মেলা

বিজয় (ডিসেম্বর ২০১৪)

আশরাফ উদ্ দীন আহমদ
  • ১০
শান্তপুর থেকে ইসমাইল এসেছে জন্মাষ্টমী মেলায় নবদ্বীপে।
হাজার একটা মন্দিরের শহর নামে খ্যাত শ্রী চৈতন্যদেবের আশ্রয় এই নবদ্বীপ। গুপ্তযুগে বাংলায় বৈষ্ণব-শৈব-শাক্ত প্রভৃতি পৌরানিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মমত প্রচলিত হয়। বৈষ্ণব সহজিয়ারা তেত্রিশ কোটি দেবতা বিশ্বাস করে না এবং প্রতিমা পুজোও করে না তারা। শ্রী চৈতন্যদেবের ভাবধারানুসারিরা একেশ্বরবাদী ধর্মের লোক অর্থাৎ বৈষ্ণব সহজিয়ারা এখানে এক ঈশ্বরের গুণ-কীর্তন করে, বৈষ্ণবধর্ম প্রবর্তক শচী-নন্দন নিমাই বা গোরাঙ্গ হলেন চৈতন্যদেব।
জন্মাষ্টমীতে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের হাট বসে নবদ্বীপে। সমগ্র ভারতবর্ষের বৈষ্ণব মতাবলম্বিরা ভাদ্রের এই চিত্রানক্ষত্রযুক্ত পূর্ণিমাকে সামনে রেখে এখানে এসে পূর্ণি লাভ করে। পরম কর“ণাময়ীর বন্দনায় নবদ্বীপের মায়াপুরী মঠের চারধারে মেলা বা উৎসব জমে ওঠে।
ঘরছাড়া বাউল ডাকে, কে যাবি রে আয়/ নবদ্বীপে হাট বসেছে/ আছে যে নিমাই--বাউলের সেই ডাক শুনে কে না এসে পারে, সবাই ছুটে আসে দলে-দলে নদীয়ার নবদ্বীপের এই গঙ্গাপাড়ে।
মায়াপুরী মঠতে ঘিরে প্রতিবছর বিশাল আয়োজন হয়। মায়াপুরী নামেই যার পরিচয়। মায়া-মমতা আর ভালোবাসার স্নিগ্ধ আছড়ে গড়া এই মায়াপুরী। গের“য়া থান পড়ে ভক্তরা একেশ্বরের আরাধনা করছে আধো চোখ বুজে। এখানে যেন ঈশ্বর সাত আসমান থেকে নেমে মিশে যায় ভক্তের জীবাত্মায়। পরমাত্মা আর জীবাত্মা কখন যে একাকার হয়ে বিশ্বব্রাহ্মান্ডের সম¯— শব্দ মিথ্যে লোভ-লালসাকে ভেঙে মিশে যায়। বিক্ষুদ্ধগঙ্গা ¯—ব্ধ হয়ে থেমে যায় সেই পরম ভালোবাসায়। ভালোবাসাও যে নিখুঁত আর সৌন্দর্যে ভরপুর হয়, তা মায়াপুরী মঠে না এলে অজানা রয়ে যায়। অš—হীন আকাশ দু’হাত বাড়িয়ে দেয় মহাসমুদ্রকে কাছে পাওয়ার বাসনায়। আর সমুদ্র তখন হু-হু করে কাঁদে অনšে—র গান শুনে। হৃদয় দলিত-মথিত হয়ে যায় জন্মান্ধের সীমাহীন ভালোবাসায়।
ইসমাইল প্রতিবছর আসে দোকান নিয়ে, সাজিয়ে বসে গঙ্গার কোল ঘেঁষে বড় রা¯—ার মুখোমুখি। শান্তপুর থেকে আরো এসেছে নন্দলাল-কার্তিকপাল-ইনাম আলী-পরিমল বাগদী-ফকির জান। ইসমাইল শুধু কৃষ্ণনগরের মাটির খেলনা আর গণেশ-কালী-শিব-শ্রীকৃষ্ণ প্রতিমা নিয়ে বসেছে দোকান খুলে। জমকালো দোকান না হলেও কৃষ্ণনগরের মাটির জিনিসের আলাদা একটা গৌরব আছে বৈ কি! ফুলিয়া থেকে নদের চাঁদের ছোটবেটা অনুপ চাঁদ এবার প্রথম এসেছে খই-মুড়ি-খাগড়ায়-গজা-বাতাসা-চিনির তৈরী হাতি-ঘোড়া-বানর-দেবদেবী সহ আরো কতো সব রকমারি খাবার নিয়ে, ইসমাইলের বড় কষ্ট লাগে নদের চাঁদের জন্য, লোকটা গতবারই বলেছিলো, আরসেবার আর হয়তো আসতে পারবো না রে বাপ--ইসমাইল উত্তরে শুধু জানিয়েছিলো, কেনো গো কাকা, কোথাও বেড়াতে-টেরাতে যাবে নাকি? ঠোঁটে মলিন হাসি টেনে জানায়,না রে বাপ আর পারিনে, শরীর আর কতোই বা চলবে, এবার বুঝি দেহত্যাগের সময় হলো রে!
ইসমাইল ভাবে মানুষ কখনো-সখনো বড় বেশি রহস্যময় হয়ে যায়। ভবিষ্যতের কথা তখন বলে যেতে পারে কি চমৎকার ভাবে। আজ নদের চাঁদ নেই, কিন্তু মানুষটার স্মৃতি আর ভালোবাসা ভুলে যাওয়ার জো নেই তার। কালনার বনমালি লোকটা বেশ রঙের বলা যায়। এ’ বয়সেও রস যেন উছলে পড়ছে, মুম্বের-কলিকাতার সিনেমার নায়ক/নায়িকাদের বড়-বড় ছবি কি সুন্দর করে চারদিকে বাঁশ পুঁতে তিনদিকে লম্বা দড়ি বেঁধে তাতে আটকে দিয়েছে খোলা আকাশের নীচে। আর সবুজ ঘাসের উপর খেঁজুরের পাটি বিছিয়ে, তারপর পুরানো ছেঁড়া আলোয়ান পেতে, তাতে শিব-কালী-গণেশ-রাধাকৃষ্ণ জোড়া বাঁধানো ছবি, ধর্মপু¯ি—কা আরো কতো কি নিয়ে বসেছে, বৃষ্টিও বড় দয়া করে লোকটাকে, আবার বলে,সবই ঠাকুরের আর্শিবাদ।
গুপ্তিপাড়ার মাধব, মিষ্টির দোকান খুলে বসেছে, তিনদিকে দরমার বেড়া আর মাথার ওপর পুরানো টিনের চাল,জং ধরা টিনে ছোট-ছোট ছিদ্র তাতে, সোকেসে সাজানো থরে-থরে নানান পদের মিষ্টি, বলি হারি লোকটার ক্ষমতা বটে। প্রতিবছর যতো মেলা-উৎসব হবে, এই মানুষটা আসবেই আসবে। সেটা রাসোৎসব হোক,নবান্ন উৎসব বা চৈত্রসংকান্ত হোক, গাজন মেলা-দোলযাত্রা আর জন্মাষ্টমীই হোক অথবা অন্য যে কোনো উৎসব বসুক না কেনো, এই মানুষটা এই নবদ্বীপে আসবে। যেন বা ওর একটা নেশা ধরে গেছে এই নবদ্বীপের বাতাসে।
ইসমাইলকে লোকটা কিন্তু বেশ ভালোবাসে। মাধবের সঙ্গে গুপ্তিপাড়াতেই ইসমাইলের পরিচয়, ওখাানে স্থায়ী একটা মিষ্টির দোকান আছে, ষ্টেশনের প¬াটফরর্মের ধারে, ওর দু’ ছেলে সামলায়। ইসমাইল তারকাশ্বরের দিকে কিছুদিন তাঁতের কাজ করেছে, সপ্তাহাšে— বাড়ি যেতো গুপ্তিপাড়া দিয়েই, সে সময়ই মাধবের সঙ্গে পরিচয়, লোকটার পেটমোটা কালো কুচকুচে চেহারার স্বাস্থ্য দেখলে বড্ডো হাসি পেতো একসময় তার। কিন্তু মনটা অনেক বড়। শান্তপুরে একবার কি একটা কাজে গিয়েছিলো, ইসমাইলের সঙ্গে দেখা হয় তখন, ইসমাইল নাছোড়বান্দা, ধরে-বেঁধে বাড়ি নিয়ে এসে বেশ আপ্যায়ন করে। লোকটারও মন ইয়া বড়, যাওয়ার সময় আ¯ে—া একটা একশত টাকার নোট দেয় ছেলেটার হাতে। তারপর আরো ক’ বার এসেছিলো তার বাড়ি। গাদাগাদা মিঠাই-মন্ডা ছেলেটার জন্যে, জামা-কাপড় ছাড়াও টাকা দিয়ে গেছে সেলামী হিসাবে, ইসমাইলের সঙ্গে গাটবাঁধা একটা সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায় সেই থেকেই, এখনো কোনো ঝুট-ঝামেলা হলে তো ওই মাধব বাবুই ছাতার মতো মাথার ওপর এসে দাঁড়ায় তার।
ওদিকের সড়কের ধারে দরমার বেড়া দিয়ে কয়েকটা দোকান সারি-সারি, রাণাঘাট-বানপুর-নাদনঘাট-গেইদের দিককার লোকেরাই ওসব দোকানের মালিক, একটু বদরাগি স্বভাবের কেউ-কেউ, কথায়-কথায় খি¯ি—-খেউড় জুড়ে দেয়, অনেকে আবার ঝগড়াও করে কদাচিৎ। মাধব বাবু বলে, ও ব্যাটারা চাষা, উদ্বাস্তু রে উদ্বাস্তু--ইসমাইল প্রশ্ন করে, উদ্বাস্তু আবার কি জিনিস? মাধব মাথায় হাত দিয়ে বলে ওঠে, আরে মরণ আমার, উদ্বাস্তু কি, জানিস না রে বেয়াক্কেল, ওরা ওপার থেকে থাপ খেয়ে এপারে এসেছে, এপারের মানুষদের বলে-কয়ে সহানুভূতি নিতে চায়, আসলে শালারা ধাপ্পাবাজ মিনমিনে শয়তান একেকটা।
একটু খটকা লাগে ইসমাইলের মনে, তার মানে রিফিউজিদের উদ্বাস্তু বলে, শান্তপুরে বাঙাল বলে এদের। এ’ ব্যাটাদের অত্যাচার যেমন, খোঁচা মারা কথাও বেশ ঝাঁঝালো, ওপার থেকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে গুষ্টি বেঁধে এদিকে এসে সিনে ফুলিয়ে হাঁটে। বড়-বড় লম্বা চওড়া কথাও বলে আবার। সে’ বার এক বাঙালকে দু’ ঘুসি মেরেই দিয়েছিলো ইসমাইল। হারামজাদা বলে কি না গর“ খাওয়া ¤ে¬চ্ছদের পাছায় লাথি মেরে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। সতিশ মিত্ত বলেছিলো, জানিস ইসমাইল এসব উল¬ুকমার্কা শয়তানগুলো সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়ায়, হিন্দু-মুসলমান স¤প্রদায় টেনে এনে এ’ সম¯— জারজগুলো চুলকে ঘা করার মতো আমাদের এতোকালের বন্ধুত্ব আর ভালোবাসায় ফাটল ধরাতে চায়।
ইসমাইল জানে, এরা ওপার থেকে আসা পঙ্গপাল। সুযোগ পেলেই সাবাড় করে দেবে ক্ষেতের ফসলের মতো সাজানো-গোছানো ঝলমলে এই সমাজটাকে। মাধব বাবুর কথা শুনে বাঙালদের সেই চোর-চোরটা মার্কাটে ছবিগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ইসমাইল এদের বেশ চেনে। বনমালী বলে ওঠে, এসব খচ্চরদের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলতে হবে। মাধব বাবুর কথার সঙ্গে বনমালীর কথাও চমৎকার মিল দেখে ইসমাইলের হাসি পায়।
প্রমক্ত গঙ্গা কুলকুলিয়ে নাকি ধেই-ধেই করে ধেয়ে যাচ্ছে কোন্ সুদূরিকায়। মা গঙ্গাভক্ত সš—ানরা স্নান করছে এখন। দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেঁকিয়ে প্রণাম করে কেউ-কেউ, মায়াপুরী মঠের সুউচ্চ মিনার দাঁড়িয়ে দেখছে সমগ্র নবদ্বীপ। এক হাজার একটা মন্দিরের শহর মহাপ্রভূ শ্রীকৃষ্ণ ধাম নবদ্বীপকে। এ’ দেখার মধ্যে কোনো ফাঁক নেই, ভালোবাসা বুকে নিয়ে দেখছে সমগ্র পৃথিবী, দেখছে ভূ-প্রকৃতি-মানুষ--মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন যুগের অনেক নিদর্শন নদীয়া জেলার বিভিন্ন অংশে পাওয়া যায়, প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যও আগন্তুক শাসককুল কর্তৃক প্রবর্তিত পশ্চিম এশীয় ধারার স্থাপত্যের সংমিশ্রণে বাংলায় চালা শৈলীর যে অভিনব ও সম্পূর্ণ স্থানীয় স্থাপত্যের উদ্ভব হয়, তার বেশ কয়েকটি উলে-খযোগ্য নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় নবদ্বীপে। শ্রীচৈতন্যদেব কর্তৃক প্রচারিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প¬াবণে নিমজ্জিত বঙ্গের সমাজ জীবনে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব চালা স্থাপত্যেও অনুভূত হয়। লোকায়ত ভাবধারায় সৃষ্ট ও লালিত এই স্থাপত্যশৈলীর অঙ্গসজ্জার বিষয়বস্তু র“পে মূলত কৃষ্ণলীলাকেই স্থান দেওয়া হয়। আর রামায়ণের কাহিনী বিশেষ করে লঙ্কাযুদ্ধকেও স্থান দেওয়া হয়েছে কার“কার্যের মধ্যে, আবার মন্দিরে পূজিত দেবতার স¤প্রদায়গত চরিত্র মন্দির গাত্রে বৈষ্ণব-শৈব ও শাক্ত দেবদেবীর সহাবস্থানে বাধা হয়নি। মধ্যযুগীয় বাংলার মন্দির ভাস্কর্য বিরল ক্ষেত্র ব্যতীত পোড়ামাটির মাধ্যমে র“পায়িত। রাজা লক্ষণসেনের রাজত্বকালে নবদ্বীপ ছিলো প্রধান একটা নগরী, তখন থেকেই নবদ্বীপ মন্দির প্রসিদ্ধ স্থান বলে বিবেচিত। সে ধারাকে অক্ষুন্ন রেখেই নবদ্বীপ এখন সনাতন ধর্মের অনুসারীদের তীর্থস্থান হলেও বৈষ্ণবদের আধিপত্য একটু বেশি। মধ্যযুগে ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন এবং শাসনের ফলেও মন্দিরের এতোটুকু ক্ষতিসাধন হয়নি। বরং তাদের উদার মনোভাব আর অসহিষ্ণু নীতির কারণে উত্তরোত্তর উৎকর্ষতা আর আধুনিকতার চিহ্য পরিলক্ষিত হয়।
ইসমাইল মানুষের মধ্যে যেমন কোনো ব্যবধান দেখে না কখনো, তেমনি মন্দির-মসজিদের মধ্যেও পার্থক্য দেখতে পায় না। তার কাছে মনে হয়, সম¯— ধর্মেই শান্ত আছে। পৃথিবীতে শান্ত প্রতিষ্ঠার জন্যই যুগে-যুগে মহামানবরা এসেছে, তাদের পদচারণায় পৃথিবী ধন্য হয়েছে, আর মানুষের মধ্যে স¤প্রীতি-সৌহাদ্য আর মৈত্রের সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে, ধর্ম তো মনকে পবিত্র করে, লোভ-লালসা-রিপু সম¯— পাপাচার থেকে গিনি সোনার মতো পুড়িয়ে-পুড়িয়ে খাঁটি করে, আর সে কারণে ধর্মের ছায়াতলে এসে মানুষ উদার হয়, মহান হয়,পবিত্র হয়। তার মনের ভেতর শান্ত নামের প্রজাপতি উড়াউড়ি করে। কিন্তু কিছু স্বার্থšে^শি মানুষ ধর্ম দিয়ে মানুষকে ভিন্ন করে রেখেছে, এরা মানুষ নয়, মোনাফেক। ইসমাইল জানে পৃথিবীতে মানুষের দুটো জাত আছে, একটা লুটেরা বা ধনীক শ্রেণী, পরের মুখের গ্রাস কেড়ে খায়, এরা ধান্দাবাজ শয়তান। আর একটা মানুষের জাত আছে, এরা নিঃস্ব-গরিব, প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে বেঁচে থাকার জন্য, এরা আমৃত্যু মানুষের মধ্যে খুঁজে ফেরে মানুষকে। মাধব আর বনমালী যেমন মানুষের মধ্যে সেরা মানুষ। মনে কোনো পাপ নেই, আছে অগাধ ভালোবাসা আর ভালোবাসা। কারো সাতে-পাচে নেই, অন্যায় সহ্য করতে পারে না কখনো। এমন মানুষ দেশে আজকাল আর বেশি নেই। হারিয়ে যাচ্ছে সব কোথায়। হঠাৎ লক্ষ্য করে ইসমাইল,একদল হিজড়ে লাইন ধরে যাচ্ছে, একসময় তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। একজন অল্প বয়সি পরিচিত হিজড়ে শরীর দুলিয়ে জানান দেয়, কি গো গোসাই, কেষ্টনগরের মাটির পুতুল হয়ে বসে থাকবে না কি গো---
ইসমাইল অনুর“প শরীর দুলিয়ে রশিকতা ঝরিয়ে একটা চোখ মেরে জানায়, না রে রাঁধা বসে থাকবো কেনো রে, তোর সঙ্গে কেষ্টনগরে ঝুলতে যাবো।
-আহা কথার ছিরি দেখো, মাইরি যাবি না কি...
-যাবো-যাবো, আগে বল্ এদ্দিন ছিলি কোথায়?
-বেশ তো আমার রসের নাগর, ফটফটিয়ে কথা বলে যে, তালে চল্ বৃন্দাবন।
-শুধু বৃন্দা কেনো, যেতে পারি তোমার সনে অযোদ্ধা কিংবা মথুরা নগরে সখি...
-আহা হেব্বি মাল একখান, পোষা কাকাতুয়া, খাঁচায় ধরে রাখবো, কলা-ছোলা দেবো আর-
-নেবে তো নাও না, ময়না যে উড়ে যাবে, আঁচলে বেঁধে রাখো।
ওমনি দলের মধ্যের আরো দু’ একজন কলকলিয়ে হেসে ওঠে। আরেকজন হিজড়া বলে ওঠে, শান্তপুরের কেষ্টকে না নিয়ে কি পারি গো!
-টুইটুম্বুর রসের নাগর, রসিক যে গো তুমি গোপাল।
-যার মনে রস আছে সেই তো রসিক, আর রসিক প্রেমিকরাই তো রসের নাগর।
-মাম্মা কি কথা বললে গোসাই-তোমার চরণে জীবন দিতে সাধ জাগে মোর/ তুমি আমায় কেটে দাও সকল আধার ভোর।
ইসমাইল বলে, এটা কি হলো, মুখে-মুখে গান বেধে ফেললে যে-
-গান-গান তো মোদের প্রাণ সখা, মুখে কেনো প্রাণের ভেতরেও তো ওই গানই তোলপাড় করে।
তারপর কিছুক্ষণ সবাই গণেশ-কালী-শ্রীকৃষ্ণ যুগল-শিবমূর্তি এবং খেলনাগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে, কয়েকজন দু’একটা কেনে। একসময় তারা আবার পূর্বের মতো চলে যায় বেদেনীদের মতো চওড়া মাজা দুলিয়ে আর লাউ ডগার মতো লকলকে শরীরখানা নাড়িয়ে পূর্বের মতো কলকলিয়ে হাসতে-হাসতে। একমিনিট যেতে না যেতেই পাশের এক মাঝবয়সি দোকানি চাপা চিৎকার করে জানাই,পাগল হইয়া যাইবো গা, কলিজায় আর চাবুক মারোস না স্বপ্নকা সুন্দরী, বুক যে ফালাফালা হইয়া যাইতাছে গা...
কালো মতো মাঝবয়সি হিজড়ে একটা বিচ্ছিরি খি¯ি— ছুঁড়ে দেয়। তার সঙ্গে আরেকজন হিজড়ে বলে ওঠে, স্বপ্নকা সুন্দরী না রে দামড়া, আমি তোর...নীচে আগুন লেগেছে ...
ইসমাইলের কানে বড় খারাপ লাগে শুনতে, এসব বাঙালদের কোনো কান্ডজ্ঞান আর হবে না। শুধু-শুধু ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করার কি দরকার, এরা কবে যে মানুষ হবে আল¬াই জানে! একসময় ইসমাইলের কানে ভেসে আসে বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের ঘরছাড়া মরমী গান, এ’ গান তো শুধু গান নয়, পথ ভোলা পথিকের অন্যরকম আবেদন, পথ ভুলিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহবানও হতে পারে। ইসমাইল মুহূর্তে তন্ময় হয়ে যায়। কোথায় পেলো এ’ সুর, এ’ সুরে এতো মায়া-ভালোবাসা কার জন্য, জানে না সে। দুরš— গঙ্গার স্রোতগুলো ছুটে-ছুটে যাচ্ছে দুষ্টু কিশোরীর মতো চোখের পলকে। সে সঙ্গে ইসমাইলের মনটা কোথায় হারিয়ে যায়--ঘুরে এলাম, দেখে এলাম/ আবার এই নবদ্বীপে/শান্ত নামের বান ডেকেছে/ গঙ্গা নদীর মায়াপুরে--
অকস্মাৎ সেই বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী একেবারে ইসমাইলের দোকানের সামনে হাজির হয়। আবার দুজনের মায়াবী কন্ঠে খেলে গান--নন্দের গোপাল রে তুই/জানিশ বড় ছলচাতুরী/ মন করে হ্যাঁচড়প্যাঁচড়/ আমি বল্ কি আর পারি-- বড় চেনা-চেনা লাগে ইসমাইলের, আগে কোথায় দেখেছে, বড় আপন মনে হচ্ছে বৈষ্ণবকে, গের“য়া আলখোল¬া পোষাক পা অবধি ঢেকে রেখেছে পরিচয়, তারপর আবার কপালে চন্দন মাটির তিলক। মাথায় জড়ানো লম্বা পাগড়ী। ঘাড়ে ঝুলি আর হাতে দোতারা, সঙ্গে আবার অপরিচিত এক মাঝবয়সি বৈষ্ণবী, ওর মুখেও কি এক মায়ার যাদু।
ইসমাইল তাকিয়ে থাকে দুজনের মুখের দিকে। কোনোভাবে আঁচ করতে পারছে না, কিন্তু বড় চেনা-চেনা এ’ মুখ, অনুমান করেও কোনো কুল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। ওমনি এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বৈষ্ণব বলে, আমাকে চিনতে পারছিস না বুঝি...
ইসমাইল কিছু বলার আগেই আবার জানালো, ওরে হতভাগা আমি তোর সামš— কাকা রে, ওই যে ঢাকিপাড়ার দিকের মাটি ফেলা কাঁচা রা¯—া।
আচমকা ইসমাইলের স্মরণ হয় হয়ে যায়, সেই বাল্যকালের স্মৃতি। বাপের হাত ধরে কতোদিন গঙ্গাধারে বেড়াতে গেছে আর তখনই সামš— কাকাকে দেখতো সে, মানুষটা বরাবরই ও’ রকমের, একদিন ইসমাইলের বাপ মরে গেলো, তারপর এ’ সামš— কাকাই তাদের সংসারে ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায়। কতোরকম সাহায্য-সহযোগিতা করেছে মানুষটা, কতো বছর তাকে দেখা গেছে বুক দিয়ে সংসারটাকে আগলিয়ে রেখেছে, কিন্তু বেশিদিন সেই সুখ সইলো না কপালে। সমাজ-সংসারের স্বার্থবাদী মানুষেরা কখনো কারো ভালো বা সুখ-আনন্দ সহ্য করতে পারে না।
ইসমাইলের মায়ের সঙ্গে সামš— কাকাকে জড়িয়ে একবার এলাকার কুচক্রি মানুষগুলো কি একটা বিচ্ছিরি বদনাম রটিয়ে দেয়। এর কয়েকদিন পরই ইসমাইলের মা কড়িবর্গায় দড়ি লাগিয়ে ঝুলে মরে। সেই থেকেই এতিম সে। তারপরও ইসমাইল শুনেছে, সামš— কাকা গ্রামের কাকে যেন ভালোবেসেছিলো, কিন্তু সেই মেয়ের একদিন বিয়ে হয়ে যায়। ভিনগাঁয়ে মেয়েটি চলে যায় পরের বাড়ির বউ হয়ে, সেই থেকেই সামš— কাকা নির“দ্দেশ। মাঝে একবার নাকি দেশে ফিরে এসেছিলো, ক’ দিন থেকেই আবার জঙ্গলের বাঘ জঙ্গলে পালিয়ে যায়। তাও অনেক বছর আগে। ইসমাইলের সঙ্গে সে’ বার দেখা হয়নি, তবে সব খবরাখবর পেয়েছে তার। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও মনের সম্পর্ক যে অনেক বড়, ইসমাইলের তাই মনে হয়। তারপর গঙ্গার জল কোথায় গিয়ে কোথায় মিশেছে, কেউ তার খবর রাখেনি। মানুষ ভারী বিচিত্র মানুষের সমাজে, এখানে কেউ কারো নয়, সবাই ছুটছে নিজেকে নিয়ে, কেউ কারো খোঁজ-খবর রাখার প্রয়োজন মনে করে না।
হঠাৎ সামš— কাকা আবার বলে ওঠে, কি গোপাল চিনতে পারলি, তোর মুখখানা দেখে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো, দেশের সবাই ভালো আছে তো?
-হ্যাঁ-হ্যাঁ সবাই আছে একরকম।
-আর কি, আচ্ছা জামাত আলী এখন কেমন আছে, লক্ষèণের বাবার হাঁপানি কি কমেছে, রহমত গায়েনের মুখ দিয়ে রক্ত বের“তো, আমি কিছু টাকা পাঠিয়েছিলাম, ঔষধ-পথ্য করতে, ও আচ্ছা, পঁচার বোনটার কি বিয়ে হয়েছে আর...
ইসমাইল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে মানুষটার দিকে, কি বলবে সে খুঁজে পায় না কোনো ভাষা। এতোগুলো মানুষের নাম মনে রেখেছে, কিন্তু জানে না এরা কেউই এখন পৃথিবীকে বেঁচে নেই। জামাতালী মুন্সী বছর খানিক আগে মরে গেলো, লক্ষèণের বাবা তারও কয়েক মাস আগে ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চলে গেলো পরপারে। লক্ষèণটা আর মানুষ হলো না বলে বড় দুঃখ করতো মানুষজনের কাছে। রাজনীতি করে বেড়াতো, বাপের কষ্ট বোঝার সাধ্য হলো না ছেলেটার। একদিন তো সেই লাশ হয়েই শাš— ছেলের মতো বাড়ি ফিরলো, এ’ শোক বাপ সহ্য করতে পারেনি। রহমত গায়েন রাজরোগের রোগী, মুখ দিয়ে রক্ত বের“তে-বের“তে একদিন মাটির সঙ্গে মিশে গেলো, সাতদিনের মাথায় প্রাণপাখি ফাকি দিয়ে উড়ে গেলো নির“দ্দেশে, একটি মাত্র মেয়ে ছিলো গায়েনের, মেয়েটাকে একদিন সুযোগ বুঝে গ্রামের কিছু লাফাঙ্গা-ইতর ছেলে-ছোকরা ধরে নিয়ে রেপ করে, পরেরদিনই মেয়েটা কুলগাছে দড়ি বেঁধে ঝুলে থাকলো। পঁচার বোন পদ্ম, দ্বিতীয় বিয়েও সইলো না কপালে, যৌতুকের বলীর শিকার হলো সে। ইসমাইল ভেবে পায় না, যার সংসার সমাজের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই, সে ঠিকই যে এতোগুলো মানুষের খবর রেখেছে, তা এক আশ্চর্য! কিন্তু দেশে তো আরো অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এর মধ্যে। যেমন ইসলাম চাচা ছেলে-পুলে নিয়ে বাংলাদেশ চলে গেছে, বেশ পেরেশানে ছিলো মানুষটা, ওপারের হিন্দুরা প্রায় ঝামেলা করতো, বিশ্বনাথ খুড়ো একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগল এখন। আর মতির মায়ের দুঃখ আর কষ্ট ঘোচাবে কে? সেই যে মানুষটা চিরকালের জন্য নিসঙ্গ হলো, আজো বেঁচে আছে, গ্রামে-গ্রামে ঘুরে চেয়ে-চিšে— খায়, শরীর খারাপ থাকলে অনাহারে থাকে দিনের পর দিন।
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে একসময় ইসমাইল বলে, কাকা তুমি আর দেশে যাবে না গো?
সামš— কাকা মুখ শুকনো করে থাকে, কোনো কথা বলতে চায় না যেন। ইসমাইল জানায়, এভাবে পথে-পথে ঘুরে কি যে শান্ত পাও তোমরা, আমি বুঝি না বাপু!
মানুষ দলে-দলে যাচ্ছে মায়াপুরী মঠের দিকে। বিশাল প্রধান গেইটের সামনে জড়ো হয়ে আছে একদল বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী আর তাদের ঘিরে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ ভক্তরা। দলের একজনের গানের গলা বেশ শুনতে, গান গাওয়া ওদের পেশা, পেশা বললে গানকে অপমান করাও হয়। নেশাও বলা যায়। সামš— কাকা বললো, বাপ আমার, আজো তুই সেই ছোট্টটি রয়ে গেছিস রে...
-তা তুমি, কোথায় থাকো তাহলে।
-আমাদের আর থাকা না থাকা, সবই সমান রে বাপ, ভগবানের দুনিয়ায় সব জায়গায় যে ঘর রে...
-তা কি হয়, এটা কি জীবন হলো কাকা, তা তোমার সঙ্গেরটাকে কোথায় পেলে?
-ও আচ্ছা, হা-রে পরিচয় করিয়ে দেয়নি তোকে, একে আমি কুড়িয়ে পেয়েছি, সে’ বার চন্দননগরের রাসের মেলা থেকে।
-বিয়ে করেছো তাহলে?
ইসমাইলের কথা শুনে হো-হো করে হাসতে থাকে সামš— কাকা। বিয়ে করবো কাকে রে বোকারাম, তুই একটা ইয়ে--
-কেনো, ওকে তুমি বিয়ে করোনি।
-দূর-দূর বোকা, আমি তো পণ করেছি বিয়ে করবো না এজন্মে, আর ও তো বিধবা রে।
-বিধবা...
-হ্যাঁ রে বিধবা ওই, বাপ-মাও নেই, থাকতো কোনো এক দূর-সম্পর্কের মামার কাছে খুন্তপাড়া নাকি তারকাশ্বরের দিকে, মামাটা মরে যাওয়ার পর ওরা তাড়িয়ে দেয়, তখন থেকেই পথে-ঘাটে।
-ও আচ্ছা, তাহলে তোমার বৈষ্ণবী মানে বৈষ্টমী।
-কেনো রে ঘেঁটু, তুই একটা নিবি নাকি, শুনেছি এখনো সংসার-ধম্ম করিসনি, কি ব্যাপার কাউকে মন-টন দিয়ে ছ্যাঁক-ট্যাক খেয়েছিস নাকি রে।
সামš— কাকার খোঁচায় ইসমাইলের মনটা কোথায় যেন বা হারিয়ে যায়। পেছনের টুকরো-টাকরা স্মৃতিগুলো চোখের সামনে হাজির হয় মুহূর্তে। ভালো সে বেসেছিলো একজনকে, সেও কি কখনো ভালোবাসতো তাকে। হয়তো ভালোবাসতো অথবা শুধুই অভিনয়। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে সবাই প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত শুধু অভিনয় করেই যায়। বৈকুন্ঠ সাহার ছোট মেয়েটা ইসমাইলের বয়সি, একসঙ্গে বেড়ে ওঠে ওরা। এভাবেই তাদের মধ্যে একটু আধটু ভালোবাসার শেকড়-বাকড় ডালপালা বি¯—ার করে। আগুনের আঁচে জ্বাল দিতে-দিতে যেমন দুধের উপরে পুরো শর হয়, তেমনি একে অপরের কাছাকাছি আসাতে ভালোবাসার ঘাটি মজবুত হয়, ভালোবাসা ঘন হয়। অর“নিমা কখন যে তার হৃদয়ের মধ্যে বাসা করে ফেলে, ইসমাইল তা বুঝতে পারেনি। সে জানতে পারেনি, একটা মেয়ে তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে, তাড়া করে বেড়ায় দিবানিশি, একসময় মনে হয়, অর“নিমা বাতাসে চুলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে, তার সম¯— অ¯ি—ত্ব জুড়ে বিরাজ করছে একটা মেয়ে। যেন সে শুধু একা নয়। আরেকজন ছায়ার ভেতর কায়া হয়ে মিশে আছে, সেই দুজনের ভালোবাসা অন্য কেউ জানতে পারেনি। পাখি-বৃক্ষ-নদী-মাটি আকাশ-বাতাস-এরা সবাই জানতো তাদের ভালোবাসার কথা, ভালোবাসার গল্প।
আকাশের নক্ষত্র-জ্যোৎস্নাভরা রাত্রি জেনেছিলো দুজন দুজনকে কাছে পেতে চায়, ভালোবাসার পূণাঙ্গ র“প দিয়ে সাজিয়ে তুলতে চায় বিশ্বসংসার। পরমাত্মার মাঝে বিলীন হয়ে মানবাত্মা সার্থকতা চায়। পৃথিবীকে ভরিয়ে দিতে চায় ফুল-ফল সৌন্দর্যে। কিন্তু তার আগেই অর“নিমা সাতপাঁকে বাঁধা পড়ে চলে যায় স্বামীর বাড়ি সুদূর মেদিনীপুর। ইসমাইল বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আকাশ দেখেছে, নির্বোধ জানোয়ার সে তখন। তার বুকের ভেতরে যে হৃৎপিন্ড আছে, তার ভাষা কে বোঝে? কার কি যায় আসে তাতে। অর“নিমা স্বামীর বাড়ি গিয়ে চারদিনের মাথায় বিশ্বসংসারকে মিথ্যে করে চলে গেলো পরমাত্মার ধ্যানে। জমিতে ছিটানো কীটনাশক খেয়ে জীবনের জ্বালা মিটিয়ে গেলো, এমন জেদি মেয়ে অর“নিমা! কখনো ভাবেনি ইসমাইল কিন্তু সে পারেনি ওমন একটা কাজ করতে। মনের ভাষাকে মনের ফ্রেমেই লটকে রেখেছে সে আজো। অর“নিমার মৃত্যুর কারণ সবাই জানার চেষ্টা করেছে, ওর এক বান্ধবী ভারতী একদিন জানাই, বিয়ের আগে ও নাকি বলেছিলো, বাবা আমার বিয়ে দিলে আমি... কিন্তু এ ’শরীর এ’ জীবনে যে শুধু ওই একজনের...
দিনেদিন মানুষ জেনে যায় সবই। ইসমাইলের ভালোবাসাকে সে সম্মান দিয়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছে হাসতে-হাসতে। বাবাকে কলংক থেকে মুক্ত করেছে, আবার নিজের ভালোবাসাকে সত্য-সুন্দর করে গেছে সে। মাঝে একদিন বৈকুন্ঠ সাহা কাঁদতে-কাঁদতে জানিয়েছিলো, ওরে হারামজাদা, আমার ওই পুতুলের মতো মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলিনে রে...কেমন তোদের ভালোবাসা ছিলো-
বাঁচাতে সে পারতো ঠিকই, কিন্তু পারেনি, এই না পারা কার অপরাধ, সে জানে না। আজো জানে না। আজো কখনো-সখনো অথবা গভীর রাত্রে, স্বপ্নের মধ্যে অর“নিমা তার কাছে আসে, কথা বলে চলে যায়। চলে যাওয়ার পর একটা সুভাস ছড়িয়ে দিয়ে যায়, সে সুভাস ভালোবাসার সুভাস। তখন শুধু কানের কাছে ভেসে আসে বৈকুন্ঠ খুড়োর সেই কথা, মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলিনে রে, কেমন তো-দে-র...ইসমাইল ভাবে মানুষকে বাঁচানোই কঠিন কাজ, মেরে ফেলাটা কাপুর“ষের কাজ, কাপুর“ষের লক্ষèণ।
আচমকা সামš— কাকা বলে ওঠে, কি রে এতো কি ভাবছিস বুড়ো পন্ডিতের মতো।
-ভাবছি চৈতন্যদেবের ধামে এলে মনটা কোথায় হারিয়ে যায় গো, সংসার-ধম্ম কিছুই আর ভালো লাগে না।
-বুঝেছি নিমাই, এ’ বয়সে তোরে চৈতন্যে পেয়ে বসেছে, কিন্তু বাপ খবরদার ভুল করিসনে, জীবনে সবচেয়ে বড় ধম্ম ঘর-সংসার স্বামী-স্ত্রী সš—ান-সš—াতি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব--
ইসমাইল নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিস্পলক চোখ দুটোতে কিসের এক মায়া খেলে যায়। ঘরের মায়া যেমন সামš— কাকাকে আর টানে না, তেমনি ইসমাইলকেও পথই এখন আপন করেছে। আর তাই জীবনটাকে নদীর মতো ভাবতে ভালো লাগে। নদী, হ্যাঁ এই প্রবাহমান গঙ্গা, দু’ পাড়ের জীবন-যাপন বি¯—ারিত কতো খেলা-স্বপ্ন সবই দেখেছে কিন্তু থামার কোনো ইচ্ছে নেই তার। ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে বহুদূরে। আজো কদাচিৎ অর“নিমা এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মেয়েটি যেন নদী, নদীর মতো পায়ে ওর নুপূর বাঁধা, রিনিঝিনি শব্দ তুলে আসে আবার রিনিঝিনি শব্দ উড়িয়ে চলে যায় ইচ্ছে মতো।
সামš— কাকা একসময় চলে যায়। মায়াপুরী মঠের ভেতর ওর কতো সাথি-সঙ্গি-ভক্ত আছে, গানে-গানে ভরে যাবে আশ্রম, সে গান তো গান নয়,পরমাত্মার সঙ্গে মিলনের জয়গান, অপার সুখ। অš—রীক্ষে হারিয়ে যাবে মনপাগলা, আর আত্মা মিলবে অসীমের সঙ্গে, আকাশ আর পাতালের ব্যবধান ঘুচে যাবে সে মুহূর্তে। ইসমাইল অনেক আগে শুনেছিলো, সামš— কাকা সনাতন হিন্দু ধম্ম ত্যাগ করে অর্থাৎ শৈব ধম্মমত ছেড়ে ব্রাহ্মধম্মে দীক্ষা নিয়েছে, অর্থাৎ
বৈষ্ণব ধম্মমত তাকে আকৃষ্ট করেছে বলা যায়। এ’ ধম্মে নাকি অপার শান্ত, শ্রী চৈতন্যদেব সেই মধ্যযুগে শান্তর বাণী ছড়িয়ে গেছে, মাটির গড়া মূর্তি নয়, প্রাণহীন প্রতিমার মধ্যে কোনো শক্তি বা ক্ষমতা নেই। পরমকর“ণাময় হলো একমাত্র অবলম্বন। তার নিরাকার উপাসনায় হলো ব্রাহ্মধম্মের বা বৈষ্ণব ধম্মমতের দীক্ষা।--সুখ নেই রে গয়া-কাশী/সুখ হলো মনের পাখী/তাকে যায় না ধরা নিমাই বলে/সুখ হলো আজব চালাকি/সুখ হলো মোহন বাশী--
ইসমাইল দূর মন্দিরের সুউচ্চঁ চূড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। শত-সহস্র কবুতর বাকবাকুম-বাকবাকুম ডাকছে আর একে-অপরকে ভালোবাসা নিবেদন করছে তারা। উদাসিন চোখ তার মন্দির দেখে, নাকি মন্দিরের ভেতরের আরেক মন্দিরের হৃদয় দেখে, সেই মন্দির যেন অর“নিমার ভালোবাসা! কিছুক্ষণ পর পাশের দোকানদার লোকটা ওর কাছে আসে, লোকটার দিকে একটু তাকিয়ে বোঝে কিছু বলবে হয়তো।
লোকটা খানিক শরীর ঝাকিয়ে সামš— কাকার দিকে ইঙ্গিত করে জানায়, গুর“-গুর“ দেখতাছে ভি আজব কারখানা, মাগার বৈষ্টমীটা কি খাসা একখানা মাল মাইরি...
ইসমাইল কিছু বলে না, নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে, কি বলবে ভেবে পায় না। আবার বলে লোকটা, গুর“ আহা পাগল হইয়া যামুগা... নবদ্বীপে হালাই ইয়ে করতাছি, ওদিকে সাতকালের বুড়ো সব দুই টাকা নয়আনা খরচা করে কচিকাচা বৈষ্টমী জুটিয়ে আনতাছে বৃন্দাবন থেকে।
বড় বেশি বেয়াদপ লোকটা, গায়ে পড়া এ’ সম¯— দোপায়া প্রাণী থেকে বরাবরই নিজেকে আলগোছে সরিয়ে রাখে ইসমাইল। তবে ওমন হাঙ্গালামী দেখে চুপ করে থাকতেও পারে না সে, উচিৎ একখানা জবাব দিতে হবে, বেহায়া পেয়েছে কি। অকস্মাৎ লোকটা বলে, কি বয়সে কি ডাসা গোপী ধইরাছে, রাঁধার সখা হইবে মনে কইতাছে, শরীর জুড়ে হুদু যৌবনের বন্যা।
ইসমাইল ফস করে জ্বলে ওঠে, আপনার মা-বোন নেই।
-হ্যাঁ-হ্যাঁ থাকবো না কেন্... মা বোন মাসি পিসি সবই আছে ভায়া, কিন্তু মা তো বাবার, বোন হলো বোনায়ের, মাসি আবার মেসোর আর পিসি, সে তো পেসো মশায়ের যে, আমার রইলো ক্যাঠা সোনা!
ইসমাইল লোকটার কথার কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না। এসব কুর“চি সম্পূর্ণ মানুষদের সঙ্গে সম্পর্কটা একটু দূরে রাখাই ভালো। বনমালী ঠিক কথায় বলে, এরা মিনমিনে শয়তান, ওপরটা যতোই চকচকে হউক না কেনো আসলে এল¬তের পা ঝাঁড়া।
বিকেলের পরপর সন্ধ্যের দিকে একদল বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ইসমাইলের দোকানের সামনে ভীড় করে। জয় গুর“, জয় গৌরের নিতাই...ইসমাইল বাম দিকে চোখ তুলে দেখে ভরাট কন্ঠে উচ্চারণ করছে শশীভূষণ বৈষ্টম। বিচিত্র ধারার মানুষ বলা যায়। কি যে মায়ায় পড়ে আছে মায়াপুরী মঠে, কেউ জানে না সে কথা। বুক ভরা ভালোবাসা লোকটার। দিনে দু’ একবার খবর নেয় সবার। ইসমাইলকে হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসে। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি মাখিয়ে শশীভূষণ চলে যায় আশ্রমের দিকে। অল্প বয়সি এক বৈষ্ণবী আড় চোখে ইসমাইলের দিকে তাকিয়ে জানায়, ঠাকুর তোমার বাড়ি কোথায় গো...
সঙ্গের আরেক বৈষ্ণবী তৎক্ষণাৎ জানালো, শান্তপুরে রে সতীন শান্তপুরে--
-বাবাহ্ বেশ তো খবর রাখিস।
-নন্দের নিমাই ঠাকুরের খোঁজ কে না রাখে, ও যে রসের নিমাই, শান্তিুপুরের কেষ্ট যে।
- আহ্হা রে, কি শোনালি মোরে সখী, মরি-মরি সইতে না-রি...চেহারা-সুরোত দেখে ঝুলে পড়তে খায়েস জাগছে ভারী।
ইসমাইল হেসে বললো, তোমার বাড়ি কোথায় রাধি?
-পথই আমার বাড়ি ঠাকুর, পথই আমার ঠিকানা!
সঙ্গের বৈষ্টমী এক চোখ টিপে আরো রসিকতা ঝরিয়ে জানালো, কি গো নাগর, মনে ধরেছে, সঙ্গে নেবে নাকি একশত এক টাকা পাঁচ আনাই কিনে।
-এত্তো টাকা কোথায় পাবো, ভালোই হলো অতো টাকাও নেই, গোপীকেও দরকার নেই। হরি বোল,জয়হরি, জয় নন্দের নন্দের জয়...
-কি গো, এখানে হরি ডাকছো যে বড়।
-হরি আছে সবখানে গো।
-ঠিক আছে একশত টাকা বাদ, তুমি এক টাকা পাঁচ আনাই দিও গোসাই।
ইসমাইল একভাবে তাকিয়ে থাকে অল্প বয়সি বৈষ্টমীর চোখের তারায়। চোখ তো নয় যেন জ্যোৎস্না রাত্রের নক্ষত্ররাজী। ওর চোখ দুটো ভারী সুন্দর, দামোদর নদীর মতো টলটল করে চোখের মনি। ঠোঁটের পাপড়ি মৃদু কাঁপছে। ইসমাইল নরোম হাসি ছড়িয়ে বলে, পথকে বাড়ি করেছো, ঘরে মনটাকে বেঁধে রাখতে পারবে সখী।
-মন তো সোনার পাখি কেষ্টো, সোনার পাখিকে কি লোহার খাঁচায় বন্দি করা যায়, ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করে দেখো না গো...
-জয় গুর“ নিতাই।
ইসমাইলের মুখের হাসিটুকু আরো গাঢ় হয়। সূর্যাদয়ের মতো একটু-একটু ফুটে ওঠে। অর“নিমার মুখচ্ছবি বৈষ্টমীর মাঝে বিলীন হয়ে যায়। অনেক দূর থেকে আসা দর্শণার্থীরা দোকানে-দোকানে ভীড় করছে এখন। পুথির মালা কিনছে কেউ-কেউ, আর কেউ বা মজা দেখছে টিয়া পাখির ভাগ্য নিয়ে খেলার। অনেক দূর থেকে আগাল বাঁশের বাঁশীর সুর ভেসে আসে কানে। একবার মনে হয়, আশেপাশে কোথাও বাঁশরী বাজায় কোনো ঘরছাড়া উদাসিন কৃষ্ণ। চারদিকে তাকিয়েও কাউকে পেলো না। ইসমাইল আর কিছু বলে না, সব ভাষা যেন বা হারিয়ে গেছে তার। তার চোখে উদার আকাশ, মায়াবী জাল ছড়িয়ে বিশাল আকাশ তাকিয়ে আছে। বুক জুড়ে লক্ষ-কোটি ভালোবাসা জেগে উঠবে হয়তো। বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীদের দরাজ কন্ঠের কীর্তন ভেসে আসছে এখন। অর“নিমাকে ভালোবাসার খাঁচায় বন্দি করেছিলো সে, কিন্তু সে ভালোবাসার খাঁচা ভেঙে চলে গেলো। এই বৈষ্ণবী তো নদীর জোয়ার, একে থামাবে কিভাবে, এর পায়ে যে ধেয়ে চলার নূপুর। মায়াপুরী মঠের মাধুর্য সিক্ত কন্ঠের মুচ্ছনায় আকাশ থেকে নেমে আসে শান্তর মেঘদূত। উড়ে-উড়ে বেড়ায় নতুন-নতুন প্রজাপতি। আর ভালোবাসার কপোত-কপোতি বাকবাকুম-বাকবাকুম ডাক দেয়। মাঝি ভাটিয়ালী গান গায়, নৌকায় তার প্রাণ এসেছে, পালে হাওয়া খেলেছে বড়। ভাটিয়ালীর ব্যাকুল সুর ঘরছাড়া করে প্রেমিক মন আর ইসমাইলকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাহমুদ হাসান পারভেজ আপনার কথাসাহিত্যে মুগ্ধ হলাম। চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনকে। আরো অনেক বড় ক্যানভাসে গল্পটি রূপ পেতে পারে। আপনার সফলতা কামনা করি।
হাফিজ রাজু চমৎকার শব্দ চয়ন, বেশ ভালো লাগল।
রুহুল আমীন রাজু anek valo laglo......(amar patai amontro roilo )
জুন খুব ভালো লিখেছেন।সত্যকে উপলব্ধি করে অনেক ভালো লিখেছেন। শুভ কামনা রইলো আমার পাতায় নিমন্ত্রণ।
ruma hamid সুন্দর অভিজ্ঞতায় লেখা , ভাল লাগল ।
রিক্তা রিচি উপস্থাপনা বেশ!!!!!!!!!
শামীম খান জীবনকে বেশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিজের মত করে সত্য কে তুলে ধরেছেন সুন্দর সাবলীল ভাষায় । ভাল লাগা আর ভোট রেখে গেলাম । শুভ কামনা নিরন্তর ।
Sima Das ভাল লিখেছেন।আমার কবিতা" বিজয়ের জয়গান"পড়ার আমন্ত্রন রইল।
আখতারুজ্জামান সোহাগ অনেক পড়াশোনা করেন আপনার গল্প পড়লে বেশ বোঝা যায়। শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস, ঘটনার ধারা বর্ণনা- সবখানেই যাদুর ছোঁয়া। সমাপ্তিটাও দারুণ। কিছু কথা থেকে গেল বাকি। দারুণ লাগল গল্পটি। শুভকামনা লেখকের জন্য।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল।আমার কবিতা "বিজয় ৭১"পড়ার আমন্ত্রন রইল।

১৭ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪