-কিন্তু তারপরও বলতে হয় খন্দকার সাহেব খুন হয়েছেন...
খুন শব্দটা শুনে আঁতকে ওঠে রোকেয়া।
-কি ভাবে,ওর তো শত্র“ ছিলো না, একেবারে গা-বাঁচানো মানুষ !
-মানুষের ওপর দেখে কি ভেতরটাকে চিনতে পারবে,তোমরা মেয়ে মানুষেরা চাকচিক্যতেই শুধু পোটে যাও আচমকা।
-কি যে বলো, এটা কি বিশ্বাস করা সম্ভব !
-পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু কি আছে ?
-কিন্তু তারপরও মনটা মানতে চায় না যে,কোথায় একটা খটকা লাগে।
-ওটা মনের ভুল,ঝেড়ে ফেলো পরিস্কার লাগবে নিজেকে আর অন্য মানুষকে নোতুন ভাবে চিনতে শেখো।
স্বামীর কথার ওপর আর কথা বলে না রোকেয়া বেগম। কপালটা কেমন চিনচিন করে ওঠে। কি বা বলতে পারে এখন, একটা দুঃসংবাদ এভাবে আসবে ভাবেনি, ওমন মানুষকে কেউ মেরে ফেলতে পারে তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না কোনোভাবে।
খুনটা হলো অবশেষে কিন্তু প্রমাণ রইলো না তেমন কিছুই। এভাবে কে খুন করতে পারে খন্দকার বসির হাওলাদার সাহেবকে ! নিজের মধ্যে রোকেয়া যুদ্ধ করতে থাকে, কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না এমন খুন, ভদ্রলোক বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন,ভালো বেতন পান, নিপাট ধোঁপদুরস্ত মানুষ, কারো সাতে-পাতে থাকে না কোনো সময়। কিন্তু তারপরও বিনা কারণে চলে যেতে হলো, কোনো দিক-নিদ্দের্শনা পায় না কেউই, এমন ঝুট-ঝামেলাহীন মানুষকে কে বা কারা খুন করতে পারে !
রোকেয়া বেগমের মন কোনো যুক্তি মানে না। বারংবার স্বামীকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে জাগে কিন্তু অভির“চি হয় না। মুহূর্তে শামুকের মতো নিজের খোলসে সিঁধিয়ে যায়। কি বলবে কাকে, যেভাবে উত্তর দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে উনি সবই জেনে গেছেন যে হাওলাদার সাহেবই দোষি একজন।
পাশের ফ্ল্যাটে দিব্বি বাস করছিলেন সস্ত্রীক, বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন,ছাপসা মানুষ বটে একজন, সন্তান-সন্তাতি হয়নি এখনো তাদের। বউটাও ভারি মিষ্টি আর লাজুক প্রকৃতির, পাশাপাশি ফ্ল্যাটে অবস্থান বলে দুজনের মধ্যে অদৃশ্য একটা মিলও গড়ে ওঠে আপনাআপনি। সময়ে অসময়ে হুটহাট করে চলে আসতো, কখনো আবার রোকেয়া বেগমও ছুটে যেতো ওর কাছে, ব্যাপারটা মোটেও একদিনে হয়নি, ক্রমে-ক্রমে একটু একটু সম্পর্কের বাঁধন শক্ত হয়েছে।
একবার কিসের এক ছুটিতে ওরা কুয়াকাটার দিকে বেড়াতেও গিয়েছিলো গাড়ি নিয়ে, অদ্ভূত মানুষ বটে ভদ্রলোক, রোকেয়া বেগমের বড় ভালো লাগে, খন্দকার সাহেবের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্কও গড়ে ওঠে কাউসারের, মমতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় রোকেয়া সেদিন। মমতার চোখে কিসের নেশা যেন ছড়িয়ে যায়, এমন কি কাউসারের মধ্যেও একরকম তোলপাড় সৃষ্টি হয়, আন্দাজে কিছুটা লক্ষ্য করেছিলো রোকেয়া। কুয়াকাটার রাতগুলো আজো কেমন নাড়া দেয়,জানালার শার্শি ধরে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
অথচ রোকেয়া বেগমের আজ বড় বেশি সন্দেহ স্বামী নামের ধুরন্ধর ব্যক্তির দিকেই, খন্দকার বসির হাওলাদারের স্ত্রী মমতা মেয়েটি নেহাৎই সুন্দরী নয়, অতি আর্কষণীয় ফিগার আর একহারা শরীরের অধিকারি তা বলা অপেক্ষা রাখে না। চোখে-মুখে কেমন একটা পেলবতা ছড়ানো থাকতো, হাসলে গালে দার“ণ একটা টোল পড়ে, দীঘির কাকচক্ষু শান্তপানিতে অকস্মাৎ মাটির ঢেলা পড়লে যেমন জলতরঙ্গ সৃষ্টি হয় তেমনি কার“কাজ করা ঠোঁটের হাসিটুকু বড় বেশি উদাসিন করে মানুষকে। রোকেয়া বেগমের কাছে ওর স্বামী লোকটাকে মোটেও মানানসই লাগে না। বেশি বয়সি স্বামীকে বড্ড চোখে লাগে, মানায় না তেমন। কেমন একটা খাপছাড়া মনে হয়, তারপরও মুখে তেমন কিছুই বলেনি কোনোদিন।
একই ফ্ল্যাটে থাকার সুবাসে রোকেয়া বেগমের সঙ্গে মাখামাখা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই আসা-যাওয়ার সূত্র ধরেই দু’নারী একই সুঁতোয় গেঁথে থাকে। সময়ের বিন্যাসে হাওলাদার স্ত্রী মমতার সঙ্গে গোলাম কাউসারেরও একটা চমৎকার সর্ম্পক গড়ে ওঠে তারপর।
খন্দকার হাওলাদারের বয়সের চেয়েও গোলাম কাউসারের বয়স খুব কম বেশি হবে না, কিন্তু ধুরন্ধর কাউসার প্রচন্ড মেয়ে পটানো মানুষ। শরীরখানা বেশ পেটানো আর মজবুত বলে বয়সকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে সহজে। তামাম রকম ছলছলনার জুড়ি নেই তার।
কাউসার-রোকেয়ার সংসারে দুটো কন্যা সন্তাতি রয়েছে, যার দেখভাল রোকেয়াকেই করতে হয়। গোলাম কাউসার ব্যবসার দিকেই বেশি সময় দেয়,টাকার চিন্তা ছাড়া তেমন কোনো ব্যাপারে মাথা গলান না, আপাদমস্তক শুধু টাকা আর টাকা। রোকেয়া বেগমের একসময় মনে হতো, মানুষটা বুঝি এই টাকার পেছনে ছুটতে-ছুটতেই মরে যাবে...
হঠাৎ হাওলাদার সাহেবের খুন হওয়ার পর কেমন চুপসে যায় কাউসার। আর সেই কারণে ব্যাপারটা মোটেও ভালো ঠেঁকে না রোকেয়ার কাছে, রহস্যটা স্পষ্ট হয় না কোনোভাবে,এর মধ্যে কি এমন যোগসূত্র থাকতে পারে বুঝে ওঠে না !
ঠাঁরে-ঠাঁরে রোকেয়া বেগম বেশ বুঝেছিলো, কাউসারের সঙ্গে মমতার একটা বিনা সুঁতোর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাই বলে এতোখানি ভাবতে পারেনি তারপরও।
খুনটা হলো রহস্যময়, এই রহস্যের ভেদ খোলসা করে বের করা বড়ই দুঃসাধ্য,মমতার গতি-বিধি সন্দেহ করা কঠিন, তবে কাউসারের অফিসের কর্মকর্তা মারফতে রোকেয়া শুনেছে, মমতা নামের এক চিকন-চাকন তম্বী তর“ণী প্রায় কাউসারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে এবং কখনো-সখনো তারা দুজনে নির“দ্দেশ হয়। কোথায় যায় কেউ না বলতে পারলেও আন্দাজে রোকেয়া বেগম অনুমান করে লং-ড্রাইভে বের হয়, হয়তো কোনো ক্যাঁফে-ব্যারে-ফ্যাষ্ট ফুডে বসে অথবা রেষ্টহাউজে-এমন অনেক কিছুই একসময় ভেবেছে, কিন্তু তাই বলে খুনের মতো জায়গায় চলে যাবে তা ধারণাই করতে পারেনি।
কাউসারের অফিস কর্মকর্তা জহির আহমেদের সঙ্গে রোকেয়ার একসময় আলগা খ্যাতির ছিলো, সে বয়সে হয়তো অনেক কিছুই, তারপরও কাউসারের ঘরে আসার পরও অর্থাৎ এ’পরিবারে বিয়ে হয়ে আসার পর বেশ কয়েক বছর চুটিয়ে সম্পর্কটা চালিয়ে গেছিলো আড়ালে-আবডালে, পুরানো প্রেম কি কেউ ভুলে যায় এতো সহজে, একটা সময় তো কাউসার টেরও পেয়ে যায়। তখন অনেক কিছুই হতে পারতো কিন্তু হয়নি,কাউসারই লাগামটা ঠিক করে ধরার চেষ্টা চালায়।
এখন সম্পর্কটা মিইয়ে গেলেও পুরানো প্রেমের সেই ধোঁয়া-ছায়া ব্যাপার তো আর মুছে যাওয়ার নয়। হয়তো থাকলে থাকতেও পারে কোথাও ঘাঁপটি মেরে কারণ প্রেম বলে কথা!
শারীরিক সম্পর্ক আর না থাকলেও মানসিক মিলন আছে একেবারে খাঁপে-খাঁপে, মাস মাসাšে— কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হলে ‘হ্যাঁলো’ শব্দ উচ্চারণ হয় মাত্র। কাউসার ওসবে তেমন একটা আমল দেয় না বটে তবে কান খুব সর্তক, নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে বলতে পারে ঠিকঠিক অনেক কিছুই, অবশ্য রোকেয়ার ওপর যথেষ্ঠ আস্থা রয়েছে এখন।
মাঝে একবার শুধু বলেছিলো, জহির আমার কর্মচারি, তার সঙ্গে পূর্বে তোমার কোনো সম্পর্ক থেকেও থাকে, এখন ভুলে যাওয়া জর“রি...
-তুমি কি বলতে চাও ?
-বলার মতো কিছু নেই, জহির আমার...
-আমি জানি তুমি বলবে জহির বেতন ভুক্ত একজন সামান্য...
-হ্যাঁ সে কারণে আমার র“চিতে বাঁধে।
-কিন্তু তোমার এটাও একবার ভাবার দরকার তুমি যে ব্যবসার ওপর দাঁড়িয়ে বড় গলায় কথা বলছো সেখানে আমার শেয়ার আছে।
-আমি ভুলেনি, তুমি দায়িত্ব নিলে বুঝিয়ে দেবো অবশ্য।
একসময় রোকেয়া আর কোনো কথা বলে না। নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
হাওলাদারের খুন হওয়ার ঘটনাটা তেমনই রহস্যঘেরা থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। রোকেয়া বোঝে, কাউসার বিমর্ষ হয়ে ইজি চেয়ারে বসে থাকলেও মনে ক্ষাণিক উৎফুল দেখায়।
হঠাৎ এক মাঝরাত্রে মোবাইল বেজে ওঠে। কাউসার ঘর থেকে বের হয়ে ঝুল-বারান্দায় যায়। ওদের কথোপকথন স্পষ্ট শোনে রোকেয়া বেগম।
সে-রাত্রে রোকেয়া প্রতিবাদি কন্ঠে বলে,তুমি কি অস্বীকার করতে পারবে যে হাওলাদার সাহেবকে তুমি খুন করোনি।
-খুন আমি করতে যাবো কেনো, তুমি কি বলতে চাও,স্পষ্ট করে বলো তো ?
-আমি কি বলতে চায় তা কি তুমি বোঝ না, নাকি বুঝতে চাইছো না।
-না মানে খন্দকার সাহেবের খুনের সাথে তুমি আমাকে জড়াতে চাইছো কেনো ?
-তোমার সাথে খন্দকারের স্ত্রীর কি সম্পর্ক, তাই আগে বলো...
-দেখো এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না কি, তুমি যদি কেঁচো খুড়তে চাও তো আমার কোনো যায় আসে না, কিন্তু সাপ বেরিয়ে আসলে তুমি সামলাতে পারবে কি ?
-তুমি সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করছো, মনে রাখবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না বুঝলে ?
-বুঝি তো সবই কিন্তু তুমি খন্দকার সাহেবের খুনের সাথে আমাকে জড়াচ্ছো কেনো বলো তো?
-মাঝ রাত্রে ফিসিরফিসির করচ্ছো তারপরও বলছো...
-তুমি যা ভাবছো তা ভুল, আর তুমি নিজেকে দিয়ে সবাইকে এক করে ফেলো না।
-নিজেকে দিয়ে মানে-
-বোঝ না বেবি, তুমি তো ভারি অভিনেত্রী, আমার সাথে ফসকা গেঁরো বাঁধার আগে তোমার কার-কার সাথে সম্পর্ক ছিলো তা কি আমি জানি না ভেবেছো ?
-দেখো মুখ সামলে কথা বলবে, সীমা লক্সঘন করবে না বলে দিচ্ছি।
-বাব্বাহ আসল জায়গায় বুঝি সূঁইয়ে দাগা পরেছে তাহলে !
-যা নয় তা বলবে না আবার বলছি।
-হ্যাঁ, আমি বললেই বুঝি গায়ে ফোঁসকা পড়ে এই তো ! তুমি অনেক কথা বলেছো...
তারপর অনেক কথা হয়,অনেক বাকবিতম্ব চলতে থাকে,অনেক কথার মধ্যে অনেক রাত্রি পার হয়ে যায়। একসময় রোকেয়া বেগম হাঁপিয়ে ওঠে,কিছু বলতে তার আর ইচ্ছে হয় না কোনো ভাবে,বড়ই নিষ্ঠুর একজন মানুষ তার স্বামী, এ’কথা বুঝতে বাকি নেই,মনের মধ্যে রাগকে কুলো চাপা দেয়। মানুষকে চেনা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় বিষয়, হয়তো কঠিনও, রোকেয়া বেগমের ভাবনাগুলো কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যেতে থাকে, চেনা মানুষও রঙ পালটে আরেক মানুষে পরিণত হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত,তখন সে কি আর মানুষ থাকে ! হয়তো খোলসের এক মানুষ মাত্র, বেশি কিছু নয়,কাউকে চেনা যায় না, কে যে আপন আর কে বা পর সে অংক বড় কঠিন ছকে নির্মিত হচ্ছে প্রতিদিন, বাতাসে বড় রকম একটা নিশ্বাস ছেড়ে হালকা স্বরে বলে ওঠে, ছি-ছি এমনও পারলে পরস্ত্রীকাতর-চরিত্রহীন...
কাউসার স্ত্রীর কথা যেন শুনতে পায়নি এমন ভাব নিয়ে বসে থাকে, কোনো জবাব দেয় না। আদিগন্ত অন্ধকার আকাশের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে,ঠোঁটের কোণে কি যৎসামান্য হাসি লুকিয়ে আছে, কেউ না বুঝলেও রাত্রের অন্ধকার ঠিকঠিক টের পেয়ে যায়।।
কন্ঠস্বর গোপন রেখে বাতাসে আনন্দ ছড়িয়ে কাউসার বলে, এতোকালও বুঝতে পারোনি বেবি পরস্ত্রীর প্রতি তোমার স্বামীর দূর্বলতার কথা...।