ক্ষুদ্র এ জীবনে মানুষ যা চায় তার সবটাই কি পায়, নাকি অপ্রাপ্তিগুলো অজস্র স্বপ্ন হয়ে কেবল হাতছানি দিয়ে বেড়ায়? আমাকেই দেখুন না- ছাব্বিশ বছরের এ জীবনে বসয়ভেদে কতই তো চাহিদা ছিল, সব কি পূরণ হয়েছে? হতে চেয়েছিলাম প্রকৌশলী, হয়েছি কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি। যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পরিবর্তে অফার আর প্রমোশন্সের খোঁজ দিয়ে বেড়াচ্ছি। কাজটা যদি সফলতার সাথে করতে পারতাম তবে কোনো খেদ থাকত না। কিন্তু আমার আফসোসটা এখানেই- ছাত্রজীবনের মার্কসসীট থেকে কর্মজীবনের ইভাল্যুয়েশনসীট পর্যন্ত কখনও কোনো কিছুতে সেরা হতে পারলাম না, আবার ব্যর্থ হয়েছি তা-ও বলা যাবে না। সবখানে মধ্যবর্তীই রয়ে গেলাম!
অর্থের বিচারে মধ্যবিত্তদের যেমন নিত্য টানাপড়েনে থাকতে হয়, যোগ্যতার বিচারেও আমাকে তেমনি দোটানায় পড়তে হয়- সেরাদের দলে যাবো, না ব্যর্থদের? আর এ থেকে তৈরি হয় দ্বিধা।
চৈতি বলে, এটা নাকি আমার দোষ না, আমার রাশির দোষ! আমাদের এ বন্ধুটির আবার অ্যাস্ট্রোলজিতে অগাধ বিশ্বাস। বলা চলে অন্ধ বিশ্বাস। ভূগোলের যেকোনো প্রান্তেই হোক না কেন, প্রথম পরিচয়ে একজন বাঙালি আরেকজন বাঙালির সাথে ঘনিষ্ঠ হবার জন্য যেখানে জিজ্ঞেস করেন, "বাড়ী কোথায়?", আমাদের চৈতি সেখানে জিজ্ঞেস করবে, "বার্থডে কবে?", যাতে রাশির আলোকে আগেভাগেই তাকে যেচে নিতে পারে। চৈতিকে এ কারণে আমরা ডাকি 'রাশি ম্যানিয়াক'।
আশিক আবার কর্মে বিশ্বাসী, বলে, "তুই শতভাগ চেষ্টা করিস না বলেই মধ্যরেখা বরাবর থাকিস।"
হবে হয়তো। কারণ যা-ই হোক, নিজের অবস্থান নিয়ে আমি প্রায়ই বেশ অপূর্ণতায় ভুগি। তারেকের সাথে দেখা হবার পর থেকে সে অপূর্ণতাবোধ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমার স্কুলজীবনের এ সহপাঠী বরাবর পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করত, ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চটায় বসত, অপরিচ্ছন্ন থাকত, আর মাত্রাতিরিক্ত বাঁদরামির কারণে ঘনঘন বড়দের শাসনের সম্মুখীন হত। সেই ছেলেই এখন ইউএসএর নামকরা তেল কোম্পানিতে চড়া বেতনের চাকরি করে, বিয়ে করে সেখানেই স্যাটল্। ওর গা থেকে এখন আর ঘামের গন্ধ আসে না, আসে পার্ক এভিনিউ এর মতো পারফিউমের ঘ্রাণ। ওর মানিব্যাগভর্তি এখন ভিসা আর মাস্টারকার্ড। ক্রকোডাইলের পোলো, ডেনিম জিন্স, অ্যাডিডাসের জুতো আর রোলেক্সের হাতঘড়িতে ওকে দেখতে লাগে বেশ।
পরশ্রীকাতর হয়েই হোক, আর প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ার ভয়েই হোক- তারেককে দেখার পর থেকে একধরনের হতাশায় ভুগছিলাম আমি। আশিক আর চৈতির অবস্থা অবশ্য আরও খারাপ। একজনের অফিসে ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের অহেতুক ঝাড়াঝাড়ি, অপরজনের বিয়ে নিয়ে পরিবারের পীড়াপীড়ি। ফলে অনেকদিন পর আড্ডা দিতে এলেও আমাদের আড্ডা জমছিল না।
মন যখন শরতের আকাশের মতো ঝলমলে থাকে, উৎফুল্ল অনুভূতিগুলো যখন ধবধবে সাদা মেঘের মতো উড়ে বেড়ায়, আমাদের আড্ডাও তখন কোনো জনপ্রিয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের মতো পরিচালিত হতে থাকে। আর মনের আকাশ যখন ছাইরঙা মেঘের ছায়ায় পরিপূর্ণ, আমাদের সম্মিলনও তখন গুরুগম্ভীর আলোচনার টকশোতে পরিণত। সেই টকশোতে এখন কিছু সময়ের বিরতি- আশিকের মোবাইলে স্নেহার কল এসেছে।
স্নেহা আমাদের হবু ভাবী, সাড়ে তিন বছর যাবত ওদের ভাব-ভালোবাসার বিনিময় চলছে। আশিককে দেখলে আমার মাঝেমাঝে মনে হয়- আমারও যদি ওর মতো কেও থাকত, যার কাঁধে হাত রেখে কালবৈশাখী উপভোগ করা যায়, যাকে নিয়ে বর্ষাদিনে নীল পর্দায় মোড়া রিক্সায় ঘুড়ে বেড়ানো যায়, শরতের কাশবনে লুকোচুরি খেলা যায়, হেমন্তের সকালে খালি পায়ে শিশিরভেজা ঘাস মাড়ানো যায়, শীতে উষ্ণতার সান্নিধ্য আর বসন্তের রোমান্টিকতা উপভোগ কর যায়।
ভাবতেই মনটা হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ব্যস, অনেক হয়েছে, আর নয়। আর নয় জীবনের হালখাতায় অপূর্ণতার হিসেব-নিকেশ কষা, এখন শুধু মনের খাতায় রঙীর স্বপ্ন আঁকা।
সামনে নতুন বছর আসছে। বাংলা নববর্ষ। নতুন বছর মানেই পুরোনো সকল ব্যথা-বেদনা ভুলে সামনে এগিয়ে চলা। চৈতি এরই মাঝে লাল পাড়ের সাদা শাড়ী কেনার চেয়েও অধিক গুরুত্বের সাথে রাশিফলের কয়েকটা পঞ্জিকা কিনে পড়া শুরু করেছে। বোর্ড পরীক্ষায় প্রশ্ন কমন পড়ার জন্য আমরা যেমন কয়েকজন স্যারের সাজেসন্স সংগ্রহ করে কমন টপিকসগুলো পড়তাম, চৈতিও তেমনি কয়েকজন জ্যোতির্বিদের সদৃশ ভবিষ্যদ্বাণীগুলো থেকে অনুমান করে নেয় ওর নতুন বছর কেমন যাবে। বেচারী!
আশিক কী করছে পয়লা বৈশাখে? জানতে প্রশ্ন করলাম। স্নেহার সাথে কথা বলার পর থেকে ওকেও ঝড়ঝড়ে লাগছে। আমার প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে বলল, "বলা যাবে না, টপ সিক্রেট!"
চৈতি আমার দিকে টিপ্পনী কেটে বলল, "দেখ, আশিক আবার বিয়ে করে ফেলে কিনা!"
কিছুক্ষণ আগের গুমসানো পরিবেশে এভাবেই ফুরফুরে হাওয়া বইতে লাগল। উৎসবের আমেজ বুঝি এক কাপ চায়ের মতো এভাবেই মনকে উজ্জীবিত করে তোলে!
বছরের প্রথম দিন আমি কী করছি তা এখনও নিশ্তিত নয়। হতে পারে-
ক) বন্ধুদের সাথে ঘুড়ে বেড়াব
খ) পরিবারের সাথে দেখা করতে বাড়ি চলে যাব
গ) সারাদিন বাসায় পড়েপড়ে ঘুমাব
ঘ) উপরের কোনোটিই নয়, অফিসের ডিউটি করতে হতে পারে।
দেখা যাক, ওইদিন কোনটায় টিক পড়ে...
সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
০৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪