মরা ক্ষেতের কাছে আলের বুকে পা রেখে মনটা কেমন মুষড়ে যায় জয়নাল মন্ডলের। নিজের চোখকে শত্র“ মনে হয় এখন। বিরান জমিন খাঁ-খাঁ করছে, কাঠফাঁটা গরমে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়, জয়নাল মন্ডলের বুক হাপড়ের মতো উঠানামা করে। আগুন ঝরা রোদে পুড়ে-পুড়ে অঙ্গার হচ্ছে জগতের মাটি, বাতাসে বইছে যেন আগুনের ফুলকি।
জয়নাল মন্ডলের মনে শান্তি নেই, পুড়ছে ক্ষেতের মাটি, পুড়ছে বুকের ভেতরের রক্ত,পুড়ছে তাবৎ শরীর। চোখের মধ্যে রাজ্যের হাহাকার, স্বপ্নগুলো কেমন পানসে হয়ে গেলো, কোথায় গেলো সে সব রাঙানো দিনগুলো, তীব্র দহনে মন-শরীর জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে, এমন ভাবে ক’ দিন আর যাবে ভেবে কুল কিনারা পায় না।
কি শুখা মাটি-রে বাবা, কি শুখা...
জয়নাল মন্ডলের কথা শুনে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়ে জমির মুন্সি। কালিগঞ্জের হাট থেকে মুরগী বিক্রি সেরে খালি ঝাঁকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে জমির।
আর কি হবে মন্ডল, মাটি পুড়ে অঙ্গার হলে ফসল ফলবে কি ভাবে!
ফসল হায় রে ফসল, কৃষকের মাটি পুড়লে প্রাণ কি বেঁচে থাকে বাবা!
জমির মুন্সি আর থামে না, প্যাডেলে পা উচিঁয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় গন্তব্যে।
জয়নাল মন্ডল অনেক দূর অবধি তাকিয়ে থাকে অবাক চোখে, দুপুর পার হয়ে আসছে, ওপাশের খাড়ি জমিটুকুও পুড়ে ফেটে চৌচির, আকাল নেমে আসছে, মঙ্গার দেশে আর কোনো প্রাণ বাঁচবে না। বাড়ির চৌহদ্দিতে এসে গোয়ালের দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, অবলা গরু দুটো না খেতে পেয়ে শুকিয়ে হাড্ডিসার হচ্ছে জমিনের মতো। বউ মর্জিনার বুকের স্তন শুকিয়ে ত্যানা এখন, কাপড়ের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায় একদলা শুকনো চামড়া, মেয়ে দুটো ক্ষুধায় বধির যেন বা।
জয়নাল মন্ডল ঘরের দাওয়ায় পা না রেখে চিৎকার করে বলে ওঠে, এভাবে পড়ে-পড়ে না মরে চলো আমরা শহরে যায়...কিন্তু হাই কষ্ট তার কথা মর্জিনা বা মেয়ে দুটো অথবা গরু দুটো কারো কানে পৌঁছে না অর্থাৎ মাটি ছেড়ে কেউই যাবে না। মাটির সঙ্গে এ’ যেন জনম-জনমের দোস্তি, কেউ কাউকে ছাড়া বাঁচবে না। বুক ভেঙে গেলেও কেউ পরাজিত নয়, শুধুই তাকিয়ে থাকা আর পানির জন্য প্রার্থনা করা, শরীরের মধ্যে যে আগুন, চোখে আগুন, আগুন নিয়ে সারাদেশ পুড়ে-পুড়ে মরে, কিন্তু কে দেখে কাকে, দূরের আকাশটাকে মনে হয় চিতা, সেই চিতায় ভস্ম হচ্ছে সে নিজেই।
দেশগ্রামের মানুষজন ছুটছে শহরমুখো, কেউ কেউ বলছে, ওই ফারাক্কার ফল এই পানির আকাল...
সবুজ বৃক্ষসারি পুড়ে ঝলসে যাচ্ছে, ফুলের আগা কেমন পোড়া, জয়নাল মন্ডল আকাশের দিকে তাকিয়ে পানিÑপানি করে চিৎকার জুড়ে দেয়, বিশাল আকাশ নির্বাক, কার কথা সে শুনবে, মাটি ফাটা-ফাটা, যেন বা আগুনের আঁচে তামাটে রূপ পেয়েছে, এই মাটি কবে যে আবার কাদা-কাদা হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই,
জয়নাল মন্ডল নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
কাঁকনহাটের ফজল সেদিন হাটবারে জানালো, কি করবো ভাই, শহরে গিয়ে দুটো কামাই করে আনি বলে, দুটো ভাত মুখে তুলে দিতে পারি বউ-ছেলে-মেয়ের...
জয়নালের বুকে কথাটা খুব লেগেছিলো, এই ফজল ছিলো এককালের বড় বাড়ির ছেলে, বাপটা মরে যাওয়ার পর শরীকে- শরীকে মামলা-মকদ্দমার জেরে সব শেষ করে পথে বসার যোগার, আজ জমি বলতে বসতের বাড়িটুকু ছাড়া কিছুই নেই। জয়নাল বসে থাকতে পারে না। মানুষের ফুটুনি ক’ দিনের রে ভাই--লোহরামের কথাটা ভারী কাঁটা ছড়ায়।
বেঞ্চের ওপাশে বসা মালঞ্চির কুতুব বলে উঠলো, পানি কি তাহলে ছাড়বে না ভারত, এদিকে তো বৃষ্টিবাদলের নামগন্ধ নেই।
জয়নাল চেপে বসলো খানিক, দেশের মানুষ মরছে ছাতি ফেটে ওদিকে ওপরওয়ালা দেখো দিব্বি বসে দেখছে রঙ্গ।
কুতুব বললো, তোমার-আমার কষ্ট দেখে কে, ওরা সব একই জাত শোষক...
জয়নাল বলে ওঠে, শাসক বা শোষক তো বুঝি না ভাই, কার কথায় যে কি হয়ে গেলো, ফারাক্কা বাঁধ হলো আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে গেলো, এখন পানি-পানি করে মরছি...
কুতুব আচমকা বলে ওঠে, এক কাজ করো মন্ডল ভাই, ভালো দাম দেখে তোমার জমি বিক্রি করে দাও!
কি বললে, জমি বিক্রি করে করবো কি?
কি করবে তা তো জানি না, জমি রেখে লাভটা কি বলো দেখি, দেশে তো আর ফসল-আবাদ হবে না।
এটা আবার কেমন ধারা কথা, ফসল-আবাদ হবে না তো মানুষজন খাবে কি!
কেনো বিদেশি চাল-গম কিনে খাবে, দেশে তো এখন শুধু বিনিয়োগ আসছে, তার মানে দেশে কল-কারখানা হবে তাই জমি দরকার, ফসলের চেয়েও ফ্যাক্টরী-কারখানা করলে উৎপাদন খরচে লাভ।
জয়নাল আর কথা বলে না, কুতুবকে অনেকদিন ধরে দেখে আসছে, দিনেদিন কি যে হলো মানুষজনের স্বভাব-চরিত্র সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আগে খ্যাতির-সম্মান করে কথা বলতো আর এখন কিনা ক্রেতার মতো কথা বলে, যেন বা কতো বড় জমিদার মানুষ হয়ে গেছে, জমি-জমা বিক্রি/ কেনার দালালি করছে দীর্ঘদিন ধরে, মাঝখান থেকে গ্রামের লোক ভূমিহীন হচ্ছে, জমি কিনছে শহরের অদৃশ্য কোনো সাহেববাবু, যাকে হয়তো গ্রামের লোকেরা কোনোদিনও দেখতে পাবে না, কিন্তু তার জমিটা কাগজের টাকার বিনিময়ে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে, কুতুবের মতো কতো মানুষ যে ওদের হয়ে কাজ করছে কে জানে। জয়নাল উঠে যায়, ফালতু মানুষের কাছে বসতে তার এখন আর সময় নেই, কুতুব ডাক দিয়ে বললো, মন্ডল ভাই জমি বেচতে চাইলে আমাকে জানালে হবে, শহরের মোটা অংকের সাহেব আছে, এদিকে তিনি জমি কিনে রাখবেন, আগামীতে মোটা কোনো কারখানা করবে হয়তো।
জয়নাল ওর কথা শুনতে চায় না,জমি যে কি জিনিস তা শুধু কৃষকই বোঝে, তার কষ্টের কথা তো কাউকে বোঝানো যাবে না। অনাহার-অভাব কষ্ট যা থাকুক না কেনো, নিজের একখন্ড জমি যে কতো আনন্দের কতো তৃপ্তির তা তো সে জানে।
সেদিন কাকডাকা সাতসকালে কুতুব তার সঙ্গী-সাথী নিয়ে জয়নাল মন্ডলের বাড়ি ছুটে আসে, মর্জিনা কুতুবকে দেখে চমকে ওঠে, বিহানবেলায় হাতির পা তাদের বাড়ি, তারপর আবার এ’ সে হাতি নয়, একেবারে পায়ে গোঁদওয়ালা হাতি, মন্ডল গোয়ালে ছিলো, চিৎকার দিয়ে বললো, কুতুব তুমি কেনো এসেছো আমার বাড়ি?
Ñকেউ কারো বাড়ি কি আসতে নেই ভাই, একই গ্রামে থাকি আমরা, সবাই তো সবার আত্মীয়, সুখ-দুঃখের কথা যদি কেউ কারোটা না শোনে তবে কিসের...
Ñঠিক আছে, কি বলতে চাও সেটা আগে বলো?
না বলছিলাম কি, আপনি কি ভাবীকে সেদিনের কথাটা জানিয়েছেন, একটা মস্ত বড়লোক অনেক জমি কিনবে কিনা, অনেকে দিচ্ছে...
তোমাকে তো বলেছিই, আমি জমি বেচবো না, আবার কি জন্য এসেছো।
এসেছি আপনার ভালোর জন্যই, আপনার জমির পাশের জমিগুলো প্রায় বিক্রি হয়ে গেছে, এখন আপনি আছেন।
আমি আছি থাকবো, সবার হোক আমি বেচবো না।
জমি শুকিয়ে যাচ্ছে, পানি আর আসবে না, ফসল ফলবে না, চোখ যতোদূর যায় সব জমি বিক্রি হবে, এখানে একদিন কল-কারখানা শহর হবে, বড়-বড় রাস্তা হবে...
জয়নাল মন্ডল কিছু বলতে পারে না, তারপর সে আর কি বলবে, শুধু কুতুবের বাপের কথাগুলো মনে আসে, মানুষটা ভালো ছিলো, যুদ্ধের বছর মরে গেলো,কারা যে মারলো বোঝা গেলো না, তার ছেলে কুতুব, কুতুবই বটে, ওর বাপের সঙ্গেই তো জয়নাল মন্ডলের বাপ সেই সাতচল্লিশে দেশ ছেড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে এলো এদেশে, সেই দেশের শোক বাপ ভুলেছিলো ঠিকই কিন্তু এদেশের মাটি হারানো শোক তো ভোলার নয়।
এদিকে জমি পুড়ছে, মানুষ মরছে আর পুড়ছে মানুষের বুক, এরমধ্যে জমি বিক্রি হচ্ছে, মানুষজন শহরমুখো, শহরের সুখ আর গ্রামের সুখ তো এক নয়, নিজের ভূমি হারানো কষ্ট তো মানুষকে বিদ্বব্ধ করে, যন্ত্রণায় খাবলে খায়, অথচ মানুষ পারে না, নিজের কাছে পরাজিত হয়ে হয়তো একটা সময় মাথা নত করে দাঁড়ায়।
বউ মর্জিনা বজ্রকন্ঠে জানায়, জান দেবো তো জমি দেবো না, পেটে পাথর বেঁধে থাকবো তবুও জমিন হাতছাড়া করবো না।
কুতুব লোকজন নিয়ে যেভাবে এসেছিলো সেই ভাবেই ফিরে যায়, রাগে ওর চোখদুটো জবা ফুলের মতো জ্বলছে, তাতে অবশ্যই মর্জিনাদের কি আসে যায়।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই এক সন্ধ্যোয় সংবাদ আসে কুতুবকে কে বা কারা যেন হত্যা করে ধড়-মুন্ডু আলাদা করে রেখে গেছে, গ্রামের লোকে সবাই গিয়ে ভীড় করে দাঁড়ায়, সত্যিই ঘটনা একটা, কারো মুখে কথা নেই, বোবা পাথর যেন, কিন্তু এমন একটা পৈশাচিক ঘটনা ঘটালো কে, কেউ অনুমান করতে পারলো না, কাউকে সন্দেহ করতেও পারলো না গ্রামবাসী। অনেকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে থানার লোকেরা ভ্যান নিয়ে এসে খেঁজুরের পাতার পুরানো চাটায়ে জড়িয়ে ভালো করে বেঁধে ভ্যানে তুললো, গ্রামবাসী দেখলো কিন্তু কেউই জানলো না প্রকৃত ঘটনা আসলে কি, কার পাপে কে বলী হয়।
মোহাব্বতপুরের মজিদ শেখ বলে উঠলো, বৃষ্টি আর হবে না গো মন্ডল, আর ফারাক্কার পানি তো ওরাই দখল করে রেখেছে।
জয়নাল মন্ডল ফিসফিসিয়ে জানাই, বৃষ্টি আসুক বা না আসুক সেটা বড় কথা নয়, কুতুব কিন্তু আর কারো বাড়ি আসবে না।
মজিদ শেখ জানতে চাইলো, কি বলছো মন্ডল কি বলছো...
জয়নাল মন্ডল আজকাল শহরে যাচ্ছে দিন আসি দিন খাই মজুরের কাজ করতে,তাই তার সংসারে অভাবটা অতো আর প্রকট নয়। কিন্তু জমি সে বিক্রি করবে না,আর কতোদিন নদীতে পানি আসবে না, আর কতোদিন খাড়িগুলো, বিল-হাওড় পানিতে ভাসবে না মন্ডল তা দেখতে চায়, সত্যিই মানুষ কি আর আগের মতো নেই, কেনো মানুষ ওমনভাবে বদলে গেলো। এভাবে কি বদল হতে হতে মানুষ একদিন আবার বানরে রূপান্তর হবে, মানুষ কি বানর ছিলো নাকি বানর কোনো একদিন মানুষ ছিলো, জয়নাল মন্ডলের কাছে ওসব কোনো প্রশ্ন নয়, তার কাছে শুধু একটাই প্রশ্ন, ফারাক্কার পানি কি তার জমিতে আসবে না, জমি কি সব বিক্রি হয়ে যাবে অদৃশ্য মানুষের কাছে।