নিজের দেশের প্রতি সকলেরই একটা মমতা থাকে। দেশের প্রতি এই মমত্ববোধকে দেশপ্রেম বলে। দেশের মাটি ফসল ফলমূল, মানুষের জীবন বাচায়। দেশের গাছের ছায়া শন্তিদান করে। দেশের মৃদু বাতাস আমাদের শরীর জুড়ায়। নিজের দেশের মাটি সকল মানুষের কাছে পরম প্রিয়।
হাদীসে আছে, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশ প্রেমিকের মতে, জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও শ্রেষ্ট। স্বদেশের প্রতিটি ধুলিকণা মানুষের নিকট পবিত্র। তাই কবি জীবনানন্দদাশ বলেছেন, বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ আমি দেখিতে চাইনা আর।
দেশপ্রেম মানুষের চরিত্রের এক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। দেশপ্রেম হৃদয়ে থাকলেই দেশের মাটি, মানুষ, প্রকৃতি সবকিছুই প্রিয় ও পবিত্র মনে হয়। নিজের দেশে জন্মগ্রহণ এবং আস্তে আস্তে সেখানে বড় হয়ে ওঠার ফলে স্বাভাবিক আকর্ষণ গড়ে ওঠে। এই আর্কষণ থেকে স্বদেশপ্রীতির যে বৈশিষ্ট প্রকাশ পায় তার জন্য মানুষ সবকিছু বিসর্জন দিতে পারে এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত। নিজের দেশের মান ও গৌরব রক্ষার জন্য মানুষ তাকে ত্যাগ স্বীকার করে দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়।
মা যেমন সন্তানকে লালন করেন তেমনি নিজের দেশকেও ভালবাসে, বুকে লালিত করেন। মাকে মানুষ যেমন ভালবাসে, তেমনি নিজের দেশকেও ভালবাসে। প্রগাঢ় এই ভালবাসায় মানুষ উপলব্ধি করে,
“জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী ”
জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে বেশি বড় মনে করার পেছনে কাজ করে দেশপ্রেম। তাই মা আর জনন্মভূমি বা নিজের দেশ এক পর্যায়ে স্থান পায়। যে দেশের মাটিতে মানুষের জন্ম হয় সেদেশের ইতিহাস তার মনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
নিজের কুঁড়েঘর থেকে যেমন মানুষ সুখ খুঁজে পায়, তোমনি নিজের দেশকে ভালবেসে প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে মাত্র নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে লাখো লাখো মানুষ শহীদ হন। স্বাধীনতার শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনেছে রক্তিম সূর্য। মায়ের ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের সূর্য সন্তানরা জীবন দিয়েছে। যাদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের এদেশ। দেশকে ভালবাসে বলেই আমরা এদেশ পেয়েছি সেই সব ব্যক্তির নাম ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দেশপ্রেম মানুষের মনকে উন্নত করে।
দেশপ্রেমের ফলে মানুষের মন মহৎ ও উদার হয়। মনের ভিতর স্বদেশের জন্য ভালো কাজ করার উৎসাহ পায়। দেশপ্রেমের মহিমার ফলে জাগ্রত হয় অপরের জন্য কল্যাণ। কবি মাইকেল মধুসূধন দত্ত স্বদেশ ছেড়ে ইউরোপে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন দেশের মাটি, মানুষ,প্রকৃতি কত যে প্রিয়। তাই বিদেশে অবস্থান কালে তিনি কপোতাক্ষ নদকে উপলক্ষ করে লিখেছিলেন-
সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে,
সতত, তোমারি কথা ভাবি এ বিরলে।
এই যে মনে পড়া, এই যে ভাবনা তার মূলে রয়েছে দেশপ্রেম।
ছাত্রজীবন থেকে দেশপ্রেম শিক্ষা অতুলনীয়। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর উচিত নিজ দেশ সম্পর্কে জানা। দেশকে ভালবাসতে হলে ছত্রজীবন থেকেই দেশের প্রতি ভাবাসা থাকতে হবে। দেশকে প্রাণের চেয়েও প্রিয় পবিত্র মনে করতে হবে। দেশকে ভালবাসতে শিখলে দেশের কল্যাণে জীবন দান করার মনোবৃত্তি জাগবে। দেশের প্রতিটি মানুষকে আপন করে ভাবতে হবে। স্বদেশপ্রেম প্রাচীনকাল থেকে গুরুত্ব পেয়ে আসছে প্রাচীন পুরান মহাকাব্যে। কৃষক শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, কামার কুমার, জেলে, তাঁতি ওরা সবাই জীবন দিয়েছে। শহীদ হয়েছে লাখো লাখো বীর। তাদের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এদেশ পেয়েছি। তাছাড়া ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই দেশকে ভালবেসে কত মানুষ অকাতরে জীবন দিয়েছে। তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, সিরাজ উদ দৌলাসহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক স্বদেশের জন্য হাসতে হাসতে জীবন উৎসর্গ করেছেন।
সবুজ শ্যামল, ছায়াঘেরা এদেশ। এদেশের প্রতি প্রত্যেক মানুষেরই কর্তব্য আছে। দেশপ্রেম থেকে এ কর্তব্য সৃষ্টি হয়। স্বদেশের মত এত প্রিয় স্থান আর নেই। যেদেশে জন্ম, যেখানে জীবনের বিকাশ সেদেশ পরম প্রিয়। দেশের প্রতি ত্যাগ স্বীকার করে মনুষ্যত্যের পরিচয় দিতে হবে। দেশের প্রতি ভাবাসার নিদর্শন দেখাতে হবে। দেশের উপকারে কাজের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের উপকারে আসে এমন কাজ করতে হবে। স্বদেশ প্রেমিক কবি গেয়েছেন।
“ আমার এই দেশেই জন্ম যেন
এই দেশেতেই মরি।”
যথার্থ মানুষ হতে হলে তার মধ্যে অনেক মহৎ গুণের সমাবেশ থাকা দরকার। দেশপ্রেম তেমনি একটি মহৎগুণ যা মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করতে প্রেরণা দেয়। এই গুণটি না থাকলে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দাবি করা যায় না। এখানে স্বার্থকে বড় মনে করলে চলবেনা। দেশের জন্য ত্যাগ স্বাীকার করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দিতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) নিজের দেশকে অনেক ভালোবাসতেন। যখন মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাচ্ছেন তখন বারবার নিজের দেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যারা দেশের জন্য কিছুই করেনা বরং নিজেদের স্বার্থ সাধনের জন্য তৎপর থাকে তারা মানুষের গুণের অধিকারী নয়। তারা পশুর পর্যায়ে পড়ে। দেশপ্রেমহীন মানুষ পশুর মতই অত্মস্বার্থে জীবন যাপন করে। তাই মানুষকে দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে হবে।
দেশপ্রেমের উপায় অনেক রকম। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহন যেমন দেশপ্রেমের পরিচায়ক, তেমনি সাহিত্য, শিল্পকলা বা অন্যান্য জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে কাজ করাও দেশপ্রেমের লক্ষণ। দেশপ্রেম নিজের দেশকে জানতে শেখায়, ভালবাসতে শেখায়। দেশের প্রেমের মাধ্যমে বিশ্বপ্রেমের অনির্বান শিখা জ্বালাতে হবে। এই প্রেমকে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিয়োজিত করে বলতে হবে ঃ “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”
ব্যক্তি স্বার্থের ওপরে স্থান দিতে হবে দেশপ্রেমকে। জীবনের মূলে জাগিয়ে রাখতে হবে দেশপ্রেমের চেতনা। তাহলেই স্বাধীন জাতির মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে। আর এই মর্মাদা সমুন্নত রাখার জন্য দেশপ্রেমকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লার মতে- মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা আমাদের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সম্পদ। বাস্তবিকই মাতা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা এ তিনের বিকল্প নেই। স্বদেশের পরিচয়েই ব্যক্তি বা জাতির পরিচয়। স্বভাষার অনুশীলনেই ব্যক্তি মানুষ ধীরে ধীরে তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে দেশের মাটিকে ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধায় ভালবাসার মধ্যেই পায় চরম সার্থকতা।
দেশপ্রেম প্রতিটি মানুষের সহজাত ব্রত। কারণ জন্মগত সূত্রেই যে দেশের একজন নাগরিক রূপে মানুষ সব অধিকার পায়। সে দেশের প্রতি তার অকৃত্তিম অনাবিল ভালবাসা থাকে এবং দেশের ভালমন্দ, স্বার্থ সুরক্ষা, উন্নতি মর্যাদা সব নিয়েই দেশবাসীর কল্যাণ কর্মে সে নিজেকে নিয়োজিত করবেই। বিশ্বের ইতিহাসে দোখা যায়, দেশের স্বাধীনতা ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে যুগে যুগে কত দেশপ্রেমিক নির্ভয়ে প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। দেশবাসীর প্রাণে চিরকাল প্রেরনার উৎসর্গ করেছেন। দেশবাসীর প্রাণে চিরকাল প্রেরনার উৎস হয়ে বিরাজ করেছেন।
স্বদেশপ্রেমিকের কৃত্রিম পোষাক পরে আজকাল এক শ্রেণির মানুষ স্বদেশের নিরীহ জনগণের শ্রমে উৎপাদিত ফসলে গড়ে তুলছে শিল্প কারখানা, হচেছ বিত্তশালী। এরা স্বদেশের প্রতি নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অতিমাত্রায় সকিয়তা এবং তার তার কাজের জন্য অপরের প্রতিবাদে তীব্র আকাঙ্খা উগ্র স্বদেশ প্রেমিকের প্রকৃত স্বরুপ অচিরে উদঘাটন করে। তাছাড়া দেশপ্রেম যার হৃদয়ে নেই, সে খাঁটি রাজনীতিবিদ হতে পারে না।
দেশে বিভিন্ন অঞ্চল থাকলে দেশ যে এক ও অখন্ড এবং তার সকল অঞ্চলের লোকের যে এটি স্বদেশ এই বোধ থেকেই জন্ম নেয় স্বদেশপ্রেম, জাতীয়বোধ। পরাধীনতার গ্লানি, স্বদেশপ্রেমিকের চিত্তে সমান্তরিক যন্ত্রনা দেয়। এ যন্ত্রনা থেকেই তিনি স্মরণাপন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার দীক্ষা করেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুররহমান প্রমুখ দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামের অক্লান্ত যোদ্ধা। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, স্বদেশপ্রেমের অমর দৃষ্টান্ত।
স্বদেশপ্রেম একটি সহজাত বৃত্তি। নিজের দেশকে ভালবাসার মধ্যে যে আন্তরিকতা, স্বদেশবাসীর কল্যাণে কর্মপ্রেরণা ও নিষ্ঠা,তা আমৃত্যু অবিচল থাকে। কবিদের কন্ঠে বারবার ধ্বনিত হয়েছে স্বদেশপ্রেমের বিচিত্র বৈশিষ্ট এবং দেশবাসীর প্রতিটি মানুষের দায়িত্বও কর্তব্যের ইঙ্গিত।
দেশ ভাবনা দেশপ্রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট। সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির চর্চার মাধ্যমে সৃজনশীল মানুষের দেশভাবনা বিচত্রিরুপে প্রকাশিত হয়। দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় জীবনের অভাব বা অপূর্ণতার প্রতি লক্ষ রেখে আমাদের সংকল্প স্থির করতে হবে এবং সে অনুযায়ী নিরলস ভাবে কাজ করে যেতে হবে। যাতে স্বদেশ হয় স্বনির্ভর,শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতা অর্জন বড় কষ্টসাপেক্ষ, কিন্তু স্বাধীনতা সংরক্ষণ কঠিনতর।
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় স্বদেশ ভূমি। এদেশকে ভালবেসে আমাদের সকলের দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া দরকার। দেশের কল্যাণের জন্য যদি আমারা ছাত্র সমাজের সুন্দর জীবন গড়ে তুলতে পারি এবং দেশের কাজে লাগাতে পারি তবেই দেশপ্রেমের সার্থক পরিচয় দেওয়া হবে।