আমি অংশুমানকে খুঁজছি। পনেরো বছর হলো ওর সাথে আমার দেখা নেই। এতবছর পর অংশুমানকে আমি কেন খুঁজছি, জানি না। তবে এই খোঁজাখুঁজি যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে করছি তা কিন্তু না। বিকালে অফিসফেরত একা একা আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে ঢুঁ মারছি। ব্যস্ত অথচ চাপা গলায় দোকানদারকে শুধোচ্ছি, ভাই, অংশুমান দাসের কবিতার বই আছে? পুরনো বইটা না, নতুন কোনো কবিতার বই? বইয়ের দোকানদার চোখজোড়া আসমানে তুলে পাল্টা প্রশ্ন করছে, খুব বিখ্যাত লেখক নাকি? কী পুরস্কার পেয়েছেন? এই বইমেলায় কবির কী বই এলো? নাতো এর কোনো বই’ই তো নেই! দশ/বারো দোকান ঘুরলে কোনো এক বই বিক্রেতা হয়তো পুরনো একটা বইয়ের ধূলো ঝেড়ে জানতে চাইছে, দেখুন তো এই কবি কিনা? হুম, সেটা অংশুমানের ‘অমল মেঘে ভাসি’ বইটি হয়তো, কিন্তু কোনো নতুন সংস্করণতো নয় যেখানে অংশুমানের খোঁজ পাবো। তবু এভাবেই আমি অংশুমানকে খুঁজে চলছি।
আবার অফিসের কাজের ফাঁকে জগতসংসারকে লুকিয়ে চুপচাপ গুগল করছি। অবশ্য আমার জগতসংসার গুটিকয়েক মানুষে সীমাবদ্ধ। বাসায় বাবা, গৃহপরিচারিকা টিয়ার মা আর অফিসে সহকর্মীরা। এরা কেউ কখনোই আমার কোনো কাজের কৈফিয়ত চায় না। একজনই শুধু চাইত, আমার হাজবেন্ড মারুফ। বছর সাতেক আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারুফ মারা যাবার পর কারো কাছে কিছু লুকানো বা জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতাও আমার নেই। তবু অংশুমানকে খোঁজার বিষয়টা আমি জনে জনে বলে বেড়াচ্ছি না। কী হতো বললে? বললে কি অংশুমানকে সহজেই খুঁজে পেতাম? যে নিজে লুকিয়ে থাকে তাকে খুঁজে পাওয়া তো সহজ না। তবু আমি অংশুমানকে খুঁজছি।
আমার মামাতো ভাই এহসানের অফিসে যেয়ে ওকে বলে এসেছি, অংশুমান নামের শূন্য দশকের হারিয়ে যাওয়া সেই কবিকে খুঁজে পেলে আমাকে জানাতে। এহসান একটা পত্রিকার সাব-এডিটর। অনেক লোকের সাথেই জানাশোনা আছে ওর। কিন্তু এহসান আমার কথা শুনে মুচকি হেসেছে, সেতু আপা, আগে দেশে কাকের সংখ্যা আর কবির সংখ্যা সমান ছিল, ফেসবুক এসে এখন আঠারো কোটির মধ্যে প্রায় পনেরো কোটি লোক কবি। গুগল আর ফেসবুক সার্চ ইঞ্জিনে নাম ছেড়ে দিলেও পনেরো বছর আগের উদীয়মান কবি মহোদয়কে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
আমার অনেক মুশকিলই এহসান এর আগে আসান করেছে। কেনো যেন মনে হচ্ছে এবারও করতে পারবে। তবে আজ সাতদিন হয়ে গেল এহসান আমাকে কিছু জানায়নি। হয়তো এখনো অংশুমানকে খুঁজে পায়নি। তবে আমি হাল ছাড়িনি, আমি ঠিক জানি, অংশুমানের সাথে আমার আবার দেখা হবে আর সেটাই আমাদের নিয়তি। আমি বরাবর নিয়তিতে বিশ্বাস করি। নিয়তিই আমাকে দিয়ে অংশুমানকে খোঁজ করাচ্ছে। নতুবা এতবছর পর অশুমানের লেখা চিঠিগুলো আমার হাতে এসে পড়বে কেন?
একসময় অংশুমান আমাকে চিঠি লিখতো। চিঠির সাথে সাথে টুকরো কাগজে কবিতাও থাকতো। একবার অংশুমান লেখক দলের সাথে দার্জিলিং গিয়েছিল। সাথে নিয়ে গিয়েছিল আমার দেয়া প্রথম উপহার, একটি কলম। আর অংশুমান ফিরে এসেছিল তরতাজা দশটি কবিতা নিয়ে। অংশুমান বলেছিল, এই দশটি কবিতার পাঠক একজনই। কোনোদিন আর কোনো পাঠক এই কবিতার খোঁজ পাবে না। সেই দশটি কবিতাও সেদিন আমি আমার বইয়ের আলমারির তাকে রাখা পুরনো ডায়েরির ভাঁজে পেয়েছি। ভেবেছিলাম, ডায়েরির সাথে কবিতাগুলোও হারিয়ে গেছে। আর অংশুমানের চিঠিগুলোও। না কিচ্ছু হারায়নি। একটা পলিপ্যাকের মধ্যে সব স্মৃতিগুলো চুপচাপ ঘুমিয়ে ছিল। আমি ছুঁয়ে দিতেই সেসব স্মৃতির ঘুম ভাঙলো আর আমিও অংশুমানকে খুঁজতে শুরু করলাম।
অংশুমানের কবিতা, চিঠির মতো ওর স্মৃতিও আজো খুব প্রিয় যেন। কবিতার পৃষ্ঠা আর চিঠির গন্ধে কেমন শরীর শিউরে ওঠা সোঁদা গন্ধ! গতকাল থেকে কতবার যে এই কাগজগুলো ছুঁয়ে দেখেছি! আমার কাছে অংশুমানকে স্পর্শের কোনো স্মৃতি নেই, এই কাগজগুলো ছাড়া। ছুঁয়ে দেখবার মতো কোনো সম্পর্কে কখনো জড়াইনি আমি আর অংশুমান। আমি জানি না, প্রেমিক অংশুমানের হাতের উত্তাপ কেমন। আমি জানি না, কবি অংশুমানের বিষাদের স্পর্শ কেমন। তবু এত বছর পর কেনো যেন মনে হচ্ছিল, এই কাগজগুলোতেই যেন অংশুমানের স্পর্শ লেগে আছে।
শেষবার যেদিন অংশুমানের সাথে আমার দেখা হলো, আমাকে স্পর্শ করার জন্য অংশুমান হাত বাড়িয়ে ছিল। সেদিন ও খুব বিষণ্ন ছিল। আমাকে আড়াল করে চোখের পানি মুছে ছিল। হয়তো ও টের পেয়েছিল, সেটাই আমাদের শেষ দেখা। আমরা সেদিন শহীদ মিনারের সামনের বেদীতে বসেছিলাম। আমাদের মতো বসে থাকা আরো কয়েক জোড়া ছেলেমেয়ে একটি মেয়ের সামনে বসে থাকা একটি ছেলের চোখ মুছবার অপ্রচলিত দৃশ্যটা দেখে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছিল। আমি অংশুমানকে কাঁদতে দেখেও ওকে পেছনে ফেলে সেদিন আমি চলে এসেছিলাম। সেদিনটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা হবার দিন। আমার মনে আছে। সেদিন আমাকে অংশুমান মিলান কুন্ডেরার উপন্যাস ‘ঠাট্টা’ বইটা আর ওর নিজের হাতে আঁকা আমার পোট্রেট উপহার দিয়েছিল। যে ছবিতে চোখ বন্ধ করে এলোচুলে আমি আঁজলা ভরা পানি তুলছি।
আমিও অংশুমানের জন্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা ডায়েরি আর দুটো কলম। অংশুমান আমার উপহার নেয়নি। আমাকে আমার দেয়া উপহার ফিরিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, যে উপহারে কোনো ভালবাসা নেই সেটা নিলে মনে হবে কেবল ঋণ শোধবার দায় তা, তাই সে নিতে পারবে না। আমি তর্ক করিনি। আমার সেই নিশ্চুপ থাকারও ব্যাখ্যা ছিল অংশুমানের কাছে, সহজে মেনে নেওয়াটা হচ্ছে এড়িয়ে যাবার ভিন্ন কৌশল। অংশুমান কীভাবে যেন আমার ভেতরটা পড়ে ফেলতো। আমি যেন ধরা পড়বার ভয়েই সেদিন সাত তাড়াতাড়ি ছুটে পালিয়ে ছিলাম।
শেষ দেখা হবার দিনের মতো অংশুমানের সাথে আমার দেখা হবার প্রথম দিনটির কথাও আমি ভুলিনি। ষোলো বছর আগের কথা। আমি তখন কণ্ঠশীলনের ক্লাস শেষে ফিরছি। পেছন থেকে কেউ একজন ডাক দিলো, এই যে, শুনছেন? আমার মতো ছাপোষা একজন কবিকে কি একটা দায় থেকে উদ্ধার করবেন? আমি অংশুমানের হাত থেকে আমার নির্বাচিত কবিতাবলীর বইখানা নিতে নিতে বিপুল বিস্ময়ে বলেছিলাম, আপনি কবি? অংশুমান হেসেছিল। কারো হাসির ব্যাখ্যা খোঁজার মতো বয়সের স্থিরতা তখনো আমার আসেনি। আমি শুধু কলকল করে বলছিলাম, আপনি আবৃত্তিকার সুমন স্যারের বন্ধু? স্যারের সাথে দেখলাম যে আজ! আমাকে আপনার কবিতা দিবেন? পাঠ করবো?
তারপর থেকে প্রতি মঙ্গল আর বুধবার অংশুমানের সাথে আমার দেখা হতো। টি.এস.সিতে কণ্ঠশীলনের ক্লাস শেষে আমি যখন ফিরতাম, অংশুমান তখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রায় দিনই আমার জন্য হাতে করে চিঠি বা কবিতা নিয়ে আসতো সে। আমি অংশুমানের কবিতা বুঝতাম ছাই। অত শত কঠিন কঠিন কবিতা আমার হজম হতো না। বলতাম, আপনি এত কঠিন করে লেখেন কেন? যুদ্ধের মধ্যে নন্দনতত্ত্ব খোঁজেন মানে! কই আর সব কবিরাতো আপনার মতো কঠিন করে লেখে না!
অংশুমান আমার কথা শুনে খুব হাসতো, সেতু আহমেদ আর অংশুমান দাস এই নাম দুটোর মধ্যেই যুদ্ধের দামামা আবার এই নাম দুটোর মধ্যেই নন্দনতত্ত্ব। দূর্বোধ্য জবাব পেয়ে আমি ভেঙচি কাটতাম, ছাই! অংশুমান বলতো, আমার কবিতা বুঝতে আপনার আরো বড় হওয়া লাগবে। আগে বড় হোন। তারপর আমার কবিতা পড়বেন। অংশুমানের এই কথা শুনে আমি গাল ফোলাতাম। যেদিন অংশুমানকে বেশি বকতে পারতাম না সেদিন বাড়ি ফিরে ওকে চিঠি লিখতাম। ওর মতো অত বড় বড় কাব্যিক চিঠি আমি লিখতে পারতাম না।
অংশুমান বলতো আমার প্রতিটা চিঠি পড়লে মনে হয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পটা পড়ছে। সম্বোধনহীন সম্পর্কের বয়ানে লেখা। অংশুমান তিনটা চিঠি লিখলে আমি জবাব দিতাম একটির। তখন অত সময় কোথায় আমার! ভার্সিটিতে ক্লাস, ল্যাবে দৌড়াদৌড়ি, টি.এস.সিতে কণ্ঠশীলনের ক্লাস, বন্ধুদের সাথে আড্ডা! তবু অংশুমানের পাল্লায় পড়ে আমাকে ওর চিঠির জবাব দিতেই হতো। নতুবা কাঙালের মতো বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন দিয়ে বলতো, একটু দয়া করুন মেয়ে, দু’লাইনতো লিখুন। আমি লিখতাম, লিখতে বসলে একশো/দুশো লাইন। কত-শত কথা! কত চিঠি লিখেছি যে অংশুমানকে, একটি বছর!
তবে অংশুমান যেমন সুন্দর কবিতা লিখতো, তেমন সুন্দর চিঠিও লিখতো। অংশুমানের শেষ চিঠির উত্তর আমার দেয়া হয়নি। কিন্তু সেই গোটা চিঠিটা আমি পড়েছিলাম একটানা অন্তত দশবার। শেষ চিঠিতে অংশুমান খুব কাটা ছেঁড়া করেছিল। এমনিতে অংশুমানের হাতের লেখা খুব সুন্দর, ঝকঝকে গোটা গোটা বর্ণমালায় সাজানো, কথার ফাঁকে ফাঁকে দুলাইন কবিতা। কিন্তু শেষ চিঠিতে বার বার তুমি, তোমাকে শব্দগুলো লিখে বার বার কেটে কেটে আপনি, আপনাকে করেছিল বলে চিঠিটা অপরিচ্ছন্ন ছিল খুব। আমার প্রথম উপহার দেয়া সেই কলমটিতেই হয়তো লিখেছিল অংশুমান। যে দিন শেষ দেখা হলো সে দিন বাড়ি ফিরে গিয়েই ও শেষ চিঠি লিখেছিল। সেদিন নাকি ফিরে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে ছিল অংশুমান। তারপর এক ফাঁকে উঠে আমাকে চিঠি লিখেছিল। অংশুমানের সেই শেষ চিঠিটা পড়ে সেদিনই আমি ড্রয়ারের অতলে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
সেতু,
আপনি খুব সুখী মানুষ। আমি সুখী মানুষ দেখলে চিনতে পারি। কেউ কেউ দুঃখকে অতিক্রম করে সুখী হতে পারে-আপনি সেই প্রকৃতির। কেউ কেউ একটু আগের অতীতকে ফেলেও বর্তমানকে নিয়ে মেতে উঠতে পারে-আপনি সেই প্রকৃতির। কেউ কেউ ক্ষণে ক্ষণে ঝড়ের মতো সুখের ঝাপটায় দিশাহীন হয়ে যায়-আপনি সেই প্রকৃতির।
আর আমি উল্টো। জানেন, দুঃখই আমার চুড়ান্ত নিয়তি। আমার ব্যক্তিগত জীবন একান্ত নির্জন। তবে পরিজনহীন জীবনের ছন্দ আমার কবিতায় আসে না। নিজের নির্জন দুঃখাবলি আমি সারাদিন হেসে আনন্দ করে ঢেকে রাখি। অথচ সকলের মাঝে সারাদিন হৈহৈ করে কাটানো আমার বেঁচে থাকা। কিন্তু আমি আপনার মতো পারি না । রাত হলে খুব একা হয়ে গেলে কিংবা দিনেও সকল লোকের মাঝে বসেও আমি যখন একা হয়ে যাই তখন আমার সব বর্তমান হারিয়ে যায়। তবু রাতটুকুতে ঘুমাতে পারতাম নিশ্চিন্তে। কিন্তু কই, আমার সে সুখটুকু আপনার মতো নিষ্ঠুর বালিকার সইবে কেন? আজ থেকে রাতের সেই সুখটুকুও কেড়ে নিলেন। এই তো মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ঘুমের জন্য কত বাহানা খুঁজলাম, পেলাম কই। আমার পাতানো মা সন্ধ্যারাণী আমার কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ঘুমো বাছা, ঘুমো। কই তার আশীর্বাদেও এক ফোঁটা ঘুম চোখে এলো নাতো! ঘুমের সাথে জলের অদলবদল হলো, সে এক বিপত্তি!
জানেন সেতু, ফ্রয়েডীয় তত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনাকে আমি ভালো বেসেছি। রাতের পর রাত নিজেকে বুঝিয়েছি, আপনাকে চাওয়া আমার উচিত না। তবু যতোই বুঝিয়েছি ততো যেন জড়িয়ে গেছি নিজের তৈরি করা ফাঁদে। তাই আপনার কাছে নিজেকে নিবেদন করার মতো বোকামি করে ফেললাম।
সেই আমার কাল হলো। তবু আমার একাকী জীবনের কলংক তো আর ঘুচলো না। আমি জানি আমাকে পিছনে ফেলে যেতে আপনার একটুও কষ্ট হয়নি। বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠেনি। কি এক দুর্বিনীত অহংকারে দৃপ্ত পায়ে যে আপনি সামনে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আমি বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখেছি আর আপনাকে খুব অভিশাপ দিয়েছি। এই পর্যন্ত পড়েই ভয় পাবেন না। আপনাকে আমি “ সুখী হবার ” অভিশাপ দিয়েছি। সেই সুখী মানুষটা জীবনের শেষ প্রান্তে যেয়েও আমার কথা মনে করে আন্তরিকতায় ভেঙে পড়বেন। আমার ভালোবাসার যে প্রাচুর্য আপনার করতলে ধারনযোগ্য হয়নি তার বায়বীয়তায় আপনি দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন।
ইতি
অংশুমান
অংশুমানের অভিশাপ নিয়ে আজো আমি খুব সুখী আছি। পনেরো বছরের সুখী জীবন কেটে গেল। যেই পনেরোটা বছর বার বার নিজেকে কেবল বুঝিয়েছি, অংশুমানকে আমি কখনো ভালোবাসিনি।