স্মরণাবর্তের বেলা অবেলা

মুক্তিযোদ্ধা (ডিসেম্বর ২০১২)

আহমাদ মুকুল
  • ৩৫
  • ১৪
‘ভাই’ বলবেন নাকি ‘স্যার’ বলবেন ভাবতে ভাবতে বিনা সম্বোধনেই হাতটি বাড়িয়ে দিলেন শামসুদ্দিন সাহেব।

: আমি শামসুদ্দিন। আপনি আমাকে ডেকেছিলেন।

বাড়িয়ে দেয়া হাতটি বোধহয় দেখেননি কর্মকর্তা ভদ্রলোক। কানে ল্যান্ডফোনের রিসিভার। দুর্বোধ্য একটা ইঙ্গিত করলেন। বসুন, অপেক্ষা করুন, তফাত যান- যে কোন একটি অর্থ হতে পারে। একজন ফোনে কথা বলা অবস্থায় তার দিকে শেকহ্যান্ডের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়া, কিংবা পরিচয় দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা ঠিক শোভনীয় নয়, জানেন শামসুদ্দিন সাহেব। কিন্তু কি করা? গত ৮৩ মিনিট ধরে ভদ্রলোককে হয় মুঠোফোন, না হয় টেলিফোনে কথা বলা অবস্থায়ই দেখছেন। দু’দফা পনেরো মিনিট করে চুপচাপ বসে থেকেছেন। মাঝখানে একবার টয়লেট, একবার ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে এসেছেন। অবস্থা তথৈবচ।

অথচ আজ সকালে ভদ্রলোকের চেম্বারে ঢুকেই তাকে পেয়ে অন্য রকম দিনের সূচনা ভেবেছিলেন। নটায় অফিস, সোয়া নটাতেই ভদ্রলোক সিটে আছেন! তার উপর কাজের লোককে সময় মত নিজ আসনে পাওয়া এ ধরণের অফিসে বিরলই বলা যায়। ভদ্রলোক মনে হয় `স্মরণীয় বাণী’ ভক্ত। টেবিলের কাঁচের নিচে সাজানো বিভিন্ন রকম বাণী নসীহত। প্রায় সবগুলোই মুখস্থ হয়ে গেল সামসুদ্দিন সাহেবের।

: শোন, কাল পর্যন্ত দেখবো আমি। ….সহ্যের একটা সীমা আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এত বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। সে যত বড় আমলাই হোক, আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে তার কাছে বারবার যেতে পারবো না……

ফোনের ওপাশে উনার জুনিয়র কেউ হয়তো। আরেক জনের সামনে বসে তার ব্যক্তিগত কিংবা দাপ্তরিক যাই হোক, ফোনালাপ শোনা- নিজের কাছেই বিব্রত লাগছে শামসুদ্দিন সাহেবের। কিন্তু উপায় কী? কাজটি এখনই করিয়ে নিতে হবে। তা নাহলে আবার কখন তাকে পাওযা যাবে এ নিশ্চয়তা কে দেবে?

কখনও কারো সাথে নমনীয় স্বরে, কখনও চেঁচিয়ে খেকিয়ে নির্দিষ্ট একটি কাজের জন্যই কথা বলে যাচ্ছেন। নাহ, খাজুরে আলাপ মোটেই করছেন না ভদ্রলোক- এটুকুই সান্তনা। শামসুদ্দিন সাহেবের পর্যবেক্ষন শক্তি খুব ভাল। মি. নেওয়াজ, যার সামনে গত দেড় ঘন্টা ধরে বসে আছেন, তার কাহিনীটি মোটামুটি ধরে ফেললেন।

চাকরির অন্তিম সীমায় মি. নেওয়াজ। মুক্তিযোদ্ধা চাকুরে হিসেবে বাড়তি দু’বছরের মেযাদ শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে সরকার সকল সরকারি চাকুরেদের অবসরের বয়সসীমা সাধারণভাবে দু’বছর করে বাড়িযেছে। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাড়তি দু’বছরের পর সাধারণ সুবিধা হিসেবে আরো দু’বছর আদায় করার জন্য তার এই দৌড় ঝাঁপ।

শামসুদ্দিন সাহেবের কাজটি নেহাতই ছোট। নেওয়াজ সাহেব কলমের খোচায় ‘প্রতিস্বাক্ষরিত’ সিলের নিচে তার স্বাক্ষরটি বসিয়ে দিলেই চলে। অথচ তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবার জন্য দু’বার ‘Query’ করেছেন। তার জিজ্ঞাসামূলক তথ্যানুসন্ধান মহামূল্যবান! ‘আবেদনকারী ও তার স্ত্রীর ম্যারেজ সার্টিফিকেট’, ‘সন্তানের জন্মনিবন্ধন সনদ’ এবং এরপরও ‘আবেদনকারীর সন্তান প্রকৃতই তার সন্তান কী না সে বিষয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সনদ’ সংগ্রহ করে জমা দিতে হয়েছে। সবশেষে অফিসার বাহাদুর সিদ্ধান্ত দিয়েছেন- ‘‘আবেদনকারীকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হতে হবে।’’ যার কারণে শামসুদ্দিন সাহেব এখানে।

কাজটি হচ্ছে না, কিংবা দেরী হচ্ছে দেখেও তেমন একটা ক্ষেদ নেই শামসুদ্দিন সাহেবের মনে। কারণ বড় কোন চাওয়া পাওয়া নিয়ে তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে ঘোরেন না। ছেলে পুলিশ বাহিনীতে কমিশন পাচ্ছে। তার পাসিং আউট অনুষ্ঠানে অভ্যাগত পিতামাতা হিসেবে ‘মুক্তিযোদ্ধা পাস’ অর্জনের চেষ্টায় তিনি এখানে। একটু বিশেষ ব্যবস্থাপনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাশে বসে স্ত্রীকে নিয়ে ছেলের মহড়া দেখার ইচ্ছে ছিল তার। নাহ্, তার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কোটায় চাকরি পায়নি। মেধা কোটাতেই নিয়োগপ্রাপ্ত। তিনি নিজেও মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে কোন সুবিধা কিংবা ভাতা নিতে আগ্রহী হননি। যদিও তার অতি টানাপোড়েনের জীবনে সরকারি সহায়তা পেলে হয়তো কিছুটা অনটন কমতো। অথচ মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় কিংবা সনদটি কিন্ত গর্বের সাথেই তিনি সংরক্ষণ করেন।

শামসুদ্দিন সাহেব অবাক হলেন- ভদ্রলোক নিজেই জ্বালায় আছেন, এর মাঝে সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে ফাইলে প্যাঁচ লাগানোর এতো বুদ্ধি পান কোথায়? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, ‘‘আপনার কী মনে হয় নিজের সন্তানের অনুষ্ঠান দেখতে আমি আরেকজনের বউকে সাথে নিয়ে যাবো? এটি কী রো’ধরা কোন ধনী পৌঢ়’র প্রমোদ ভ্রমণ?’’ এর মধ্যে হঠাৎ পরিস্থিতি বদলালো। ‘‘আপনার কাজটি যেন কী”- টেবিলের ওপাশ থেকে আসা অভাবনীয় পরিবর্তিত আওয়াজে স্মরণ থেকে সময়ে ফিরলেন শামসুদ্দিন সাহেব।

: ফাইলটি আপনার সামনেই আছে। তবে আপনি আপনার নিজের কাজটি আগে সারুন। আমার তাড়া নেই।

: ওহ, আপনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা দেখছি! ফাইল থেকে মাথা উঠিয়ে বললেন নেওয়াজ সাহেব।

: জ্বী। মনে করে দেখুন তো, চেনা যায়? আমরা বোধহয় একই ইউনিটে ছিলাম!

অপ্রস্তুত হলেন নেওয়াজ সাহেব। স্মৃতি বড় ঝাপসা হয়ে গেছে। প্রায় কিছুই আজকাল তার মনে পড়ে না। চেনার চেষ্টা করছেন ভদ্রলোককে। চেষ্টাটি ব্যর্থ হওয়ায় একদিকে ভালই হয়েছে, বিচ্ছু কমান্ডার শামসু’র যুদ্ধ ময়দানের নিষ্ঠুর ঠাণ্ডা চাউনীর কথা মনে পড়লে হয়তো এই শীতল ঘরেই তার ঘাম ছুটতো। তার অবচেতন মন হয়তো মনে করতে চাইছে না ভাঙা পা নিয়ে পাহাড়ী পথে দশ মাইল হাঁটার কথা। পাক বাহিনীর আচমকা আক্রমণে ক্যাস্প গুটাতে বাধ্য হয় তারা। অপারগ নেওয়াজ হাল ছেড়ে দিয়েছিল, আরেকটু হলেই ধরা পড়ে মারা পড়তো। শামসু রাইফেল তাক করে ওকে দৌঁড়াতে বাধ্য করে। জ্ঞান ফিরে পেয়ে নেওয়াজ নিজেকে শামসুর কাঁধে আবিষ্কার করেছিল। পরে নিরাপদ ছাউনীতে বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনেছিলো- ছেড়ে আসা এলাকা পুণর্দখলে শামসু কমান্ডারের ভয়ানক গেরিলা যুদ্ধের কথা।

কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছেন নেওয়াজ। চাকরি জীবনের আশু ভবিষ্যত ভেবে অশান্তি, নাকি ফেলে আসা সময়ের কোন সংকোচ! ….ফাইলটি ছেড়ে দেয়া দরকার। ‘প্রতিস্বাক্ষরিত’ এর নিচে সইটা দিতে যাবেন, ঠিক সে সময়ে মুঠোফোন বাজলো। তার চিন্তাজুড়ে অবস্থান নেয়া বিষয়টির জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ফোন। গভীর আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আবার। হিসেবী ‘বর্তমান’ আবারও ভুলিয়ে দিলো গৌরবময় অতীতকে।

আর ভদ্রলোককে বিরক্ত করা যায় না। তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতা(!) দিয়ে ফাইলটি নিষ্পত্তি করতে চেয়েছেন। শামসুদ্দিন সাহেব নিজেই সাক্ষী। ভদ্রলোকের কাজের বোঝায় শাকের আঁটি হয়ে বসে থাকা শোভনীয় মনে হলো না তার। নিঃশব্দে উঠে পড়ে চলে আসলেন একেবারে। তার ভাবলেশহীন নজরে ফেলে আসা ব্যক্তিটির জন্য মায়া, নাকি এক ব্যর্থ যোদ্ধার জন্য করুণা ঝরে পড়লো- ধরা গেল না।

ছেলেকে ফোন করলেন।

‘‘…..আমরা আসছি তোমার অনুষ্ঠানে। তবে কোন উচ্চ আসনে বসে নয়, তোমার সম্মাননা পদক গ্রহণ সমতল থেকেই দেখবো। ওখান থেকে দুনিয়াটা কাছ থেকে দেখা যায়, গর্বটাও সবচেয়ে ভাল মতন অনুভব করা যায়।’’

তার ছেলে আত্মস্থ করে বাবার অনুভূতি। পারিবারিক ঘরানায় বাবার আদর্শ ভালমতই নিতে পেরেছে সে। অনেক চাওয়া পাওয়া মানুষের। অনেক আকুতি, অভাব অভিযোগ শোনে অহরহ। অথচ তার বাবা ব্যতিক্রম। তিনি প্রায়ই বলেন-

‘‘দেশটির কাছ থেকে এখনও চাওয়ার সময় হয়নি,……চারাগাছ পুঁতে বটের ছায়া আশা করলে তো চলে না। গাছটিকে বড় হতে দিতে হবে, যত্নআত্মি করতে হবে। বৃক্ষ হয়ে উঠলে একদিন শুধু ছায়া নয় সুমিষ্ট ফলও দেবে।’’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
রনীল শেষের উপলব্ধিটা অপূর্ব... আমাদের সবার তো এভাবেই চিন্তা করা উচিত... মেসেজ, লেখনী, উপলব্ধি- সব মিলিয়ে সুন্দর একটা গল্প...
খন্দকার আনিসুর রহমান জ্যোতি গল্পটা ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়বার দরকার ছিল না যদি জানতাম শেষের এমন দুটি লাইন রয়েছে.........বেশ কিছু লেখা এবারের সংখ্যায় পড়লাম তাতে সবাই দেশের কাছে শুধু চায়ে নিজেদের অক্ষমতাকে জাহির করেছে.... কিন্তু দেশষকে দেয়ার কোন কথা সেখানে নেই....চারা গাছটিকে যত্ন করার মুরোদ নেই অথচ ফল খাওয়ার সখ.....হায়রে মানুষ! আপনার লেখা পড়েও কি তাদের চৈতন্য ফিরবে মুকুল ভাই????? যাইহোক অনেক ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম...ধন্যবাদ আপনাকে..............
তাপসকিরণ রায় ছোট গল্পটি ভারী ভালো লাগলো.লেখককে ধন্যবাদ জানাতেই হয়.
হাসান মসফিক ভালো লাগলো। আমি আসলে বেশ আশাহীন । তাই আশাবাদী মানুষ আর কথা বার্তা শুনলে , নিজের আশাহীনতার ঘোর খানিকটা কাটে! শুভেচ্ছা। আপনার চীন দেশ সফর কেমন হল?
নিরব নিশাচর এই হলো মুকুল ভাইয়ের গল্প... গতবার গল্প পড়ে যেই অতৃপ্তিটা ছিল এবার তা পুষিয়ে দিলেন... ভিতরের স্যাটায়ার এবং শেষ অংশের মোরাল উক্তি একজন পাঠকের হলেও মোরাল পরিবর্তন আনবে... যাই হোক, শেষের প্যারাটা বাস্তবের কোনো শামসু-দের ভিতর থাকুক না থাকুক, বাস্তবের কোনো এক লেখকের মনে আছে দেখে ভালো লাগলো... তবে চারাগাছটা যেন আ'গাছা না হয়ে যায় সেটাই শুধু ভয়... !!
আশিক বিন রহিম vaiya amar antorer ghovir theke apna-k donnobad.sundor golper jonno...
মোহাঃ সাইদুল হক বেশ ভালো লেগেছে গল্পটি। শুভ কামনা রইলো।
রোদের ছায়া আজকেই একটা চ্যানেলে একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনলাম, উনি বললেন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে গেলে তাদের কে কোন সম্মানই দেখানো হয়না । আর আপনার গল্পেও সেই বাস্তবতার ছোঁয়া । বেশ ভালো লাগলো । ''‘‘দেশটির কাছ থেকে এখনও চাওয়ার সময় হয়নি,……চারাগাছ পুঁতে বটের ছায়া আশা করলে তো চলে না। গাছটিকে বড় হতে দিতে হবে, যত্নআত্মি করতে হবে। বৃক্ষ হয়ে উঠলে একদিন শুধু ছায়া নয় সুমিষ্ট ফলও দেবে।'' কিন্তু কবে যে সেই সময় হবে ??
বশির আহমেদ আপনার গল্পটি আমার বেশ মনে ধরেছে । সামছুদ্দিন সাহেবের মত মুক্তিযোদ্ধারা সব সময় বঞ্চিতই থেকেই যাবে কারণ আজ যে যতবেশী যোগাযোগ রক্ষা করে তৈল মর্দনে পারঙ্গম সে ততবেশী লাভবান । সুন্দর গল্পের জন্য ধন্যবাদ ।
সুমন অসাধারণ উপস্থাপনা, পরিমিতি বোধটা নজর কাড়ল।

১৯ জানুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৪৩ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪