বাসটা অকস্মাৎ বিশ্রী একটা শব্দ করে দাঁড়ালো পৌরসভার প্রধান গেইটের মুখে। কয়েকজন যাত্রীর সাথে বাস থেকে নেমে ডাকঘর মোড়ের দ¶িণ দিকের রা¯—া ধরে সোজা যেতে থাকে পরীবানু। অর্জুন গাছের মাথায় দুপুরের রৌদ্দ খেলা করছে,কয়েকটা কাক কা-কা ¯^রে ডেকে যাচ্ছে,পৌরসভার গেইটের মাথায় দুটো শালিক বসে। পরীবানু এখন হাঁটছে, কাঁধে তার একটা পুটলি জাতীয় কিছু, এলোমেলো শাড়ির আঁচল বাতাসে খেলছে, একসময় ব্যানার্জীদের পুকুরপাড়ের সর“ পথের পাশের ঘাসে ধপ করে বসে পড়ে, তারপর পুটলি খুলে পানবাটা বের করে। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে একটা পানের পিঠে ঘষে। একটু দুরে তাকিয়ে দেখে আনমনে, তারপর একটু কুঁচো সুপারি আর বাবা জর্দ্দা মুরিয়ে পানটা মুখের ভেতর পাচার করে দেয়। দাঁতগুলো ¶য়ে-¶য়ে কেমন যেনো হয়ে গেছে। একটু হাসলেই দাঁতগলিয়ে মহাসাগর দেখা যায়। চোখ দুটো কতোকাল যাবৎ খাদে পড়ে আছে তারই বা ইতিহাস কে রাখে? মনে হয় মুখের চোয়াল ভেঙে গেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে। চিবুকে কালের রেখা শুধু জানিয়ে দেয় পৃথিবীর বয়স। সর“ মেঠো পথের মতো চিকন শরীরখানা মাজা ভেঙে কোনো মতো এগিয়ে যায়, যেন বা একটা আধমরা হেলে সাপ পথের পাশ দিয়ে যাচ্ছে খেয়াল মতো। শরীরে মাংস আছে কি নেই তা বোঝার উপায় নেই,মনে হয় ব্যাঙের চামড়ার মতো পরীবানুর অ¯ি—ত্বের মধ্যে একটা পাতলা আবরণ, তার শক্ত হাড়গুলোকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। কালো চিটচিটে শাড়িটা কবে যে কে দিয়েছে, তার নাম ধাম পাওয়া এখন ঐতিহাসিকদের ব্যাপার।
পুকুরপাড়ে গোলকলমি-আকন্দ-সেয়াকুল বুঁজকাঁটার ঝোপ-ঝাড়। তার আশেপাশে দু’চারটা খেজুরগাছ মাথা চাড়া দিচ্ছে, সেই খেজুর গাছের ডালে কয়েকটা পাখি লুকোচুরি খেলে বেড়াচ্ছে নিশ্চিšে—। পরীবানু পান চিবুতে চিবুতে আবার সেদিক তাকিয়ে থাকে, চোখ তার আরো উদাসীন এখন। পূবের বাঁশঝাড়ের ভেতর সর“ পথ ধরে সাইকেলে চড়ে বিষ্টুর ছেলে ভাদু এদিকে এগিয়ে আসে। পরীবানুকে পুকুরপাড়ে বসে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে বাঁ পা-টা নামিয়ে বলে, কি গো মাসি এখানে, পড়š— বেলার রোদ তখন বাঁশঝাড়ের পিঠে আলো-আঁধারিতে খেলছে। দুরে একটা কোকিল ডেকে যাচ্ছে আপন খেয়ালে। পুকুরঘাটে কয়েকজন মেয়েলোক নাইছে,বুক উদোম করে মাঝবয়সি মেয়েগুলো যেভাবে নাইছে, তাতে পরীবানুর লজ্জা লাগে। চোখে মোটামুটি এখনো দেখতে পায় বলেই,দূরের দিকে তাকিয়ে, পেছনের ¯^ৃতিগুলো মনের মধ্যে হাতড়ে হাসে কদাচিৎ। তার সময়ে সে-কি দিনই না ছিলো,কোথায় গেলো সে-সব কাল। বয়সের ভারে সব যেনো নুয়ে পড়ে আছে মহাকালের কাছে। ভাদু আবার পরীবানুকে বলে, ও মাসী এখানে বসে কি ভাবছো গো...
এবার ভাদুর কথা পরীবানুর কানে যায়। তার দিকে ¤ান হাসি ছড়িয়ে বলে, কে বাছা তুই, বিষ্টুর ছেলে ভা-দু...তারপর এক গাল হেসে উঠে।
হ্যাঁ-হ্যাঁ গো মাসী, ভাদু আমি, তা ধরেছো তো....যাক তা হাতে পুটলি নিয়ে কোথায়?
পরীবানু একটা নিশ্বাস ফেলে। কিছু¶ণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো, আর কোথায় যাবো, আমঘাটা গিয়েছিলাম, রাধী ছেলে জন্ম দিয়েই কি যেন ওই অসুখে মরে গেলো রে...ভাদু একটু হোঁচট খায়।
কি হয়েছিলো, রাধীর বর ডাক্তার কবিরাজ দেখায়নি।
অনেক¶ণ নি¯—ব্ধ থেকে পরীবানু বলে, হ্যাঁ ওই ডাক্তার! ডাক্তার বেটা বলেছিলো, গায়ে সুই ফোটাবে, সেই ভয়েই মেয়েটা ভাদু, এবার হা হা করে উঠে কেঁদে ওঠে।
আহা তাই বলে কি না নিজ হাতে মারলে মাসী,গায়ে ইঞ্জেকশন দিলে কি এমন ¶তি হতো? তা ওর বাচ্চা কোথায় হয়েছিলো? পরীবানু ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খায় একটু । কি বলতে হবে, বুঝে পাই না। একটু সময় নিয়ে উত্তর দেয় নিজের বাড়িতেই হয়। ওর শ্বাশুড়ী ভালো ধাঁই কি-না! আমিও ছিলাম, তবে হাত দেয়নি.... বয়স হয়েছে হাত-শরীর কাঁপে। কাছে পিঠের জিনিষ চোখেও দেখি না খুব একটা...
পরীবানুর কথা শেষ হতেই ভাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,ভালোই করেছো মাসী, দুনিয়া যেখানে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,সেখানেতোমরা ধাঁইগুলো গর“র গলার দড়ি দিয়ে দুনিয়াটাকে পেছনের দিকে নিয়ে বেঁধে রাখতে চাও! কি যে তোমাদের ধ্যান ধারণা, সনাতনী জ্ঞান এখন বিজ্ঞানের এই যুগে অচল মাসী...
পরীবানু ভাদুর কথা শুনে রেগে যায়। কিন্তু এ’সময়ে কিছু বলতে চাই না। বাতাসের ধাক্কায় নিমগাছের পাতাগুলো ঝিরঝিরিয়ে কাঁপে।
এক সময় ভাদু প্যাডেলে পা তুলে সাইকেল চালিয়ে চলে যায়। খুব কাছ থেকে মাইকের গান ভেসে আসে। সাজু মুন্সির মেয়ে ময়নার বিয়ের গায়ে হলুদ,ছেলে কালনার জামসেদপুরের,কাপড়ের দোকান আছে। খয়েরের বাবা আগে ফুটে ব্যবসা করে কিছু টাকা হাতিয়েছিলো, সেই সুত্র ধরেই খয়ের আজ দোকান নিয়ে বিশাল সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেদারসে ব্যবসা করছে। তাছাড়া জামসেদপুরে খয়ের ভি.ডি.ও হল দিয়েছে, বছর খানিক ধরে। সকাল থেকে রাত্রি অবধি বাংলাদেশ-মুম্বে-কলকাতা- পাকি¯—ানের সুপারহিট ছবিগুলো চলে, কোনো-কোনো দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী কখনো-সখনো কেনিয়া-কোরিয়া-সুইডেন-ডেনমার্কের বু-ফ্লিম চালানো হয়। সে চার্য আবার অনেক, বিশেষ দর্শকরা অবগত আছে। পরীবানু অনেক আগে থেকে জানে কালনার ময়েজ উদ্দীনের বড় ছেলে খয়েরের সঙ্গে ময়নার বিয়ের খবর। খয়ের হওয়ার সময় পরীবানুই যে ওর মায়ের কাছে ছিলো,খয়েরের জন্মের নাড়ি কাটে। শুধু খয়েরেই নয়,ময়েজ উদ্দীনের বৌয়ের তিন ছেলে পাঁচ মেয়ে সব কটি পরীবানুর হাতে হয়। শেষেরটা হওয়ার সময় খয়েরের মায়ের প্রাণ আর ফিরলো না,তারপর চিরকালের জন্য নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, সেই হলো পরীবানুর হাতে প্রথম মরা। আর সেই জের চলছে পরীবানুর উপর আজ অবধি,মুখ বন্ধ রেখে সবই সহ্য করে। এছাড়া তার কি বা উপায় আছে। ময়নাও তো তারই হাত দিয়েই পৃথিবীর আলোতে এসেছে,ওর সব ক’টি ভাই-বোনও পরীবানুর হাত ধরে জীবন পেয়েছে। বিষ্টুর বউ যতদিন বেঁচে ছিলো বড় ভালোবাসতো পরীবানুকে। কিন্তু এখন সময় বড় খারাপ।
পরীবানুর মন উদাস হয়ে যায়, কোথায় গেলো সেসব দিনগুলো, দিনকাল কিভাবে পাল্টে গেলো বোঝে না পরীবানু। আজকাল ছেলেছোকরাগুলো কি সব বোঝে? পুর“ষ ডাক্তারের হাতে, ছিঁ-ছিঁ এ কি দিনকাল... মানুষের হায়া-শরম সব কি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে,এ’কোন কাল এসে পড়লো,একেই কি বলে কলিকাল! মনে মনে পরীবানু অনেকদিন ভেবেছে কথাগুলো। পরীবানু নিজের মনেই বক-বক করতে থাকে। দূরে তাকিয়ে দেখে আকাশটাকে একপলক। শাšি—পুরের আকাশ আর বাতাস তার কাছে কতো পরিচিত। কয়েকদিনের ব্যবধানে মনে হচ্ছে,পরিবানু কতোদিন শাšি—পুর থেকে দূরে সরে ছিলো। এখানে এই মাটির বুকে শেষ জীবন কাটিয়ে দেবে আর যতদিন বাঁচে,কোথাও যাবে না কোনোদিন সে। কোথাও গিয়ে কি নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারবে? পারবে না ক¶নো,আর পারবে না বলেই,সেবার হিন্দু –মুসলমানের জাতিগত ধুয়ো তুলে দেশটা ভাগ হলো, মুসলমানদের একটা দেশ হলো,¯^াধীন দেশ,কিন্তু পরিবানু নিজেকে শুধুমাত্র মুসলমান পরিচয় দিয়ে হিন্দু দেশ ছেড়ে মুসলমান দেশে ফিরে যায়নি। কেনো যাবে? কোথায় যাবে। যাওয়া বললেই কি যাওয়া যায়,মানুষ কি কখনো ইচ্ছের বির“দ্ধে কোথাও যেতে পারে? পরিচিত আকাশ বাতাস মাটি দেশ মানুষ নদী গাছ গাছালি ছেড়ে কেনো যাবে? নির্বাসন কি সবার জন্য? পরীবানুর ¯^ামীও যায়নি। অনেক চিš—া শেষে হিন্দুদেশেই থেকে যায়। নতুন দেশ নতুন পরিবেশ নতুন মানুষের কাছে যেতে মন সাঁই দেয়নি। মনে মনে ভেবেছে শুধু কি ধর্মের জন্যে মানুষ মানুষের শত্র“ হয়!
পরীবানু এখন আর নিজের কপালের দোষ দেয় না,মনটাকে শক্ত করে বেঁধেছে। মনে মনে শুধু বলে, আলাহ্ যা ভালো চেয়েছেন, তাই করেছেন,এছাড়া তার বা কতোটুকু ¶মতা। এদেশের মাটি আর মানুষগুলো তাকে আজো ভালোবাসে বলেই যে সে বেঁচে আছে। পৃথিবীর আলো-হাওয়া পানি পেয়ে বৃ¶ যেমন বাঁচে,তেমনি পরীবানু বেঁচে আছে। আর সেজন্য কখনো সখনো বৃ¶ের সাথে কথা বলে। এই গাছগুলো যেন তার সাথে অতি আত্মীয় হয়ে গল্প করে, আবার প্রাণ খুলে হাসে।
পরীবানুর বিয়ে হয়েছিলো এক বনিয়াদী ঘরে,¯^ামী বেচারা তাকে ভালোবাসতো প্রচন্ড। লংকাকান্ড বাধিয়ে ফেলতো চোখের এতটুকু আড়াল হলেই। সেই ¯^ামী গোবেচারা একে একে চারটে সš—ান দিয়েছিলো তাকে। কিন্তু পরীবানু একটাকেও বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। জন্মের পনেরো দিনের মাথায় কোল ছেড়ে চলে যায়। অনেক তাবিজ কবজ করেছিলো ওর ¯^ামী-শাশুরী মা। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হয়নি,চারটে সš—ানই তাকে ফাঁকি দেয়।
লোকে বলতো, কোলের দোষ...কেউ বা বলতো,বুকের দুধে বিষ...অনেকে আবার আরেকটু বাড়িয়ে বলেছে,পরীবানু রা¶ুসী, ওই সš—ানদের খায়...পরীবানু ওদের কথা শুনে শুধুই কেঁদেছে গুমরে-গুমরে। নিজের সম¯— প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে তাকিয়ে দেখেছে বোবা চোখে,ওর চোখের ভাষা কেউ বোঝেনি কোনোদিন। বুঝেছে শুধু ওই পুকুরের মাঝখানে পোঁতা বাঁশের ওপর বসা মাছরাঙ্গা পাখিটি। অথবা বুঝেছে আম-জাম নারিকেল-নিম তাল-খেজুর গাছ আর বাঁশঝাড়ের পাতায়-পাতায় ছড়ানো রূপালী রোদটুকু।
একদিন বেচারী ¯^ামী মাঠ থেকে কাজ সেরে এসে মেঝেতে বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে। তারপর দু’দিন কালোজ্বরে অজ্ঞান থেকে তিন দিনের দিন চোখ বুঁজলো চিরকালের জন্যে। পরীবানুকে কাফনের মতো শুভ্র শাদা শাড়ি পনিয়ে লোকটি ধেঁই ধেঁই করে চলে গেলো সীমাহীন আকাশের কাছেকাছি,কি এক অভিমানে? পরীবানু কিছুই জানে না,শুধু আকাশের কাছে এখন প্রশ্ন তার,অনেক অনেক প্রশ্ন! রাধী তার বোনের মেয়ে, সেই ছোট বয়েসেই ফুলিয়া থেকে নিয়ে আসে। রাধীর মা যেদিন হঠাৎ মরে যায়, কি এক পঁচানো রোগে। কবরেজ বলেছিলো, বাতাসের দোষ...হেকিম বলেছিলো,রোগটা বড় মারাত্বক হে-কিন্তু খরচার কারণে রাধীর বাপ আর চিকিৎসা করালো না,শেষে ওই গাছ-গাছরা তাবিজ কবজ করেও কিছুই হলো না... সেই রাধীকে কসাই বাপ রাখতে চাইলো না। মুখের উপর বলেই দিলো,এই আতুরে বাচ্চাকে নিয়ে কি আমি আমার জীবন যৌবন মাটি করবো...পরীবানু নিজ চোখেই দেখলো এক পাষন্ডকে। মনে মনে ভাবলো, এও বাপ একজন তাহলে।
সন্ধ্যার মুখোমুখি এখন। বাড়ির লাউমাচার কাছে দাঁড়িয়ে পরীবানু আকাশ দেখে। আকাশের সাতরঙটা পরপর ফুটে উঠে এবং তা সন্ধ্যে অবধি লেগে থাকে আকাশের বুকে। পরীবানুর আজ কেউ নেই পৃথিবীতে,¯^ামী-সš—ান-রাধী সবাই তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। কি নিষ্ঠুর পৃথিবী! এতবড় এই পৃথিবী কিন্তু পরীবানুর আপন কে আছে?
লাউ মাচায় ঝুলে আছে কয়েকটি লাউ, গতবারের তুলনায় এবার লাউ বেশি এসেছে গাছে। পাশের বাড়ির জুলেখার মাকে দায়িত্ব দিয়ে রাধীকে দেখতে গিয়েছিলো,পাড়ার হা-হাভাতে মেয়েরা লাউ কি লাউয়ের কঁচি পাতাগুলো নিঃশেষ করে ফেলতো, কুঁয়োর কাছে পেয়ারাগাছের নিচে কয়েকটা মুরগী ঘুরে বেড়াচ্ছে এলোমেলো। বড় লাল মোরগটা রাধীকে দেবে বলে সেবার কিনেছিলো নয়নতলীর হাট থেকে,কিন্তু একবার এসে রাধী দেখেই বলেছিলো, থাক না মাসী,তোমার তো সব মুরগী... মোরগটা এখানে বেশি আনন্দে আছে। রাধীর কথা মনে হতেই পরীবানুর চোখ পানিতে ভরে যায়। শাšি—পুরের আকাশেও মেঘ আছে,অকস্মাৎ কেঁদে ফেলবে কোন সময় বলা মুশকিল। বাতাস একটু-একটু বেশ জানান দিচ্ছে গায়ে,কুলগাছের পাতারা দুলছে,কলাগাছের ছেঁড়া-ছেঁড়া পাতাগুলো শিরশির করে বাতাসের সঙ্গে কথা বলছে যেন বা, অনেক দুরে একটা কাক ডাকছে থেকে-থেকে। হঠাৎ হাঁপাতে-হাঁপাতে উত্তরপাড়ার নজির শেখের মেজোছেলে ফরিদ শেখ পরীবানুর বাড়ির ঝাঁপ ঠেলে উঠোনের চৌহদ্দিতে দাঁড়ালো,বাঁশঝাড়ের কচি বাঁশপাতার মতো ওর দুটো ঠোঁট কাঁপছে। পরীবানু জানে ফরিদের বউ রাবেয়ার বাচ্চা হবে,বেশ ক’দিন পরীবানু গিয়ে রাবেয়ার তলপেট মালিশ করে দিয়ে এসেছিলো এবং বাচ্চা ভালো ভাবে আছে জানিয়েছে পরীবানু । এও অবশেষে বলেছে পরীবানু,সে এ কাজ করতে পারবে না। চোখে ভালো মতো না দেখতে পেলে এ কাজ করা উচিত না,এমন কি পরীবানু থানার হাসপাতালে ভর্তির কথাও বলেছিলো ওকে। ফরিদের আগমনে বুঝে যায় পরীবানু ম¯— বড় বিপদ হয়েছে রাবেয়ার,আত্মচিৎকার দিয়ে ফরিদ বলে,মাসী সর্বনাশ হয়ে গেছে গো ...
পরীবানু হাহাকার করে উঠলো, কি সর্বনাশ হলো বাবা....
হাঁপাতে হাঁপাতে ফরিদ বলে,রাবেয়া চিৎ হয়ে পড়ে গেছে মাথা ঘুরে...
কি ভাবে হারামজাদী পড়লো,আহা রে ওর তো এ’মাসেই হওয়ার ...
কাঁদো কাঁদো ¯^রে ফরিদ বলে, ঘরের দাওয়া থেকে নামতে গিয়ে কান্ডটা হয়ে গেলো,রক্তের বন্যা ঝরছে মাসী,মনে হয় রাবেয়া...মাসী তুমি চলো,একটু দেখো।
রাত্রের নিশাচর জোনাকিরা এখন বাসর সাজিয়ে বসেছে চারদিকে। আম গাছের মাথায় ওদের আসর,চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কাছের মানুষকেও দেখার উপায় নেই,পাতার মর্মর শব্দ বাতাসে, কি একটা পতঙ্গ থেকে-থেকে ডেকে যাচ্ছে। পরীবানু কান খাড়া করে কিছু¶ণ শুনে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিনয়ী কন্ঠে বললো, না-না বাবা আমি পারবো না, তুই ডাক্তার দেখা। তাছাড়া আমি চোখে আর তেমন দেখতে পাই না, তুই...
ফরিদ এবার আরো অনুরোধের সুরে বললো, কে-কি বললো তা বিশ্বাস করি না মাসী । জন্ম-মৃত্যু সবই তো আলাহর হাত। কেউ কি ইচ্ছা করে মারে... চলো মাসী, তোমার পায়ে পড়ি,তাছাড়া কারিমন খালা নছিমন চাচী তো আছে তোমাকে সাহায্য করবে। তোমার পাকা হাত...
মাঝ প্রহরেই রাবেয়া একটা ফুটফুটে চাঁদের থালার মতো ছেলে বিয়োলো। পরীবানু ফোঁকলা দাঁতে হাসে,চারদিক আলো যেন বা ঝলসে পড়ছে,কোথায় ছিলো এত আলো ? রাত্রের কালো অন্ধকার ক্রমে-ক্রমে কেটে যাচ্ছে। হঠাৎ এবাড়িটা ভুলে যায় সম¯— কষ্ট যন্ত্রনা।ওর চোখে এখন ভালোবাসার সীমাহীন হিলোল। রাবেয়াকে ঘিরে আজ এ বাড়িতে বড় আনন্দ উৎসব বসেছে। শেষ প্রহরে রাবেয়ার জ্ঞান ফেরে,তার পাশে শুয়ে আছে এক রাজপুত্র। এ’রাজপুত্রকে আজ থেকে প্রাণ ভরে আদর করবে। ভালোবাসায়-ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে রাজপুত্রকে। পরীবানুর চোখে অশ্র“ জমে,তার চোখের ভাষা কেউ বোঝে না। রাবেয়ার ঠোঁটের পাশ দিয়ে একটু হাসি চলকে যায়। সদ্য ফোটা লাল গোলাপের মতো কচি শিশুর ঠোঁট দুটো রক্তিমাভা ছড়ানো,আর চোখ দুটো যেন শেষ প্রহরের তারকা। এখন সে ঘুমোচ্ছে, রাবেয়া তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখে। সীমাহীন আনন্দ আর সোহাগ বুক জুড়ে তার । অনেক সাধনায় সে বস্তু পাওয়া যায়, তার মুল্য অনেক অনেক বেশি। প্রথম প্রসুতির হাসিটুকু দেখে আর দশজন ধাঁই এর মতো পরীবানুর মনটা কি এক আনন্দ আবেশে জড়িয়ে যায়। এক সময় রাধীর কথা মনে পরে তার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পারে না কিছুতেই,কান্না যেন বোবা পাথর, শুধু তাকিয়ে দেখে। সম¯— কান্নাগুলি মনে হলো হিমালয়ের বরফ হয়ে গেছে। আর কি কোনোদিন গলবে না,পরীবানু কাঁদতে পারে না। এ’বাড়ির কোন বউয়ের এই প্রথম সš—ান। আর সেই কারণে বাড়িটাকে সবাই যেন বা আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছে। পরীবানুর মনটা কলার খোসার মত এলিয়ে যায়।
হঠাৎ এক সময় দমকে দমকে হাসতে থাকে। পরীবানু আর কাঁদতে পারে না, হয়তো বা পারবে না কোনদিন,সে পাকা ধাঁই। চোখে তেমন দেখতে না পেলেও পাকা হাতের কারণে আজ পরীবানু সিদ্ধি লাভ করেছে। মনটা আকস্মিক আনন্দে ভরে ওঠে কানায়-কানায়। ধাঁই প্রয়োজন তাহলে ফুরিয়ে যায়নি। মনে মনে কি যেন ¯^তন্ত্র আবেগে হারিয়ে যায়। ফরিদের মত ছেলেরা মানিক চিনতে ভুল করে না। সমাজে তাহলে মানিক চেনার অভাব নাই। কাঁচকে মানিক মনে করেনি তাই তার এত কদর।
এখন পরীবানুর চোখে ভেসে আসছে ¯^প্ন, হাজার হাজার ¯^প্নের লাল নীল গোলাপী প্রজাপতি। রাবেয়ার হাসি আর সদ্য প্রসুত শিশুর ঠোঁট দেখে পরীবানুর বুকে এক অন্যরকম আনন্দ জাগে। এ আনন্দ নতুন চর জেগে ওঠার মত মনে হলো। #####