ওরা কারা?

বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী (নভেম্বর ২০১৮)

ঐশিকা বসু
  • 0
  • 0
  • ৬১
সন্ধেবেলায় সমুদ্রের ধারে বসে হাওয়া খেতে কার না ভাল লাগে? আর যদি সেটা হয় হানিমুন ট্যুর তবে তো কথাই নেই। বাঙালির হানিমুনের ঐতিহ্যবাহী গন্তব্য পুরীর সমুদ্রের পার। আর সেখানেই মৃদুল হাওয়ার স্রোত, ঈষদোষ্ণ বালি, সাগরের গর্জন, জলের কলকলানি, ঢেউয়ের ওঠানামার সাথে নিজেদের একাত্ম করে নিয়ে চুটিয়ে গল্প করছিল রণক আর সুচন্দ্রা। যে জায়গাটায় ওরা বসেছিল সেখানে খুব একটা লোকজনের ভিড় ছিল না। ফলে ওদের আলাপচারিতা জমেছিল ভাল। এমন সময় হঠাৎ এসে উদয় হল ওরা।
‘বাবা, তোমরা কোত্থেকে আসছো?’ রণক চমকে তাকিয়ে দেখে বছর পঁয়ষট্টির এক বৃদ্ধ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গায়ের রঙ ফরসা, পরনে একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবী আর খাকী প্যান্ট। রণক হঠাৎ বেশ বিস্মিত হয়ে পড়ল বৃদ্ধকে দেখে। তার মনে হতে লাগল একে যেন কোথাও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায় দেখেছে, সেটা কিছুতেই মনে করে উঠতে পারল না। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে খানিকবাদে সে উত্তর করল, ‘কলকাতায়, মানে কলকাতার কাছেই, নৈহাটিতে’।
পাশ থেকে সুচন্দ্রা বলে ওঠে, ‘আর আপনারা?’
বৃদ্ধ তার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে নেয় তারপর উত্তর করে, ‘বাড়ী আমার কলকাতার কেষ্টপুরে, তবে পুরীটাও একটা অস্থায়ী আবাস বলতে পারো। মাঝেমাঝেই চলে আসি। যখন ইচ্ছে হয়, তখনই দুজনে কাটিয়ে দিই। এটাই আমাদের হানিমুন।’ কথাগুলো বলে বৃদ্ধ উদাত্ত স্বরে হাঃ হাঃ করে হেসে নিলো। পাশ থেকে ষাটোর্দ্ধ এক স্ত্রীলোক এসে বৃদ্ধকে বলতে লাগল, ‘তুমিও যেমন, ওরা একটু গল্প করছে, এখনই তোমার ওদেরকে জ্বালাতে হল’। এই কথা বলতে বলতে সেও সুচন্দ্রার পাশে এসে বসে পড়ল এবং তার গায়ে হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগল, ‘মা’কে দেখতে তো বেশ, যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। তা মা তোমার নাম কি?’ সুচন্দ্রা তার নাম বলে। বৃদ্ধ বলে, ‘আমার নাম চন্দ্রনাথ পোদ্দার। লোকে ডাকে চন্দ্র বলে। তোমার নামের সাথে বেশ মিল আছে। বয়সটা অল্প থাকলে আর দেখতে হত না...’ বৃদ্ধ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। বৃদ্ধা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘থামো তো তুমি, আর মেলা বকতে হবে না। ওফ্‌, বকবার ফুরসত পেলেই হল, থামতেই চায় না’। এবার সে রণকের দিকে ফিরে বলল, ‘তা বাবা তোমার নাম কি?’ রণক তার নাম বলতেই সে বলে, ‘বাঃ, কি সুন্দর নাম!’ ওদিকে চন্দ্রনাথ বলে ওঠে, ‘নাঃ, নামটা আমার, বুঝলে, পছন্দ হয়নি’।
চন্দ্রনাথের স্ত্রী বলে, ‘কেন?’
- ধুর এমন একটা নাম যার কোন মানে নেই। কি লাভ এইসব বাহারি নাম রেখে? আজকালকার দিনে এইসব নাম রাখাটা একটা ফ্যাশান হয়েছে বটে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
সে যাই হোক, রণক আর সুচন্দ্রা দুজনেই বুঝল তাদের গল্প করবার মজাটা একেবারে সমূলে বিনষ্ট হল। মাঝে মাঝে সুচন্দ্রার ইচ্ছে করছিল কোন বিশেষ কাজের অজুহাত দেখিয়ে তারা সেখান থেকে উঠে চলে যায়। কিন্তু রণক বলল, সেটা খুব খারাপ দেখায়, বিশেষ করে বুড়োবুড়ি দুজনেই তাদের বাপ-মায়ের বয়সী। কাজেই ওদের এইসব কথাবার্তাতেই তাদের পড়ে থাকতে হল। চন্দ্রনাথ সুচন্দ্রাকে বলে, ‘জানো মা, তোমার কাকিমার ভাল নাম সে কিছুতেই কাউকে বলে না। কিন্তু জানলে অবাক হবে...’ তাকে থামিয়ে দিয়ে বুড়ি বলে ওঠে, ‘আর বলতে হবে না। নিজের দিকটা আগে দেখো’।
চন্দ্রনাথ এবার আয়েস করে বসে রণককে জিগ্যেস করে, ‘তা তোমরা এলে কবে? আর ফেরবার প্ল্যানই বা কবে আছে?’
রণক জানায়, বেশ কিছুদিন হল তারা এসেছে। কাল সকালেই তাদের ফেরবার ট্রেন।
ওর কথা শুনে চন্দ্রনাথের মুখটা যেন বেশ কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে তার স্ত্রীয়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কিছু ইঙ্গিত করল। তারপর সে রণককে বলল, ‘তা বাবারা, তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগছে। তোমাদের এই বয়সটা সত্যিই খুব ভাল।’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমাদের তো তিনকাল গিয়ে এককালে এসেছে। তোমাদের দেখেও ভাল লাগে।’
সুচন্দ্রা মৃদু হেসে ওঠে। রণক প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আপনারা কোন হোটেলে উঠেছেন?’ চন্দ্রনাথ বলে তার হোটেলের নাম। রণক তাকালো সুচন্দ্রার দিকে। সুচন্দ্রা মিষ্টি হেসে বলে ওঠে, ‘আমরাও তো ঐ হোটেলেই উঠেছি। রুম নাম্বার – ২১৩। আপনাদের?’

* * *

‘আমার একটা কথা মাথায় ঘুরছে জানো’। জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে রণক বলতে থাকে, ‘এদের দুজনকেই আমি চিনি। কোথাও একটা দেখেছি। তোমার কিছু মনে হচ্ছে?’
সুচন্দ্রা চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে, ‘আমার আবার অন্যরকম মনে হচ্ছে।’ – সুচন্দ্রা তার লাল টপটা খুলে বিছানার ওপর রেখে দিতে দিতে বলে, ‘কিন্তু সেটা এমন কিছু না’।
রণক বলে, ‘কাম অন বেবি। কিছু তো বল। বুড়োবুড়িকে কোথাও তো আমি দেখেইছি। শুধু মনে করতে পারছি না, কোথায়?’
সুচন্দ্রা মুচকি হেসে বলে, ‘কোথায় বলবো?’
- বল।
- এইখানে। বলে সে ঠোঁট টিপে মুচকি হেসে নিজের বুকের মাঝখানটাতে দেখায়।
সুচন্দ্রাকে মুচকি হাসলে ভারী মিষ্টি লাগে। এমনিতেও দেখতে ওকে যথেষ্ট সুন্দর। গায়ের রঙ কাঁচা সোনার মত। হাসলে গালে টোল খায়। আর এখন প্রায় টপলেস.... একটা ব্রেসিয়ারে রঙটা আরো খুলেছে ভাল। ওর বুকের খাঁজটা রণককে লোভে আরো লোলুপ করে তোলে।
রণক ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পরনেও একটা জাঙিয়া। রণক এগিয়ে যায় ওর দিকে। আস্তে করে ওকে জড়িয়ে ধরে। তারপর ক্লিভেজে হাত রাখতে যাবে এমন সময়....
দরজায় কে ধাক্কা মারল? সুচন্দ্রা একছুটে বাথরুমে চলে যায়। আর রণকও পাজামাটা কোনোক্রমে গলিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। ততক্ষণে দরজায় আরো দুবার ঘা পড়ে গেছে। দরজা খুলতেই দেখা গেল, চন্দ্রনাথ আর তার স্ত্রী।
পিন খাওয়া বেলুনের মত চুপসে গেল রণক। তবু আতিথেয়তা না করে পারেই বা কি করে! ওদের ডেকে এনে ঘরে বসালো সে। চন্দ্রনাথ তার হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে বলে, ‘আজ তোমাদের একটা সারপ্রাইজ দেব বলে এসেছি’। তারপরেই একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, ‘তা আমার মা কোথায়? তাকে তো দেখছি না?’
বলতে না বলতে সুচন্দ্রা বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। ‘এই তো, এসেছে। এসো, মা এসো’। বলে সে সুচন্দ্রাকে নিজের পাশে এনে বসায়। তারপর বলে, আজ তোমাদের আর বাইরে খেতে যেতে হবে না।
সুচন্দ্রা জিগ্যেস করে, কেন?
উত্তরটা চন্দ্রনাথের স্ত্রীই দেয়, ‘আজ ঠিক করেছি, তোমাদের দুজনকেই আমি রান্না করে খাওয়াবো। রাত্তিরে তোমাদের দুজনেরই নিমন্ত্রণ রইল। অবশ্যই চলে এসো কিন্তু’।
সে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই চন্দ্রনাথ বলে ওঠে, ‘তাই বলে ভেবো না, তোমাদের জন্যই আলাদা ব্যবস্থা হচ্ছে। পুরীতে এলে আমরা বাজারঘাট রান্নাবান্না সব এখানেই করি। তার অবশ্য কারণও আছে।’ তারপর একটু থেমে রণকের দিকে একটু চোখ মেরে সে বলে, ‘এর ফাঁকে জানিয়ে রাখি, আমার গিন্নীর রান্নার যা হাত না....হেঁ হেঁ, তারিফ না করে পারবেই না’।
গিন্নী মৃদু অনুযোগের সুরে বলে ওঠে, ‘থামবে তুমি? কি পাগলামো শুরু করেছো বল তো?’ তারপর সুচন্দ্রার দিকে ফিরে বলে, ‘ওঁর কথায় পাত্তা দিও না তো। উনি একটু বেশি বকেন’।
‘সে আর বলতে...’ সুচন্দ্রার পেছন থেকে আস্তে করে ফুট কাটে রণক। তারপর কেশে নিয়ে বলে, ‘তা যাই হোক, সে খুব ভাল কথা। কিন্তু হঠাৎ এমন নিমন্ত্রণ? কাকা-কাকিমার হ্যাপি অ্যানিভার্সারি বুঝি?’
হেসে নিয়ে চন্দ্রনাথের স্ত্রী উত্তর দেয়, ‘না না। এমনিই। তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগল, বাবা। অবশ্যই এসো। তোমাদের জন্য রান্না করে রাখব’।
আপনার ছেলেমেয়ে কেউ আসেনি?’ – সুচন্দ্রা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে।
চন্দ্রনাথ বলে, ‘না মা। তার আসার কোন সুযোগ নেই’।
- কেন?
- কারণ সে মারা গেছে। একটাই মেয়ে ছিল আমার। বাইশ বছর বয়সেই...বলতে বলতে কথাগুলো হঠাৎ আটকে যায় তার।
ওদের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বাকিটুকু বলে চন্দ্রনাথের স্ত্রী, ‘অফিস থেকে বাড়ি ফেরবার সময় একটা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল তন্বিতা, আমার মেয়ে’। কথাগুলো বলতে বলতে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে ওর। হঠাৎই থমথমে হয়ে ওঠে গোটা পরিবেশ।
আর কথা বিশেষ এগোল না। নিমন্ত্রণ সেরে তখনই উঠে পড়ল ওরা। দরজা খুলে বেরোতে যাবে, এমন সময় রণক চন্দ্রনাথকে বলে, ‘আচ্ছা কাকু, একটা কথা জিগ্যেস করব?’
- কি বল?
- আচ্ছা, আপনাকে দেখে খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে। আপনি কি আমাকে চেনেন? বা কোথাও দেখেছেন? আমি ঠিক মনে করতে পারছি না’।
কথাগুলো শুনে বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা বিদ্রূপাত্মক হাসির রেখা ফুটে উঠল। তারপরে সে বলল, ‘এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। হয়ত একসময় পারব’। এই বলে সে আর কোন কথার অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। পিছন পিছন বেরিয়ে গেল ওর স্ত্রীও। রণক ওর কথাগুলো ঠিকমত বুঝতে পারল না। আবার এর কোন উত্তরও করতে পারল না।
ঘরে ফিরে দেখে সুচন্দ্রা টিভি চালিয়ে বসে গেছে। ‘ওফ্‌, তোমাকে নিয়ে আর পারি না? ফাঁক পেয়েছো, অমনি টিভির সামনে বসে পড়েছো’।
সুচন্দ্রা এটা ওটা চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলে, ‘ধুর, ভাল বাংলা চ্যানেলই নেই’।
- আর বাংলা চ্যানেল খুঁজতে হবে না। শোন না, তাহলে কি ঠিক করলে, যাবে তো রাত্তিরে ওনাদের ঘরে?
- ভাবছি।
- কি ভাবছ?
সুচন্দ্রা এবার টিভির থেকে মুখ সরিয়ে রণকের দিকে তাকিয়ে সেই আগের মত মুচকি হেসে বলে, ‘হঠাৎ এত দয়া কেন?’
- আরে বাবা, বুড়োবুড়ি মানুষ। সাতকুলে কেউ নেই, শুনলে তো, মেয়েটাও মারা গেছে। তাই এখন অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে দেখলে ওদের ভাল লাগে, তাদের সাথে সময় কাটাতে চায়। ব্যস, এই তো!
সুচন্দ্রা এবার একটু ভাববিহ্বল স্বরে বলে, ‘হয়ত তাই...’ তারপর আবার একটু ভেবে নিয়ে বলে, ‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে অন্যরকম কিছু হলেও হতে পারে।‘
- কি বলতে চাইছো তুমি?
ঠোঁট উলটে সুচন্দ্রা বলে, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না’।
রণক ওর কথায় পাত্তা দেয় না, ‘ধুর্‌ তোমার কথা রাখো তো। নেমন্তন্ন করে আশা করি বিষ মিশিয়ে খাওয়াবে না’।
সুচন্দ্রা এবার হেসে ফেলে, ‘আরে ধুর্‌ আমি কি তাই বলেছি নাকি? আচ্ছা, একটা ব্যাপার তুমি খেয়াল করেছো?
- কি?
- চন্দ্রনাথের নাকের নীচে একটা ছোট্ট লাল জড়ুল আছে।
রণক অধৈর্য হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে?’
সুচন্দ্রা একটু রহস্য করে বলে, ‘তোমারও কিন্তু ঠিক একই জায়গায় লাল জড়ুল আছে’।
রণক একটু বিস্মিত হয়, সে বলে, ‘তার মানে? কি বলতে চাইছো?’
সুচন্দ্রা আবার ঠোঁট ওলটায়, ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না’।
এ নিয়ে ওদের আর কথা এগোয় না। প্রসঙ্গান্তরে চলে যায় রণক।

* * *

‘চিংড়ি মাছের মালাইকারি আগে কিন্তু এত ভাল খাইনি। কি বল? রান্নার হাত আপনার কিন্তু দারুণ, কাকিমা’। থালার শেষ ঝোলটুকুও সাপটে খেয়ে আঙুল চাটতে চাটতে রণক বলতে থাকে। সুচন্দ্রাও তার কথায় সায় দেয়। কাকিমা ওর কথায় মৃদু হেসে বলে, ‘তাও তো মশলা দিইনি ঠিকমত। আর এই বিদেশ বিভূঁইয়ে কি আর সব কিছু ঠিকমত পাওয়া যায়?’
রণক দেখতে থাকে, হোটেলের ঘরেই একদিকে রান্নাঘর। আর সেখানে গ্যাস ওভেন, সিলিন্ডার। রান্নাবান্নার জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম – এরা এখানে বেড়াতে এসেছে না সংসার পেতেছে বোঝা যাচ্ছে না। চন্দ্রনাথ খাটের ওপর বসে বর্তমান পড়ছে। আর তার পাশেই একটা ছোট্ট টেবিল সেখানে বসে খাচ্ছে রণক আর সুচন্দ্রা। সুচন্দ্রার বরাবরই খেতে একটু সময় লাগে। লাঞ্চ হোক বা ডিনার আধঘণ্টা তার লাগবেই।
তবে একটা ব্যাপার দেখে অবাক হল ওরা দুজনেই। চন্দ্রনাথ কিন্তু এখন একটু যেন গম্ভীর। সময়ে সময়ে দুএকটা মন্তব্য করা বই তো তার মুখে কথা নেই। একমনে কাগজ পড়ছে। অন্য সময়ে যার মুখে খই ফুটত, তার এহেন আচরণে সুচন্দ্রা আর রণক দুজনেই কিছুটা বিস্মিত হল। রণক তো একবার জিগ্যেস করেই ফেলল, ‘কাকুকে কিছুটা গম্ভীর লাগছে? কিছু চিন্তা করছেন নাকি?’
চন্দ্রনাথবাবু মুখে হাসি টেনে বলল, ‘না বাবা, তা নয়। আসলে অনেকদিন পরে আজ একটা অধরা জিনিসকে হাতের মুঠোয় পেয়ে এত ভাল লাগছে। কতদিন ধরে আমি এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম....’ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল চন্দ্রনাথ। তার স্ত্রী ধমকে উঠল, ‘তুমি কিসব যা তা বলছ বল তো? ওরা নতুন এসেছে, আমাদের সঙ্গে ওদের আজকেই প্রথম পরিচয়। তোমার এই ভাবসাব দেখে ওরা কি ভাববে বল দেখি’।
স্ত্রীয়ের ধমকে প্রথমটায় চন্দ্রনাথবাবু কিছু থমকে গেল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, জানি ওরা হয়ত আমাদের বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাতে কি? আমি ওদের সব জানিয়েই যাব’।
চন্দ্রনাথবাবুর স্ত্রী বলল, ‘কি বলছ কি তুমি?’
- হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এই বলে সে হাতের কাগজটাকে বিছানার একপাশে ভাঁজ করে রাখল।
সুচন্দ্রার খাওয়া তখন সবে শেষ হয়েছে। বিস্মিত হয়ে গেছে রণক আর সে। কি বলছে এরা দুজনে? হঠাৎ এত কথা কাটাকাটিই বা কেন? রণক জানতে চায়, ‘কি হয়েছে? আপনারা এমন উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন কেন? কি বলতে চান আমাদের?’
চন্দ্রনাথ বলতে শুরু করল, ‘শোন ভাই, কথাটা এবার খোলাখুলিই বলি। আমার আসল নাম চন্দ্রনাথ পোদ্দার নয়। আমার নাম রণক ঘোষাল’। তারপর সে তার স্ত্রীয়ের দিকে আঙুল তুলে দেখাল, ‘আর ওর নাম হল সুচন্দ্রা দাস’। চন্দ্রনাথের স্ত্রী মুখটাকে অন্যদিকে সরিয়ে নিল।
রণক বোকাবোকা একটা হাসি হেসে বলে, ‘কিসব বলছেন আপনি? এ তো আমাদের নাম!’
- ঠিকই বলছি। শোন, হয়ত তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। তবু বলি। অনেকদিন ধরেই আমাদের ইচ্ছে ছিল, আমাদের নিজেদের অতীতটাকে দেখবার। আমি ২০৭৪ সাল থেকে আসছি। আসলে টাইম মেশিনে করে যেকোনো সময়ে ভ্রমণ করাটা আমাদের কাছে আর কোন ব্যাপারই নয়। আমরা দুজনেই আমাদের অতীতটাকে খুঁজতাম পুরীর সিবিচে। সে কারণে পুরীতে মাঝে মধ্যেই আসতাম। আমার মনে ছিল পুরীতে আমরা দুজনে হানিমুন ট্যুরে এসেছিলাম। কিন্তু পুরীর এই জনসমুদ্রে নিজেদের কিছুতেই খুঁজে পেতাম না। আজ হঠাৎই পেলাম। কি বলব, এত আনন্দ হচ্ছিল। অথচ নিজেদের পরিচয়টাও দিতে পারছি না। জানি, তোমরা বিশ্বাস করবে না। সেই কারণে একটা ছদ্মনাম বলে তোমাদের সাথে পরিচিত হয়েছি। তোমাদেরকে যে বাড়িতে এনে খাওয়াতে পারলাম, সেটাই আমাদের বড় পাওনা।
এই বলে চন্দ্রনাথ থামল। সুচন্দ্রা বলল, ‘কিন্তু আপনার এই কথাগুলো কিন্তু আমরা সত্যিই বিশ্বাস করতে পারলাম না। এটা কি করে সম্ভব?’
চন্দ্রনাথ একটু মৃদু হাসল। তারপর খাটের পাশের একটা টেবিল থেকে একটা সাদা খাম সুচন্দ্রার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা এখন খুলো না। কাল সকালে ট্রেন ধরবে। ট্রেনে উঠে তারপর দেখো’।

* * *

পরের দিন ফেরার সময় ট্রেনে যেতে যেতে সুচন্দ্রা রণককে জিগ্যেস করল, ‘আচ্ছা, চন্দ্রনাথবাবুর কথাগুলো তোমার বিশ্বাস হয়েছে?’
রণক মোবাইলে ক্যাণ্ডি খেলছিল, মুখ না তুলেই উত্তর দিল, ‘একদমই নয়। ওসব ফালতু গাঁজাখুরি গপ্পো আমার ভাল লাগে না’।
সুচন্দ্রা প্রথমে কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, ‘আচ্ছা হতেও তো পারে ওনার কথাগুলো সত্যি। যদি হয়, তাহলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার! আর তাছাড়া আমরা জানবোই বা কি করে, আমাদের বয়সকালে টাইমমেশিনে করে নিজেদের ছোটবেলাটাতে চলে যাওয়া যাবে কিনা?’
খেলা রেখে মোবাইলটা একপাশে সরিয়ে রণক বলে, ‘ওদের সাথে মিশে মিশে তোমার মাথাটাও দেখছি গেছে। দেখো, বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরা মানুষের একটা সাধারণ লক্ষণ। ওদেরও তাই হয়েছে। আর আমার ধারণা, মেয়ে মারা যাবার পর ওদের মাথাটা আরোই বিগড়েছে। সেই কারণে আমাদের মত দুজন অচেনা কাপলকে ডেকে এনে জামাই আদর করে খাওয়াতে বসে গেছে। হয়ত এটা ঠিক, আমাদের মধ্যে ওরা নিজেদের ছোটবেলাটা খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে, আমাদেরকে নিজেদের অতীত বলে ওদের দাবী করাটা মোটেই ওর উচিত হয়নি। যতসব ভাট’।
রণক থামল। সুচন্দ্রা ওর দিকে একটা সাদা খাম বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা আমাকে চন্দ্রনাথবাবু দিয়েছিলেন’।
খামটা খোলাই ছিল। ভেতর থেকে রণক একটা ছবি বের করে আনল। ছবিটা তাদের বিয়ের ছবি। অবাক হয়ে রণক দেখল বিয়ের সময় তাদের মালা বদলের ছবি।
সুচন্দ্রা বলে, ‘আমি কিন্তু বিয়ের সময় এই শাড়িটাই পড়েছিলাম। আর তুমিও এই লাল ধুতিটাই পড়েছিলে। মনে আছে? আর ফোটোটার পিছনে দেখো কি লেখা আছে?’
রণক উলটে দেখে সেখানে লেখা আছে, আমাদের বিবাহ ০৯.০৯.২০১৮।
সুচন্দ্রা বলে, ‘এ ছবিটা তাহলে চন্দ্রনাথবাবুর হাতে এলো কিভাবে?’
রণক খানিকক্ষণ উল্টেপাল্টে ছবিটাকে দেখে সুচন্দ্রাকে ফেরত দিয়ে দেয়। তারপর বলে, দেখো, বিয়ের শাড়ি আর ধুতিটা মোটামুটিভাবে আজকের দিনে কমন। কাজেই এটা বানানো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। আর কয়েকদিন আগেই তো ৯ই সেপ্টেম্বরের বিয়ে গেল। ফলে ডেটটাও আন্দাজ করেই নেওয়া যায়। আর ফটোশপ করে আজ কি না করা যায়? কে বলতে পারে, এ ছবিটা পুরোটাই ফেক। সুপারইম্পোজ করে করা। পুরীর সিবিচে ওনারা আমাদের ছবি তুলেছিলেন, মনে আছে?
সুচন্দ্রা বলে, ‘হ্যাঁ, তা আছে, কিন্তু এত কিছু ব্যাপার একসাথে পুরোটাই কাকতালীয়ভাবে মিলে যাবে, এটাও কেমন বিশ্বাস হয় না, তাই না? আর তাছাড়া ওদের দেখে তোমারও তো চেনা চেনা মনে হচ্ছিল।’
রণক উত্তর দেয়, ‘ও ওরকম মাঝে মাঝে অনেককে দেখেই লাগে। তাই বলে এইসব আজগুবি গল্পে বিশ্বাস করবার লোক আমি নই।’ তারপর কিছুক্ষণ থেমে আবার সে বলে, ‘তবে যাই বল তাই বল আমার মনে হচ্ছে, চন্দ্রনাথ বাবু খুব রসিক মানুষ। নইলে এমনটা কেউ করত না।’
মুচকি হেসে সুচন্দ্রা বলে, ‘তা আর বলতে, তোমারই মত রসিক।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন

লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য

এটি একটি হাল্কা চালের গল্প। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এতে কোন বিজ্ঞানধর্মীতা নেই। কিন্তু আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত পড়ে গেলে পাঠক বুঝতে পারবেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর একটা অঙ্গুলিনির্দেশ এখানে রয়েছে। পাঠকগণ, গল্পটা পড়ুন, আশা করি, পড়বার পর সবটাই বুঝতে পারবেন।

০৫ সেপ্টেম্বর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৮ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪