আকবর ডাকে, বীরবল বীরবল…কোথায় তোমার বুদ্ধিবল? উচ্চারে বীরবল, বলুন মহামহিম, কোথায় ব্যর্থ হইল মোর বুদ্ধির ছল?
সম্রাট কহেন- আমি এক মহাপ্রতাপশালী সম্রাট, চাই না আমার সাম্রাজ্যে কোন প্রজা থাকুক হীনবল, দুর্বল।
- হয় উহাদের সবল করুন, দূর করুন ক্ষুধা! নতুবা দিন খেদাইয়া, রাজ্য হইতে পেদাইয়া; বলুন রাজন কি আপনার অভিপ্রায়? বীরবলের জিজ্ঞাসা।
সম্রাটের পরিস্কার বাসনা- তিনি চান সবলের সমাহার, থাকিবে না দেশে আকাল অনাহার, সকলে করিবে সুষ্ঠু আচার। অভাবী লোক থাকিলেই সমস্যা, নানা দাবী, নানা দাওয়া। কাহাতক সহ্য করা যায়, এত চাওয়া-পাওয়া?
যুগের বীরবল। বুদ্ধিতে অতি খাঁটি। ছলে কলে করিতে পারেন এক-আকাশ আর মাটি। অথচ বীরবল এইবার পায় নাই কোন মসনদি পদ, পরিচ্ছন্নতাবাদী বলিয়া সম্রাট রাখিয়াছেন দূরে, ভাবিয়া আপদ। সবিনয়ে বলে, মন্ত্রণা দিব আর কী? আপনার নয়া নবরত্ন অন্ন বস্ত্র বাসস্থান মন্ত্রকেরা কোন কাজ রাখিয়াছে বাকী? কড়ি মন্ত্রী কাড়িয়া নিয়াছে গরীবের ফুটা কড়ি, মানুষ হারাইয়াছে অর্থ, লগ্নির বাজারে; কেন্দ্রীয় কোষাগারপতি ঘুমায় আরাম চেয়ারে। কৃষকের জমি কাড়িয়া নিয়া বানায় ধনীরা আবাসন, বাসস্থানমন্ত্রী সাইনবোর্ড ভাঙিয়া করিতেছেন প্রহসন। বেঁচারাম বেঁচিয়া যাইতেছে, অর্থভারাক্রান্ত কেনারাম কিনিয়া যাইতেছে, দু:খিরাম চাষ ছাড়িয়া থালা লইয়া নগরে আপনার জ্বালা বাড়াইতেছে।
মনুষ্যমন্ত্রী মানব সকলকে সম্পদ নয়, বোঝা হিসাবে বৈদেশে পাঠাইয়া বলির পাঠা বানাইতেছেন, আর মনুষ্য প্রেরক দালালেরা দাস প্রথার সওদাগরের মত বাজার খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।
রক্ষামন্ত্রী করেন রক্ষা কোতয়ালের, অপরাধী গুটিকয়েক-যাহাই পায় সাজা, তাহাদের তরে আপনাদিগের ক্ষমার দুয়ার খোলা। শিশুরা আর দল বাঁধিয়া নাইতে নামে না নদী খাল জলাশয়ে…না জানি কখন, জলাধারপতি কিংবা ধীবর, অভিশংসন করে, পিটাইয়া মারে ঘোষিয়া ‘মৎসলুটেরা তস্কর’।
হে রাজন, আপনার রাজে সবচেয়ে সহজ কর্মগুলি কী অবগত আছেন? আমদানী বিকিকিনি আর রসদ মজুদদারী। উৎপাদনে নজর কম অতি, বেশী লাভের ক্ষেত্র বিকিকিনি। মূল্যরেখা যেখানে চলে একমূখী। বানিজ্যপতিগণ যাহা হউক একটা কিছু মূল্য বলিয়া দিলেই হয়, ক্রেতাগণকে বিনা জিজ্ঞাসায় তাহাই লইতে হয়। …ওহ হো…দুঃখিত মহারাজ, বুঝাইতে ব্যর্থ? তাহা হইলে উদাহরন দেই- ধরুন বানিজ্যপতি প্রতিটি তিল বেঁচিতে চায় তালের ওজনের সমতূল্যে, সে প্রাথমিকভাবে মূল্য বাধিবে দশাসই কুমড়ার ওজনে। ….গেল গেল রব উঠিলে চারিদিকে, আপনার বিকিকিনি মন্ত্রক করে হস্তক্ষেপ।
বানিজ্যপতিকে ডাকিয়া করেন আস্ফালন। বীরদর্পে কুমড়া হইতে নামাইয়া তালের ওজনে, তিলের মূল্য করেন নির্ধারন। তদপর বাজার হয় সয়লাব, তিলে। অত্যাবশ্যকীয় তিল কিনিয়া ক্রেতা ফিরেন ঘরে, সদাইয়ের ভার নয়, সংসারের ভারে ন্যুজ্ব, শুন্য পকেটে ভবিষ্যত, পেট চালানোর ভয়।
ভাবিবার রহিয়াছে আরো অনেক বিষয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়াছে, যদিও পরিসংখ্যান নিয়া নানা মুনি প্রকাশ করিতেছেন নানা মত। মানুষ কমিলে প্রবৃদ্ধি বেশি দেখাইবে, মাথাপিছু আয় বাড়িবে। চিন্তার কিছু নাই। বিড়বিড় করিয়া বীরবল মাথা দুলায়।
প্রবৃদ্ধি আরো ঘটিবে। উড়াল পথ আর বিশালাকায় সেতু আসিতেছে, পথমন্ত্রীর কল্যাণে। সড়ক পথ বেহাল নাজুক, দুর্ঘটনায় মরিতেছে মানুষ, বেশুমার…নিন্দুকেরা মাথা নাড়ে। অতি সত্য কথা। তবে কী হইবে তাহাতে, মানুষের কিবা দরকার রাজপথে অতি চলাচল? জ্বালানী সাশ্রয়ে স্বাবলম্বী হইবে দেশ, বাঁচিবেও সিএনজি গ্যাস। বিমানে চড়িবে যাহার আছে সংস্থান, বাকীরা বেলুনে চড়িয়া করিবে আগমন প্রস্থান।
বেদনা বিধুর…নাগরিকের পথ অতি বন্ধুর। কেন এই সমস্ত হতাশাবাণী শুনাও আমারে? নাই কি কোন আশার বানী, অথবা কোন উন্নতি, সম্রাট সখেদে বলে।
উন্নতি মানে যদি ধরেন বৃদ্ধি….তাহা হইলে অনেক বলিতে পারি। দুর্নীতির উন্নতি, খুন-খারাপির উন্নতি, কাহারো কাহারো অর্থ-বিত্তের উন্নতি প্রভূত ঘটিয়াছে।
থামো থামো…টানো তোমার অতিকথনে যতি। মধ্যাহ্ন নিকটাগত, মহারাজার ক্ষুন্নিবৃত্তির সময় আগত। পরিবেশিত হয় রেকাবি ভরিয়া আহার যত। আহারসমূহ অনেক দূরে, শারীরিক সামর্থ মাঝখানে বাধা। নাড়িয়া চাড়িয়া সম্রাট লহেন একটিমাত্র ব্যঞ্জন, কম মশলায় রাঁধা। পরিচারকের ক্ষুধাতুর নজর….আহার্যসমূহ মহার্ঘ, মাঝখানে বাধা দারিদ্র। ….ক্ষুধা আর রসনাসামর্থ সমান আসনে বসায়, রাজা আর প্রজায়।
আহারকক্ষ হইতে ফিরিয়া আসেন মহারাজা, চিন্তায় ভাঁজ বলিরেখা। বীরবল খুলিতে বসেন বুদ্ধির ঝাপি। হাত নাড়িয়া নিবৃত্ত করেন সম্রাট। নিজের বিবেকে লাগিয়াছে টান, না লাগিবে তাহার পরামর্শ দান। নীরবতা ভর করে প্রাসাদ জুড়িয়া। মৌনতা ভাঙেন রাজা- ভাবিতেছি একটু মৃগয়া করিয়া আসি। হা’ হইলে শুনিয়া, মৃগয়ার কথা? যাইবো আফ্রিকায়…কিনিবো জমি, মুফতে করিব জঙ্গল সাফারি। তথা হইতে ব্যোমযান ভাড়া আনিবার কাজও করিতে হইবে সমাধা….বলিতে বলিতে বিশ্রামে যান মহারাজা।
আপাততঃ এইখানেই টানি ইতি, রাজালাপের সাময়িক বিরতি। আগামীতে যদি হয় উঁহাদের কথোপকথন, যদি ধরা পড়ে ক্লোজ সার্কিট রিসিভারে...আনিব আবার আপনাদের সন্নিকটে। সেই পর্যন্ত….সঙ্গেই থাকুন।
(সম্পূর্ণ বিষয়টি লেখকের আকাশ-কুসুম কল্পণা। কল্পণাবিলাসী পাঠক ব্যতিত অন্য কাহারো ইহা পাঠ বর্জনীয়।)