যদি লেগে যায়, এমন কি ক্ষতি-- কপালে থাকলে ঠেকায় কে !
বলা তো যায় না, কখন কার ভাগ্য আচমকা টাকশালের লোহার সিন্ধুকের মতো খুলে যায়। মানুষই তো পৃথিবীতে ভাগ্য নিয়ে আসে, আর এই মানুষই তো নিয়তির ওপর বিশ্বাস করে, নির্ভর করে কাটায় তাবৎ জীবন। আর এ সমস্ত মানুষই আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপটি কাকতালীয় ভাবে পেয়ে যায়। এটা বিলকুল সত্য মানে ধ্রুব সত্য,আজ কারোই অজানা নেই। কারণ এটাই স্বাভাবিক !
ক্বচিৎ মানুষ হয়তো বা ভাগ্যটাকে অবিশ্বাস করে অথবা এটাকে এক ধরণের পাগলামি বলেও উপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু তা এক প্রকার আবেগ বা ক্ষণিকের ব্যাপার। পরক্ষণে সে হয়তো ভাগ্যের কাছেই নতজানু হয়ে আবার দাঁড়াচ্ছে, এবং এটাই বাস্তবসম্মত। তাছাড়া সমস্ত ধর্মেও বলেছে,“ভাগ্যকে বিশ্বাস করো”। নিয়তির ওপর একমাত্র পুরাদস্তুর গদ্ধর্ভ ছাড়া সবাই আস্থা এবং বিশ্বাস রাখে।
ফুলজান এক ধরণের হাজার ভাবনা ভাবছে টানা কয়েকদিন যাবৎ। তারপর আজ হাটে এসেছে। সোম-বৃহস্পতিবার তালতলীর হাট, কড়কড়ে দশটা টাকা বুক ফুলিয়ে ওই টিকিট বিক্রেতা ছোকরার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পর আনকোড়া নোতুন যে টিকিট হাতে পায়, সেটি তার কাছে মনে হয় এক পরম সম্পদ। বুক পকেটে অকপটে চালান করে দেয় গোপনে। মনটা পুলকে ভরে ওঠে ফুলজানের। অজানা এক আনন্দে মনের গহনে ফিসফিসিয়ে কি যেন বলে যায় চুপিচুপি।
সকালের হাটভরা মানুষ, যেন বা উপছে পড়ছে মানুষে। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ। নরোম রোদ গায়ে জড়িয়ে যে যার কাজে ব্যস্ত এখন। তার ওপর চায়ের ষ্টলগুলোতে গল্প গুজবের তুমুল আড্ডা আর অকেজো বা ভুয়ো লোকের বকবকানি। হয়তো ফালতু গেঁজানিই সব, পরচর্চা-লোকনিন্দা যাকে বলে,অকাজের কাজিদের যা কাজ আর কি।
ঝিরিঝিরিয়ে উদাস করা হিমশীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে দিকভ্রান্ত হয়ে। শীতের শেষ আমেজ আর স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতি, মাঘের তৃতীয় সপ্তাহ চলে গিয়ে চতুর্থ সপ্তাহ পড়েছে। এর মধ্যে ফাল্গুনের সেই মিষ্টি-মিষ্টি হৃদয় জুড়ানো হাওয়া বুকের মধ্যে অন্যরকমভাবে তোলপার সৃষ্টি করছে যেন। শরীর ছুঁয়ে- ছুঁয়ে কি এক রোমান্টিক শিহরণ মনকে আচ্ছন্ন করছে, মন যেন এখন ব্যাকুল করা বাঁশরীর সুর, এ’সুরে কাঁপন লাগে, নিসঙ্গ কৌঁমুদীর মতো আকাশের কোলে ঝুলে থাকতে বড় অভিলাশ জাগে। এবড়ো-থেবড়ো মাঠ-ঘাট-আকাশ আঁকাবাঁকা সরু মেঁঠো সড়ক কেমন উদাস-উদাস ভাবে নির্বাক তাকিয়ে। বাতাসের ছোঁয়ায় মুখরিত হয়ে ওঠে বৃক্ষরাজী প্রকৃতি, পাখিরাও নীরব নয় কেউ যেন এ’মুহূর্তে।
ফুলজান আজ এ’ মুহূর্তে হারিয়ে যাবে। কোথাও তার হারিয়ে যেতে নেই মানা। মনে-মনে একটু ভাবে সে, লটারীর চলিশ লক্ষ টাকা যদি তার ভাগ্যে সত্যসত্যিই লেগেই যায়, তখন সে কি করবে, ভাবতেই হৃদয়ের মধ্যে আছড়ে-পাছড়ে পড়ে সাগর স্রোত। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে নির্বিকার, উচ্ছাসিত দৃষ্টিতে আকাশ দেখে। আকাশ বড় বেশি সুন্দর, মাঘের আকাশ যাত্রাদলের ঘেমটাওয়ালী রোকশানার শরীরের মতো একেবারে পরিপাটি ঝরঝরে এবং আকর্ষণীয়। শুধুই দৃষ্টি মেলে নিস্পলক দেখতে অভিলাশ জাগে। দেখার যেন বা সাধ মেটে না। কি আছে ওই শক্সিখনী লাউ ডগার মতো মসৃণ শরীরে। এমন শরীর যেন সিনেমার ওইসমস্ত নায়িকাদেরই হয়, কিন্তু রোকসানা পেলো কোথা থেকে,বুঝে পায় না সে।
রোকশানার দৃষ্টিবাণ ফুলজানকে অকপটে বিদ্ধ করেছিলো সেদিন। বুকের মধ্যের তেজী শেয়াল ডেকে ওঠে কি এক আনন্দে ! বাঁকানো ওই সপ্তমী চাঁদের মতো চোখ নয়,যেন হরিণীর কা¯ে— চোখ। যদি চল্লিশ লক্ষ টাকা ভাগ্যে মিলে যায়, তখন ঘেমটাওয়ালী রোকশানাকে খুঁজবে, অথবা ওমন একটা নাগিনী সে ঘরে এনে পোষ মানাবে।
চলিশ লক্ষ টাকা প্রথম পুরস্কার ! ভাবা যায়, সে কি মোটা অংকের টাকা। ফুলজানই তো হবে তখন মহিষডাঙার সবচেয়ে বড় ধনী ব্যক্তি। কতো-শত মানুষ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ফুলজানকে সামনের কাতারে দেখতে চাইবে। ঢাকা থেকে মন্ত্রী বা বড়সড়ো আমলা এসে যেমন ফিতে কেটে ফুলের টাটকা মালা গলায় নেয়, শান্তির কবুতর নীলাকাশে উড়িয়ে দেয়। হাজার-হাজার নারী-পুরুষ থেকে ফুলের সতেজ পাপড়ির মতো কচি-কাঁচারা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গন্যমান্য ব্যক্তিকে সম্মান জানায়,ফুলের নিরাভরণ পাপড়ি ছিটিয়ে, সেইভাবে একদিন এলাকার লোকগুলো তাকে সম্মান দেবে। সময় বলে দেবে সব তখন, “মানুষ চিনলি না-রে পাগল/ মানুষ খুঁজলি না/ পথের মাঝে মানুষ পড়ে/ তারেই দেখলি না”...
ফুলজান পুরস্কার পেলেও এমন অবস্থা সরেজমিনে সৃষ্টি হবে বৈ কি ! সে কি আনন্দ। জেলা সদরের দৈনিক পত্রিকাগুলো তাকে নিয়ে বড়-বড় অক্ষরে কতো প্রশংসা ছাপবে। ছবি ছাপবে রাজধানীর দৈনিক। সেই আনন্দ শিহরণে শরীর মন কেমন পুলকে নেচে উঠছে ফুলজানের।
ফুলজান একটা চায়ের ষ্টলে বসে। আজাদ কবরেজের বড় ছেলে আজম চোরাচালানের ব্যবসায় প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়ে শেষেমেশে এখন হাটে চায়ের ষ্টল খুলে বসেছে।
খালগাঁয়ের এই চার সড়কের মোড়ে বুড়ো বট-অশ্বথগাছের নীচে সপ্তাহে দু’দিন হাট ছাড়াও প্রতিদিন বিকেলের দিকে বাজার বসে। লোকের সমাগম মন্দ হয় না। বেচাবিক্রির ঝকমারি ঢের,পাশাপাশি বেশ ক’খানা দোকান বসে গেছে এরই মধ্যে এদিক-ওদিক। দক্ষিণ দিকের প্রাইমারী স্কুল মাঠেও হাটবারের দিন উপছে থাকে মানুষজনে। দশ/বারো গ্রামের মানুষ এসে বিকিকিনি করছে দেদারসে। ফুলজান অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে অনেকক্ষণ অবধি। আজম এককাপ চা এগিয়ে ধরে তার সামনে। ফুলজানের খানিকটা ভালো লাগে এ’ কারণে যে, এতো লোকের ভীরেও আজমের দৃষ্টি এড়ায়নি সে। তার দিকেও নজর আছে তাহলে। মনে-মনে ফুলজানের একটু অহংকারবোধ জাগে। নিজের মধ্যে নিজেকে অন্য এক মানুষে পরিণত করতে থাকে।
টিকিট কেনার সাথে-সাথে সাধারণ মানুষজন তাহলে মূল্য যখন দিচ্ছে,তখন পুরস্কারটা পেলে কি অবস্থা হবে ? বাজিমাৎ হয়ে যাবে ! সে দৃশ্য ভাবা যায় না, ফুলজান আর কিছু ভাবতে পারে না। সে দৃশ্য চোখের পাতায় বারংবার ফিরে-ফিরে আসছে, কি করবে,চোখ কি বন্ধ করে ফেলবে, ভাবতেই পারছে না এখন সে। না-না আর কিছুই সে ভাববে না, ভাবতে গেলেই মনটা হাওয়ায় ভেসে যেতে চাইছে তার। গ্যাস বেলুনের মতো আকাশে উড়ে যাবে নাকি আজ। চা’ টুকু তলানি পর্যন্ত শেষ করে এবার উঠে দাঁড়ায়।
পাশের দোকানের মালিক হাসান কামলার ছেলে হাকিম, কর্ম সংস্থান ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিয়ে হাটে মুদীর দোকান খুলে বসেছে। জায়গীর থেকে পড়াশুনা করেছিলো, কিন্তু সে-ই বাড়ির স্কুল পড়–য়া মেয়ে মিলির সঙ্গে যৌন সর্ম্পক গড়ে ওঠার কারণে একেবারে বাচ্চা চলে আসে, ছেলে নেহাৎই যখন মন্দ নয়, তখন আর কি ! মিলির বাপ ধরে পড়ে বিয়ে দিয়ে দেয় রাতারাতি। তারপর পড়াশুনা শিকেয় তুলে হাটে মুদীর দোকান খুলে দেয়। ব্যাংক লোনও কেমনে-কেমনে পাইয়ে দেয়, এখন সামলাও ঝাক্কি, ঋণ শোধ করো আর সংসারের ঘানি টানো। ফুলজান ভাবে, ব্যাটা এখন আস্তো মোষ। শ্বশুর আবার বেজায় ধুরন্ধর, শ্বশুরের টাকায় মায়া-মমতা হবে না, নিজের পায়ে নিজে পরিপূর্ণ একজন মানুষে পরিণত হোক, এমন এক প্রত্যয় জাগিয়ে তুলতেই লোন তুলে দিয়ে জামাইকে সাজিয়ে দিয়েছে দোকান। তার ওপর সরকার যখন হাত খুলে দিচ্ছে, তখন আবার নিতে এতো দ্বিধা কিসের।
হাকিমের দোকানের দিকে একবার উঁকি দিয়ে হনহনিয়ে হাতে ঝুলিটা শক্ত করে ধরে মানুষের বিশাল সমুদ্রে নেমে যায়। হাসান কামলার কথা বারংবার মনে পড়ে যাচ্ছে এখন, মানুষটা ভূমিহীন নিঃস্ব, গরুর মতো সারাজীবন খেটেছিলো, কিন্তু দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা করতে জেরবার অবস্থা হতো তার। ফুলজানের বুকের ভেতরটা কেমন হাঁপিয়ে ওঠে। সে-ই হাসান কামলার ছেলে হাকিম আজ মুদী দোকানের মালিক। একমাত্র টাকায় মানুষকে সবার ওপরের সম্মানের মানুষ করে।
লটারীর টিকিটওয়ালার মাইকের ডাক শোনা যাচ্ছে তখনো। শহর থেকে রিক্সা সাজিয়ে এনেছে, বেশ কয়েকখানা রিক্সা এসেছে লটারীর টিকিট বিক্রি করতে। চমৎকার সিজিনাল ব্যবসা বটে। ওদিকে আরো মাইকের শব্দ। সমস্ত শব্দগুলো একসঙ্গে মিলে মিশে জগাখিচুরী রুপ নিয়েছে। ঘা-পাঁচড়া-দাউদ-বিঘাউত-এগজিমা-ইঁদুর মারার বিষ-উকুন মারার বিষ থেকে শুরু করে যৌন সক্ষমের জন্য মালিশ মলম-হালুয়া অথবা জোঁক বা পান্ডার তেল, যা নিয়মিত মালিশ করলে শিশ্ন লম্বা এবং মোটা হয় বলেও মাইকে জোর চিৎকার প্রচার চলছে বিক্ষিপ্তভাবে। সে সঙ্গে বষীবরণের-স্বামীকে ঘরে ফেরানোর তাবিজ-কবজও মাইকের প্রচারের মাধ্যমে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে আবার। ওপাশে আবার পসরা সাজিয়ে বসেছে এক সাপুড়ে। বিশাল টেপরেকর্ডার মাউথপিস সবই আছে ওর কাছে। অবিশ্বাস করবার কিছু নেই, সবাই চারদিক থেকে সারি বেঁধে বসে বেশ মজার তামাসা দেখছে, সঙ্গের ছোকরা আবার বেশ খানিক ফাজিল প্রকৃতির মনে হলেও রসে একেবারে টুইটুম্বর, সবই সাজানো কথার ফুলঝুড়ি আর কি।
মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শারীরিক কসরত দেখাচ্ছে, মুখে বিভিন্ন রকম সব অদ্ভূত শব্দ করে নিজের সরু কোমর নাচিয়ে বলছে, আহা বে সিনেমার নায়িকা শাবনূর, আমারে পাগল করলি গে...
ওর কথার ধরণ শুনে ছোট-ছোট কুঁচো-কাঁচারা খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে, এখানেই ছোকরার তেলেশমাতি কারবার। এক সময় ছোকরা একটু গম্ভীর হয়ে বলে, ছেলে-পিলে আন্ডা-বাচ্চা সরে যা, আমি এখন এর্ডাল নাচ দেখাবো--কেউ কেউ ভয়ে পেছনে লুকোলো, দু’চারজনকে ঠেলা মেরে তাড়ালো। তারপরু ঝাঁকা নাকা ঝাঁকা নাক” বলে একটা গানের কলি বিশ্রীভাবে উচ্চারণ করে, কোমর মাজা নাচিয়ে উল্টোপাল্টা লাফ দিয়ে একটু থেমে বললো, সিনেমায় এভাবে কে নেচেছিলো বলেন তো ?
সামনে বসে থাকা এক মাঝবয়সি লোক মৃদূ হেসে বলে, পপি।
উপস্থিত সব দর্শক পাগলের মতো একসঙ্গে হেসে উঠলো। ফাজিল ছোকরার ইচঁড়ে পাকামি আর ভঙ্গি আরো বেড়ে গেলো মুহূর্তে। লোকটাকে ‘নানা’ সম্ভাষণ করে চোখ মটকে হেসে বললো, আমার নানা তাহলি ঠিকঠিক মতো ছহবত করে তো...
দর্শকের হাসিতে ফেটে পড়লো জটলা। আরে নানার দেখি সব কিছুতেই বেশ নজর গো, যাক নানা আসল কথা বলি, নানীর সঙ্গে মাঝে-সাঝে হয়-টয় তো--
নানা লোকটা দ্বিগুণ উৎসাহে আর রশিকতা ঝরিয়ে বলে, মাঝে-মাঝে কি বে, প্রতিরাত্রেই জবরদশ করি গে...
কারো বুঝতে বাকি নেই নানা লোকটা আসলে ওদেরই একজন সদস্য।
নানা তখন মিটিমিটি হাসে,এটাও দর্শক টানার এক কৌশল বটে।
ছোকরা তখন এক ধাঁপ এগিয়ে বলে, নানা গে একখান গোপন কথা আছে, আগে বলো কাউকে বলবে না ?
উপস্থিত দর্শক একবাক্যে বলে, কি বলো, নানা বলবে না,আরে আমরা তো আছি।
ছোকরা আবার বলে, কি বলবো আর, বিয়া তো হলো না, পলি-ময়ুরী- নাসরীনের ছবি দেখে আমার একরাত্রে সাতবার স্বপ্নদোষ হয়েছে, কিন্তু নানা,মোকাদ্দেশ কবিরাজের জব্বর হালুয়া খেয়ে আমি শক্তি ফিরে পেয়েছি, এখন আমার কোনো ভয় নেই, এখন আমি নানীর সঙ্গেও...
ফুলজান আর দাঁড়িয়ে থাকে না ভিড়ের মধ্যে। ওদিকে আবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ঢাকার ছবির গান বাজাচ্ছে, কখনো সিনেমার সংলাপ।
জ্বীন-ভূত বা উটকো আলায়-বালায়ের আছড় থেকে রক্ষার জন্য তাবিজ কবজও ইদানিং মাইকে আহবান করে বিক্রি হয়। দিনে-দিন কতো পরিবর্তন হচ্ছে। একেক সময় মানুষকে একেক দুনিয়ায় নিয়ে যায়। সপ্তাহে দুটো দিন হাটবার। এই দুটো দিন হাটুরেদের উপছানো ভিড় মন্দ লাগে না। এতো মানুষ কোথা থেকে আসে, আবার বিকেলের পরপর সব কোথায় ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যায়। কেমন এক রহস্য-রহস্য ঠেকে ফুলজানের কাছে। চড়ুঁই পাখির মতো সময় ফুরুৎ করে উড়ে চলে যায় যেন বা অনেকের কাছে মনে হয়। সময়কে রশিদ চাকলাদারের গরুর খোঁয়ারে বেঁধে রাখতে পারলে বেশ সুবিধার হতো। ওমন করে বলা নেই, কওয়া নেই,পালিয়ে যেতে তো পারতো না কখনো। ফুলজানেরও তাই মনে হয়।
হাটে এসে দীর্ঘক্ষণ বসে-বসে মানুষ দেখতে তার একরকম ভালোই লাগে, আজকে যেন বা একটু বেশি রকমই ভালো লাগছে তার। মনের মধ্যে অন্যরকম আনন্দ বড় বেশি আকুপাকু করছে এখন। বাজার করার পর আবার মনে হলো, আরেক কাপ চা খেলে মন্দ হতো না।
প্রাইমারী স্কুল মাঠের ওদিকেই বিষ্ণু কাকার দোকান দিয়েছে এরমধ্যে, অনেকদিন কোথায়-কোথায় কাটিয়ে এসে থিতু হয়ে বসেছে বলে শুনেছে, আজ একবার দেখা করবে, দেখা করে কথাও বলে, তারপর ফুলজান এক কাপ চা খায়। তিনকাল গিয়ে শেষকালে এসে ঠেকেছে তবুও লোকটার মনের মধ্যে রসের এতোটুকু কমতি হয়নি। বাঁশের বাঁকারির ওপর মাটির আচ্ছাদন দিয়ে তৈরী ষ্টল। তিনদিকে ঘেরা এবং মাথার ওপরে খড়-ছনের ছাউনী। ভেতরে তিনদিকে বেশ যতœ করে পুরানো পেপার থেকে কেটে-কেটে সিনেমার নায়িকাদের ছবিগুলো সাঁটিয়েছে। ফুলজান বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে অনেকটা সময়।
সুন্দরী মেয়েগুলো কি নির্লজ্জভাবে শরীর উন্মুক্ত করে দেখাচ্ছে ছবিতে, ফুলজানের শরীরেও কেমন এক শিহরণ খেলে যায়। যাত্রাদলের সেই খেমটাওয়ালি রোকশানার চাইতেও কি আহামরি এ’ সমস্ত মাগীগুলো,বিশ্বাস হতে চায় না কোনোভাবে। অকস্মাৎ মনটা বড় উদাসিন হয়ে ওঠে। অনেকদিন আগের ছবিগুলো স্মৃতির ক্যানভাসে ধোঁয়াটে আর কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে। কিশোর বয়সে রাবিয়া নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ফুলজানের, চঞ্চল প্রজাপতির মতো ছিলো মেয়েটা। চোখে-মুখে কিসের এক রমণীয় নেশা ছিলো, একই গ্রামে আর দশটা ছেলে মেয়ের মতো রাবিয়া-ফুলজান বড় হয়। মাথাভাঙা নদীপাড়ে কতোদিন দুজন কিশোর-কিশোরী ছুটে খেলে বেরিয়েছে নদীর মতো। আজ বড় বেশি মনে পড়ে সে সমস্ত টুকরো-টাকরা স্মৃতি।
রাবিয়ার মনটা ছিলো আকাশের মতো উদার আর বিশাল। দুজন কিশোর কিশোরী প্রকৃতির নিয়মে দিনে-দিন কলাগাছের মতো হু-হু করে বেড়ে ওঠে। পূর্ণিমার গোলগাল চাঁদও একসময় অকস্মাৎ থমকে দাঁড়ায়। একটু-আধটু করে কাছে আসতে-আসতে দুজনে দুজনার হয়ে যায়। ফুলজানের বুকের ঠিক পাজরে রাবিয়া এক স্বতন্ত্র অ¯ি—ত্ব, সে অ¯ি—ত্ব বেঁচে থাকার জন্য, বলা যায় স্বপ্ন দেখার অবলম্বন। একে অপরের গাঢ় ভালোবাসা আষাঢ়-শ্রাবণের মাথাভাঙা নদীর কুল ছাঁপিয়ে যাওয়া পানির মতো। আচম্বিতে উথলে ওঠে। ভালোবাসার হিরন্ময় বীজ একটু-একটু করে অংকুরিত হাওয়ার মুহূর্তে রাবিয়া একদিন জানায়, বাপ তার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে।
ফুলজান কিছু বলতে পারেনি। তৎক্ষণাৎ যেন নিকষ কালো অন্ধকার ছেঁয়ে ফেলে তার তাবৎ দুনিয়া। তামাম কলহ স্তব্ধ হয়ে যায়। নির্বোধ আর নিস্তল পাথরের মতো স্থির হয়ে শুধু অনিণিমেষ নয়নে তাকিয়ে দেখেছে একজন আপনজনের চলে যাওয়া। রাবিয়া দূর কোন্ গাঁয়ে কার বা বাড়ির বউ হয়ে যায়, ফুলজান আটকাতে পারেনি। শুধু চেয়ে দেখে বুকের গহীন জ্বালায় নিজে জ্বলেছে একটু-একটু করে। কারণ তার কোনো ক্ষমতা নেই আটকানোর।
চাল-চুলোহীন একজন বেকার, তার ওপর দরিদ্র এতিম ছেলের হাতে কেনো তুলে দেবে মেয়েকে কোন্ সে বাপ। অসহায় বিধবা মা একমাত্র ছেলের জন্য কতো চেষ্টা করেছিলো,যদি রাবিয়া বউ হয়ে ঘরে আসে,ছেলে তার আয় রোজগারের চেষ্টা নিশ্চয় করবে। কিন্তু রাবিয়ার বাপ দেওয়ান আজরফ মুন্সী অপমানিত করে, দূর-দূর করে বাড়ির রোয়াক থেকেই তার মাকে তাড়িয়ে দেয়। ছোটলোক নাকি কুকুরের জাত এবং সে কুকুরকে বাড়িতে কেউই জিয়াফত করে পাশে বসিয়ে খাওয়ায় না, কারণ কুকুরের সঙ্গে কোনো ভদ্র মানুষ খায় না। মাকে দেওয়ান সাহেব এ’কথা বলে, আজো স্মরণে আছে ফুলজানের।
আজ এ’মুহূর্তে মায়ের সেই ক্রন্দনরত মুখচ্ছবি বড় বেশি মনে পড়ে। একজন মানুষ কতোটা ওপরে উঠলে খোদার দুনিয়ায় এমন ধারার কথা বলতে পারে।
ফুলজান জানে না ওসব, তবে আজ স্পষ্ট অনুধাবণ করে,টাকা ছাড়া একজন মানুষের বাস্তব দুনিয়ায় বাস করার কোনো মূল্য নেই। সেইদিনই ফুলজান হাড়ে-হাড়ে বুঝেছে, মানুষ কখনোই মানুষকে সম্মান করে না, মানুষ সম্মানিত হয় টাকার বিচারে। যার যতো বেশি টাকা, তার ততো বেশি সম্মান।
টাকা হলো সকল ক্ষমতার উৎস। টাকা মানুষকে স্বপ্ন দেখায় এবং এই টাকায় স্বপ্ন নির্মানের চাবিকাঠি। এই টাকার জন্যই নিজের চোখের সামনে দেখেছে, বাপটা একরকম বিনা চিকিৎসায় চোখ বুঁজলো। ছেলে হয়েও সে কোনো উপায় বের করতে পারেনি। এই হলো তার সবচেয়ে বড় অক্ষমতা। এখনো দেখছে, বিধবা মা’টাকে, সেই কাকডাকা সাত সকালে বের হয়ে, সন্ধ্যা অবধি কি-ই না পরিশ্রম করে মুখ বুঁজে। লোকের বাড়ির কাজটা কি আর চাট্টিখানি ব্যাপার। কতো রকম হুকুম ফরমায়েশ, হাড়ভাঙা পরিশ্রম যাকে বলে আর কি, সবই তো করতে হয় মাকে।
ফুলজান আকাশের নক্ষত্রের মতো শুধু নিস্পলক চোখে তাকিয়ে দেখে,সেই বাল্যকাল থেকেই ঝলসানো গনগনে এই পৃথিবীর মাথার ওপরের সূর্যটাকে দেখছে। কখনো বড় সাধ হয় সূর্যটাকে হাতের মুঠোয় টেনে নিয়ে ছিঁড়ে খেতে। কিন্তু পারে না, কারণ সে ক্ষমতা তার নেই। পৃথিবী কি যে নিষ্ঠুর দানব সে তো জানে। আর সে কারণে পৃথিবীর কাছে, তার কোনো চাওয়া- পাওয়া নেই।
বাল্যকালে আইজুল মোলার পাঠশালায় পড়তো ফুলজান। বরাবরই সে ওই পড়াশুনায় বেশ ভালো ছিলো,মনোযোগিও ছিলো, পাঠশালা পাশ করে হাই স্কুলে যেতে পারলো না। কারণ সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা বড় জটিল আর পিচ্ছিল,কোথায় পাবে কাক্সিখত সেই পথের ঠিকানা। ফুলজানকে বাধ্য হয়ে বাপ তখন সঙ্গে নেয়। গাছ ঝুড়ানো ছাড়াও পরের বাড়ি কামলা হিসেবে গতর খাটিয়ে খেলে ভাতের কষ্ট হবে না। ফুলজান সে বয়সে বেশি কিছু না বুঝলেও অনেক কিছুই বুঝতো।
তারপর একদিন ফুলজানের বাপ চন্দনগাজীর জোতদার হাবিবুর মন্ডলের বাড়ির নারকোল গাছ ঝুড়াতে গিয়ে গাছ থেকে পা পিছলে পড়ে বিছানাগত হয়। মাজা আর বুকের পাজরের সব ক’খানা হাড় ভেঙে খানখান হয়ে যায়। সারাদিন-রাত্রি শুধু কি এক কঠিন যন্ত্রণায় কাতরিয়েছে বোবা জানোয়ারের মতো। ছেলে হয়ে ফুলজান নির্বাক চোখে তাকিয়ে দেখেছে বাপের বিভৎস সেই মৃত্যু যন্ত্রণা।
দুই/তিন মাস বিছানায় পড়ে শোচনীয়ভাবে কাতরাতে-কাতরাতে একদিন বিনা নোটিশেই যেন বা চলে গেলো। আজো সে সমস্ত দৃশ্যপট ফুলজানের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর কিছুই ভাবতে পারে না এ’মুহূর্তে। একসময় ষ্টল থেকে বের হয়ে এলোমেলো হাঁটতে থাকে ফুলজান।
রাত্রে ঘুমের মধ্যে অনেক স্বপ্ন ভীড় করে ফুলজানের মাথায়। স্বপ্নরা কখনো-সখনো খুবই বাস্তবিক হয়ে ধরা দেয়। ফুলজান ভাবে স্বপ্ন কি কখনো সত্য হয় ? রাবিয়াকে কতোদিন দেখেনি, সে কি এখনো তাকে স্মরণে রেখেছে। নিরিবিলি কখনো কি তার জন্য একটু...
স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসার সাজিয়ে নিশ্চয় খুব সুখে আছে। সুখের মহারাণী ভিক্টোরিয়া এখন রাবিয়া। চোখ একটু বন্ধ করলেই স্বপ্নের মায়াবী দোলনায় রাবিয়া উপস্থিত হয়। তার উজ্জ্বল উপস্থিতি হৃদয় কন্দরে উপলব্ধি করে ফুলজান। মনটা এখন বড় হাঁপড়ে ওঠে।
বালিশের তলা থেকে লটারীর টিকিটখানা বের করে একবার দেখে, তারপর কি যেন ভাবে একটু। টিকিটের মধ্যে রাবিয়ার পরিচ্ছন্ন মুখচ্ছবি কিভাবে যেন বা অংকিত হয়ে আছে। ফুলজান বারংবার নেড়েচেড়ে দেখে। চোখ দুটো দু’বার কচলে নেয় আবার। ওপাশের বিছানায় ওর মা শুয়ে আছে। এখনো ভোর হওয়ার অনেক বাকি, ভোর হলেই তার মাকে ছুটতে হবে ঝি-গিরি করতে লোকের বাড়ি। আর তাকে দৌঁড়াতে হবে গরু চড়াতে। ফুলজান এবার বিছানা থেকে উঠে বসে। অনেকক্ষণ কি এক ভাবনায় কেটে যায়। ভাবনাগুলো বড় কষ্ট দেয়। নাকি বুকের মধ্যে খন্ড-খন্ড দুঃখের সৃষ্টি করে। ফুলজান বুঝেও যেন বোঝে না কিছুই। পরের দিন ভোরেও ওই একই স্বপ্ন দেখে। দিন শেষ হয় আবার। আবার একটা দিন আসে। এভাবে দিন যায়, রাত্রি আসে, রাত্রি যায় আবার দিন আসে।
হাটভত্তি মানুষ যেন বা ফ্যাঁলফ্যাল করে তাকিয়ে, বিদ্রপ করে ফুলজানের দিকে, কেনো যে মানুষের চোখে এতোটুকু ভালোবাসা নেই, দারিদ্রতাকে নিয়ে বিদ্রপ করে, স্বপ্নকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে,শুধু কাঁটার মতো উপেক্ষা ছড়িয়ে দেয় চলার পথে।
বিবর্ণ ম্রীয়মান চোখ আর কখনো স্বপ্ন দেখবে না। স্বপ্ন সে তো স্বপ্ন--সে এক মৃত্যু নক্ষত্র- অগ্নিগিরি, রাত্রি শেষ হয়ে পাতলা আলো আকাশ ফেটে বের হলেই রাবিয়ার মতো ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। স্বপ্ন আর রাবিয়ারা কখনো থাকে না ফুলজানের মতো মানুষের কাছে। যাত্রাদলের খেমটাওয়ালী রোকসানার রুপ লাবণ্য আর শারীরিক সম্ভার শুধু টানতে জানে, ভালোবাসা ছড়াতে পারে না। ফুলজান আর কাউকে কোনোদিন ভালোবাসবে না, স্বপ্ন কখনো দেখবে না কোনো মেয়েকে ভালোবেসে। তাকে কেউই আজ অবধি চিনতে পারলো না, সত্যিই তো কেনোই বা চিনবে,তার তো অগাধ টাকা নেই, টাকা ছাড়া এই পৃথিবী যে অচল ! ফুলজান ওসবই জানে আজ।
হাটের মানুষগুলো যেন বা তাকে এখনো দেখছে। ফুলজান ওদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। বিশাল আকাশটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে কি এখন ? সবাই কি তাহলে তাকে দেখে ওমন বিদ্রুপ করছে ! কেনো এই বিদ্র“প ফুলজান জানে না তা নয়, তার দারিদ্রতাকে কটাক্ষ করা আর কি। তার রাঙানো স্বপ্নকে ব্যঙ্গ করছে অথবা তার নিরপরাধ স্নিগ্ধ প্রেমকে বিদ্র“প করছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ এবং প্রাণীকুল।
পৃথিবীর মানুষগুলো একজোট হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ঠাঁট্টায় ভেঙে পড়ছে। কিংবা তার ছিন্নভিন্ন রুগ্ন জীবনকে কেমন উপেক্ষা করছে। ফুলজান মাথা নীচু করে হাঁটে। সবাই তাকে এমন করে অবাক বিস্ময়ে দেখছে কেনো ? বোঝে না ফুলজান। জীবন জটিল এক অংক, ফুলজান তা বেশ জানে, কিন্তু এ’ মুহূর্তে সে স্তব্ধ পাথর। পাথরের বুক চিড়ে কোনোদিন কোনো ভাষা বেরোয় না। স্বপ্নভাঙা মানুষের স্বপ্নগুলোকে কখনো ধরা যায় না। স্বপ্ন সে এক ওই সুদূর আকাশের নক্ষত্র। সে নক্ষত্র আকাশের কোলে ঝুলে আছে। স্বাপ্নিক মানুষেরা কখনো হয়তো বা সে নভোমন্ডলে হারিয়ে নিজেকে খোঁজে। ভালোবাসার সন্ধানে দিশেহারা মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করে, এই নিপুঁণ উৎসর্গের মাঝে বাঁচে অন্য এক মানুষ। ফুলজান কি তাহলে এখনো নিজেকে সেভাবে মহাকালের কাছে পুরোপুরি তুলে ধরতে পারেনি। চিন্তার রেশের ঘোড়া আরব্যরজনীর রাজহংসের মতো রুপালী ডানায় উড়ে যায়। উড়ে যায় প্রেমের সান্নিধ্যে, স্তম্ভিত পাথুরে মূর্তি হয়ে পৃথিবীর মানুষগুলো তাকিয়ে আছে। প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায় আরেকটি স্বপ্ন, আরেকটি নদী, আরেকটি পৃথিবী--
ফুলজান বিলীয়মান সূর্যা¯ে—র কাছাকাছি দাঁড়িয়ে নিজেকে আরেকবার খুব নিবিড় ভাবে প্রত্যক্ষ করে। বিমোহিত সুনীল আকাশ তখনো সাতরঙা স্বপ্নের আঙ্গিকে দন্ডায়মান। ফুলজান আলোর সাম্পানে চড়ে জেলাই বিকাতে-বিকাতে জাপরানি দ্বীপে পাড়ি জমায়। যে দ্বীপে অনেক-অনেক স্বপ্ন বীজ গচ্ছিত আছে।