এক…
মহিলাটার বয়স মনে হয় ত্রিশের কাছাকাছি হবে। তবুও শরীরটা বেশ মেদবহুল বলে বয়সটা একটু বেশীই লাগছে। কিন্তু তারপরও এমন না যে তাকে আন্টি বলে ডাকতে হবে।সঙ্গে কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেই, ছেলে বা মেয়ে কাউকেই সাথে দেখা যাচ্ছে না সেরকম। মনে হয় একাই শপিং এসেছে সে। শাড়ী কিনবে তাই বিপনি বিতানেরে ঐ দোকানটাতে দেখছিলো একটার পর একটা। কিছুতেই যেন পছন্দ হচ্ছে না। পছন্দ হচ্ছে না দেখে সে যেমন বিরক্ত হচ্ছে, বিক্রেতা ছেলেটাও বোঝা যাচ্ছে শাড়ী দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে মহিলাটা যখন বলে উঠল
-আচ্ছা, অন্য কোন রকম কালেকশন আছে কিনা দেখান ত। ছেলেটা তখন চটকরে বলে ফেলল
- না আন্টি, আর কোন ডিজাইনের কালেকশন নাই। সব দেখাই ফালাইছি।
কথাটা শুনতেই মহিলার কপালটা যেন একটু কুচকে গেল। আরো বোঝা গেল তার চোখ-মুখ যেন রাগে লাল হয়ে উঠছে। ঠিক যেমন বিষধর সাপ ছোবল দেওয়ার জন্য ফনা তুলে সটান হয়ে দাড়িয়ে যায় সেরকম। কিন্তু মনে হল মহিলাটা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিচ্ছে। একটু স্বাভাবিক হয়ে, ঠিক কেমন যেন উত্তেজনাটা প্রশমন করেই আস্তে করে বলল
- এই তোমার বয়স কত?
- ২৪ বছর
- তো, আমার ২৭ বছর হলে তোমার সাথে পার্থক্য কত হল? তাতে কি আমি তোমার আন্টি হয়ে গেলাম?
- সরি , সরি আপা ভুল হয়ে গেছে।
- ঠিক আছে রাখো তোমার শাড়ীগুলো , আমার পছন্দ হচ্ছে না।
বলেই মহিলাটা যেন দোকান থেকে হন হন করে বেরিয়ে গেল। দোকানে দুজন কাষ্টমারই ছিল সেই মহিলাটা আর সোহেল, সোহেল অনেকক্ষণ ধরে দোকানের ক্রেতা হিসাবে বিষয়টা দেখছিলো আর একটু মজাও পাচ্ছিল যেন। দোকানের ক্যাশে বসা মাঝ-বয়সি সওদাগর তার বিক্রয় কর্মচারীর কান্ড কারখানা পরখ করছিলেন, মনে হল মহিলাটা বেরিয়ে যেতেই তিনিও মুচকি মুচকি হাসছিলেন। মাঝে কয়েকবার সোহেলের সাথে দোকানদারটার চোখাচোখি হয়েছিল বলে সে দোকানের ভিতরকার পরিবেশ এবং বিক্রয় প্রতিনিধিদের ভদ্রতা, অভদ্রতা আর সৌজন্যবোধ এসব নিয়ে বেশ চিন্তিত বোধকরছিলো। যদিও সেখানে সে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি মহিলাটার সাথে সহমর্মী হওয়ার, তবুও ছেলেটার এমন রসহীন কাটখোট্টা আচরন সোহেলের একদমই পছন্দ হয়নি।
দুই…
এধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনা সোহেলের নজরে পড়েছিলো বিভিন্ন মার্কেট-সুপারমল এ শপিং আর ঘোরাঘুরি করার সুবাদে। কিন্তু এবারের বিষয়টা একেবারে চোখের সামনে হওয়ায় সেও বেশ ভাবাভাবি করছে বিষয়টা নিয়ে। আসলে আমাদের দেশের এসব দোকান কর্মচারীদের বলতে গেলে কোন প্রশিক্ষনই নাই। কিভাবে গ্রাহক সমাদর করবে বেচা বিক্রি বাড়ানোর জন্য অথবা কাস্টমারদের সাথে যে একটু কৌশলী আচরণ করতে হবে, এমনকি গ্রাহকদের নজর কাড়ার জন্য পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শনের কোন তরিকাও যেন তাদের জানা নেই।অনেক দোকানদারদের বলতেও শুনেছে সোহেল
-আরে ভাই পছন্দ হইলে নেন, না হইলে যানত ভাই। এত প্যাচালের দরকার নাই।
তার মধ্যে মহিলা গ্রাহকদের সাথে অসৌজন্যমুলক আচরণের অভিযোগত আছেই। আসলেই দেশটাতে হল কী কে জানে? মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা জিনিষটা যেন দিন দিন শুন্যের কোটায় চলে আসছে। কী রাজনীতি বলেন আর সামাজিক পরিবেশ বলেন সবখানেই যেন অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।
-যাক গে, এসব ভেবে আমার মাথা নষ্ট করার দরকার নেই বাপু,
বলেই নিজেকে নিয়ে ভাবতে চাইল সোহেল এবার। তবু মাথা থেকে পোকাটা যেন নামতেই চাইছেনা। মনে মনে ভাবলো সে ‘এটা কি তবে আমাদের জন্যে সামাজিক ব্যাধি হয়ে গেল’?
তিন…
পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজার হয়ে জামাল খান, অতঃপর চেরাগী আড্ডায়। অনেকদুর পথ। সন্ধ্যা ৬টার আড্ডায় পৌছতে গেলে দুই/তিন টায় না বেরুলে খবর আছে। তার জন্যই আগে ভাগেই বাস স্টপেজে এসে বাসে চেপে বসল সোহেল। সূয্য মাত্র হেলেছে প্রখরতাটা এখনো বেশ আছে বলে সানগ্লাসটা চোখেরেখেই জানালার পাশের একটা সিটে বসে পড়ল সে।আসার সময় বউটা বেশ করে বলে দিয়েছে-
-দেখ, যেন বেশী রাত হয়ে না যায়। তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু।
-আরে না, পাঁচটায় সবাই চলে আসবে। সাতটায় আমি ঠিকই বেরিয়ে যাবো, তুমি চিন্তা করো না।
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই যেন বাসটা ছুটে চলছে লালখান বাজারের দিকে। যাত্রী সংখ্যাও কম না, দেখতে দেখতে অল্প সময়েই একেবারের ঠাসাঠাসি অবস্থা হয়ে গেল আর ভিতরের তাপমাত্রাটাও যেন থার্মোমিটার ফাটিয়ে পারদগুলো বেরিয়ে পড়বে এখনই সেরকম হয়ে গেল। তারমধ্যে হেলপারটার খিস্তি-খেউর শুনতে শুনতে এযাত্রাটা পাড়ি দিতে হবে এটাই সার। এলোমেলোএসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ করে চান্দিটা যেন আরো এক ছেবলা চড়াক করে উঠলো তার। যখন সে শুনলো ‘আংকেল ভাড়াটা দেন’ বলে কন্ডাকটরটা ভাড়া চাইছে তার কাছে। প্রথমে সে পাত্তা দেয়নি, এবার দেখলো সিটের সামনে দাড়িয়ে থাকা দু’যাত্রীকে ফাঁক করে মাথাটা গলিয়ে কন্ডাকটর বেটা সোহেলের কাঁধে আলতো করে নাড়া দিয়ে আবার বলে উঠল-
- ‘আংকেল ভাড়াটা দেন’।
মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল সোহেলের। বেটা বলে কী। তাকে কী যে বলবে বুঝে উঠতে পারছে না সে।মনে মনে ভাবল ‘বেটার বয়সতো কমনা আমার কাছাকাছিই হবে,তবুও আমাকে আংকেল ডাকল কেন’। কয়েক পলক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো ছেলেটার দিকে। মাথায় তখলো চিন্তার ঘুরপাক চলছে ‘ শালার চুলত এখনও পাকে নি একটাও, বয়স মাত্র ছত্রিশ পেরিয়েছে। ক্লিন সেভ ছাড়া কখনো বের হয় না বাসা থেকে, বন্ধু বান্ধবরা সবসময় স্মার্ট লুকিং বলে বাহাবা দেয় সবসময়। আজকে কী হল তাহলে? এই বেটা বলে কিনা আংকেল?’ নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নেয় সোহেল। ইচ্ছে করল কষে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় বেটার গালে। হঠাৎ মাথাটা যেন একটু নেড়ে সংযত হয় সোহেল। ‘ধুত্তরী ছাই, এসব কী ভাবছে সে, পথেঘাঠে এসব বিষয় নিয়ে মাতামাতি করতে নেই’। নিজেকে নিজে বোঝাতে লাগলো, পাছে হীতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। হাতাহাতি থেকে গনধোলাই এর পর্য়াযেও চলে যেতে পারে পরিস্থিতি, সুতরাং চেপে যাওয়াই ভাল।
- এই নে , লালখান বাজার।
বলেই চুপচাপ ভাড়াটা দিয়ে দিলো সোহেল। যেন কোন উত্তাপ নেই, শান্ত, শীতল হিমেল হাওয়ায় নিস্তব্দ পরিবেশ চারিদিকে, আর দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত দেওয়া কালবৈশাখী যেনো ভিতরে ভিতরে সোহেলকে ওলট পালট করে দিচ্ছে শুধু। সাথে সাথে সেদিনের সেই মহিলাটার কথা মনে হতেই নিজের অজান্তেই ঠোঠটা বাঁকা হয়ে মুচকি হাসি চলে আসলো সোহেলের মুখে। সকাল বেলায় বাচ্চাটাকে নিয়ে যখন স্কুলে যায়, তখন পিচ্চিগুলোর মুখে আংকেল ডাকটা শুনতে বেশ ভালই লাগত কিন্তু আজ প্রথমবার কোন যুবক তাকে আংকেল ডাকাতে সে যেন চমকেই উঠলো। আসলেই আমরা কেউ আংকেল/আন্টি হতে চাই না, সবাই ভাইয়া/আপাই থাকতে চাই বয়স যা হবে হউক।
বাস থেকে নেমে একটু হেটে রাস্তা পেরিয়ে রিকসায় উঠলো সোহেল জামাল খান চেরাগী’র উদ্দেশ্যে। ঢাল বেয়ে রিকসা টেনে নিচ্ছে রিকসাওয়ালা। এখনো আনমনা হয়ে আছে সোহেল , কানের কাছে যেন সেই ডাকটা ভাসছে বার বার, আংকেল… আংকেল..।
লেখার সাথে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা
ব্যাখ্যায় লেখকের বক্তব্য
কাটখোট্টা মানে হলো রসহীন, খামখেয়ালী । আমি গল্পে যে সিকোয়েন্সটা আনতে চেয়েছি সেটা হলো কাছাকাছি বয়সের কেউ যদি আপনাকে আংকেল ডাকে তখন পরিবেশটা আসলেই রসকষহীন , ভারী হয়ে যায়। বাচ্চারা আপনাকে আংকেল ডাকবে তখন আপনি পুলকিত হবেন কারন সে আপনাকে বাপের সমতুল্য করেছে যেখানে দায়িত্ববোধের ব্যাপার নিহিত। আর যখন সমবয়সি বা কাছাকাছি বয়সের কেউ আংকেল ডাকল তখন নিশ্চয়ই সে অবজ্ঞা বা খামখেয়ালী করে ডাকল, এবং সে বুঝাতে চাইল যে আপনি বুড়ো হয়ে গেছেন, যেটা যে কারে ইগো’তে লাগতে পারে। আর সেটা একবারেই একটা নিরস অবমাননাজনক। তাই আমি মনে করি লেখাটাকে সেই দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করে দেখবেন। লেখাতে বিষয়টা আরো পরিস্কার করার জন্য সম্পাদনা করেছি আবার। আশা করি পড়ে দেখবেন। অনেক ধন্যবাদ।
২৪ আগষ্ট - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪