তাড়াহুড়ো করে মোড় ঘুরতে গিয়েই বিপত্তি। একেবারে অ্যাক্সিডেন্টই করে বসল পবিত্র। ওদিক থেকে যে একটা মোটরসাইকেল আসছে তা তো সে বুঝতেই পারেনি। কি করে বা আর পারবে? মোটরসাইকেলওয়ালা যদি হর্ন না দিয়েই হোন্ডাটা বাঁই করে ঘুরিয়ে দেয় তবে কি আর পবিত্রকে দোষ দেওয়া যায়?
‘দেখে চলতে পারো না?’ রাস্তায় পড়ে চেঁচিয়ে ওঠে সে। তার সাইকেলটা ছিটকে পড়েছে খানিকদূরে, চাকাদুটো আস্তে আস্তে ঘুরে চলেছে তখনও। আশ্চর্য ব্যাপার! ধাক্কা মেরে চলে গেল, অথচ একবার ফিরেও তাকাল না ছেলেটা। সতেরো আঠারোর মত বয়স হবে। পেছনে সিটে বসে তার গায়ে লেপ্টে রয়েছে লাল টপ আর শর্ট জিন্স পরা তারই বয়সী একটা মেয়ে। ছেলেটার এমন ভ্রূক্ষেপহীন মনোভাবে বেশ বিচলিত হয়ে পড়ল পবিত্র। হাজার হোক, সে তো তার বাবার বয়সী পঞ্চাশোর্দ্ধ এক ভদ্রলোক। তার প্রতি একটা সহমর্মিতা দেখানো তো ওদের কর্তব্য ছিল। যুগের কি মহিমা!
পবিত্রর পা কেটে তখন গলগল রক্ত ঝরছে। হাতে, থুতনিতেও কেটে ছড়ে গেছে। কনুই আর হাঁটুতে চোট লেগেছে, বেশ যন্ত্রণা। অথচ কেউই এল না তাকে সাহায্য করতে। অবশ্য রাস্তাতে কেউ ছিলও না। এই ভরদুপুরে আশেপাশের গৃহস্থ বাড়িগুলোও সব ঘুমন্ত। ইশার শরীরটা আজ ভাল নেই। টুপুসও স্কুলে গেছে। তাই তাড়াতাড়ি অফিস সেরে বাড়ি ফিরছিল পবিত্র যাতে সে স্ত্রীকে কিছু সাহায্য করতে পারে। কিন্তু অবস্থাটা এখন এমনই দাঁড়াল যে তার পক্ষে কাউকে সাহায্য করা তো দূরস্থ, তারই বরং এখন সাহায্যের প্রয়োজন।
সে উঠে কোনোমতে দাঁড়াতে যাবে এমন সময় কানে এল একটা হৈ হৈ শব্দ। পবিত্র তাকিয়ে দেখে দুটো ছেলে দৌড়তে দৌড়তে এদিকেই আসছে। একজনের রোগা পাতলা চেহারা, অন্যজনের গাঁট্টাগোট্টা। রোগা ছেলেটার চোখদুটো খুব উজ্জ্বল, বেশ সজীব। চোদ্দো কি পনেরোর মত বয়স হবে। অন্যজনের বয়স একটু বেশী বলেই মনে হল।
‘কি হয়েছে কাকু? পড়ে গেছেন? চিন্তা নেই, চাপ নেবেন না। আস্তে আস্তে আমার এই হাতটা ধরে ভর দিয়ে উঠুন। পুকাই, তুই কাকুর ঐ হাতটা ঘর।‘ গাঁট্টাগোট্টা চেহারা যেন সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। তারপর ধরাধরি করে পবিত্রকে ওরা সামনের একটা বাড়ির উঁচু দাওয়ার ওপর বসায়।
‘পুকাই, তুই গিয়ে ক্লাব থেকে ফার্স্ট এড বক্সটা নিয়ে আয় তো। আর আমি দেখি এদিকে কোথাও জল পাওয়া যায় কিনা। ছেলেটা বাড়ির ভেতর ঢুকে হাঁক ছাড়তে লাগল, ‘কেউ আছেন বাড়িতে?’ বাড়িতে কেউই ছিল না। তিন-চারবার হাঁকডাকের পরেও কেউই যখন দরজা খুলল না, ছেলেটা অন্যত্র জলের খোঁজ করতে বাধ্য হল। অবশ্য সামনেই একটা কল পাওয়া গেল। টাইমকল। সিমেন্ট বাঁধানো কলপাড়। দেড়টা এখনও বাজেনি, তাই জল থাকারই কথা। কলটা একটু খুলতেই ফস্ করে জল ছিটকে এসে ছেলেটার পা দুটো ভিজিয়ে দিল। বারমুডাটাও ভিজল খানিক। ছেলেটা পকেট থেকে একটা রুমাল বার করে সেটাকে জলে ধুয়ে নিল। তারপর নারকোলের একটা মালাইচাকি জোগাড় করে তাতে কিছুটা জল ভরে নিল। পবিত্র তখন মাথাটা দাওয়ার থামে এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ বিশ্রাম নিচ্ছে।
সত্যি বলতে কি, পবিত্র যেন তখন ওদের ধন্যবাদ দেওয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছিল। তার মনে হতে লাগল, এরা যেন মানুষ নয়। স্বয়ং ভগবান এদের দেবদূত করে পাঠিয়েছেন, তারই সেবার জন্য। তাই তো এদের সাথে রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এদের এত আপন মনে হয়। যেন নিজের ছেলে তাকে জল দিয়ে তার কাটা জায়গাগুলো ধুয়ে দিচ্ছে। ব্যথায় টনটন করা কনুইয়ে শীতল জলের মলম দিচ্ছে। পবিত্র তাকে মোলায়েম স্বরে বলে, ‘তোমাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব বাবা। তোমরা না এসে পড়লে আমি এখনও এখানেই পড়ে থাকতাম। বয়স হয়েছে, এখন তো তোমরাই আমাদের দেখবে। তা তোমার নাম কি বাবা?’
ছেলেটা রুমাল ধুয়ে নিংড়ে নেয়, তারপর রক্ত মুছতে মুছতে বলে, ‘অর্জুন’।
- ‘বাঃ ভাল। কোথায় থাকো তুমি? কিসে পড়?’
- ‘এই তো এখানেই। এখানে আমায় মোটামুটি সবাই চেনে। শুধু অর্জু বললেই হবে’।
- বাঃ তোমার তো তাহলে বেশ নামডাক আছে। অ্যাঁ! বেশ করিৎকর্মা তো তুমি, গুড। এই তো চাই।
অর্জু নিঃশব্দে কাজ করে যায়। একটা কথাও বলে না। পবিত্রই আবার বলে ওঠে, ‘কিন্তু তুমি কিসে পড় তা তো বললে না?’
- সামনের বছর মাধ্যমিক।‘
মাধ্যমিক শুনে একটু অবাক হয় পবিত্র। কারণ মাধ্যমিকের তুলনায় এ ছেলেকে একটু বড় বলেই মনে হচ্ছে। যাক গে, তবে ওর কথাবার্তা বলার মধ্যে বেশ একটা চটপটে ভাব আছে, একটা দৃঢ়তাও।
খানিকক্ষণ বাদে পুকাইকে আসতে দেখা গেল। হাতে একটা বাক্স। যার সামনেটায় লেখা, ফার্স্ট এইড্। পুকাই আসতেই ওর হাত থেকে বাক্সটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় অর্জু। ‘কি করিস কি? এত দেরি কেন?’ খিঁচিয়ে ওঠে অর্জু। তার গলার দেমাকি স্বরে বেশ থতমত খেয়ে গেছিল পুকাই, সে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই অর্জু তাকে অর্ডারি গলায় বলে, ‘যা, মোড় থেকে একটা রিক্সা ডেকে আন।‘ পুকাই যেন ওর এই আদেশেরই অপেক্ষা করছিল। আজ্ঞা পেতেই সে হনহন করে হাঁটা লাগাল মোড়ের দিকে।
পবিত্র বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘আবার রিক্সা কেন? আমিই হেঁটে চলে যেতে পারব। এখন ব্যথা অনেক কমে গেছে।‘
তাকে বাধা দিয়ে অর্জু গমগম করে ওঠে, ‘থামুন দেখি কাকু। অর্জু যখন আছে, তখন সে-ই আপনার সব দায়িত্ব নেবে। আপনি আমাদের পাড়ায় এসে যখন চোট পেয়েছেন, আর আমি বসে থাকব?’
- ‘হাঃ, হাঃ, হাঃ। সত্যি তুমি একটা পাগল। ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। তবে আমাদের বাড়িতে একবার এস কিন্তু। কাছেই আমার বাড়ি। তোমাকে দেখলে আমার ঘরের লোক যে কত খুশি হবে।‘ বলতে বলতে একটু থামে পবিত্র। তারপর সে আবার শুরু করে, ‘তোমাদের মত ছেলেরা আছে বলেই তো পৃথিবীটা এখনো টিকে আছে বাবা।‘
এসব কথার কোন উত্তর দেয় না অর্জু। সে নিজের মনে কাজ করে যেতে থাকে। বাক্সটা খুলে লাল মলম বের করে সে পায়ের কাটা ঘায়ে লাগিয়ে দেয়।
ইতিমধ্যে রিক্সার আওয়াজ শোনা যায়। ‘চলুন কাকু, রিক্সা এসে গেছে’। দাঁত বের করে কোমল গলায় বলে অর্জু। পবিত্রর হাজার মানা সত্ত্বেও অর্জু আর পুকাই তাকে ধরাধরি করে রিক্সায় তোলে। আর তারা রিক্সার পেছন পেছন সাইকেলে যাবে ঠিক করে। সাইকেলটার হ্যাণ্ডেলটা ঘুরে গেছিল। দু এক জায়গায় ঘটাং ঘটাং আওয়াজ। ওরাই সেসব ঠিক করে দিল। তারপরে সাইকেলে উঠে বসল পুকাই। আর তার পেছনে ক্যারিয়ারের দুই দিকে দু-পা ফাঁকা করে বসে অর্জু। খানিকদূর যেতেই অর্জু চেঁচিয়ে ওঠে, ‘দেখুন কাকু, আমাদের নতুন ক্লাব। আপনার ডানদিকে।‘
পবিত্র পাশ ফিরতেই দেখে, ‘কৈশোর সমিতি’, স্থাপিত ২০১৩। রেজিস্ট্রি নম্বরটা অবশ্য কোথাও খুঁজে পেল না সে।
মিনিট দশেক চলার পরে পবিত্রর বাড়ি আসে। হলুদ রঙের দোতলা বাড়িটার সামনে কিছুটা বাগান। রিক্সা থেকে নামার সময় অর্জু আর এগিয়ে এল না।
‘কত ভাই?’
‘তিরিশ’। সটান জবাব দেয় রিক্সাওয়ালা।
‘অ্যাঁ! এইটুকু আসতেই তিরিশ কি গো?’ পবিত্র অর্জুদের মুখের দিকে একবার তাকায়। ওরা বাড়ির উঠোনে তখন সাইকেলটা রেখে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে একটা কথাও তারা বলে না। অগত্যা পবিত্র পকেট থেকে তিরিশটা টাকা বের করে রিক্সাওয়ালার হাতে দেয়।
ভাড়া মিটিয়ে পবিত্র সাইকেলটাকে ঘরে ঢোকাতে যাবে এমন সময় অর্জু বলে ওঠে, ‘তাহলে আমাদেরও ছেড়ে দিন কাকু।‘
- অ্যাঁ। না না। ছাড়ব কি? তোমরা এস। ঘরে এসে একটু বস। তোমাদের আজকে না খাইয়ে ছাড়ছি না। সত্যি তোমরা না থাকলে ...।‘
- ‘ আরে না না। আমরা সেকথা বলছি না। বলছি, আমাদের ভাড়াটাও এবার মিটিয়ে দিন। জানেনই তো রেট। একশো। দুজনের টোটাল দুশো। টাকাটা ছাড়ুন। কাটি।‘ কর্কশভাবে বলে ওঠে অর্জু।
পবিত্র খানিকটা সময় জন্য হাঁ হয়ে থাকে। তারপর অবাকপারা গলায় বলে, ‘ কি বলছ কি তুমি? তবে এই জন্যেই কি তোমরা এত সব কাজ করে দিলে?’
অর্জুও ততধিক বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, ‘তা নয় তো কি? এমনি এমনি এত খাটতে যাব কেন? তাও তো বেশি কিছুই চাইলাম না। মাত্র দুশোটা টাকা, তাইতেই এই?’ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হেসে ওঠে অর্জু।
পবিত্র আর কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে একশো টাকার দুটো নোট বের করে অর্জুর হাতে দেয়। অর্জু একবার ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে চলে যায়। যাবার আগে শুধু বলে যায়, ‘নিজের খেয়াল রাখবেন, আর কিছু হয়ে গেলে আমরা তো আছিই। চলি’।
পবিত্র টের পায়, তার হাত পা কাঁপছে। সে এই প্রতিদান কল্পনাও করতে পারে নি। আজকের কৈশোর কি এতটাই বিষয়ী? সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কিছুক্ষণ পর সে দরজা ঠকঠক করে।
ইশা এসে দরজা খুলতেই চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ও মা! কি হয়েছে তোমার? পড়ে গেছিলে বুঝি? ও মা গো!”
- চুপ কর, চুপ কর। ভাল্লাগছে না এই চেঁচামেচি’। বিরক্তিতে স্ত্রীকে ধমকে ওঠে সে।
- কেন? কি হয়েছে?
পবিত্র ঘরে ঢুকে খাটে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেয়। শরীরের থেকেও তার মন অনেক বেশি ক্লান্ত আর অবসন্ন। বুকে একটা কষ্ট অনুভব করে সে। তারপর ইশাকে সে সমস্ত কথা খুলে বলে।
ইশা সবটা শোনে। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘তো?’
পবিত্র একটু অবাক হয়।
ইশা আবার বলে, ‘তুমি সুস্থভাবে বাড়ি এসেছ এটাই কি বড় নয়?’
পবিত্র আরো আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘কিন্তু তাই বলে ওরা টাকা নেবে? এটা কি ধরনের ব্যবসা?’
ইশা পবিত্রর গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে, ‘কি ছেলেমানুষ গো তুমি? একেবারে সেকেলেই রয়ে গেলে। বলি আজকের যুগে টাকা ছাড়া চলে? বরং আমি তো ভালই বলব। তুমি সুস্থ হয়ে নিরাপদে বাড়ি এসেছ এটাই তো ভাল। না হলে হাত পা ভেঙে কোথায় পড়ে থাকতে। সেই তুলনায় ওদের সার্ভিসটা ভালই বলতে হবে।
পবিত্র আর কোন উত্তর করে না। বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর চোখদুটো বন্ধ করে দেয়। ইশা অবাক হয়ে লক্ষ করে পবিত্রর চোখের কোণে একবিন্দু জল চিকচিক করছে ঠিক মুক্তোর মত।