ফুটপাতের জনস্রোতের ভেতর দিয়ে ফটিক এখন ছুটছে, এতো মানুষ শহরময়, শহরটা যেন হাঙর, পারে তো একেবারে গিলে খেয়ে তৃপ্তি মেটায়, কিন্তু খাচ্ছে কই, তাই তো মানুষ শুধু বাড়ছে, কতো যে মানুষ এ’ শহরে কে বা বলতে পারে, মানুষের পদভারে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে দানবের মতো শহরটার শরীর, ফটিকের মনে হয় মানুষগুলো শহরটাকে বড় বেশি সংকুচিত করে রেখেছে, আর তাই নিঃশ্বাস নিতে এতো কষ্ট। ওদিকের ব্যাংক সড়কের ডান কোণ ঘেঁষে ফটিক ছুটছে লোকালয়হীন অরণ্যের দিকে, মস্ত এই শহরে অরণ্যের বড় অভাব, কোথায় এতোটুকু নীলাকাশ, কোথায় যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি, বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করে, চোখে জ্বালা ধরে, আর কতোটা সময় এভাবে দৌঁড়াবে সে, জানে না কিছুই কতোক্ষণ এই শহর আটকে রাখবে তাকে এমনভাবে।
মায়ের চোখ দুটো বড় বেশি মনে ভাসে, কাজলা দীঘির স্বচ্ছ সেই কাকচক্ষু পানির মতো মায়ের চোখ দুটো, কতোদিন মায়ের মুখটা দেখেনি, শহরের কাঠ-ইট-লোহ অর্থাৎ কংকীটের আচ্ছাদনের মধ্যে অনেকটা ভুলেই গিয়েছে যেন, বিষ্ণুপুরের জোড়াদীঘির ওপারের তরীর কথাও ভুলে ছিলো, তরী এখন কি বা করছে, ওর বাবা তো দেশ ছেড়ে একেবারে চলে যাবে কোথায় এমন একটা সংবাদ পেয়েছিলো, এমন কোথায় আছে তারা! তরী কি আর ভোরের সেই শুভ্র ফুলের মালা গাঁথে একলা বসে, সেই ফুলগুলো কতো সতেজ ছিলো ঠিক ওর মুখটার মতো, কতোদিন দেখা হয়নি ওর সাথে, অনেক-অনেকদিনই তো হয়ে গেলো, কি যে শহর সব কেমন ভুলিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু এখন সে মুক্ত, আকাশের ওই পাখির মতো যেদিকে ইচ্ছে সেদিক সে উড়ে যাবে, কেউ বাধা দেওয়ার নেই।
হঠাৎ বুকের কাছে হাত দিয়ে ফটিক দেখে তার মাদুলীখানা নেই, শহরের কোলহলে ভিড়-ধাক্কায় কোথায় বা পড়ে গেছে কার সঙ্গে টান লেগে। সত্যপীরের মাজারের মাদুলী, সে’ বার শিবসংক্রান্তি মেলার সময় মা সত্যপীরের মাজার থেকে মাদুলীটা এনেছিলো, কি জন্য যে মা ওই মাদুলীখানা এনেছিলো তা আজো ফটিক জানে না, বুঝেছিলো হয়তো তার ভালোর জন্যই মা এনেছে, কিন্তু মাদুলীখানা গলায় দেওয়ার ক’ দিনের মাথায় ফটিকের শহরে আসার মোক্ষম সুযোগ এসে যায়, মা তখন হেসে বলে, সত্যপীর মনবাসনা পূরণ করেছে, তোর একটা হেল্লা হলো রে বাবা। মাদুলীর এতো শক্তি তা তো জানতো না, কিন্তু একেবারে হাতেহাতে ফলে যাওয়া দেখে সেও কম আশ্চর্য হয়নি।
তবে হেল্লা আর কি, শহরে গাড়ির হেলপারি করা, কিন্তু আর না, এই কাজ তার ভালো লাগে না, কতোদিন ধরে শহরে পড়ে আছে এই গাড়ির চাকার সঙ্গে, আজ যেন মুক্তির আনন্দে মুক্তবিহঙ্গ সে, এই শহরের লোকারণ্য থেকে মুক্তির উল্লাসে ফিরে যাবে নদী ঘেরা ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা চিরসবুজ সেই বিষ্ণুপুর গ্রামে, প্রজাপতির রেণু মেখে হারিয়ে যাবে সুদূর কোথায়! মনে পড়ে কোকিলা মাঝির কথা, কতোদিন ওর নায়ে চড়ে বেড়িয়েছে ফটিক, নদীর দেশের ছেলে সে, তার কি আর শহরে মন টেকে, বুকের মধ্যে মাছের মতো কলবল করে কতো না বলা কথা, সব কথা সে বলবে মাকে গিয়ে, আর তরীকে তো কতো কথাই না বলবে, কোকিলা মাঝির ভরাট কন্ঠের গান এখনো কানে ভাসে, ওর গান যে কতোকাল শোনেনি, মনটা কেমন করে ওঠে। ওমন সুর কি আর হয় এ’ সব শহুরে গানে, শহরের গান তো গান নয় যেন কাকের চিৎকার নাকি অকারণে ড্রাম বাজানো, কানের পদ্যা ফেটে যাওয়ার যোগার হয় আর বুকের ভেতর দমদম করে ওঠে, তখন কোকিলা মাঝির গানের কথা মনে হয়, নাহ্ আর সে ফিরে যাবে না, গ্রাম তাকে ডাকছে, কতোকালের চির পরিচিত গ্রাম, ওমন মায়া ভরা প্রাণ শীতল করা বাতাসের গ্রামখানি কি পৃথিবীতে আর আছে, নাই- নাই, আর তাই তো মন টানে, বলে, চল্ রে পাগলা গ্রামে যাই/ গ্রামে আছে হাটবাজার, আর আছে ভালোবাসার মন্ডা-মিঠাই...
ফটিক ভাবছে মাকে এতোদিন সে কিভাবে ভুলে ছিলো, মাও তো কোনো খোঁজ-খবর নেয়নি, বাপটা সে’বার মাকে মারতে-মারতে তাড়িয়ে দিলো, কতোদিন এভাবে মানুষ সহৃ করতে পারে, ওর মা তো অনেকদিন তারপরও সহৃ করেছে, ফটিক শুনেছিলো বাপটা নাকি আবার বিয়ে করবে, এ’ জন্য মাকে আর ভালো লাগছে না, মা তো সে’ বার ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসে নানাবাড়ি, নানা তো খুবই ভালো মানুষ কিন্তু হতদরিদ্র্য, তারই দিন চলে না, তারওপর একটা অন্ধ-আধাপাগল মেয়ে ঘাড়ে, সে’সঙ্গে আবার আরেকটা স্বামীছাড়া মেয়ে সন্তান নিয়ে, মা চেয়েছিলো ফটিকের একটা কিছু হলে জীবন বেশ চলে যাবে, কিন্তু ফটিক তো কিছুই করতে পারলো না। শহরে এসে কি করবে, তার চেয়ে গ্রামে গিয়ে মাটি কাটা কাজ করবে, নয়তো বাড়ির ধারে যে ড্যাঙড়হাট বাজার প্রতিদিন দুপুরের পর বসে, সেখানে ভাজাপোড়ার দোকান খুলে বসলে বেশ পয়সা রোজগার করতে পারবে, মা-নানা-খালাকে নিয়ে ভালোই চলে যাবে। শহরের চেয়ে গ্রাম অনেক ভালো, সেখানে কোনো কষ্ট নেই, মানুষের গালাগাল শুনতে হয় না, কানমোলা থেকে মাথায় গাট্টা খেতে-খেতে মাথায় আলু জমেছে কতো, তার চেয়ে গ্রামে যদি কোকিলা মাঝির সাথে পারানির কাজে লাগে, নিশ্চয় পেটে ভাতের পয়সা দেবে এবং মায়ের সংসারটাও চালাতে পারবে, তারপর আছে শীতল গায়েন, সে’বারও কতো করে বললো, চল্ রে পাগলা, দূরে গিয়ে ঘুরে আসি...
সে আবার কোথায় গো!
মনের সিংহাসনে...
হাসতে থাকে ফটিক, কতো সুন্দর করে কথা বলে শীতল গায়েন। ভাবতে থাকে অনেকটা সময়।
যাবি তো বল্ না, দেবো কিনে কৃষ্ণনগরের খেলনা...
সে কোথায় গায়েন?
সঙ্গে যাবি, দেখতে পাবি, মজার-মজার শহর-নগর, হাট-বাজার আর গ্রাম-বন্দর---
ভারি সুন্দর কথা বলো তো!
কথা কি আর বলতে হয়, কথা দিয়ে কথা সাজায়, যাবি রে পাগলা, ফিরবে শেষে বাদলা...
যাবো তো বটে, কিন্তু এবার না গো!
তারপর তো সত্যপীরের তাবিজের গুণে শহরে চলে আসা, যাওয়াটা আর হলো না ওমন লোকের সঙ্গে থাকলে খাওয়া-পড়ার যেমন কোনো চিন্তা নেই, তেমনি বেশ হাসি-আনন্দের মধ্যে কাটবে সময়। শীতল গায়েন লোক ভালো, গ্রাম-গঞ্জে নগরে-বন্দরে যাত্রার গান করে বেড়ায়, বছরের দশ মাসই কোথায়-কোথায় ঘুরে বেড়ায়, ওর মেয়ে পদ্ম সে’ বার ত্রিবেণীসঙ্গমের মেলায় হারিয়ে গেছে, অনেক খোজাখুজি করেও কোনো হদিস মেলেনি আজো, সত্যিই কি পদ্ম হারিয়ে গেছে, নাকি এতোদিনে ফিরে এসেছে কোথা থেকে, ফটিকের একই বয়সি, দেখতে বেশ ফুটফুটে, তরীরা যদি দেশ ছেড়ে চলে যায় আর পদ্ম ফিরে না আসে, তাহলে তারই বা ফিরে যাওয়ার কি দরকার, ট্রেন চলছে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে, নদী-নালা সব কিছু দূরে ফেলে ট্রেন ছুটছে যেন বাতাসের সঙ্গে, অনেক দূরে সবুজ গাছের ভেতর বাড়িঘরগুলো ছবি হয়ে ভেসে উঠেছে, সিনেমায় দেখা ছবি যেন, শহরের সড়কে গাড়ির হেলপার হওয়া কঠিন কাজ, সেই কঠিন থেকে সে মুক্তির আনন্দে নেচে-নেচে বাড়ি ফিরছে, কতোদিন যেন সে বুক ভরে শ্বাস নেয়নি, আজ তার তাই ওমন খুশি, সেই খুশি ওর চোখে-মুখে ছড়িয়ে যায়। গ্রাম যেন শুধু গ্রাম নয়, মায়ের শীতল বুক, যে বুকে শুধু তার স্থান ছিলো, কতোকাল মায়ের ওই মুখের হাসি দেখেনি, আচলের পরশ গায়ে নেয়নি, কতোদিন হলো ভুলে গেছে সব যেন ফটিক।
বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে ফটিক, ওই তো বাড়ি তাদের, সবুজে ছাঁওয়া ছোট্ট গ্রাম, কতো পাখি ডেকে যায়, পাখিদের গানে-গানে মুখর থাকে সমস্ত গ্রাম, এই তো ফটিকের পরিচয়, বাড়ির ধারে এসে দেখে সেই বাড়ি সে’ রকম নেই, অনেক পরিবর্তন হয়েছে, ইটের প্রাচীরের ওপর নকশাকাটা টিনের চালা, কোথায় পেলো মা এতো টাকা, বাড়ির সামনে যে উঠোনটুকু ছিলো, সেখানে বেশ পরিচ্ছন্ন করে পরিকল্পনা মাফিক সবজির বাগান হয়েছে, বাঁশের বাঁকারি দিয়ে মাচা, কচি-কচি সবুজ কতো শশা ঝুলে আছে, ফটিক দেখে বেশ মনোযোগ দিয়ে, মন কেমন যেন হয়ে ওঠে, বাড়ির ভেতর ঢুকে দেখে বিশাল সেই রোয়াকে লাল পাড়ের বাহারি শাড়ি পড়ে ওর মা দাঁড়িয়ে, ফটিকের চিনতে বেশ কষ্ট হয়, এতো কঠিন কেনো ওই মুখের হাসি, সেই হাসিটুকু কোথায় গেলো, মা ওকে হাত বাড়িয়ে ডাকে, এতোদিনে বাবা তোর মনে হলো মায়ের কথা...
ফটিক হোঁচট খায়, কি বলছে তার মা, ওমন সুরে তো কখনো সে শোনেনি মায়ের কথা। মা কি তবে সেই সুরে কথা বলতে ভুলে গেছে, মাকে চিনতে কেমন যেন একটু কষ্ট হয়, বিকেলের মোলায়েম সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, বাড়িটা কেমন শান্ত হলেও অনেকটা অপরিচিত লাগে, নানা-মামা কেউ কি নেই এখন, কোথায় গেলো সবাই, হঠাৎ বড় ঘর থেকে সাবের মুন্সীর বড় ব্যাটা হেকমতউল্লা বেরিয়ে আসে, ফটিক বেশ চেনে ওকে, মানুষটা অনেক খারাপ, ঘরে তিন তিনটে বউ, ধানের কারবার করে বেশ টাকা কামিয়েছে, চাতালের মেয়ে-বৌদের নিয়েও নাকি বেশ রটনা আছে, ওই কিনা মায়ের সঙ্গে, ফটিক থেমে যায়, নিজেকে অনেক কথা ভাবতে দেয়, মানুষটা কে তাহলে, আচমকা লোকটা বলে, আরে ফটিক যে, তা শহর থেকে বেশ কামায়-ফামায় করে বাড়ি ফিরলে বুঝি...
ঠিক সেই সুরেই মা কথা বলে উঠলো, ছেলের মুখটা শুকিয়ে কেমন আমসি হয়ে গেছে দেখো, তা বাবা তোর নানা তো মরে গেছে, খালাটাও কোথায় পালিয়ে গেছে।
মায়ের কথা ফটিকের কোনো মতে বিশ্বাস হতে চায় না, এতো কিছু হয়ে গেছে অথচ সে কোনো খবর পায়নি, তা কি সম্ভব, এতো ঘটনা ঘটলো কিভাবে, নানা মরে গেলো, ভালো মানুষ আধাপাগলা অন্ধ খালাটাও চলে গেলো, নাকি ওই হেতমত সবাইকে সাবাড় করে মাকে দখল করেছে এভাবেই। মা আবার বলে ওঠে, ওই তোর বাপ হয় ব্যাটা, তোর জন্য প্রায় আকুল হয়ে থাকে, আজো তোর নাম বলছিলো।
বাপ হয় শব্দটা শুনে ফটিকের কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দেয়, তাহলে ওর মা তাকে শহরে পাঠিয়ে বিয়ে করেছে, এখানে যে এতো বড় একটা ব্যাপার ছিলো তা তো ধরতে পারেনি, নিজের বাপ মেরে-পিটিয়ে তাড়িয়ে দিলো আর তারপরই ফটিককে শহরে হেলপারি করতে পাঠালো মা, এবং সেও হয়তো হেকতমউল্লার ফন্দি ছিলো, খালাকে তাড়িয়েছে, নানাকে গলা টিপে মেরে ফেলেছে কি না তাও তো বলা যায় না। মানুষ তাহলে ইচ্ছে করলে সবই পারে, সেই হেকমত যে কি না একবার ফটিককে চাতালের সেই ছোট্ট ঘরটাই নিয়ে বলেছিলো, তোর লুঙিটা তুলে হামাগুড়ি দিয়ে বস তো...
ফটিক বলে, তুমি একটা ইতর, ঘরে তোমার বউ আছে আর তুমি আমাকে খারাপ করবে।
ধ্যাৎ পাগলা, খারাপ কি রে, মজা আছে।
তোমার মজার পাছায় লাথি মারি, বৌয়ের কাছে যাও।
বৌ কি রে বলদ, তোর মধ্যে যাবো, দিবি কি না বল।
তোমোর ইয়ে কেটে দেবো...
কেটে দিবি তো দেনা রে চোদনা।
তারপর বেশ জোরজবস্তি করে চালাঘরের ভেতর, সেদিন ছিলো বৃষ্টির দিন, তবে ধানের মৌসুম ছিলো না, চারদিক বেশ খা-খা করছিলো, মানুষজনও তেমন ছিলো না, হেকমতউল্লা ছুটে গিয়ে ফটিকের লুঙিতে টান দিয়ে খুলে ফেলে, হাতের কাছে ঘরের মধ্যে যে বাঁশখানা ছিলো সেটা দেখিয়ে ভয় দেখায়, যদি তুই পালানোর চেষ্টা করিস তো সাপের মতো বাঁশ দিয়ে তোকে মেরে ফেলবো। সেদিনের কথা আজো স্মরণে আছে, তারপর ফটিকে ফন্দি করে কিভাবে বের হয় সেটা আরেক কাহিনী। সেই মানুষটা কিনা এভাবে শোধ নেবে ভাবেনি, সেদিন শুধু সাপের মতো ফসফস করে উঠেছিলো, আর তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে এতোটুকু হয়ে গিয়েছিলো, আজো মনে আছে ফটিকের, ধস্তাধস্তি করে শেষপর্যন্ত ফটিককে একেবারে হাতের কাছে পেয়ে গিয়েছিলো, মাতাল এবং ক্ষুধাত্ব একজন পশু বলেই মনে হয়েছিলো, ফটিক যখন দেখে আর কোনো উপায় নেই, জানোয়ারটা তাকে ছাড়বে না, একটা পথ বের করতে হবে, তখন সে হেকমতউল্লার লুঙির ভেতরের জিনিসটাকে আদর করবার নাম করে ঠিক একসময় অন্ডকোষ দুটো টেনে চিপে-দাঁত দিয়ে কাঁমড়ে ধরে, পারে তো দু’ হাতে টেনে নিয়ে ওই দুটোকে ছিড়ে খায়, রাজহাঁসের ডিম দেখে যেভাবে গৃহস্থ আনন্দে আত্মহারা, সেভাবেই ফটিক নিজেকে নিয়ে পালিয়ে আসে ওই দুটো জিনিশ নিয়ে। দৃশ্যটা মনে হতেই থুতু ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে ওর মুখে, সে ঘটনা কাউকে বলেনি, হঠাৎ দেখে চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই কৃর্তি, সেই জানোয়ারকে কিভাবে বাপ বলবে সে ভেবে পায় না। নিজের বাপ যেমন একটা জানোয়ার তেমনি এ’ আরেক জিনিস, দু’জনই একই ধাতুর গড়া। দুজনের চোখে বিষ, সেই বিষের ছোবলে মানুষ মরলে মরবে কিন্তু ফটিক মরবে না বরং আরেক দফা ছোবল মারবে।
কোকিলামাঝির গান কি আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় না, কোথায় গেলো তরীরা, ওদের বাড়িখানা তো মনে হয় নীরব, চলে গেলো সব, পদ্মর আর কোনো খোঁজ তাহলে পাওয়া যায়নি, মানুষ কি এভাবে হারিয়ে যায়। কোথায় হারায় নানাভাই-খালা আর তরীরা কোথায় আছে, নদীর দেশের মানুষ, নদীর বুকে হারিয়ে যায় আবার চর জাগার মতো জেগে ওঠে কিন্তু তরীরা তো আর ফিরে আসবে না, আসে না নানা-খালা বা পদ্মরা, বাকি থাকে লেনদেন, জীবনের কঠিন হিসেব সে আর কষে রাখে টালী খাতায়, সময়ের নক্ষত্র সময়ের নদী ধরে দিগন্তে নিজেকে খুঁজে যায় বা হারিয়ে যায়।
আবার মা বলে ওঠে, আয় বাবা ঘরে আয়, কতোদিন পরে এলি, মুখ শুকিয়ে, চোখের কোলে কালি জমেছে...
ফটিক থেমে যায়, সে কোথায় যাবে এখন, ধান-চালের চাতাল ছেড়ে এখন হেকমতউল্লা এ’ বাড়িতে স্থান গেড়েছে, তার চোখে আনন্দ, কিন্তু ফটিকের মনে আগুন-বিষজ্বালা, কোথায় লুকোবে, শীতল গায়েনের সঙ্গি হলে কতো ভালো ছিলো, মানুষ দেশ-বিদেশ করে বেড়ায়, গান বাঁধে এবং গান গায়, ওর সুরের বাহার মনকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়, আজ কোথায় সে, মন বলে চল রে পাগলা মদিনায়/যেথায় আছে ভালোবাসার ঠাঁই/ চোখ দুটো পাগল হয়ে তারে যে হাতড়ায়/ নদীর দেশের মানুষ বটে চল্ যায়-চল্ যায়...
ফটিক রাত্রের অন্ধকার কেটে মাঠের পর মাঠ ভেঙে চলে যায়, শহরে যাবে না, বাড়িও থাকবে না, সে পদ্মর মতো হারিয়ে যাবে, তরীদের মতো দেশ ছেড়ে নিরুদ্দেশে যাত্রা করবে,তবু সে নিজ গ্রামে আর থাকবে না, গ্রামের বাতাসে বিষ লেগেছে, কীটনাশক বিষে নদীর পানি বিষাক্ত, বাতাস বিষাক্ত, সবুজ শ্যামলিমা মাঠ-ঘাট সব কেমন বিষাক্ত হয়ে গেছে, তাই এই গ্রামে আর সে থাকবে না, শীতল গায়েনের পথের সঙ্গি হবে, তরীদের খুঁজবে দেশে-বিদেশে। কেনো তরীরা চলে যায় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, পেছনে যে কতো হাহাকার কতো স্মৃতি ছোপ-ছোপ দাগ হয়ে থাকে তা কি দেখার কোনো প্রয়োজনবোধ করে না, পদ্মরা হারিয়ে যায় মেলায়, কেনো ফটিক হারিয়ে ফেলে মাকে, যে মা তার ছিলো, সে কেনো আজ অন্যের বউ নাকি খেলার পুতুল, আকাশে আজ চাঁদের আলো নেই, এতো অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি, কোথায় ছিলো এতো আঁধার। আঁধারের ভেতর দিয়ে পারানি মাঝির মতো সে যাবে কুলে, পেছনে পড়ে থাক্ যতো কালো-কালো নকশাকাঁটা ভয়াবহ অন্ধকার।