(১)
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর। আধো আলো-আধারীতে গা ঘেঁষাঘেষি করে দুই বন্ধু স্কুলে যাচ্ছে। গ্রাম কিংবা শহরতলীর হিসাবে স্কুলটি খুব দূরে নয়। শহরের শেষ প্রান্তে। শহর এবং পাশের গ্রাম/শহরতলী থেকেও ছেলেমেযেরা পড়তে আসে। যারা একটু অবস্থাপন্ন তারা এটুকু পথই রিকশায় যায়। অভিজাত ঘরের দু’য়েকটি ছেলেমেয়ে গাড়িতে করে আসে। আবিদ আর শাহিন তলানী গ্রুপের। শহরতলী থেকে মাইল খানেক পথ হেঁটে যায় ওরা। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সূর্য ওঠা দেখে। কুটুর কুটুর গল্পে, হাসি-তামাশায় কখন যেন ওদের পথ ফুরোয়।
-আজ খুব শীত, না রে? বলতে বলতে শাহিন সোয়েটার কান পর্যন্ত তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। ওদিকে আবিদ তার সোয়েটারটা গায়ে না দিয়ে কায়দা করে কোমরে বেঁধে রেখেছে।
-তোর শীত আজ কই গেলো রে?
-ধুর, কোথায় শীত? কলার উঁচিয়ে আরো স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে আবিদ।
-কালকেও দেখলাম, ঠাণ্ডার ভয়ে পুকুরে নামলি না, আজ তোর এত তেজ! চেহারায় বিস্ময় আর ভাষায় কৌতুক শাহিনের।
আবিদের আর উত্তর দেয়া লাগে না। ঘন কুয়াশায় স্কুল ভবনটি এখনও দেখা না গেলেও কলরব বলে দেয় ওরা স্কুল গেটের কাছাকাছি। এক ক্লাস, একই শাখায় পড়ে ওরা। শাহিন মেধাবী ছাত্র। প্রথম দু’তিন জনের মধ্যে ওর রেজাল্ট থাকে। আবিদ পেছনের দিকে। টেনে টুনে পাশ করে এগুচ্ছে।
(২)
বাংলা ২য় পত্রের ক্লাস চলছে। সৃজনশীল রচনা লেখাচ্ছেন শিক্ষক। বাতেন স্যার প্রায়ই এটা করান। বইয়ের মুখস্থ রচনাধারার বাইরে লেখালেখি। কোন ধরাবাঁধা কাঠামো নেই। যে যার মত লিখবে। ভিন্নধর্মী খোলামেলা ভাষা পছন্দ করেন তিনি। সপ্তাহের কোন দিন লিখান ‘আমার দেশ, আমার স্বপ্ন’, কোন দিন দেন ‘আমার আগামীর লক্ষ্য’। আজ বাতেন স্যার ঢুকেই লিখতে দিলেন….আমার প্রিয় ঋতু।
পুরো শ্রেণীকক্ষ নিশ্চুপ। বাতেন স্যার সবার লেখা জমা নিয়ে পড়ছেন। খুব দ্রুত পড়তে পারেন ভদ্রলোক। সবগুলো লেখা পড়ে ফেলবেন এর মধ্যে। নজর কাড়া লেখার অংশ পড়ে শোনাবেন। হাস্যকর কোন কথা বা ভয়ানক কোন ভুল নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবেন। লেখকের নাম নিয়ে লজ্জায় ফেলবেন না। ভুল ধরিয়ে দেবেন। ঠিক তটস্থ না হলেও সবাই স্নায়বিক টানে থাকে। না জানি প্রশংসায় লাল হতে নয়, না জানি বকা খেয়ে কার মুখ নীল হয়।
একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছেন শিক্ষক। বেশীর ভাগই গতানুগতিক লেখা।….প্রিয় ঋতু বসন্ত…শীতের পর দখিনা সমীরণ নিয়ে বসন্ত আসে।….শীতনিদ্রা থেকে বেরুনো সরীসৃপের মত প্রকৃতি জেগে ওঠে…..গাছের নতুন পাতা নতুন খোলসের মত চকচক করে…কত ধরণের উপমা! পড়ে চলেন স্যার। আরেক জন লিখেছে বর্ষার কথা।….অতি বৃষ্টি কিংবা বন্যায় যখন চারিদিক ডুবে যায়, মনে হয় যেন সাগর, গাড়ি চলার আলোড়নে মাঝে মাঝে ওয়াটার স্পোর্টের ওয়েভ সৃষ্টি হয়…নগরেই থিমপার্কের মজা।
একটা লেখায় নজর আটকে পড়ে।…খড়ের ছাউনীর উপর পলিথিনের মোড়কও ঠেকাতে পারে না শ্রাবণধারার বর্ষা। বর্ষায় তাই আমার মনে বাজে না নবধারার গান।….শীতে অনেক কষ্ট, গরম কাপড়ের টানাটানি। বর্ষায় যেই ছিদ্রগুলো দিয়ে বৃষ্টির ছাট ঢুকে ভিজিয়ে দেয় সব, শীতে সেখান দিয়ে ঢোকে হুহু করা ঠাণ্ডা।….বড় লোকেরা শীতকযন্ত্র আমদানী করে যেখানে কষ্টবিলাস করে, সেখানে আমার ঘৃনা এই শীতলতাকে….শীতের পরে বসন্ত বয়ে নিয়ে আসে নানা রোগশোক। আমার ভাল লাগে তাই গ্রীষ্ম। বৃষ্টিহীন উত্তপ্ত ঋতুই আমার ঢের বেশী পছন্দ!!!
শাহিনের দারিদ্র সম্বন্ধে জানেন বাতেন স্যার। ওর লেখা নিয়েও উচ্চ ধারণা তার। কি সাহসী স্বীকারোক্তি, ভিন্ন ধরণের দারুন এক অভিব্যক্তি! নজর তুলে তাকান। শাহিনের সাথে চোখাচোখি হয়। নীরব ভাষা পড়তে পারেন তিনি। ছাত্র-শিক্ষকের নিঃশব্দ যোগাযোগ হয়ে যায়।
লেখাটি পড়ে শোনান সবাইকে বাতেন স্যার। ভরাট গলায় আবৃত্তির সুরে প্রবন্ধ পড়েন। কার লেখা এটি, কৌতুহল সবার। পড়া শেষ করে অধিবেশনের সমাপ্তি টানেন স্যার। অন্যান্য দিন ভাল লেখা পেলে লেখককে ডেকে পিঠ চাপড়ে দেন। আজ অনুচ্চারিতই থাকলো লেখকের নাম। শাহিনের চোখের কৃতজ্ঞতা নজর এড়াল না আপ্লুত শিক্ষকের। চোখের জল আড়াল করে উঠে পড়লেন তিনি।
(৩)
ছুটি শেষে বাড়ি ফেরার আগে দূরন্তপনা। ছেলেরা দলেবলে ফুটবল ক্রিকেট নিয়ে নামে। প্রায় দুপুর। শীত নেই। সূর্যের হাসিমাখা রোদে ছুটন্ত বালক, শিশুদের কান বেয়ে চিকণ ঘামের ধারা নামে। সোয়েটার খুলে বিভিন্ন ভঙ্গিতে গলায়, পিঠে, কোমরে পেঁচিয়ে ছেলেরা সব মাঠে। শাহিন, আবিদরাও মাঠে ফুটবল নিয়ে মেতে যায়।
-এই, এত গরমে সোয়েটার খুলিস নি কেন রে? শাহিনকে জিজ্ঞেস করে আবিদ।
দরদর করে গা বেয়ে নামা ঘাম আড়াল করে শাহিন। একটু শীত শীত ভাব দেখিয়ে আবিদের কাছ থেকে দূরে সরে যায় সে।
খেলা শেষে বইয়ের ঝোলা কাঁধে নিয়ে দুই বন্ধু বাড়ির পথ ধরে।
আবিদ শাহিনের কাছ ঘেষে আসে। প্রায় ফিঁসফিস করে বলে, ঐ রচনাটা তোর লেখা, না রে?
শাহিন নিশ্চুপ। আবিদ আরো ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ায় ওর দিকে। কোমরে পেঁচিয়ে রাখা সোয়েটারটা শাহিনের চোখের সামনে মেলে ধরে। প্রায় পুরোটা পোকায় কাটা, শতচ্ছিন্ন শীতবস্ত্র। নীল রংটি চটে গিয়ে ধরেছে আকাশীভাব। নিজের পোশাক কাহিনী খুলে বলে। পড়ার অবস্থা নেই এটার। সবার করুণার দৃষ্টি এড়াতে এটাই হাতা দুটো দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখে, আর স্মার্টনেস দেখিয়ে আড়ালে শীতে কাঁপে, শৈশব পেরুনো সদ্য বালক আবিদ। আবিদের এভাবে নিজেকে মেলে দেয়ার চেষ্টা মুগ্ধ করে শাহিনকে। সাহসীও করে।
শাহিনের জড়তা কাটে। সে তার সোয়েটার গা থেকে খুলে ফেলে। পকেট কালিমাখা, দুই জায়গায় তালি দেয়া বগল ছেড়া শার্ট দেখায় বন্ধুকে। নতুন সোয়েটার কিনতে গিয়ে জামা কেনার টাকায় কমতি পড়েছে ওর বাবার। তাই ছেড়া শার্টের উপর চকচকে নতুন সোয়েটার পরে থাকে। দিনভর আগুন গরমেও পৌষের শীত গায়ে মাখিয়ে চলে।
নতুন দৃষ্টি নিয়ে আবার পথ চলা শুরু করে দুই বন্ধু। দারিদ্র ঢেকে রাখার ছেলেমানুষী অভিপ্রায়ী ছিল তারা। পাঠ আর বিদ্যালয়ে সমশ্রেণীর দুজন নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সম্পর্কের এক নয়া রূপ উন্মোচিত হয় ওদের কাছে। ‘দরিদ্র’ নামক নতুন আবিষ্কৃত শ্রেণীবন্ধু ওরা। দারিদ্রকে আর লজ্জা নয়, শত্রু হিসেবে লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা নেয় ওরা।
শাহিন আজকের রচনায় আংশিক তুলে ধরা শীতকযন্ত্রের গল্প বলে। ওর বাবা এক ধনী পরিবারের নিরাপত্তা প্রহরী। এক অনুষ্ঠানে ঐ বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ওর। অদ্ভূত সুন্দর বাড়ি। একেকটা ঘর ওদের পুরো বাড়ির সমান। দারুন সাজানো গোছানো। পাড়ার টি-স্টলের টেলিভিশনে দেখা নাটক সিনেমার কোন বাড়িতে যেন গিয়েছিল সে। সবকিছুই মুগ্ধ করেছিল ওকে। শুধু একটা জিনিস পছন্দ হয়নি। ভাদ্র মাসে ঐ বাড়িতে ঢুকে শীতে কাঁপছিল সে। উৎসবে খোলামেলা চলাফেরার সুযোগে এক রুমে ঢুকে দেখে, ওর চেয়ে একটু ছোট এক শিশু কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আরেক বৃদ্ধকে দেখে গলায় মাফলার পেঁচানো।
যেই শীত তাড়াতে ওরা আগুন জ্বালায়। অনেক কষ্টে কেনা খড়ি পোড়ায়। শীতের বাড়তি কাপড় কিনতে গিয়ে প্রয়োজনীয জামাটা কেনা হয়ে ওঠে না। সেই শীত ওই বাড়িতে সারাটি বছর বিরাজ করে। কত হতভাগা আর কষ্টসহিষ্ণু ঐ বড়লোকেরা! ওর জিজ্ঞাসামাখা চেহারা দেখে বাবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ওকে বুঝিয়ে বলেন। গম্ভীর ঝিমঝিম আওয়াজ করা যন্ত্রগুলোকে চিনিয়ে দেন। বুঝলো কিছুটা। কিন্তু মাথায় ঢুকলো না-গরম দূর করার প্রয়োজনীয় যন্ত্রটি দিয়ে এভাবে কৃত্রিম শীত বানিয়ে রাখার যৌক্তিকতা কী?
বাড়ি ফিরে তাপানুকূলের বিষয়টি বই পড়লেই ও জানতে পারতো। কিন্তু ব্যাপারটা ওর আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে নি। বরং প্রযুক্তিটির প্রতি প্রচ্ছন্ন ঘৃনা আর ধনীদের এই শীত কিংবা কষ্টবিলাসের জন্য ওদের প্রতি করুণাবোধই জাগে ওর মনে। প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে বড় হয়ে প্রকৌশলী অথবা বিজ্ঞানী যাই হোক, এমন জিনিস বানাবে না, যা দারিদ্রকে অপমান করে।
(৪)
পাকা রাস্তা অনেক আগেই ফুরিয়েছে। মাটির রাস্তা শেষে ওরা যার যার বাড়ি পৌঁছে। আটপৌরে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে গড়ায়। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় পড়তে বসে শাহিন। প্রচণ্ড শীতে কাতর দাদার কাশির শব্দ শুনতে পায় সে। কল্পণাবিলাসী হয় তার মন। এক রাতে সব কষ্ট ভোগ করে যদি পুরো শীত পার করা যেত! ধনীদের বাড়ি দাওয়াত খাওয়ার কথা মনে করে, গলা পর্যন্ত খেয়ে আসে, যাতে আরো দুয়েক বেলা না খেয়ে থাকতে পারে। এভাবে পুরো শরীর ঠাণ্ডায় বরফ হয়ে যাওয়ার এক রাতের কষ্টে যদি মওসুম পার হয়ে যেত, তাহলে পুরো কষ্ট সে নিজের শরীরে নিত্।
সে কল্পণাবিলাসী হয়, তবে কল্পণাশ্রয়ী হয় না। হাসির গল্পের সেই ডিমওয়ালার মত মিথ্যে ভাবনার ঝাঁকুনিতে বাস্তবের ডিমের ঝাঁকা মাথা থেকে ফেলে নষ্ট করতে সে নারাজ। ভাবনার জগত ছেড়ে বাবার কষ্টের সম্পদ বইয়ে ডুবে যায় বালক শাহিন। তাদের ঘরের সবচে দামী আসবাব একটি র্যাকভর্তি বই। একদিন, এক মুহুর্তে সব বই পড়ে ফেলার কঠিন নিয়ত নেই তার। তবে এই বইগুলোই ওর শক্তি….শীত দারিদ্র অবহেলা অবজ্ঞা-সব তাড়াবে সে।
বইয়ে মগ্ন জ্বলজ্বলে মুখ হারিকেনের শিখার চেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
১৯ জানুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
৪৩ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪