হায় রাত!

রাত (মে ২০১৪)

ডা: প্রবীর আচার্য্য নয়ন
  • ১৪
  • ১৩
মেডিকেলের রাত অন্য জায়গার মতো নয়। এখানে রাতেও অনেক রোগী আসে। ডাক্তারদের আসা যাওয়া চলে। রোগীর আত্মীয়রা এখানে সেখানে শুয়ে থাকে। হঠাৎ বুকফাটা কান্নার শব্দ শোনা যায়। বুঝা যায় কোন রোগীর জীবনের সমাপ্তি হয়েছে। এক বিছানায় মারা যাওয়া রোগীকে দেখে অন্য বিছানার রোগীরা ভাবতে থাকে নিজের মৃত্যুর কথা। একটি সনদপত্র নিয়ে চলে যায় মরদেহ। খুব কম সময়ের ব্যবধানে নতুন কেউ দখল করে বিছানাটা। অন্যদিকে একই রাতে হয়তো জন্ম নেয় নতুন কেউ। সুস্থ স্বাভাবিক হলেতো কথা নেই। অসুস্থ অস্বাভাবিক হলে তাকে নিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। কখনো সন্তান সুস্থ থাকলেও মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দরকার হয় রক্তের। তৈরী থাকে রক্ত বিক্রেতারা। হয়ে যায় রক্তের বেচা কেনা। কখনো শিশুও বেচাকেনা হয়ে যায় এমন রাতে। হায়রে রাত! মরমে মরমে তার ঘাত প্রতিঘাত।

পুণম ডাক্তার হিসেবে বেশ নাম করেছে। মেডিকেলের গাইনী বিভাগে কাজ করে সে। শৈশবে স্বপ্ন দেখতো বড় ডাক্তার হবে। গ্রামে যখন প্রসবের সময় অদক্ষ ধাত্রীদের হাতে কোন শিশুর মৃত্যুর কথা শুনত, তখন ভাবতো সে এমন দক্ষতা অর্জন করবে যাতে তার হাতে কোন শিশু জন্মের সময় মারা না যায়। বাস্তবেও তাই হয়েছে। লোকে বলে পুণম আপা ধন্বন্তরী। অনেক জটিল রোগীর সফল অপারেশন করেছে সে। এদেশে এখনো সব উন্নত যন্ত্রপাতি আসে নি। তবে একসময় আসবে বলে তার বিশ্বাস। কোন ডাক্তারের সুনাম বাড়লে হাজার রকম ঝামেলাও বাড়ে। যাদের সুনাম নেই তারা নানা রকম গুজব ছড়ায়। পুণম শুনেছে তার নামে প্রচার করা হচ্ছে -উনার কাছে গেলে নরম্যাল ডেলিভারিও সিজার করায়। টাকা খাওয়ার ফন্দি। এদের কথায় প্ররোচিত হয়ে যত মা ও সন্তান প্রাণ হারাচ্ছে সে জন্য কি এরা দায়ী নয়। রাতে রোগী দেখতে গেলে নিন্দুকেরা অশোভন মন্তব্য করে। আচ্ছা! অসুখ কি দিন রাত দেখে আসে! তাছাড়া ডাক্তারের আবার দিন রাত কি!

আজকে কাজে মন বসছে না। একটা প্রভাবশালী চক্র প্রভাব খাটিয়ে তাকে প্রমোশনের নামে প্রহসন করে গ্রামের একটা মেডিকেলের প্রধান করে পাঠাচ্ছে। গ্রামে যেতে তার আপত্তি নাই। কিন্তু যতটা খবর পেয়েছে তাতে খুব দুশ্চিন্তার কারণও আছে। ওখানে কেউ খুব একটা টিকতে পারে না। প্রভাবশালীদের ইচ্ছেমতো সব রিপোর্ট দিতে হয়। ওদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গেলে অসহ্য নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়। কয়েকদিন আগে রাতে কর্তব্যরত এক নার্সকে নাকি ওখানকার চেয়ারম্যানের ছোট ভাই জোর করে একটা কেবিনে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাইরে দাড়ানো ছিল দুইজন ক্যাডার। এতগুলো ডাক্তার, নার্স, স্টাফ কেউ কিছু করতে পারল না। হায় রাত! আর কতকাল শুনতে হবে সভ্রমহারা আর্তনাদ!

ওদের আখাড়াটা চালের গুদামের ভেতরে। চেয়ারম্যানের ভাই বাদশা মিয়া বসে আছে একটা রিভোলভিং চেয়ারে। এসি রুমে। পনের মিনিট পর পর এয়ার ফ্রেশনার সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। মেডিকেলের ঘটনাটা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ আসছে। তার ভাই অবশ্য ঘটনাস্থলে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে এবং চিকিৎসার জন্য কিছু টাকাও দিয়ে এসছে। তবুও নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি এনজিও বেশ বাড়াবাড়ি করছে। রাতে দলনেত্রীর সাথে দেখা করে হিসেবটা মিটিয়ে ফেলতে হবে। থানার ওসি অবশ্য গত রাতে দেখা করে গেছে।রাতের অন্ধকারে বিক্রি করে গেছে তার আদর্শ।
চেয়ারম্যান সাহেবের ফোন
-ছোট ভাই তুমি কয়দিনের লাইগা পাহাড়ের নীল কুঠিয়ায় গিয়া থাক। পরিস্থিতি শান্ত হইলে আমি ফোন করুমনে। এখানকার সব আমি সামাল দিমু। কোন চিন্তা কইরো না।
-ঠিক আছে, ভাইজান।
ও পাশ থেকে ফোন রেখে দিল। একটা সাধারণ নার্সের সাথে রাতে একটু মজা করার জন্য তাকে এলাকা ছাড়তে হবে।
-তবুও ভাইজান যখন কইছে গা ঢাকা দিয়া থাকি।

বাদশা মিয়া পাহাড়ে নীল কুঠিয়ায় এসেছে দুদিন হল। এখানে ওদের চোরাই গাছ, ইলেকট্রিকের তার, চোরাই খাম্বা, আর বিভিন্ন পুরোনো মূর্তি ও শিল্পকর্ম পাচারের ব্যবসা আছে। একবার কয়েকজন পাহাড়ী মেয়েকেও বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। দুদিনেই ব্যবসাটা গুছিয়ে নিয়েছে। আজকে একটু দোচোয়ানির ব্যবস্থা করতে বলেছে কেয়ারটেকারকে। রাতে তার সেবার জন্য মহুয়া নামে এক পাহাড়ী মেয়ে আছে। বাদশা মিয়া মহুয়াকে ডাকল। মহুয়ার আরাম পেয়ে বাদশা মিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। মহুয়া টাকা নিয়ে যায়। তার বাবাকে দেয়। বাবা কাঁদে। টাকা না পেলে বাজার করতে পারতো না। অভাবের তাড়নায় কত মহুয়া কত বাবুজিকে আরাম দিয়ে রাতে ঘুম পাড়ায় দিনের সূর্য তার খবর রাখে না। তার খবর রাখে রাতের আকাশের চাঁদ আর তারারা।

আজ ডাক্তার পুণমের মেয়ে স্বপ্নার জন্মবার্ষিকী। রাতে কয়েকজন ডাক্তার ও আত্মীয়দের নিমন্ত্রন করেছে। ছুটি নিয়ে সারাদিন নিজে বেশ কিছু সুস্বাদু খাবার তৈরি করেছে। ফ্ল্যাটের দরজা জানালার পর্দা পরিবর্তন করেছে। ঝাড়বাতিগুলো জ্বালানো হয়েছে। অনেকদিন কণ্ঠ সাধনা করা হয়নি। আজ সবার অনুরোধে একটি জন্মদিনের গান গাইল পুণম। নিয়মিত কাজের বাইরে এই ভিন্নতার স্বাদ বড় বেশি উপভোগ করে সে। ডাক্তার হলেও সে তো একজন মানুষ যার ঘর আছে, বর আছে, সুখ আছে, সন্তান আছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে সব গুছিয়ে শুতে গেল বিছানায়। স্বপ্না ঘুমিয়ে পড়েছে। বহুদিন পর স্বামী স্ত্রীতে অন্যরকম সুখ বয়ে গেল। স্বপ্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো স্বপ্নারতো পাঁচ বছর হলো। এবার কি নতুন কেউকে আনবে। রাত! কখনো কত সুখের! কত আনন্দের হয়!

এখানে আসার পর থেকে একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে। রোগীদের জন্য আসা সরকারী ঔষধ চুরি হয়ে যায়। নিয়োগকৃত ডাক্তারদের অধিকাংশই উপস্থিত থাকে না। সরকারী কোয়ার্টারে থেকে ওরা ভিজিট নিয়ে রোগী দেখে। সিলিণ্ডার আছে, অক্সিজেন নাই। কোথায় গেছে কোন রেকর্ড নাই। বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেল কাছেই একটা ক্লিনিকে কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। কোন রোগী আসলে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাগজ লিখে দিয়েই দায়িত্ব শেষ। বিশটা শয্যায় চার জন রোগীও নাই। যারা আছে তারাও ঠিক রোগী নয়। রাজনৈতিক কারণে মেডিকেলে আশ্রয় নিয়েছে। আজকে একজন ভর্তি হতে এসেছিল। পুণম দেয়নি। বলেছে যারা আছে তাদেরকেও দু- একদিনের মধ্যে ডিসচার্জ করে দেবে। ডাক্তারদের নিয়ে একটা মিটিং করতে হবে। স্টাফদের দাপট ডাক্তারদের চেয়ে বেশি। চরম অব্যবস্থাপনা। একবার চেষ্টা করে দেখতে হবে ঠিক করা যায় কি না। একটা ফোন আসল।
-হ্যালো, ডাক্তার পুণম বলছি।
-আপা, আচ্ছালামালাইকুম। আমি বাচ্চু চেয়ারম্যান বলতাছি।
-হ্যা, বলুন চেয়ারম্যান সাহেব। আপনার জন্য কি করতে পারি।
-আপা, আপনে মাইয়া মানুষ। ইজ্জতের ডর থাকলে পোলাডারে ভর্তি কইরা লইয়েন।
পুণম নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করল। কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে তার মন সাই দিল না। ছেলেটা আবার এসেছে। পুণম তাকে সরাসরি বলে দিল
- উনাকে বলে দিবেন মেয়ে বলে কেউকে দুর্বল ভাবা ঠিক নয়।
ছেলেটা যাবার পর মনে হল জলে থেকে কুমিরের সাথে লড়াই করা ঠিক হচ্ছে না।

রাত আটটা। একটা মাইক্রো এসে থামল মেডিক্যলের সামনে। কয়েকজন সশস্ত্র ক্যাডার কামাণ্ডো স্টাইলে নামল গাড়ি থেকে। সরাসরি গিয়ে ঢুকল পুণমের রুমে। কিছু বুঝে উঠার আগেই কালো কাপড়ে চোখ মুখ হাত বেঁধে কোলে তুলে নিল ডাক্তার পুণমকে। মাইক্রো বাস ছাড়ার শব্দ শুনল। বিশ মিনিট পর তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলল একটি বিছানায়। চোখের বাঁধন যখন খুলল তখন আবছা অন্ধকারে দেখল চারজন লোক শকুনের মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর যা ঘটল তা সে মনে করতে চায় না। পরে মেডিকেলের কাছেই ওকে ফেলে দিয়ে গেছে ওরা। মুখের বাঁধন খুলে আস্তে আস্তে রুমে ঢুকল। ঘড়িতে এখনো বারোটা বাজে নি। কিন্তু তার জীবনের বারোটা বেজে গেছে।

সাক্ষী আকাশের চাঁদ, ছায়াপথ, ধ্রুবতারা। সাক্ষী রাতের পেঁচা, নিশাচর, জোনাকিরা। সাক্ষী তরুলতা, সাগরের ঢেউ। রাতের আঁধারে হায়! কত কী যে হয়ে যায়, কতজন কি হারায়, কতজন কত পায়, জানেনা, জানেনা তা কেউ।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
জান্নাতুল ফেরদৌস ডাক্তারের পত্নি হিসাবে ডাক্তারদের জীবন ও মেডিকেলের কাজ সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা আছে । আপনি নিয়মিত লিখছেন বলে অভিনন্দন।
ধন্যবাদ জান্নাতুল ফেরদৌস "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
সকাল রয় খুব ভাবনাযুক্ত রচনা। ভালো লাগা।
ধন্যবাদ সকাল রয় "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য
মিলন বনিক নয়ন ভাই...খুব সুন্দর উপস্থাপনা...খুব ভালো লাগলো...শুভ কামনা....
ধন্যবাদ মিলন বনিক "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
বশির আহমেদ রাতের কালো দিকটা এমন নিখুত ভাবে বর্ননা করেছেন যা পড়ে আতকে উঠা ছাড়া উপায় নেই । রাজনীতি এদেশে জবর দখল নীতিতে পরিনত হয়েছে । সুতরাং এ দেশে এর চেয়ে ভালি কিছু আশা করা বৃথা । ভাল থাকবেন শুভেচ্ছা জানবেন ।
ধন্যবাদ বশির আহমেদ "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
দেবল নস্কর অসাধারন, খুব ভালো লেগেছে ||| আমার কবিতায় আমন্ত্রন রইল ||
ধন্যবাদ দেবল নস্কর "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
মোজাম্মেল কবির দেশের রাজনীতি যত দিন পেশী শক্তির প্রভাব মুক্ত না হবে... কোথায় নয় কাজে যেদিন আমরা সভ্য হবো সেদিন এই সব অনাচার থেকে জাতি মুক্তি পাবে...
ধন্যবাদ মোজাম্মেল কবির "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
biplobi biplob Hay rat tumi ki sudu e narir shomvrom kara naoyu.! Naki bichitrota daka o vinnotar.
ধন্যবাদ বিপ্লবী বিপ্লব "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
Gazi Nishad বিশেষ ভালোলাগা। আমার কবিতার সাথে কেমন যেন একটা মিল আছে। আমন্ত্রণ রইলো আমার কবিতায়।
ধন্যবাদ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
ঝরা পাতা খুব ভাল লাগলো... as a doctor I just feel there should be many more writings like this. vote and well wishes...:)
ধন্যবাদ ঝরা পাতা "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।
আপেল মাহমুদ রাতের মতোই আমাদের সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। দুঃখ লাগে তবুও আমরা অসহায়। ধন্যবাদ লেখককে।
ধন্যবাদ আপেল মাহমুদ "হায় রাত!" গল্পে আপনার অসাধারণ সুন্দর মন্তব‌্যের জন্য।

২০ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৩৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪