আমিও কি তবে ভালবাসি তারে

অভিমান (এপ্রিল ২০২১)

কাজী জাহাঙ্গীর
  • 0
  • ৫৫৩
এক.

অনেকদিন ক্লাসে যাই না, কিন্তু এবার না গিয়ে উপায় নেই। সামেনের ৫ তারিখ তিতাসের জন্মদিন, তাকে উইশ করার পরিকল্পনা বানাতে হবে। অনেক দুর থেকে কলেজে যেতে হয় আমার, পাবলিক বাসের ঠেলাঠেলি ভেঙে প্রতিদিন কলেজে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না। তাছাড়া পারিবারিক দৈন্যতাও কখনো কখনো বাধ সাধে কলেজে না যেতে কারণ আসা যাওয়ার খরচ যেগাড় না হওয়া। যাক গে সে কথা । আমি, মিজু তিতাস একই প্র্যাকটিক্যাল টিমের সদস্য। টিমে আরো সদস্য থাকলেও কেন জানি না আমরা তিনজন কেমন করে একই মানসিকতা বা কেমন যেন একজন আরেক জনকে বুঝতে পারা বা সহযোগীভাবাপন্ন হিসেবে একটা টিম ওয়ার্ক দাড় করিয়ে ফেলেছি। একজন না এলে আরেকজন সাহায্য করা, ক্লাসনোট সংগ্রহ বা নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা পরযালোচনা করে একটা প্র্শ্নোউত্তরের অবকাঠামো দাড় করিয়ে ফেলাতে আমাদের মননে বেশ সামঞ্জস্যতা এসে গিয়েছিল। তিতাস একমাএ মেযে সদস্য হওয়ায় তার প্রতি দুজনেরই একটা এক্সট্রা সমাদর ছিল আমাদের মাঝে। তিনজনই প্রাইভেট পড়ছি একই অধ্যাপকের কাছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ার। কলেজ গ্রা্উন্ডে ঢুকতে আমাদের একটু আগে পরে হতে পারে, কিন্তু ক্লাস শেষে ফিরে যাবার সময় তিতাসকে নিরাপদে গাড়িতে তুলে না দিয়ে দুজনেরই বাসায় ফেরা হয় না। তিন বন্ধুর এই একান্ত হৃদ্যতা তিনজনকেই একটা অদৃশ্য সুতোয় বেধে রেখে‡Q এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে যেন। কলেজের ক্লাস শেষে ফাঁকা সময় পেলেই তিনজন হাঁটতে হাটতে গুলজার হোটেলের সেই অর্ধেক ফলস ছাদ দিয়ে বানানো দোতলায় বসে ভাজা ছোলাবুট, সাথে আলুর চপ খাওয়ার সেই মুহুর্তগুলোর কথা কখনো ভোলা যাবেনা। ভোলা যাবেনা মিজুÕর অবদানও, ওই শালা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের সন্তান হওয়ায় ওর পকেট সবসময় তাজা থাকতো, তাই প্রায়ই খাওয়াদাওয়ার পর বিল পরিশোধ করা বা গাড়ি ভাড়া মেটানোর কাজটায় আমাকে টেনশন নিতে হতো না। আর তিতাসতো আছেই দ্বীতিয় জন হিসাবে, সুতরাং আমি এসব ব্যাপারে থার্ড পারসোন সিঙ্গুলার নাম্বার হয়েই থাকতাম।


দুই.

প্রস্তুতি নিয়েছিলাম এবার তিতাসের জন্মদিনে আমিই তাদের খাওয়াব। ৫ অক্টোবর একটু আগেভাগেই কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়েছি। উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের বারান্দায় উবু হয়ে রেলিং এ কুনুই ভর দিয়ে দৃষ্টি ধরে রেখেছি পথের দিকে কখন তিতাসকে দেখতে পাবো। চট্টগ্রাম কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের দোতলার বারান্দায় দাড়ালে একটা সুবিধা ছিলো যেদিক থেকেই ছাত্র ছাত্রী আসতো দেখা যেতো। ডানপাশের খেলার মাঠের দিক থেকে, কেন্টিন গেট দিয়ে লাইব্রেরীর সামনে দিয়ে, একাডেমিক ভবন থেকে বেরিয়ে বাংলা ভবনের পাশ দিয়ে পাহাড় ঢাল বেয়ে নেমে আসা পথে অথবা কলেজের মুল ফটক বেয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রী মিলনায়তনের পাশ বেয়ে নেমে আসা সিড়ি দিয়ে, যেদিক থেকেই আসুক না কেন পরিস্কার দেখা যেত। আর যদি জীববিদ্যার গলি বেয়ে উঠে উদ্ভিদ বিদ্যা ভবনে আসে তাহলে তো ক্লাসে ঢোকার আগে আমার সামনেই পড়তে হবে। ক্লাসের সময় বোধ হয় হয়ে গেল, মিজু ডাক দিল ক্লাসে যেতে। তিতাস এলো না। মিজু’র ডাকে ক্লাসে আসলেও কিছুতেই মনোযোগ বাড়াতে পারছিনা স্যারের লেকচারএ। আমার অন্যমনষ্কতা স্যারেরও দৃষ্টি এড়ায়নি, তার জন্য বেশ বকুনিও খেতে হল। ক্লাস শেষ হতেই মিজুকে প্রশ্ন করলাম-

- তিতাস এল না কেনরে?
- আমি কী করে বলবো কেন এল না
- গতকাল এসেছিলো ?
- হ্যাঁ এসেছিলো
- তো আজকের ব্যাপারে কোন আলাপ করেছিলি, আজকের প্ল্যান কী?
- না, তুই আসিস নি তাই আমিও কিচ্ছু বলিনি
- বিকেলে কি ওর বাসায় যাবি ?
- না দোস্ত, আমার অন্য একটা কাজ আছে। এই নে ৫০টাকা, একশ টাকার একটা ফুলের বাকেট কিনে তুই ওর বসায় গিয়ে দিয়ে আসিস।

শালার কথা শুনে মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলালাম। তিনদিন অনুপস্থিত থাকার পর তিতাসের জন্মদিনে ওদের খাওয়ানোর একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কলেজে এলাম আজ, মিজুর ভাবটা দেখে পিত্তিটা জ্বলে গেল। ওর টাকা দেওয়ার ভঙ্গিটা দেখে নিজেকে একটা ফকির মনে হলো। কিন্তু আজ পকেটে কিছু টাকা ছিল বলে প্রথমে একটু ভাব দেখালাম-
- না, না, লাগবে না টাকা, তুই না গেলে আমিও যাব না। থাক গা…
- আরে যা না, দু’জনে শেয়ার করে নে
- না না টাকা লাগবে না, আমার কাছে টাকা আছে। আজকে আমি তোদেরকে খাওয়ানো প্রস্তুতি নিয়ে এসছিলাম।

কথাগুলো শুনে একটা মৃদু হাসি দিয়ে ও আমার দিকে তাকাল, আমিও ওর দিকে তাকিয়ে। আমি যদিও একটা ভাব নিয়ে নিলাম তবু মনে মনে এই ভেবে একটু দুর্বলতা অনুভব করলাম যে, টাকার বিষয়ে ওর সাথে আমি কিন্তু পেরে উঠব না। তারপরেও ওর টাকাটা নিতে রাজী হলাম না, ওই শালা আসলে ম্যানেজ করতে পারে। একটা স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে বলল-

- ঠিক আছে ওগুলো রাখ্ এখন, ও আসলে তিনজন একসাথে খাবো পরে। এখন যা, আমি এগুলো শেয়ার করছি। কিছু ফুল কিনে ওকে দিয়ে আয়।

হাতের মধ্যে জোর করে টাকাটা গুজে দেওয়ায় আর না করলাম না। ভাবলাম ভালই হলো, একা যাবো তিতাসের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুল কিনতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হল। অলরেডি দুপুর গড়িয়ে গেছে এখন খাওয়ার এসময় যাওয়া ঠিক হবে না, তাতে তিতাস দুপুরের খাবার নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওকে হঠাৎ করে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিতে মন সায় দিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম বিকেলেই যাবো। শেষ বিকেলের দিকে কয়েক গোছা রজনীগন্ধা আর গোলাপ নিয়ে তিতাসের বাসায় ঢুকলাম। ও কিন্তু ভাল চটপটি রান্না করতে পারে, তিতাসের জন্মদিনে ওর হাতের রান্না করা চটপটি খাওয়া আমাদের জন্য একটা বাড়তি আকর্ষন ছিল। ইচ্ছেমত চটপটি খেয়ে অনেক্ষণ চুটিয়ে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে যখন বেরুতে যাবো তখনই যেন চোখে শর্ষে ফুলের ভুত দেখতে পেলাম। আর যা দেখলাম তাতে আমার শরীরে চিমটি কেটে দেখার ইচ্ছে হল, আমি কি সত্যি দেখছি কিনা। মিজু একোন খেলা খেলল আমার সাথে। সে কি আমার দৈন্যতাকে উপহাস করলো। আর একটা মিনিটও ওই বাসায় আমার বসতে ইচ্ছে হল না। বিদায় নেওয়ার জন্য্ উঠে দাড়িয়েছি, তিতাসের মুখের দিকেও তাকাতে পারছি না। জ্বল জ্বল করা আমার চোখের ক্ষোভাগ্নিতে মনে হলো ওর চেহারায় গোধুলির রঙিন আস্তরনের মত একটা আভা ভেসে উঠেছে, সেটা কি আমার অপমানের লজ্জায়, নাকি মিজু Õর আগমনের আনন্দে বুঝতে পারলাম না। উঠে গেছি তো উঠে গেছি, সে কী ভাববে না ভাববে তার তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। আমার পথ যেন আর ফুরোয় না। কম্পিউটারের জিপ করা দৃশ্যের মত বার বার চোখের সামনে সেই দৃশ্যপট ভেসে উঠছে শুধু। তারপরও পাগুলো ঠেলে ঠেলে সামনে ফেলে ফেলে গন্তব্যহীন পথ ভাঙার যুদ্ধে নেমেছি যেন।


তিন.


আমি বিদায় নিয়ে উঠতে যাবো এমন সময়ে কলিং বেল বেজে উঠল। তিতাস আমাকে একটু বসতে বলে দরজা খুলতে গেল। ড্রইং রুমের সোফায় বসে আমার চোখ জোড়া সি সি ক্যামেরার মত স্থির হয়ে আছে দরজায়। ময়ুর পেখমের মত ফুলের বাকেটের পেছনের বড় ডালাটা দেখলাম খুবঘন করে গোলাপ দিয়ে ঠাসা। দরজার প্রস্থ সমান বিশাল ডালাটা আগে ঘরের দিকে ঢুকিয়ে বাঁকা হয়ে প্রবেশ করতে দেখলাম মিজুকে। আমি তো জানি সে আসবে না। সে আমাকে বলেছিল তার অন্য কাজ আছে, তাই সে আজ আসতে পারবে না। তিতাসের জন্য ফুল কিনতে সে আমাকে টাকাও দিয়েছিল। তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে এ কোন্ খেলার সূচনা ঘটালো সে?

- ইস , আমি আর ভাবতে পারছি না। এই কি আমাদের সমমানসিকতা ?


অনেক কষ্টে নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছি এই বলে যে, এতে আর ভাবা-ভাবির কী আছে। বন্ধুত্বের সিড়ি ডিঙ্গিয়ে তিতাস আর মিজু হয়তো আরো এগিয়ে গেছে। দিনের পরদিন আমি যখন ক্লাসে আসি না, তখন ওরাতো এক সাথে ক্লাস করে, এক সাথেই প্রাইভেটে যায়। আর ক্লাস শেষে মিজুই তো ও’কে গাড়িতে তুলে দেয়। তৃতীয় কেউ যদি সাথে না থাকে তাহলে এটাতে হতেই পারে। এভাবে হয়তো আরো কাছাকাছি এসেছে দুজন। তাই জন্মদিনের এই মোক্ষম সময়ে নিজেকে নিবেদন করার সুযোগ মিজু হাতছাড়া করবে কেন? তাই হয়তো আমাকে এড়াতে চেয়েছে সে ঐ ছলচাতুরিতে। তবুও মনকে বোঝাতে পারছিনা তাতে আমার সমস্যাটা কী। মিজু যদি তিতাসকে ভালবেসে থাকে তো ভালবাসবে, আর তিতস যদি মিজুকে গ্রহন করে নিতে চায় তো নেবে, তাতে আমার কিসের এত মাথা ব্যাথা?

এসব ভাবনায় আমার সমস্ত মস্তিষ্ক যেন উলট পালট হয়ে যায়। তারপর মনটা যেন বিবেক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসলে তোমার ক্ষতিটা কী, ভাবতো পার ?

বিবেকের এই প্রশ্নে আমার চলার পথটা হঠাৎ যেন থমকে যায়। সারা শরীর আমার ঠান্ডা হয়ে আসে। মিজুকে এই মুহুর্তে হাতের কাছে পেলে ইচ্ছেমত ধোলাই করে নেয়ার সাধ হলেও বিবেক বেটা আরো একটা প্রশ্ন মনে করিয়ে দিলো

- তুমি এত জ্বলছ কেন হে ? তুমিও কি তবে তিতাসকে…

এবার সিডর এর চেয়েও বিশাল একটা ঘুর্ণিঝড় যেন ধেয়ে আসলো আমার দিকে। আকাশের সমস্ত নীল যেন নিংড়ে আসে আমার ব্যাথার ছাইদানিতে। বাগানের সমস্ত ফুল যেন ঝপ ঝপ করে ঝরে পড়ে গেল, যদি উম্মাদ আমি সব তছনছ করে ফেলি তার আগেই । তিতাসের সে আভাময় চেহারাটা যেন আবার ঘুরে দাড়ায় আমার চোখের সামনে। এই মুহুর্তে মনে হলো আমি মিজু নামের কাউকে চিনিনা। অন্তরের চিলোকোঠায় যেন এতদিন তোলাছিল তিতাস নামের একটা গোলাপ, সেটা এখন কার হবে ?

- আমিও কি তবে...

ভাবনার ঘুনপোকাগুলো অভিমানে চুপসে যায় হঠাৎ। বিবেকের প্রশ্নে মনটা শুধু চিৎকার করে উঠে

- তিতাস…, তিতাস...
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মোঃ মাইদুল সরকার গল্পটা আরেকটু ঘটনাবহুল ও বিস্তৃত হলে দারুণ হতো। বন্ধুত্বের গল্প পাঠ এ ভাললাগা জানবেন।
ফয়জুল মহী সুনিপুনতায় ভরপুর সুনীলবর্ণ চয়ন

২৪ আগষ্ট - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৪৬ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "অবহেলা”
কবিতার বিষয় "অবহেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৪