-ধরনীর সকল গরল আমি কণ্ঠে করেছি ধারণ….আমি নীলকণ্ঠ!....
-আরে রাখেন মিয়া আপনের কাব্যগিরি…..যেইটা করার সেইটা করেন। বদ্যি আপনে রোগ-ব্যামোর তত্ত্ব-তালাশ করেন, দাওয়াই দেন….বিষে মইরা যাই।
-বলেন কি! কি সর্পে কাটলো আপনেরে? বান্ধন কই? সর্পের কামড়ের জায়গায় গিট্টা দেন নাই, করছেন কি?
-বদ্যি হালায় কয় কি?.....এই শহরে ইট পাত্থরে শুদ্ধা পচন ধরছে, বাসিন্দাগোই বাঁচনের উপায় নাই….সাপখোপ আইবো কই থেইকা?
-তয় বিষ আইলো কি বাতাসে উইড়া?
-ঐ মিয়া, আপনে কোন নগরে বাস করেন? বাতাসে বিষ নাই এই দেশে?....তয় আমি হেই বিষের কতা কই নাই। কইছি বেদনার কতা।
নগর বদ্যির সাথে নাগরিকের বিষালাপ। অনেক কয়ডা ইংলিশে লেখা ডিগ্রি আছে এই ডাক্তারের। যদিও এলোপ্যাথিক, হোমিওপ্যাথিক, শিকড়বাকড়ওলা হেকিম আর ফুটপাথে শ্রীপুরের বড়ি বেচা লেকচারার- সবাইরেই এক পাল্লায় মাপে এই রোগী। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক দাওয়াখানা। তবু রোগীর শরীরে না-শুকা ঘাম। শূল বেদনা, পিত্তে পাথর, বায়ুচড়া, চর্মে ঘর্ম এবং ঘাওয়ের আছর….নানাহ সমস্যা নিয়া রোগীর পথ্যপ্রার্থনা।
রোগ তালাশে জিজ্ঞাসায় নামেন বদ্যি মশায়। তিনি অতিশয় সদয়, কবি বইলাই হয়তো, হাজারটা পরীক্ষা নিরীক্ষার বদলে নিজের নয়ন জোড়ার উপরই নির্ভর করেন। বেশী টেস্ট ফেস্ট দেন না, ওষুধও লেখেন অনেক কম, তাই কোম্পানিওয়ালাগো ভীড়বাট্টা কম।
-খান কী?
-দেখেন ডাক্তার সাব, গালি দিয়েন না। তার উপর মাইয়া মাইনষের গালি! আমার মুখ ছুটলে কিন্তু…..খবর আছে।
-ধুরো মিয়া, খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে জানতে চাই, মেনু….বুঝছেন এইবার?
¬¬¬¬¬
-ভাই, আমি চাইনিজ ফাইনিজ খাওন ছাড়ান দিছি বহুত আগে, মেনু ফেনু কইতে পারুম না। তয় শাক সবজি মাছ মাংস সবই খাই। নিজে দেইখা বাইছা তরতাজা ভাল জিনিস কিনি।
আসলেই তাই। মোটা মানিক বাজার সদাইয়ে অতি টনটনা। টাটকা সবুজ শাকসবজি কিনে। মাছ কিনে হাজার টিপা টুপা। ফুলকার লাল রং নিশ্চিত না হইয়া সে ট্যাকে হাত দেয় না। ফলের মইধ্যে দাগ দুগ দেখলে উল্টা হাটা দেয়। ডাক্তাররে এইসব বিস্তারিত খুইলা বলে।
ডাক্তার জিগায়-
আপনের কোষ্ঠের অবস্থা কি?
-মুখ সামলাইয়া কথা ক’ন বদ্যি বুড়া! আমার চৈদ্দ গুষ্টিতে কুষ্ঠ রোগ নাই। আর কোষ্টি মিলাইয়া যদি রোগ ধরার কতা কন, তাইলে শুইনা রাখেন আমি সনাতন ধর্মের লোক না।
-আরে মর জ্বালা….আমি কোষ্ঠ মানে ‘মল’ পায়খানার কথা জানতে চাইরে ভাই। আপনের বাড়ির আর সবাইর কথাও এট্টু কইয়েন।
-হেইডা কন। মনে করেন, আমার সারা বছরই ‘ছেইর’ চলে। বদনা টানতে টানতে আঙ্গুলে কড়া পইড়া লোহার মতন শক্ত হইয়া গেছে। ওয়াসার পানি ফুরায়, পেটের আউটলেট থামে না….এইদিকে বউয়ের হইছে গিয়া উল্টা, আপনের ভাষায় কইতে হয় ‘কোষ্ঠপ্রেম’। পেটথন ‘উনারা’ বাইর হইতে চায় না। দিনভর ত্যাগসাধনা, বাথরুমে চলে কুথনিকাব্য। ঘটির পর ঘটি জোলাপ সেবন ফেইল। হারা বছর লবন তরকারি মাখাইয়া ইসব গুলের ভুষি চলতাছে।
ডাক্তার খানিকটা চিন্তিত্ হয়।
-আপনের রোগ সমস্যার কথা পরে কই। আগে শুনেন, কি করতে হইবো? তাজা খাওন বাদ। এখন থেইকা বাজারে গিয়া হুগাইয়া জন্ডিসে ধরসে এমন হইলদা শাক সবজি কিনবেন। পইচা গইলা মাছি পোকা পরছে এমন মাছ কিনবেন। মৌসুমী ফল খাওয়া বারণ। গাছে উইঠ্যা বাদুরে খাওয়া, পক্ষীতে কামড়ানো কোন ফলটল পাইলে খাইতে পারেন। একটু আকটু জ্বর সর্দি হইতে পারে….‘পাইখ্যা ইনফ্লুয়েঞ্জা’ যারে কয়। তয় বিষে ধরতো না।
এইসব নাখাস্তা পরামর্শ মোটা মানিক তার ইহজনমে শুনে নাই। মাইনকায় ভাবে, এইখানে আইসা আবার কোন চিপায় পড়লাম! রোগীর ক্ষণে উদাস, ক্ষনে আগুইন্যা চেহারা দেইখা ডাক্তার প্রমাদ গুনে। ভাবে- যতই কম বুঝুক, ইনারে সবকিছু খুইলা বলাই ভাল।
-আপনেরে প্রিজার্ভেটিভ ব্যারামে ধরছে। হজমের রসের সাথে ফরমালিন কার্বাইডের কষ প্যাঁচ খাইছে, হেগোর কিলাকিলিতে আপনার পেটদানি, পিত্ত, অলিগলি সবখানে ভেজাল লাগছে। যতসব বেদনার কারণ ঐখানে।
ডাক্তারে কয় কি! বেশ কিছুদিন ধইরা বিদ্যূৎ সাশ্রয়ের বিরাট সুবিধা পাইতেছিল মানিকের পরিবার। বাজার থেইকা আনা কাঁচা বাজার মাছ মাংস ফলফলাদি ফ্রিজে রাখন লাগতো না। দিন সপ্তাহ মাস জুইড়া একদম ফেরেশ। খালি ঠাণ্ডা পানির জন্য ব্যবহার বেকার ভাইব্যা ফ্রিজখান মুইছা মাইছা প্যাকেটে ঢুকাইয়া রাখছে। ‘ফরমালিন সিনড্রোম’-এর বিরাট ভক্ত হইয়া গেছিল সে।
কয়দিন ধইরা ভাবতেছিল, আধবুড়ি বউডা জুয়ানকি ধইরা রাখার লাইগা কত সুনু পাউডার কিরিম মাখে, মুখে খানিক ফরমালিন মাইখা থুইলেই তো হয়। বালতির পানিতে দুয়েক ফোটা মাইরা দিয়া ডেইলি গোসল করলে তো বয়সও আটকাইয়া রাখা যায়।…..অংকে কাঁচা ছোড পোলাডারে কার্বাইড দিয়া পাকাইয়া লওন যায় কিনা সেই চিন্তাও অনেকদূর আগাইয়া গেছিল।
সেইদিন এক ফলের আড়তদার সূরে সূরে গাইতেছিল, সে মুগ্ধ হইয়া শুনতেছিল-‘‘তেল নুন না দিলে রোচে না সালুন খাসা….কেমিক্যাল না মাখিলে হয়না ফল ডাসা। কাঠাল খেজুর আনারস কলা আম….তাজা খাইয়া মুখে লইবেন কেমিক্যাল বাবার নাম।’’
বড় ছাওয়ালডার প্রাইভেট ভারসিটি থেইকা নাকি পোলাপানগো কাঁচাবাজারে শিক্ষা সফরে নিয়া যাওন ধরছে। পোলায় কয়- ‘‘পুরা দেশ হইয়া গেছে রাসায়নিকে ঠাসা, ফলিত রসায়নের ল্যাবওয়ার্ক ঢাকার কাঁচাবাজারেই সাইরা লওয়া যায়।’’
মাইনকায় চাইরদিকে আন্ধার দেখে। নায়ক কিংবা ভিলেন হইয়া সিনেমার ধুমসি নায়িকার তলে পইরা চাপা খাওন সহ্য করা যায়। বুড়িগঙ্গা তুরাগের পচা পানিতে একবেলা চুবাইয়া আসন যায়। কিন্তক পচাগলা জিনিস পয়সা দিয়া কিন্যা খামু, এইডা মানন যায়? ডাক্তাররে কয়- ‘‘এইসব তো সবার গা-সওয়া হইয়া গেছে। আমি একলা কিছুই পাল্টাইতে পারুম না। আপনে বেদনা কমার ওষুধ দেন।’’
-আপনার যেই রকম ইচ্ছা….চালাইয়া যান। শহরের বিউটিফিকেশনের মতন শইলখান উপর দিয়া তরতাজা দেখাইবো। কয়দিন পর রুহ আত্মা ঠিকই উড়াল দিবো।
-আছেই কী, আর উড়াল দিবোই বা কী….আত্মাখান তো কবেই পইচা গইলা শেষ, বিবেকডা’রে যেইদিন গলায় ফাঁস দিযা মারছি!’’ মনটা তাহার বিবাগী হয়।
সড়কে নামে মোটা মানিক। নানান কিসিমের মানুষ রাস্তায়। বাস টেম্পু ফুটপাথে হাজার পদের টেনশন। কারও মনে জ্বালা, কারো জ্বালা পেটে। কেউ উচা সিড়িতে উঠতে ব্যস্ত, কেউ হোঁচট খাইয়া মাজা ভাংগে। কেউ পার্ট লয়, ফান্দে ফেলাইয়া চিপায় নিয়া কানে কানে ‘সিস্টেমে’ আইতে কয়। আছেন কিছু লংটাইম ইজারাদার- একপক্ষ চলতি সুখের ফিরিস্তি শুনায়; অন্যপক্ষ অতীতের কাসুন্দি ঘাটে, আবারো স্বপ্ন দেখতে ডাকে।
ঐদিকে বাণিজ্যওলাদের বিজ্ঞাপনের চিল্লাপাল্লায় দিশাহারা অবস্থা। জ্ঞানীজনে কইছিল- কথা কম কাজ বেশী; ‘হাওয়াই বচন’ কোম্পানি অহন শুনায়- যত কথা, তত সাশ্রয়।…….একদল কয় ‘‘কাছে থাকুন’’…..সঙ্গিনধারীগণের ঘুরাঘুরি দেইখা কইলজা ধক কইরা ওঠে, আরেক মহাজনের অমৃত বাণী মনে পড়ে ‘‘……দূরে থাকুন’’…..না হইলে মাঝখানে পইড়া পাছায় প্যাদানি খাওনের সমূহ ডর।
এত দ্বন্দে বাঁচি কেমনে!…প্যাঁচ খাওয়া ভাবনায় ‘মাইনকা চিপা’ হইতে বাঁচার আশায় দ্রুত বাড়ির পথে পা চালায় সে। কোথায় যেন কীর্তন বাজে, শহরে আর এই সূর আসবো কই থেইকা। অন্তরই বোধহয় গাইয়া উঠে-
………জ্ঞানদাস কহে কানুর পিরীতি মরণ অধিক শেল…….’’
(গল্পের নাম এবং শেষ লাইনের গানের কথা পদাবলী-কীর্তন, জ্ঞানদাস হতে সংগৃহীত।)
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“জানুয়ারী ২০২৫” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ জানুয়ারী, ২০২৫ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।
প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী