অ্যালার্মের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসল ইমন, আর উঠেই টের পেল পিঠে প্রচণ্ড ব্যাথা। সোফা আসলে বসার জন্যই, শোবার জন্য না। কিন্তু সে যেখানে থাকে, সেখানে খাট নেই, ওর পাসে আছে ডেস্ক, চেয়ার, কর্নার টেবিল আরও দুটো ডেস্ক আর চেয়ার। তার পাশের সোফাতেই কদিন ধরে রাতে ঘুমায় সে। এটা ওর অফিস। বাবার করে যাওয়া ছোট একটা অফিস, বাবা গত বছর মারা যাবার পর থেকে ওকেই দেখতে হয়। কিন্তু ঘুমাতে হত না। এখন হচ্ছে... হচ্ছে না বলে করছে বলব কিনা জানি না।
ইমন উঠে বসল ঠিকই, কিন্তু সোফা ছেড়ে উঠল না। বন্ধ হয়ে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে লাগল। মাঝে মাঝে ওর ঠোঁট কেঁপে উঠছে, তাই বোঝা যাচ্ছে ও জীবন্ত, না হলে বঝার উপায় নেই। ২৯ বছরের এই যুবকের থাকার কথা প্রাণবন্ত অথচ সে যে জীবন্ত তা বুঝতেই বেগ পেতে হয়!...
১০দিন আগেও তার জীবন টা ঠিক ছিল, সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি ঠিক ১০ দিন পর তাকে তার অফিসের সোফা থেকে একা ঘুম থেকে উঠতে হবে!
ইমন প্রেম করে বিয়ে করেছিল জলিকে ২০০৩ সালে, নিজেরাই, এক প্রকার শখের বসেই। ২০১১ তে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করে জলিকে নিজের ঘরে নিয়ে এসেছিল ইমন। সুখে শান্তিতে সংসার চলছিল তাদের। এত হাসি খুসি মেয়েটা সবার মন জয় করে অচিরেই ঘরের পাকা গিন্নী হয়ে গিয়েছিল। গত বছর যখন এমন আর জলি সুখবর পেল নতুন অতিথির, তখন তাদের খুসি দেখে কে! আলট্রাসোনোগ্রাফি করে জমজ বাচ্চা টের পাবার পর অবর্ণনীয় খুশিতে ভরে ছিল সারা ঘর। বাচ্চাদের জামা, জুতা, খেলনায় ভরে উঠল ছোট একটি রুম। কি নাম রাখবে তাদের, কবে আকিকা হবে, কোথায় হবে, কে কে আসবে সব হিসেব করতে থাকল তারা। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে ইমন, তার অনাগত সন্তানদের জন্য সদা সতর্ক। জলি খেল কিনা, কখন খেল, কি খেল, ঘুমাল কিনা, কাজ করল নাতো এসব বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখত তাকে। আত্মীয়, বন্ধু সবাই খুশি। দেখতে দেখতে সময় হয়ে এল। জলিকে সবচেয়ে ভাল জাইগাতেই ভর্তি করাতে ছেয়েছিল ইমন, কিন্তু ওর পক্ষে একা সে খরচ টানা সম্ভব না। কিন্তু তবুও দেশের নাম করা এক গায়নী ডাক্তারের কাছেই জলিকে দেখাল। সে যে হাসপাতালে বসে সেখানেই ওকে ভর্তি করাল। সেই শুভদিনও এল, ৩ সেপ্টেম্বর জলি দুই সুস্থ জমজ ছেলের মা হল। জলির প্রেসার বেড়ে গিয়েছিল, ওজন বেড়ে গিয়েছিল, সাথে বেড়েছিল আনন্দ। প্রথম মা হবার অনুভূতি, তা যারা হয়েছে তারাই বুঝবে। ওদিন রাতেই জলির ফুসফুসে পানি এসেছিল। ডাক্তার এসে দেখল, বলল ভয় পাবার কিছু নেই। পরদিন সকালে ওর ব্যাথা শুরু হল হঠাৎ , ইমন ডাক্তারকে ডেকে আনলে, সে জলিকে আইসিইউ তে নিয়ে যায়, পরে আবার বের করে আনে। ৫ তারিখ আবার ব্যাথা উঠে, ডাক্তারকে পাওয়া যায় না, সে তার প্রাইভেট ক্লিনিকে। রাতে ডাক্তার এসে জলিকে আবার আইসিইউ তে নিয়ে যায় আর সেখানেই মারা যায় সদ্য হওয়া মা!
এত কঠিন একটা বিষয় লিখে ফেলা কত সহজ এক লাইনে! অথচ এক লাইনের জন্য আমার গল্পের নায়ক হারিয়ে ফেলল সব! জলির পরিবারের সবাই ইমনকে দোষ দিতে শুরু করল। কেন সে আরও ভাল হাসপাতালে রাখল না, তার টাকা নেই সে চাইল না কেন! ইমন কোন কথারই জবাব দিল না।
জলির লাশ নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের বাড়িতে। তার শেষ ইচ্ছা তার বাবার কবরের পাশে শায়িত হবার, পূর্ণ করল ইমন। কি কপাল ছেলেটার, নিজের স্রিকে দাফন করে আসার পর শুনতে হল...”তোমার আর কি? তুমি তো বিয়ে করে নতুন বউ পেয়ে যাবে, আমাদের মেয়ে তো আসবে না!” আর পারল না ইমন... ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে!
আর সেই নবজাতকরা! খুব অদ্ভুত কোন কারনে ইমনের মা তার নাতিদের রাখতে নারাজ! এই দুধের বাচ্চাদের জায়গা হল তাদের খালার কাছে, তাও অল্প কিছুর জন্য! তাও তারা থাকে চট্টগ্রামে। ইমনের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাচ্চাগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে ইমন রেখে আসল তাদের। মার উপর রাগ করে বাসায় যায় না, থাকে অফিসে।
এই তার জীবন! জমজ ছেলে আর তাদের আহ্লাদী মাকে নিয়ে যেই ঘর ভরে থাকার কথা, ইমন যেতে পারে না সেখানে। জলির সাথে এত সৃতি! খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সব যেন তার দিকে তাকিয়ে থাকে! মানুষের কথা শুনে চুপ করে থাকলেও এই কাঠ, পাথরের মধ্যে যে প্রেম ছিল তার, তাদের নির্বাক ভাষা ওকে কাঁদিয়ে তোলে। ছুটে বের হয়ে যায় ঘর থেকে, দম নেয় ও। বাস্তবতা থেকে তো দম নিতে পারে না তবুও!
কি আছে ওর ভবিষ্যতে? ওর বাচ্চাদের নিয়ে আসতে পারবে ওর কাছে? মা ছাড়া পালতে পারবে? জলিকে ছাড়া ঐ বাড়িতে যেতে পারবে? মা কোলে তুলে নেবে নাতিদের? জলির আত্মীয়রা ওর সাথে স্বাভাবিক হবে? জলিকে ছাড়া এই নিষ্ঠুর দুনিয়া একা পাড়ি দিতে পারবে? আর ঐ ডাক্তার, তার কি বিচার হবে? এইসব রাশি রাশি প্রস্ন নিয়ে ওর প্রতিটি রাত শেষ হয়,দিন শুরু হয়, স্বস্তি পায়না।
...কারেন্ট আসল, ফ্যান ঘুরছে। ওর কি একটু স্বস্তি লাগল?