এক. খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। বয়স হয়েছে তার। তার উপর পাহাড়ি পথ। তবু দীর্ঘদিনের অভ্যস্ততায় ঠিকই চলেন চড়াই উৎরাই পথে। বিকেল হয়ে গেছে। সন্ধ্যে নামার আগেই সমতলে ফিরতে হবে। মাঝারি আকারের একটি গাছের ডালে একটা লন্ঠন ঝোলানো। প্রতিদিন বিকেলে এসে সলতেয় আগুন দিয়ে যান। তেল শেষ হলে ভরে দেন। পরদিন ভোরে এসে বাতি নেভান। ১৮ বছর ধরে বৃদ্ধের একই রুটিন।
পাহাড়ের গভীর থেকে লোকালয়ে প্রবেশের জায়গাটিতে এই আলোকবর্তিকা। আজো নিষ্ফলা। যারা এই পথে হারিয়ে গেছে, তারা ফেরেনি। আদৌ কোনদিন ফিরবে কিনা কেউ জানে না। ইভান বুড়ো আশা হারান না। একজনও যদি ফেরে! যদি অন্ধকারে পথ না চেনে! তাই পথনির্দেশ রেখে যান। প্রতিদিন আলো নিভিয়ে আবার জ্বেলে আশার নবায়ন করে চলেন। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে। কান পাতেন কোন মানুষের কণ্ঠধ্বনি কিংবা প্রতিধ্বনি বাজে কিনা।
দুই. পাহাড়ের ওপারে আরেক জগত। আরেক জীবনকাহিনী রচিত হয়েছে সেখানে। হ্যামিলনবাসী জানে না ওপারে কি আছে। পাহাড়বাসীরাও জানে না কেমন আছে তাদের ফেলে আসা জন্মভূমি।
‘‘….মুক্তি দাও…..মুক্তি দাও।’’ ছোট ছোট বদ্ধ গুহাগুলো থেকে করুণ আর্তনাদ শোনা যায়। এই আওয়াজ বৃদ্ধ বাঁশিওয়ালার কাছে পাহাড়ের খাঁজে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শব্দ, পাখির ডাক, আর ঝরনার জল ঝরার শব্দের মতই প্রাত্যহিক, আটপৌরে। খেয়ালও হয়তো করে না সেভাবে, শিশুকন্ঠগুলো ধীরে ধীরে পুরুষকন্ঠ হয়ে উঠছে।
‘‘…মা…মাগো….’’ বলে মোলায়েম শিশু কান্নাগুলো আজ প্রায়ই ‘‘দেয়াল ভাঙ’’ দাবীর বজ্রকন্ঠ হয়ে তার কানে ঢোকে। নির্বিকার বুড়ো এক মনে কাজ করে যায়। পাহাড় থেকে কচি বাঁশ এনে বাঁশি বানায়। দুর-দূরান্তের গ্রামে বিক্রি করে সংসার চালায়। সংসার বলতে একদল ছেলেমেয়ে তার, যদিও সব বন্দি। সাময়িক ক্ষোভে মায়া যাদুতে ধরে এনেছিলেন পরের ছেলেমেয়েকে, এক অজানা উদ্দেশ্যে কয়েদ করে রেখেছেন। কাজের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন পথে চলাচল করে। কেউ চেনে না, এমন সব এলাকায় ঘুরে বেড়ায়।
-আরেকটি উজ্জ্বল দিন। আজ কি মুক্তি মিলবে?’’ বন্দী মিচেল বদ্ধ গুহার জানালা দিয়ে বুড়োকে জিজ্ঞাসা করে। সামনের আঙিনায় বসা বৃদ্ধ পুরনো বাঁশিটার দুদিকেই ফুঁ দেয়ার চেষ্টা করে। বাঁশি আর বাজে না।
-কতবার বলেছি, যেই দিন এই বাঁশি বাজবে, সেই দিন গুহার আগল খুলবে।’’ মিচেলকে উদ্দেশ করে বৃদ্ধের জবাব।
….বাঁশি বাজাও….নষ্ট বাঁশি ঠিক করো….আলো দেখবো….মুক্ত হাওয়ায় প্রশ্বাস নেবো….ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠে অনেক আওয়াজ এক হয়।
বহুদিনের ব্যর্থ চেষ্টা বাদ রেখে বৃদ্ধ নতুন বাঁশির বোঝা নিয়ে রওনা হয়। নষ্ট বাঁশিটা পড়ে থাকে তার জায়গায়।
তরুণদের দৃষ্টিতে হতাশা জাগে। কান্নায় রূপ নেয় কয়েকটি চিৎকার….‘‘মায়ের কাছে যাবো!’’
তিন. বৃদ্ধ ইভান শহরে ফেরার পথে। নদীর পাড়ে একটু বসেন। নদীটি পাহাড়ের গভীর থেকে সৃষ্ট কয়েকটি ঝর্নার সম্মিলন। স্রোতধারার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। উল্টো পথে নদীর উৎসমুখে নজর নিয়ে যান। কোন সুখবর নেই এখানেও। নদীর ধারা বেয়ে আসে না কোন আশার বাণী।
বাঁশিওয়ালা বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার পর কতদিন হল। কারো কারো কাছে হিসেব আছে। হ্যামিলন বাসীরা আজ অনেকেই বৃদ্ধ, কেউ প্রৌঢ়, কেউ বয়সের মধ্যগগনে। কোন তরুণ যুবা শিশু নেই। তরুণ যুবা কেন নেই-এটা জানা কথা। বাঁশির পেছনে ছোটা শিশুরা আর ফেরে নি। অভিশপ্ত কিনা কে জানে, এরপর আর একটি শিশুও জন্ম নেয়নি এই শহরে। একটা প্রজন্ম পুরোপুরি শূন্য।
ইভান ভাবতে ভাবতে বাড়ির পথে চলেন। শহরবাসীর কান্নার জল মিশে রাইন নদীর জল প্রতিদিন নোনা হয়। অনুশোচনার কান্না। অনেক পাপের ফল কেঁদে কেঁদে ভোগ করছে তারা। তবে সব আত্মা কি আজো শুদ্ধ হয়েছে? প্রতারণা, ঈর্ষা, লোভ, ক্ষমতার মোহের ছায়া আজো এখানে সূর্যালোক দূরে রাখে।
সন্তান হারানোর ‘কষ্ট-স্মৃতি’ এখন আঠারো বছরের পূর্ণ যুবক। কোন এক সন্ন্যাসী ভবিষ্যতবাণী করে গিয়েছিলেন- ‘‘শেষ আত্মাটি যেদিন শুদ্ধ হবে, সেদিন হয়তো ‘ওরা’ ফিরে আসবে।’’ ভুলে গিয়েছিলেন কথাটি! হঠাৎ তার মনে পড়লো।
থামলেন ইভান। ঘুরে দাঁড়ালেন। উল্টো পথে শহরকেন্দ্রে রওয়ানা হলেন।
চার. শহরের অভিজাত এলাকায় সাবেক মেয়রের বাসভবন। সদ্যসাবেক মেয়র সাহেব ঘাসকাটা যন্ত্র নিয়ে সামনের লন ছাঁটছেন। ছাঁটছেন, নাকি পাশের আস্তাবলে রাখা ঘোড়ার জন্য ঘাস কাটছেন, পরিষ্কার নয়। ‘‘মহাজনের কাজের অভাব’’…বিড়বিড় করেন ইভান। বুড়োকে দেখে কাজ গুটিয়ে বৈঠকখানায় আসলেন মি. হাওয়ার্ড। বৈঠকখানার টেবিলে নানা রকম পোস্টার লিফলেট। ইভান নেড়েচেড়ে দেখেন, এগুলো নতুন নগর-পিতার বিরুদ্ধে প্রচারপত্র। ইভানকে দেখে হারানো দিনের কষ্টের স্মৃতি ভাসে হাওয়ার্ডের অন্তরে। এই নেতাও তার সন্তান হারিয়েছিলেন। তিনি তখন তার দলের মাঝারি কর্মী।
ইভান বেশ ক’বছর আগের এক কাহিনী শোনালো তাকে।…অজ্ঞাতনামা সাধুর আত্মশুদ্ধির বিস্মৃতপ্রায় পরামর্শ। হাওয়ার্ড উঠে পড়লেন। হারানো সন্তানের ছবিটির সামনে দাঁড়ালেন। ছবি আর স্মৃতির মানুষ কখনও বড় হয় না। টুকটুকে মেয়েটি ছবিতে কেমন হাসছে! এক ফোঁটা জল ঝরলো চোখ থেকে। একটা লাইটার বের করলেন পকেট থেকে। বাগানে নামলেন, সমস্ত প্রচারপত্র এক করে আগুন ধরিয়ে দিলেন। ধোঁয়া উঠলো। আগুনে পুড়ে তার মনের বিষ ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে গেল।
দু’জন হনহন করে ছুটলেন শেষ ব্যক্তিটির খোঁজে।
মেয়র মহোদয়কেও বাড়িতেই পেলেন তারা। কাগজের পোটলায় মুড়ে আনা ছাই উপহার দিলেন বর্তমান মেয়রকে সাবেক মেয়র। তিনজন মিলে কি যেন কথা হল। কর্মচারীরা এই অনির্ধারিত সভায় অবাক। না জানি কোন শলায় মেতেছে দুই পরস্পর বিরোধী নেতা।
মেয়র সাহেব খসখস করে পদত্যাগ পত্র লিখতে শুরু করতেই সাবেক মেয়র কাগজ কলম কেড়ে নিলেন। বললেন- -আমার প্রিয় নেতা। আমার আনুগত্য আপনার কাছে সোপর্দ করেছি। চলুন, আপনার নেতৃত্বে আরেকবার সবাই মিলে চেষ্টা করি।’’
পাঁচ. সাইরেন বাজলো নগর ভবনের। দলে দলে মানুষ বের হল। হাতে হাত বাঁধা দুই নেতার পিছু পিছু ছুটলও নগর প্রান্তে।
‘‘…….ফিরে এসো শান্তি……ফিরে এসো আমাদের সন্তানেরা!’’ হাজার কণ্ঠ। কিন্তু আওয়াজ হল একটি।
গণকন্ঠ পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসলো। পাহাড় থেকে একটি নুড়িও খসে পড়লো না। কিন্তু বুড়ো বাঁশিওয়ালা কেঁপে উঠলো থরথর করে। বাঁশির ঝোলা ফেলে ঝটিতে ফিরতি পথ ধরল। আঙিনায় ফিরে এসে পুরনো বাঁশিটা হাতে নিল।
খোন্দকার শাহিদুল হক
প্রিয় মুকুল ভাই, খুব আনন্দ হচ্ছে আপনাকে বিজয়ী দেখতে পেয়ে। খুব ভাল লাগল। এখানে আসলে প্রথমে আপনার কথাটাই আমার মনে পড়ে। এখানে হাতেগোনা দুএক জনের সাথে পরিচয় আছে। তারমধ্যে আপনি অন্যতম। জানি আপনার মনটা ততটা এখনো থিতু হয়নি তথাপি এই বিজয়ে একটু হলেও মনে পাঠকদের ভালোবাসার পরশ মিলবে। আপনাকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি। শুভকামনা সততত। ভাল থাকবেন।
প্রিয় শাহিদ ভাই, সত্যিই মনটি এখনও থিতু হয় নি। বেশ স্থবিরতা কাজ করছে এখনও। মন্তব্য পড়ে যাই, লেখাও পড়ছি কিছু কিছু। জবাব কিংবা মন্তব্য দেয়ার মত অক্ষরশক্তি তেমনটি এখনও পাচ্ছি না। তবে যতটুকু ফিরে পেয়েছি তার সাকূল্যে আগামী সংখ্যার লেখা তৈরি করছি। স্বতঃস্ফূর্ততা ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়াপ্রার্থী।
জাফর পাঠাণ
কি মুকুল ভাই পূর্ণ নাম্বারটিতো আমার গুনে গুনে নিলেন কিন্তু গল্পের উপর আমার করা মন্তব্যটির উত্তরটিতো দিলেন না !যাক শুভ কামনা রইল আগামির জন্য এবং বর্তমান স্থান অর্জনের মাধ্যমে উৎরিয়ে যাওয়ার জন্য রইল বৈশাখী শুভেচ্ছা।
মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ
গল্পের রূপকে স্বকালও স্বদেশকে রূপায়ণের প্রচেষ্টা সত্যি অতুলনীয়। চরিত্রের নাম স্থান পরিবেশও প্রতীকী মনে হলেও আমার কাছে এটি একটি বেশ পরিচিত প্রেক্ষাপট। অভিনন্দন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।