলো। আমরা বড়রা একটু দূরে ঘাসে ঢাকা সবুজ গালিচায় পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। পার্কের চারপাশ ঘিরে থাকা শুভ্র, নিরেট ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁকে ফাঁকে অস্তগামী সূর্যের লুকোচুরি খেলা বেশ লাগছিলো। শীতের সন্ধ্যাটা খুব তাড়াতাড়িই আসে।আকাশের পটে নানা রঙ্গের ছোঁয়ায় সূর্য ডুবে যাচ্ছিল অন্ধকারের নীচে।
ঠিক হলো পরের দিন সাজেক ভ্যালি ঘুরতে যাব। তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পুকুর পাড়ে চলে এলাম। সূর্যের তির্যক রশ্মি ডালপালার ফাঁক দিয়ে গলে গলে পড়তে লাগলো শিশির সিক্ত ঠাণ্ডা পুকুর জলে। পাতা ধোঁয়া, ঝরা শিশিরের ফোঁটা মৃদু আলোড়ন তোলে পানিতে। আমিও টোকা দিয়ে মৃদু ঢেউয়ে তার প্রতিউত্তর দিলাম। কালচে শীতল পানিতে মুখ ধুয়ে মন এতটা হালকা হয়ে গেলো, মনে হলো বুঝি কুয়াশার মতো পাঁক খেতে খেতে দূর ওই আকাশে চলে যাবে।
সাজেকের পথে রওনা হতে হতে একটু বেশিই সকাল হয়ে গেলো। ড্রাইভার সেটা পোষাতে শর্টকাট রাস্তা ধরলো। ইট বিছানো রাস্তা তার উপর কোথাও কোথাও কিছু ইট উধাও। লটরপটর ঝাঁকি খেতে খেতে চারপাশের নানা বর্ণের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে মুগ্ধ করে রাখল। শীতের বিদায় আর বসন্তকে আমন্ত্রন জানানোর পালা এখন। দুপাশের ঘন গাছপালার নিষ্পত্র ডালগুলোর এখনও পাতার সরসর ধ্বনি তোলার ক্ষমতা হয়নি। শুধু একে অন্যকে আলতো ছুঁয়ে সান্তনা দিচ্ছে। শীঘ্রই তারা আবার জেগে উঠবে। আধবোজা মুকুলেরা গাছেদের এই নগ্নতার নির্লজ্জ অপমানের হাত থেকে রেহাই দেবে। শীতের রুক্ষ, বিরস শীতল হাওয়ায় ঝরা পাতাগুলো উড়ে উড়ে যেন সেই বার্তা শুনিয়ে যাচ্ছে।
উজোবাজার থেকে আমরা প্রধান রাস্তা ধরলাম। পিচঢালা রাস্তার দুইপাশে নালা কাটা।এক জায়গায় দুটো পাহাড়ি ছোট বাচ্চা নালার মধ্যে বসে কি যেন খেলায় মগ্ন ছিল। আমাদের গাড়ি কাছে আসতেই হাত তুলে টাটা দিতে লাগলো। আমরা তো সবাই অবাক। কিছুদূর যাওয়ার পর স্কুলব্যাগ কাঁধে আরও কয়েকটা ছেলেমেয়ে আমাদের টাটা দিতে লাগলো। এবার আমরাও প্রতিজবাবে হাত নেড়ে দিলাম। বুঝলাম যে এখানে পর্যটকদের আনাগোনার কারনেই সহজ সরল পাহাড়িরা এই অভ্যর্থনা শিখেছে।
উঁচু নিচু সর্পিল পথের দুপাশের কলাগাছ, বাশগাছ আরও অজানা সবুজ গাছের দৃশ্য যেন দেখেও আশ মিটছিলো না। উপর থেকে নীচের সরু নদীটা একবার স্পষ্ট হচ্ছিলো আবার কিছু পরেই যেন উধাও হয়ে যাচ্ছিলো। কুয়াশায় ঘেরা রহস্যময় পাহাড়গুলো মনে শান্তির প্রলেপ দিয়ে যেতে লাগলো। সূর্যের তেজরশ্মিতে কাশফুলগুলো যেন সাদা কুলফি। অথচ নদীর পাশের কাশফুল দেখলে মনে হয় সূতায় বাঁধা সাদা প্রজাপতি। হেলেদুলে হাতছানি দেয়। প্রকৃতির কি ভিন্নতা!
বেশ কয়েকটা সেতু পার হয়ে এলাম। সেতুর দুপাশে অনেক হলুদ রোদে দেয়া। মুলির বেড়ায় ঘেরা ঘরগুলোর দাওয়ায় বসে উপজাতি মেয়েরা কাপড় বুনছে।কেউ আবার ইউক্যালিপ্টাস গাছের ছায়ায় অলস সময় কাটাচ্ছে।মাঝে মাঝে কিছু মোটা মোটা অনেক পুরানো গাছ। বড় আর কয়েকটা ছোট গাছ একটার সাথে আরেকটা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। বড় গাছগুলোর কিছু ডাল নিষ্পত্র আর কিছু বিবর্ণ সবুজ পাতায় ভরা। সম্পূর্ণ পত্রবিহীন ছোট গাছগুলো যেন পেন্সিলের স্কেচ। একটা কালো কুচকুচে গাছ, শুধু দু তিনটা শাখা ছাড়া আর কিছুই নেই। দেখে মনে হয় কেউ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে!কতো নাম না জানা পাহাড়ি ঝোপ।হলুদ হলুদ জংলী ফুলের উপর ছোট ছোট প্রজাপতির মেলা।আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথেকখনও উঠছি, কখনও নামছি। এর যেন শেষ নেই। চারপাশের দৃশ্যের মধ্যে এতো উদারতা আর ভালোলাগা ছড়ানো যে মনে হচ্ছিলো,“এ পথ যেন কখনও শেষ না হয়।”
দেখতে দেখতে রুইলুই পাড়ায় চলে এলাম। কাঁচা পাকা বর্ণিল ঘর বাড়ি। নীল টিন, বাদামী রংয়ের কাঠ আর নীচের এক ফুট লাল ইটের তৈরি ক্লাব হাউজটা ভীষণ সুন্দর। আজ বোধ হয় ওদের কোন অনুষ্ঠান। ক্লাবের সামনে শামিয়ানা টাঙানো।চেয়ারে উপজাতি মেয়েরা সুন্দর করে সেজেগুজে বসে আছে। চলতি পথের এই দৃশ্যটা সত্যি মুগ্ধকর। মুলি ঘেরা ঘরগুলোতেও ছিল রংয়ের ছোঁয়া।আর এক কি.মি. পরেই সাজেক বি.জি.বি. ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। এদিকে রাস্তার পাশে বড় বড় গাছপালা নেই। দূরের কালো পাহাড়টা এখন অনেকটাই স্পষ্ট। রাস্তা থেকে ক্যাম্প একটু উঁচুতে। মাটির খাঁজ কাটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনটা কেমন উদাসী হাওয়ায় উড়াল দিতে লাগলো। বড় বড় গাছপালার ছায়া ঘেরা জায়গায় চাদর বিছিয়ে আমরা বসে পড়লাম। দুপুরের খাওয়া সাথেই নিয়ে এসেছিলাম।তারপর খাওয়া দাওয়া, হৈচৈ, ছবি তোলা, গল্পগুজবে অনেকটা সময় কেটে গেলো।
ক্যাম্প থেকে আরও কিছুদূর হেঁটে পাথরের উপর অবস্থিত সাজেক পাড়াতে গেলাম। এই ভ্যালীর সর্বোচ্চ উঁচু স্থান। পাথর কাটা কয়েকটা সিঁড়ি টপকে সেখানে পৌঁছালাম। স্থানীয়দের আচরণ বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ। বেশীরভাগ গ্রামবাসী খ্রীষ্ঠান। একটা গীর্জাও আছে। আমি বড় একটা পাথরখণ্ডের উপর দাঁড়ালাম। নীচে সবুজ উপত্যকা আর উপরে ধোঁয়াশা গাঢ় নীল আকাশ।ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট ঢেউ খেলানো উপত্যকাগুলো যেন রং-চটা সবুজের চাদরে মোড়ানো।বাতাসে পাহাড়ি ফুলের বা পাতার ঝাঁজালো ঘ্রান।পাথরের ফাঁকে ফাঁকে গজানো ফার্ন।গাছের ডালে ময়না পাখির কর্কশ চেঁচামেচি। সবকিছু আমায় মোহাবিষ্ট করে রাখলো। এতো সুন্দর রূপ শুধু এই বাংলায়ই পাওয়া সম্ভব। এতোদিন মনের কোনে যে ছেঁড়া অসহনীয় স্মৃতিগুলো জমিয়ে ছিলাম,আজ তা এখানে মৃদু বাতাসে উড়ে চলা শুকনো পাতাগুলোর সাথে উড়িয়ে দিলাম। চলে যাক, উড়ে যাক, নীচে আরও নীচে উপত্যকার শেষে নোংরা আবর্জনাতেই ওদের জায়গা হওয়া উচিৎ। মনের কোনে জমিয়ে রেখে আর নিজেকে কলুষিত করতে চাই না। হয়তো এভাবেই ভাবতে ভাবতে সময়ের পর সময় পার করে দিতে পারতাম। কিন্তু বিদায় যে নিতেই হবে। শেষবারের মতো এই মনমাতানো, রংসাজানো, দুঃখ ভুলানিয়া নৈসর্গিক রূপ আমার হৃদয় পটে এঁকে নিলাম।