এক.
-ডিনার রেডি স্যার। সান্ধ্য আহারের যান্ত্রিক ঘোষণা।
-আরেকটু পরে। ৫০০ কি.মি পরেই একটি দারুণ স্টেশন আছে। যাত্রাবিরতি করব, ওখানে রিফুয়েলিং হবে। আমার ডিনারও ওসময়ই সার্ভ করো, ব্যস্ত ক্যাপ্টেনের জবাব।
প্যাসেঞ্জার কত এখন? ক্যাপ্টেনের জিজ্ঞাসা।
- হিউম্যান ১, হিউমনয়েড ৫, এন্ড্রোয়েড রোবো ১৭। তিনটা ক্যারেজে এরা। বাকী সাতটা ক্যারেজ খালি। হা-লং বে’ স্টেশনে ভিয়েতনামি’জ বড় একটা পার্সেল আনলোড হয়েছে।। তিনজন ইউ-কাউন্সিল কর্মকর্তা ওখানেই নেমে গেছেন। রোবো’দের বড় গ্রুপটাও সাথে নেমেছে। যান্ত্রিক উত্তর।
(ইউনিভার্সাল কাউন্সিল এর আর্থ হেডকোয়ার্টার ভিয়েতনামে। হা লং বে’ আন্ডার ওয়াটার রেল স্টেশন, ওটাই এ অঞ্চলের সবচে’ ব্যস্ত স্টেশন)।
- নতুন কেউ ওঠে নি?
- একজন। ভদ্রমহিলা। আর্থ এইচকিউ এর সংরক্ষিত কেবিনে আছেন।
প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ক্যাপ্টেন এবং কপোট্রনিক ট্রেনগার্ড কাম সহকারীর কথোপকথন। পৃথিবীর বুক চিরে ট্রান্স-ওশেন টিউব ট্রেন ঘন্টায় ১০০০ কি.মি. বেগে চলছে।
-স্যার, এখনকার জন্য হালকা কিছু? ফ্রেশ কিছু সাপ্লাই পেয়েছি আজ। উত্তর না পেয়ে বুঝল ক্যাপ্টেন সীটে নেই। প্যাসেঞ্জার ক্যারিজে গেছেন হয়ত।
দুই.
ঠিক তাই। প্যাসেঞ্জারদের সাথে হাই-হ্যালো’তে ব্যস্ত ক্যাপ্টেন মূর্তজা। হিউমেনয়েড-দের মৃত চাউনি আর এন্ড্রোয়েড-দের আধা যান্ত্রিক ভাষা এড়িয়ে দ্রুতই ভি-১ কোচে পৌঁছুল ক্যাপ্টেন। হিউমেনয়েড-দের যন্ত্র হওয়ার চেষ্টা আর এন্ড্রো-দের মানবীয় ভাব সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে বিরক্ত সে।
- আপনি ঠিক আছেন? কোন সমস্যা আছে? একঘেয়ে আওয়াজের জবাবে মৃদু মাথা নাড়ল ঐশী। আড়চোখে নড়াচড়া দেখে ভাবল হলোগ্রাফিক এটেনডেন্ট বুঝি। রেলওয়ে চিন্তা-ভাবনায় এখনও ব্যাকডেটেড রয়ে গেছে। একজন মাত্র মানব যাত্রী! তার জন্যে অবশ্য আর কী করতে পারে পরিবহন সংস্থাটি?
-শুভ সন্ধ্যা, ম্যাম। একটা বাড়ানো মানবীয় হাত দেখে চমকে উঠল ঐশী। সে ছাড়া কামরায় আর নেই কেউ। সশরীরে এটেনডেন্টও আসতে পারে না এখানে। ওহ…তাকিয়ে দেখল স্বয়ং ক্যাপ্টেন। ইউনিফরম এবং ব্যাজ দেখে চিনল। চমকেই উঠল, বেশ উঁচু র্যাং কের অফিসার। মেকানিক্যাল এবং অপারেশনাল ডিগ্রিগুলো জ্বলজ্বল করছে র্যাং ক ব্যাজে। সাথে বেশকিছু সাহসিকতার পদক। অভ্যস্ত গতিতে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গেল ঐশী।
স্যালুট করা থেকে কোনরকমে নিজেকে নিজেকে থামালো। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ানো হাতটা গ্রহণ করল।
- শুভ সন্ধ্যা, ধন্যবাদ। ঐশী’র সপ্রতিভ পাল্টা অভিবাদন।
এবার থমকানোর পালা ক্যাপ্টেনের। অতি পরিচিত একজোড়া চোখ! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে নিজের ভেতরের উথাল পাথাল সামলালো মূর্তজা।
- ক্যা’পন মূর্তজা এখানে, এই ট্রেনের চালক। আপনার ভ্রমন আনন্দময় হোক।
- আমি ঐশী, কাউন্সিল পরিদর্শক।’’ বাকী পরিচয়টুকু বলল না।
- সামনে একটি লম্বা যাত্রা বিরতি আছে। রিফুয়েলিং হবে। ইচ্ছে করলে নেমে হাটাহাটি করে আসতে পারেন।’’ বন্ধুত্বের সূর মূর্তজার।
- চেষ্টা করব সুযোগ নিতে। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
তিন.
ক্যাপ্টেন বিদায় নিলে ঐশী ওর ফাইলে মুখ ডুবালো। হিজিবিজি ইউনি-সাইফার কোডে লেখা। চাকরীতে এখনও নতুন। কোড ভেঙে পড়তে সময় লাগে।
টাইম বাউন্ডারী ভাঙা এক আইন লঙ্ঘনকারীর এক্টিভিটি রেকর্ড। …..ইউনিভার্সাল টাইম কোড-এর ১১৭৮.০৯১১৪.০০.০৩.১৭ বিধি ভেঙেছিল লোকটি। সময় পরিভ্রমণে মানবিক সম্পর্কে জড়ানো বিষয়ক অপরাধ। মোটা দাগে বর্তমান আইন হল- সময় ভ্রমণে শুধু দর্শকের ভূমিকা ছাড়া অন্য যে কোন কাজই অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এমনকি গবেষণার জন্য নমুনা সংগ্রহেও অত্যন্ত কড়াকড়ি করে রাখা হয়েছে। বেশকিছু বিপর্যয়ের পর ইউ-কাউন্সিল আইনে এসব ঢুকাতে বাধ্য হয়েছে।
মরটন উজাহুরা কিহান, একবিংশ শতাব্দীর এক উচ্চাভিলাষী মুক্ত চিন্তার মানুষ। বড়ই দুর্ভাগা ভাবত নিজেকে। ভাবতেই পারে। একে তো তার ‘সময়’ ছিল তার চেয়ে পিছিয়ে, তার উপর জন্ম হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের তালিকার তলানির এক দেশে। তার দেশ, সমাজ, অর্থনীতি নিয়ে হয়ত কোন অভিযোগ ছিল না। তবে নিজের ধ্যান-ধারনা আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ নিয়ে দেশ-চিন্তকদের সাথে তার সহাবস্থান আরামদায়ক হয়ে ওঠেনি। সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টির উপক্রম হলে সে মুক্তির পথ খোঁজে। তার যুগের স্বাভাবিক প্রবণতায় দেশ ত্যাগের ভাবনাটা আসতে পারত।
কিন্তু তার বেলায় সেটি ঘটেনি। চিন্তাশক্তি আর উদ্ভাবনী ক্ষমতা তাকে সময় ও ভূখণ্ডের গণ্ডি অতিক্রম করার পথ দেখায়। ‘সময়’কে জয় করা তার দুনিয়ায় কল্পনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ‘সময়’ তখনও গাণিতিক হিসাবের ‘যোগ্যতম মাত্রা’ হিসেবেই পরিচিতি পায় নি। সেই যুগে সকল প্রতিবন্ধ অতিক্রম করে নিজেকে প্রস্তুত করে।
তারপর…এক লম্বা কাহিনী। নিজের জীবন এবং পারিপার্শ্বিকতার ঘড়িকে সে এক হাজার বছর এগিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এর মাঝে কঠোর সাধনায় নিজেকে এক হাজার বছর পরের সময়ের সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয়ার সামর্থ সৃষ্টি করে। ৩০২৫ সালে এক মধ্যম মানের সভ্যতায় নিজেকে রোপণ করে। সময় এবং জগতটা অনেক হিসেব করেই ঠিক করেছিল। মহাবিশ্বে ধ্বংস হানাহানির ৪০০ বছর পর পুনর্গঠনের পর্যায়ে থাকা জগতটি তার জন্য অনুকূলই ছিল।
দ্বিতীয় জীবনকালের সময় এবং ভূখণ্ডের সাথে সে ভালই মানিয়ে নেয়। নিজের বিজ্ঞানী পরিচয় ঢেকে সাধারণ পেশাদার হিসেবে কাজ খুঁজতে থাকে। এক সময় ‘টাইম ইনডিফরেন্ট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ পেয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মহিলা ছিলেন আরেক মুক্তমনা মানুষ। কাজের সূত্রে বন্ধুত্ব, পরবর্তীতে সম্পর্কে জড়ায় তারা। সে সময় এক দুর্ঘটনায় মরটন কিহানের মস্তিষ্ক উচ্চ মাত্রার তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়। পরে অবশ্য জানা যায়, সেটি দুর্ঘটনা ছিল না। দারুণ সাহসিক এক কাজে ভদ্রলোক জেনেশুনে নিজের উপর এই বিপদটি টেনে এনেছিলেন।
মহাজাগতিক চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানোর পর পুরো ব্যাপারটি ধরা পড়ে। তার জিন কোড দেখে ডাক্তাররা অবাক হয়, ম্যানিপুলেশনের চিহ্ন পায়। জিনে জটিল কিছু প্রক্রিয়া করে একবিংশ শতাব্দীর মানুষটি দশ শতাব্দী পরের জগতে টিকে থাকার অভিযোজন ক্ষমতা অর্জন করে। লোকটির চিন্তাশক্তি দেখে ডাক্তাররা অবাক হয়। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মানুষ ছিল সে। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, মানুষের জীনকোড মাত্র ভাঙতে পেরেছিলেন সে সময়ের কিছু শীর্ষ বিজ্ঞানী। উচ্চ পর্যায়ের গবেষণাও শুরু হয় নি। সে জগতের বাসিন্দা হয়ে এই লোক এক হাজার বছর পরের মানুষের শরীরগত অবস্থা চিন্তা করে সেভাবে নিজের দেহে পরিবর্তন আনে!
অতিক্রান্ত এক হাজার বছরে পৃথিবীর গড় তাপ, বাতাসের আর্দ্রতা, বায়ুর মিশ্রণে নতুন উপাদান উপস্থিতি, অক্সিজেন-কার্বন ডাই-অক্সাইডের অনুপাত- এসব হাজারো পরিবর্তনে লোকটি সুস্থভাবে বেঁচে ছিল। জীবজগতের সূক্ষ্ণ বিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। বিস্মিত গবেষকরা আরো অবাক হয় লোকটির মস্তিষ্ক ব্যবহার দেখে। রক্ষিত স্মৃতি এবং মস্তিষ্কের শতকরা ব্যবহার বিস্ময়কর!
চার.
ফাইল থেকে মুখ তোলে ঐশী। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। মহাজাগতিক আদর্শ সময় (ইউএসটি) হিসেবে সন্ধ্যা, কিন্তু স্থানীয় সময় হয়ত বিকেল হবে। ইসস….ট্রেনটি যদি ১০০ বা তার নীচ গতিতে চলত! কী সুন্দর সবুজ একটা ভূখণ্ড বাইরে। ট্রেনটি টানেল পার হয়ে একটি সবুজ প্রান্তর দিয়ে যাচ্ছে। গতির কারণে বাইরেটা সবুজাভ পর্দা বলে মনে হচ্ছে। একঘেয়ে লাগছে ভ্রমণটা। ঠিক করে ফেলল, সামনের বিরতিতে নামবে।
নামার আগেই ফাইলটা পড়ে শেষ করতে হবে। আবার ভেতরে ঢোকে।
……..আইন মেনে পুরো বিষয়টা ইউ-কাউন্সিলকে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর আগে চিকিৎসায় তার আক্রান্ত মস্তিষ্ক পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে তারা। সুস্থ হওয়ার পর কিহানকে পুনর্বাসন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হয়। সর্বোচ্চ পরিবেশ আদালত তাকে বাধ্যতামূলক শ্রমের শাস্তি দেয়- আধা-যন্ত্র হয়ে একটি ট্রেন ক্রু হিসেবে কাজ করতে হবে। ২০ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ ভ্রমণ করতে হবে। তবে তার আগে ট্রেন চালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, যেখানে তার কাজ সে এলাকা সম্বন্ধে জানা- এসব বিষয়ে দু’বছর প্রশিক্ষণ নিতে হবে…..
ফাইলটি বন্ধ করল ঐশী। মনে মনে কাজের ছক আঁকতে বসল। সে নতুন রিক্রুট তার দপ্তরে। গোয়েন্দাগিরি টাইপের কাজ। মূল কাজ পর্যবেক্ষণ এবং রিপোর্ট দেয়া। তার নতুন বস এই কাজটা দিয়ে তাকে পরখ করে নিতে চাইছেন। অন দা জব ট্রেনিং। তাই মরটন উজাহুরা-কে কোথায় পাওয়া যাবে, তা বলে দেন নি। এমনকি ছবি, চেহারার বর্ণনা কিছুই না। চোখ কান খোলা রেখে তার খোঁজ করতে হবে। পুনর্বাসনে থাকা লোকটিকে খুঁজে বের করে তার কার্যক্রম সম্বন্ধে একটা প্রতিবেদন দিতে হবে তাকে।
পাঁচ.
- ‘‘যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা এখনই যাত্রা-বিরতি করব। আমরা যে এলাকাটিতে থামবো সেটি একটি সবুজ ব-দ্বীপ। ঐতিহ্যবাহী হিমালয় পর্বতমালা এবং বঙ্গোপসাগরের মাঝে এটি একটি সমভূমি এলাকা। কাঁচঘেরা স্টেশন থেকে এর হারানো সবুজের কিছুটা দেখতে পাবেন। আশেপাশে ভয়ানক দূষণ থাকায় আপাততঃ বাইরে যাওয়া চলবে না।’’
ঘোষণা শুনে নামার প্রস্তুতি নিলো ঐশী। ট্রেনের গতি শূন্যের কোঠায়। স্মার্ট ফোল্ডারটা ভাঁজ করে ব্যাগে ঢোকাল।
এক্সিট দরজায় দাঁড়ানো মাত্র বাইরের আবহাওয়া, দৃশ্যমানতা বর্ণনা করল ডোর কনসোল। সম্মতি জানালে দরজা খুলল। বেশ বড়সড় স্টেশন। গড়পড়তা স্টেশনের সাধারণ দৃশ্য- মোবাইল ফুড আউটলেট, রোবো এটেনডেন্ট, তথ্যকেন্দ্র এড়িয়ে এগুতে এগুতে ক্যাপেটনকে দেখতে পেল। মনে হয় যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল। হাসিমুখে এগিযে আসলো।
- চলুন, বাংলাদেশী সবুজ চা আর ফুচকা খাবেন।
লোকটিকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশী বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হলেও চোখে লাগল না। আশেপাশে কোন মানুষ নেই। ওরাই দু’জন এতবড় স্টেশনে, একটু বাড়তি হৃদ্যতা হতেই পারে।
- ‘চা’ চিনলাম। সবুজ চায়ের কথাও শুনেছি। কিন্তু ‘ফুচকা’ টা কী? ঐশীর প্রশ্নবোধক চাউনি।
ছয়.
চায়ের স্বাদ বিটকেলে লাগল। কিন্তু ফুচকা নামে যেটি খেল, অদ্ভুত কিন্তু ভয়াবহ মজার। জিহ্বায় কেমন একটা ধারালো খোঁচা লাগে। অপরিচিত ‘ঝাল’ স্বাদটার ব্যাখ্যা ওর মন এভাবেই করল। তবে টক স্বাদটা চেনা, ওর খুবই প্রিয়।
গাইডের মত ক্যাপ্টেন বলে চলেন।
‘‘…..এই দেশটা ছিল সুজলা সুফলা। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলো সাগরে যাওয়ার পথে পুরো ভূখণ্ডকে রসালো আর উর্বর করে রাখত। মানুষগুলোও ছিল এই মাটির মত। কম চাওয়ার। এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এক অপশক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার সুফল সেভাবে পায়নি অভাগা জাতিটি। দারিদ্র্যের সাথে লড়াইয়ের চেয়ে নিজেদের মতাদর্শের লড়াই আর হীন স্বার্থসিদ্ধির বেসাতিতে উঠে দাঁড়াতে পারেনি সেভাবে।
…..তারপরও হাসি আনন্দ গানে মেতে থাকত সাধারণ মানুষেরা……বিশ্ব ক্ষমতা লড়াইয়ের দৌড়ে না থাকলেও পারমানবিক ক্ষয়-ক্ষতির হাত থেকে বাঁচে নি, আশে-পাশে কিছু বৃহৎ শত্রু-মিত্র ছিল। তার উপর নিজেদের টেকসই উন্নয়ন না ঘটাতে পেরে বিপর্যয়ের সামনে পড়ে।
….শুনেছি এখন বেশ কয়েক ফুট গর্ত করে চাষযোগ্য মাটি পাওয়া যায়, এখনকার কিছু পরিশ্রমী মানুষ পুকুর খুড়ে হলেও সবুজ সৃষ্টি করছেন।”
- এই এলাকা নিয়ে পড়াশোনা আছে বুঝি! ঐশী জানতে চায়।
- পড়াশোনা তো আছেই, তার উপর আমি এখানকারই সন্তান। মূর্তজার মুখে সুস্পষ্ট গর্বের চিহ্ন।
বিদ্যুৎ গতিতে ঐশীর মনের খচখচানিটা কেটে গেল। সমীকরণ মিলে গেল। মরটন উজাহুরা > মরটুজা > মুর্তজা। কিহান > খান। বেশ কিছু ভাষা-উপভাষা পেরিয়ে আর বেশ কয়েকবার কোড আন-কোড হতে হতে আদি ‘মুর্তজা খান’ নামটির এই অবস্থা। চলতে থাকা ভাবনার একটা জট খুলে গেল।
স্বচ্ছ কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখতে দেখতে কথা বলছিল ওরা। পাশেই প্রধান ফটক। লাল হরফে জ্বল জ্বল করছে- “স্ট্রিকলি ফরবিডেন টু ক্রস”।
গেট কনসোলের সাথে কী যেন বার্তা বিনিময় করল মূর্তজা। গেট খোলা যাবে না। নিষেধাজ্ঞা অতিক্রম করার জন্য শেষ অস্ত্র ঝারল সে- ‘‘স্টেশন লিমিটের মধ্যে স্টেশন মাস্টার এবং লোকো-মাস্টার(ট্রেন চালক) এর অবাধ প্রবেশাধিকার থাকবে এবং আগমন-নির্গমন বাধাহীন থাকবে।” রেলওয়ে নিরাপত্তা আইনের মোক্ষম ধারা প্রয়োগের কারণে নিষিদ্ধ গেট খুলে দিতে বাধ্য হল ইনটেলিজেন্ট অপারেটর।
ঐশীর অবাক দৃষ্টির মাঝে মূর্তজা বেড়িয়ে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরে এসে বলল,
- চলুন অকৃত্রিম এক সবুজ দেখাবো আপনাকে। বাইরের পরিবেশ এখন নিরাপদ।
এই লোকের যে কোন কথাতেই ‘না’ বলার ক্ষমতা যেন আগেই হারিয়েছে ঐশী। আর এখনতো এই ভদ্রলোক তার ‘সাবজেক্ট’। ক্যাপ্টেনের পিছু পিছু বেরিয়ে আসলো। সবুজ জীবন্ত উদ্ভিদ গুল্মের এক মিউজিয়ামের মধ্যে যেন সে! স্টেশন লেভেল থেকে একটু নীচে প্রাকৃতিক কার্পেট মোড়ানো একটা সবুজ মাঠ।
- ওটা ধানক্ষেত….এর উপর দিয়ে যখন হাওয়া বয়ে যেত…মাতাল হত মন! কৃষকের খাদ্যের উৎস ছিল না শুধু, ছিল সৌন্দর্যয়ের লীলাভূমি…বলতে বলতে উদাস হয় মূর্তজা।
ডিএনএ’র কোন টানে যেন সবুজের এই মেলায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করল ঐশী’র।
ধোঁয়াটে হাওয়ার একটা ঝাপটা লাগতেই তড়িঘড়ি করে ঐশীকে এক রকম টেনে হিঁচড়ে স্টেশনে নিয়ে এল ক্যাপ্টেন। বুঝল দূষিত বাতাস বইতে শুরু করছিল।
সাত.
ট্রেনে উঠে পুনর্বাসন ইনস্পেক্টর রিপোর্ট লিখতে বসলেন,……লোকটি এখনো আবেগপ্রবণ আছেন। মানুষের প্রতি মমত্ববোধ প্রচণ্ড। লিঙ্গভেদে কোন আলাদা মনোভাব নেই। নারীকে একজন মানুষ হিসেবেই ভাবেন।….জন্মভূমির প্রতি টান অসীম। …একান্ত ব্যক্তিগত কারণে স্টেশনের নিরাপত্তা সীমা অতিক্রম করেছিলেন। প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে একটি লাইন লিখে রাখল, দোটানায় আছে, রাখবে কিনা- ‘ভাবাবেগকে মূল্য দিয়ে নিছক সবুজ দেখানোর প্রয়োজনে নিজেকেসহ আরেক জন মানুষের জীবন বিপন্ন করেছিলেন।’
লিখতে লিখতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ঐশী। মা’র কথা মনে পড়ল। একটা বার্তা লিখে ফেলল- ‘মা, আমার এই অ্যাসাইনমেন্ট প্রায় শেষ। সুন্দর একটা দেশ দেখলাম। জলদিই বাড়ি ফিরব।….আর ভেব না, একদিন ঠিকই বাবা’কে উদ্ধার করে তোমার সামনে নিয়ে আসব।’
ট্রেন চলতে শুরু করেছে। অটো পাইলট অন, চোখ বুজে আধ শোয়া মূর্তজা। একটা হিসেব মেলাতে কষ্ট হয় তার, দু’বছর প্রশিক্ষণ, এখানে মাস ছয়েক কাজ…এর মাঝে মেয়েটি এত বড় হয়ে গেল কীভাবে? ওদের ছেড়ে আসার সময় মেয়েটির জন্ম প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছিল। চিকিৎসা সময় এবং একাধিক টাইম পকেট অতিক্রমের জটিল হিসেব মিলিয়ে তার মন শান্ত হল।
মনের মণিকোঠায় লিখে চলে- প্রিয় শ্যানন, আজ আমাদের মেয়ের সাথে দেখা হল। একজোড়া মায়াবী চোখ বয়ে বেড়ানো আমার মেয়েকে চিনতে এক ন্যানো-সেকেন্ডও লাগে নি। সেই তোমার চাউনি! ওর কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলাম। চিনে ফেললে বা সন্দেহ করলে ওর রিপোর্টটা নিরপেক্ষ হবে না। আমার মেয়ে প্রথম কাজটি আবেগে নষ্ট করে ফেলুক, এটা হতে দিতে পারি? তবে জান, তুমি যা দেখনি, আজ ওকে দেখিয়ে ফেলেছি- আমার প্রিয় সবুজ জন্মভূমি…..
আট.
স্ত্রী শ্যাননের সাথে তার যোগাযোগ নিষিদ্ধ, কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক থেকে ব্লক করা। তবে মূর্তজা ঠিকই পারে। এই চিন্তাটাই ট্রান্সপোর্ট করে দিতে পারে শ্যাননের মস্তিষ্কে। পারে মা মেয়েকে নিয়ে ভাবনার একটা কনফারেন্স করে ফেলতে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায় সে। আর আইন ভাঙতে চায় না। তার মন পড়ে আছে, সাজা ভোগশেষে কবে ফিরবে স্ত্রী-সন্তানের কাছে, সশরীরে! মুক্তির অপেক্ষায় সময়কে টপকে চলা এক লড়াকু সৈনিক।
ঐশীর বার্তা পেয়ে শ্যাননের চোখ ভিজল। মন ঠিক করল, এবার মেয়ে ঘরে ফিরলে ওর বাবার পুরো গল্প শোনাবে।
গানটি অনেক দিন পর শুনতে ইচ্ছে হল।
…………..আসিবে সে একদিন….আসিবে ফিরে লাল টিপ হয়ে….কপালে পড়িবে তায়।….বাদল ধারার ফোঁটায় ফোঁটায়…কী ছোঁয়া লাগে গো গা’য়।…..অতুল বনে উতলা মনে….কাঁদে কে গোধূলি বেলায়…প্রণয় বিধুরা সিমন্তিনী….কোন সে পানে ধায়….।