বদরু বৃত্তান্ত

ভালোবাসা / ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারী ২০১৫)

আশরাফ উদ্ দীন আহমদ
  • 0
  • ১৭
লাউডগার মতো তরতরিয়ে বেড়ে যাচ্ছে রৌদ্্র, কার্তিকের সকালের সোনা ঝরা রৌদ্রের হাসিটুকু বড় দুর্লভ, ঝিকিমিকি আলোয় ভরিয়ে দেয় বিশ্বলোকালয়। সেই সঙ্গে ক্রমশঃ সোহাগি হয়ে ওঠে খালপাড়ের ছোট-ছোট ধান-শস্য ভরপুর গ্রামের বাড়িগুলো। ধানজ্যোৎস্নায় আলোকিত হয় পরিপূর্ণ অবয়ব, জমিন কখন সোনা ঝরা স্বপ্ন-স্বপ্নকন্যা। মিঠে রৌদ্রের ছোঁয়ায় আকৃষ্ট হয় হরেক রকমের পাখপাখিলি, খালপাড়ের সদ্য নিখোঁজ কহির মুন্সীর ছোট ছেলে বদরু সাইকেলে চেপে এবড়ো-থেবড়ো মাটি ফেলা পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বনাথ হাজরার কাঠ ফাড়ায়ের মিলে হাজির হয় তখন। কাঠফাড়ায়ের কাজটা কেনো যে ওর সব থেকে ভালো লাগে তা সে নিজেই জানে। ওর বাপ কহির মুন্সী মুক্তারপুরের নটবহর মাঝির ছেলে বলরামের হোন্ডা সাড়ায়ের দোকানে রেখেছিলো কিছুদিন, বলরাম হাসি মুখে বদরুর সব দায়িত্ব ¯ে^চ্ছায় কাঁধে তুলে নেয়। ওমন একটা ছেলে কাছেপিঠে থাকলে নেহাৎ-ই সুবিধা বৈ-তো অসুবিধা নয়। কাজ-ফাজ শিখলেও সে শিখে পুরোদস্তুর হোন্ডা মেকার হলে মন্দ কি! কিন্তু জোচ্চর বদরু বাপের মুখ রাখেনি, বড় বেশি ফক্কর বনে যায় রাতারাতি, বাকশৈলী কওমী বালিকা মাদ্রাসার পাঁজরের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায় কয়েকদিন, শেষাশেষি কোনো এক উঠতি ছেমড়ির পিরিতে মজে, ঝোলে তালগাছের বাবুই পাখির বাসার মতো, তারপর আর সে উপাখ্যান বেশিদূর গড়াতে পারেনি, মাঝখানে হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়, মেয়ের খালাতো ভাই চৌকিদার বরজাহান শেখ কি সব কানাঘুঁষা শুনে একরাত্রে বদরুর ওপর কাকতালীয়ভাবে চড়াও হয়। অর্থাৎ মাথার খুলি দু’ ফাঁক করতে মরিয়া হলেও মায়ের দুধের বদলৌতে রক্ষা পেয়ে যায় সত্যসত্যি, থানা হাসপাতালে টানা বাইশ দিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসে দেখে ফুলমতির বিয়ে হয়ে গেছে চৌকিদার খালাতো ভায়ের ছোট শালার সঙ্গে, এ’ কথা প্রথম শুনে নিজেকে কোনোক্রমে সংবরণ করতে পারেনি, একটু-একটু নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে স্থির থেকে একেবারে নিশ্চুপ পাথর হয়ে যায়। মাঝে উন্মাদের মতো কয়েকদিন কোথায়-কোথায় উড়ে ঘুরে বেড়ায়, তারপর সীমান্তের ওপারে কুষ্টিয়ায় লালন মেলায় কার সঙ্গে চলে যায়। কেউ আর সে সংবাদ রাখেনি, অনেকদিন কেটে যায়, অনেকদিন পর উলুঝুলু অবস্থায় আবার ফিরে আসে শান্তি—পুরে, শান্তি—পুরের শিবেন মলি­কই প্রথম সংবাদটা জানায়, বদরুর মেজো মামা সীমান্তের সাইডে দু’ নম্বর ব্যবসা করে, ভাগ্নের পাগলামী হজম করে কিভাবে চেপে গেছে সে কথা শিবেন ভেবে পায় না।
একদিন পড়ন্ত বেলায় কাজলাদীঘির পাশ দিয়ে বদরু হেঁটে যায় আকন্দগাছের ঝোঁপের ভেতর সরু সড়ক ধরে, ওপাশ দিয়ে প্রতিবেশি এক বউদি উলুজুলু আধাপাগলা বদরুকে দেখে খানিক ফিক করে হেসে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর দাঁত চিবিয়ে-চিবিয়ে রসময় মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। বদরু গায়ে তেমন একটা মাখে না ওসব কথা। সেদিনও গাঁয়ের বউদি-বউঝি’ রা বদরুকে দেখে টিপকানি কেটে বলেছিলো, নয়া জামানার মজনু নাকি মমতাজের শা-জাহান...
গ্রামীণ রাস্তা ধরে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দে গরুর গাড়ি চলে যায় শিবতলার হাটের দিকে ব্যাপারিদের সওদাপাতি নিয়ে, আলী মিয়ার ছেলে নকিব এখন রতনপুর বাজারের সভাপতি, ওর আড়তের বাঁধা কয়েন শ্যামনগরের জ্যোাতিন সাউয়ের ছেলে নিমাই। কিন্তু বছর পাঁচেকের মাথায় নকিবের সঙ্গে কি এক বিষয় নিয়ে বাকবিতম্ব করে এবং তারপরেই কাজটা ছেড়ে দেয় বেমালুম। নকিবের সঙ্গে আবার বদরুর গলায়-গলায় ভাব আছে, কয়েক বছর নাকি দুজনে গাঁয়ের একই প্রাইমারী স্কুলের পড়েছে, বদরু তো ওই অবধি বিদ্যা কিন্তু নকিব হাইস্কুলেও গিয়েছে বছর কয়েক বাপের সঙ্গে পুরানো হিরো সাইকেলের পেছনের ক্যারিয়ালে চেপে। ওর বাপ আলী মিয়া ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতো, ছেলে হবে দেশ-গ্রামের সেরা সন্তান, কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন এবং জটিল বিষয়। হঠাৎ একদিন দুঃসংবাদ এলো, আলী মিয়া টাউন থেকে গাঁয়ে ফেরার পথে হার্টফেল করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, তারপর সব ফর্সা, স্বপ্ন-আশা রঙের প্রলেপের মতো হালকা ঝড়েই সব এলোমেলো হয়ে উড়ে যায় কোথায়, নকিব বাপের ব্যবসাপাতি দেখভাল করলেও ওমন গোবেচারা ব্যবসা মোটেও ভালো ঠেকে না, আর তাই নতুন ব্যবসাপাতি হাতাবার ফন্দি-ফিকির করে এখন, রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ যাকে বলে তাই হতে চায়, এক্কেবারে মস্ত মানুষ হবে, ওই সেই কালো পথে বিনে সুতোর টান আর কি! নিজেকে এখন একজন সাহেব-সুহেব ভাব দেখায়, আয়-রোজগার দেখেই তো, বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় রতনপুর বাজারের সভাপতি নির্বাচিত হয়, আল্লা যাকে দেয় বুক থেকে গলার নোলি অবধি ডুবিয়ে-চুবিয়ে দেয় বটে। বদরুর একসময় অহংকার হতো বন্ধুর জন্য, কিন্তু এখন বিচ্ছিরি লাগে সব কিছু, বড় স্বার্থপর হয়ে গেছে এখন পুরানো বন্ধু-বান্ধবদেরও আর তোয়াক্কা করে না। নিমায়ের সঙ্গে হাটে বাজারে দেখা-সাক্ষাৎ হলে কতো কথা ফড়ফড়িয়ে বলে, নকিব এখন আর সেই নকিব নেই, বিদেশী মদের কারবার ফেঁদে বসেছে, সীমান্তের ধারে-কাছে গাঁজা চাষের জন্য বিশাল জমি নামকাওয়াস্তে মূলে কিনেছে গত বছর ঠিকঠিক খরার সময়। দিনেদিন কেমন সব একটু-একটু করে উল্টে-পাল্টে যাচ্ছে, কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না,এমনই কি হয়, সময় যেন এখন পারদের মতো ছুটে-ছুটে একস্থান থেকে আরেক স্থানে লাফিয়ে পড়ছে, গাঁ-গ্রামের মানুষগুলো বড় নির্ভেজাল, অতো সব ছয়-নয় যেমন বোঝে না আবার সাতকে সতেরো করতেও পারে না, জীবনটাকে উড়নগাইনের ছন্দের তালে বেঁধে নিয়েছে, সামনে যাওয়ার চেয়েও পেছনে বারবার তাকানোর স্বাদ সংবরণ করতে পারে না।
সেদিন মাঝামাঝি বেলায় পালপাড়া দিয়ে আসবার সময় বদরুকে দেখেই শ্যাকড়া বাড়ির বউ নমিতা টোলপড়া গালে হাসি ছড়িয়ে বলে, চন্ডিদাসের এখন বোষ্ঠম হওয়ার খায়েস হয়েছে গো!
বদরু ঠোঁটে-মুখে হাসে শুধু, গৌরের বউদি নমিতা, গৌরের বড়দা বিভূতি বছর চারেক হলো দেশান্তর, লোকে বলে নিরুদ্দেশ, কেউ বলে কাশীবাস করছে, কেউ বা বলে সন্নাসী হয়ে বিদেশ-বিভূঁয়ে ঘুরছে, অনেকে আগ বাড়িয়ে বলে ওঠে, হিন্দুদের আর এদেশে রাখবে না, কেটেকুটে নিপাত করে ফেলেছে হয়তো বা বিভূতিকে, যার মুখে যা আসে দেদারসে বলে মনের খেদ মিটাই। কিন্তু নমিতা বউদির স্বামী বিভূতি সত্যসত্যিই যে কোথায় গেলো সে হদিস কেউ পেলো না, আর গৌরের সে’ বার রাসের মেলার পরপর কঠিন ব্যামো হলো আর তিন দিনের দিন সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে চলে গেলো স্বর্গে, নমিতা বউদির দিকে একঝলক তাকিয়ে বদরু বলে, বোষ্টম হলেই বা অসুবিধা কোথায়, বৈষ্টমী পেতে তো নবদ্বীপ যেতে হবে না, ঘরের কাছে পালপাড়ায় এলেই সমস্যা নিকেশ হবে তো!
ঠোঁট উলটে এক চোখ মেরে নমিতা জানায়, আহা মরণ আমার, কচি ডাগর নিয়ে মরি আর কি, আমার এই মাঝ বয়সি শরীরটাকে কোন্ তরিকায় ঘায়েল করবে শুনি...
বদরু রসিকতা আরো খানিক বাড়িয়ে বললো, কৃষ্ণ প্রেমে মজিলো রাঁধা/ প্রেম নদীতে কিসের বাঁধা/ আমি হলাম কঁচি ডাগর/ রসেতে যে মধুর সাগর/ তুমি প্রেম করিবে রাইবিনোদিনী/ আমি তোমার মনের মনি/ সকল মধু দেবো তোমার পায়ে/ এসো-এসো রাঁধা তুমি আমারও নায়ে...
তারপর-তারপর কি করবে শুনি তো, বদমায়েশ কৃষ্ণ আমার, বলেই হাসতে থাকে নমিতা বউদি চোখের তারায় পদ্মফুল ফুটিয়ে, সদ্য তোলা বেলপাতার মতো মসৃণ গালে তখনো লেগে আছে রেশমী আলো আভা, চিকচিকিয়ে ওঠে বদরুর চোখের সামনে শ্যাকড়া বাড়ির বউ নমিতা বউদির রূপের তরতাজা লাউডগা শরীর।
গাঁয়ের ময়-মরুব্বিরা বদরুর নিকটতম আত্মীয়-স্বজনদের প্রায়শ বলে, কবিরাজ দেখাও, মস্ত ব্যাধি হয়েছে আন্দাজ করা যায়, ক্ষণে ভালো তো আবার যে কে সেই অবস্থা। বদরুর মামা ব্যাপারটাকে সেভাবে পাত্তা দেয় না। শুনেও না শোনার ভান করে, অন্য ধাতের মানুষ বটে, ওমন মুখপোড়া হনুমানের জন্য সে একটা কানাকড়িও যে খরচা করবে না এজন্মে, তাও বোঝা যায়। মাঝে কয়েকটা মাস নাকি আবার বদরু ওই গাঙ্গাপাড়ার গাজী দেওয়ান বয়াতির আশ্রমে ডেরা বাঁধে, সেই আলুথালু জোবরজোব্বর গাঁয়ের মাথায় জটাধারী ঝাঁকড়া চুল দেখে কেউই ঠাওড় করতে পারতো না এই সেই বদরু। এ’ সময় ছেলের শোকে একদিন ওর মাও অকস্মাৎ মারা যায়, বদরু তখন গ্রাম থেকে অনেক দূরে কোথাও ছিলো, মায়ের মরার সংবাদ ওর কানে মাস খানিক পরে আসে,তারপর মহেষখালী গ্রাম ছেড়ে ছুটতে-ছুটতে মায়ের কবরের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পরে, কাঁদতে-কাঁদতে কান্নার নদী বয়ে যায় কবরখানায়। গাঁয়ের আবল-বৃদ্ধ বউ-ঝি’রা স্থির নয়নে দেখে একজন প্রেমিক পুরুষ বদরু’র কান্নার ঝর্ণাধারা। মৃত্তিকা যেন কেঁদে ওঠে বাদামী রঙের একটি সদ্য জন্ম নেওয়া বাছুর পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসে যেভাবে চঞ্চল হয়ে ওঠে, বদরু’র কান্নার তীব্রতা সেভাবে বেড়ে ওঠে পারদের মতো, সবার চোখের কোণ সত্যসত্যিই সিক্ত হয়ে যায়, নির্বাক-নিশ্চুপ সমাজের মানুষগুলো অনুধাবণ করে প্রেমিকের বুক চাপড়ানো হাহাকার। তারপরও কেউ-কেউ পৃথিবীর নিয়মাবলী রক্ষা করে গতানুগতিক কথার শোক মিশিয়ে সান্ত¡না দেয় বুক সমান। বুকের গভীর মমতায় টেনে নেয়, মায়ের মতো কেউই তো হওয়ার নয়, তবুও প্রকৃতির ধারাবাহিক নিয়মের কেউ তা খন্ডাতে পারে না একচুল, সে ক্ষমতা বা দুঃসাহস কারো নেই। সবই মুখ বুজে মেনে নিতে হয়,অস্তিত্বের মতো নিয়তির লিখন বলে। বদরু সেই থেকে আর ফিরে যায়নি, বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে বেলা-অবেলা কেটে যায় ওর, মায়ের ঘরের দেহলিতে বসে নীল আকাশটাকে থিতু চোখে দেখে কি বা খোঁজে কেউ তা জানে না। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটা মাস-বছর। বাড়ির কেউ কিছু খেতে দিলে খায়, নয়তো নয়। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথাও বলে না। শুধু ওই গভীর চোখ দিয়ে প্রেমিক পুরুষ বদরু যে কি দেখে অপলক, কারো তো বোঝার বা অনুমান করার ফুরসত নেই। এর মধ্যে ওর ফুপাতো বোন জযতুন ওদের বাড়ির পেছনে ঝাঁকড়া মস্ত কুলগাছটায় দড়ি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়ে একদিন, ফুলের পাপড়ির মতো সেই তরতাজা লাশখানা দেখে অনিমেষ। জয়তুনের সঙ্গে ওর সেজো মামার সম্পর্ক ছিলো বলে শোনা যায় একটু-আধটু, মামা-ভাগ্নীর অবৈধ সম্পর্কের ব্যাপার, একেবারে ঘরোয়া বিষয়, আশপাশ থেকে কানাঘুষা চলছিলো অনেকদিন থেকেই, কেউ-কেউ পাত্তা না দিলেও কেউ আবার আগ বাড়িয়ে ফপরদালালী করতে আসে। ওদের বাড়া ভাতে আগুন ঢেলে শেষাবধি সত্যসত্যিই হাতেনাতে ধরা পড়ে, জয়তুনের তখন বাড়বাড়ন্ত অর্থাৎ পাঁচ মাসের পোয়াতি, সবার কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার, কেউ-কেউ ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো, কালে-কালে আরো কতো দেখবো, কেয়ামতের সময় আর বুঝি বাকি নেই...
তারপর বাবা-মায়ের ভায়ের-আত্মীয়-স্বজনের অকথ্য ভাষার খিস্তি খেউর আর অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরেই নাকি পৃথিবীর প্রতি বিতৃষ্ণা আর বিদ্র“প করে চলে গেলো অস্বাভাবিক ভাবেই।
লাশকাটা ঘর থেকে জয়তুনের তরতাজা সেই শরীরখানা বাড়িতে ফেরৎ আসলো, তখন আরেক চেহারার মানবী সে জয়তুন। কতো না ধকল গেছে ওর ওপর তার খবর কে রাখে! ইন্টার্নি ডাক্তার থেকে পাতি ডাক্তার তারপর ডোম-ওয়ার্ড বয়গুলোর হাতের পেষণে যাচ্ছেতাই অবস্থা, কতো কি যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে ওর ওপর, তবেই না ওদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে, মুখ বুঁজেই তাবৎ অত্যাচার-পাষবিক নিপীড়ন সহ্য করেছে অবলীলায় বাধ্য মেয়ের মতো। বদরু অশ্র“সজল নয়নে নিস্পলক তাকিয়ে ছিলো কতোটা সময় লাশকাটা ঘর থেকে ফেরৎ আসা জয়তুনের দিকে। ওর পাজর ভাঙা বুকের করুণ আর্তনাদ হয়তো কেউই শুনতে পায়নি সেদিন, তাঁতিপাড়ার বখাটে যুবক নিমাই রাতারাতি সিদ্ধপুরুষ হলো বৃন্দাবন নাকি হরিদ্বারে তীর্থ করে ফিরে। কেতাদুরস্ত মানুষ এখন সে। কাজীহাটার একসময়কার ছিঁচকে চোর নেংড়া রহমান দু’ নম্বার ব্যবসাটাকে আরো বেগবান করে দুটো কাঁচা পয়সা কামিয়ে উড়োজাহাজে চেপে মক্কা গিয়ে মুন্ডুকেশ খন্ডন করে তারপর শুভ্র শাদা থান (কাফন) জড়িয়ে কাবাশরীফের কালো পাথরটাকে চুম্বুন এবং সাত সাতবার প্রদক্ষিণ করলো, আস্তো একটা খাসীও কুরবানী দিয়েছে, এখন সে হাজি শব্দটা সাঁটিয়ে ফেলেছে নামের আগে, দু’নম্বর ব্যবসার সঙ্গে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা এবং কাঠ ফাড়ায়ের ও কাঠ বেচা-কেনার ব্যবসাটাকে আরো চাঙ্গা করলো, সবই নসিব, কপালের মাজেজা হয়তো একই বলে। গোবেচারার হাবভাব দেখলে ভুল হলেও আসলে ভেতরে-ভেতরে আস্তো ধুরন্দর বদের আঁটি, নিজের ইতরামী যতোই দাড়ীর নীচে লুকিয়ে রাখুক না কেনো, আলবত একদিন বুঁনোশুয়োরের মতো বেড়িয়ে আসবে প্রকৃত চেহারা। বড় বেশি মেপে কথা বললেও কোথায় একটা জোচচুরি যেন রেখে দেয়, নিজের সঙ্গে জাঁকিয়ে বুদ্ধি-শলাপরামর্শ করে, তারপর আবার বছর সাতেক থেকে তো হাটের ইজারাদার সেই, তারওপর গোঁদের মুখে বিষফোঁড়া, সামনে নাকি পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রার্থী হবে বলেও চুপিসারে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে সেটাও তো দেখার বিষয় বটে, কিন্তু লুকোছাপের কি আছে, চাঁদ আকাশে উঠলে তো লোকে দেখবেই, বেতনভুক্ত কর্মচারীগুলো এদিক-ওদিক কানাঘুঁষো করলেও নেংড়া রহমানের মুখে কলুপ আঁটা। পাক্কা গেছো শিয়াল, রক্তের কণায়-কণায় বুদ্ধির কারখানা। তবে ওপরওয়ালা একচক্ষু হরিণের মতো অনেকটা, কার ভাগ্যে শিকে ছিড়ে পড়ে সেটাও নাকি বরাদ্দ করা পূর্বের পরিকল্পনা মাফিক, মল­বীরা এখানে-সেখানে বলে বেড়ায় সে’সব কথা, এতে আবার আশ্চর্যেরই বা কি, তেল চুকচুকে ফুলেল মাথাতেই তেল ঝরে পড়ে চুঁয়ে-চুঁয়ে, সবই ওপরওয়ালার নেয়ামত বলে কেউ-কেউ হয়তো, বিশ্বনাথ হাজরা ভেবে কুল-কিনারা পায় না, এতো কিছু থাকতে রহমান হাজী কেনো তার পৈত্রিক পেশাতে ভাগ বসাতে গেলো,দক্ষিণপাড়ায় রায়হাটী অঞ্চলের হিন্দুদের বিষয়-সম্পত্তি রাতারাতি নামকাওয়াস্তে পানির দরে নাকি রহমান হাজী কিনে স্বসম্মানে বর্ডার পার করে দিচ্ছে বলেও এলাকার নানান জনের মুখে একটু আধটু ছিঁটে-ফোটা শোনা যাচ্ছে। হয়তো হবে বা সবই সত্য অথবা সবই নিন্দুকের নিন্দা রটনা।
অকস্মাৎ একদিন বদরুর ছোট চাচা জহির মুন্সী কাউকে কিছু না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো, মানুষজন কতো খোঁজ-খবর তালাশ করেও কোনো হদিশ পেলো না। সাত তল­াট খুঁজে যখন তার টিকির দেখাও পেলো না, তখন একদিন বুড়ো শিবতলার মাঠের ধারে গলায় দড়ি অবস্থায় জহির মুন্সীর দেহটা মিললো, কে যে কাকে মারে আর কে যে কারে বাঁচায়, সে এক প্রশ্ন বটে, মানুষ মরে আবার বাঁচে, এর মধ্যেই কতো অংক কতো হিসেব নিকেস, কার বোঝার সাধ্যি, কিন্তু মৃত্যুর কারণ বোঝা গেলো না যদিও তারপরও মনে হলো কোনো রহস্য আছে, যেভাবে ওর বড় ভাই অর্থাৎ বদরুর বাপ কহির মুন্সী কাকতালীয়ভাবে নিখোঁজ হলো, সেই ভাবেই কি জহির মুন্সী হারিয়ে গেলো, বদরু সংবাদ শুনে ছুটে এলো, সেও কোনো কুল-কিনার খুঁজে পেলো না, কোথায় একটা অদৃশ্য সুঁতো তাদের নিয়ে খেলছে, কার হাতে ধরা সেই সুঁতোর নাগাল, জহির মুন্সীর কোনো সন্তান-সন্তাতি ছিলো না, বেশ কিছু জমি-জমা করেছিলো, বিলমালয়ের ওদিকে পানবরোজ করবার জন্য কিছু জমি বর্গাও নিয়েছিলো, মৃত্যুটা একটা রহস্য রয়ে গেলো, গ্রামবাসী তাকিয়ে দেখলো, বুড়ো শিবতলার দিকে কেউ আর যেতে চাইলো না রাতবিরাত তো দূরের কথা দিনসকালেও নয়, কেউ-কেউ বললো, জায়গাটা মোটেও সুবিধের নয়...
গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারতো, কিন্তু শেষ হলো না,একদিন বদরুর কাছে খবর আসলো, ফুলমতির স্বামী নছিমনের ধাক্কায় মাথা ফেটে মারা গেছে, শালার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলো ফুলমতির চৌকিদার খালাতো ভাই, কিন্তু সংসার বেশিদিন টিকলো না, বদরু সত্যিই হাসতে ভুলে গেলো, স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকলো কুয়োতলার কাছের ওই পুরোনো ঘোড়ানিম গাছটার দিকে, কতোদিনের গাছটা সেইভাবেই দাঁড়িয়ে, কেমন যেন দেখতে হয়েছে, দিনেদিন শরীর বাড়ছে, বদরুর চোখটা দূরের ওই ডালটার দিকে,কতোগুলো পাখি বাসা বেঁধেছে কে জানে, গাছেই তো পাখিরা বাসা বাঁধে এতে আবার আশ্চর্যের কি! কিন্তু তারপরও একটা আশ্চর্যচিহৃ এখানে থাকবে, রঙ-তুলীর মতো হয়তো ব্যাপারখানা হবে, কোথায় কোন্ রঙের প্রলেপ লাগে আন্দাজ করা তো যায় না, তাই কিছু রঙ রেখে দিলাম উপস্থিত এখানে, সুতরাং...।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
সৃজন শারফিনুল ভাল লাগলো অনেক শুভ কামনা।।।
ভালো লাগেনি ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
রবিউল ই রুবেন ভালো লাগল। আরো ভালো করতে হবে। ভোট রেখে গেলাম। আমার পাতায় সময় করে একবার আসবেন।
ভালো লাগেনি ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫

১৭ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

বিজ্ঞপ্তি

“নভেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ নভেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।

প্রতিযোগিতার নিয়মাবলী