মা’র সাথে ভিক্ষা করতে করতে পথ চলা ছয় বছরের শিশু হোসেনের । আন্দরকিল্লা, মোমিন রোড, নিউ মার্কেট এক বছর যাবত ঘোরাফিরা করতে করতে সব হোসেন’র কাছে পানির মত হয়ে গেছে। কোন্ রাস্তা দিয়ে ঢুকে কোন রাস্তা দিয়ে বেরুতে হবে সেটা তার নখদর্পনে। তাই মাঝে মাঝে এই বয়সেই সে আহ্লাদ আবদারের ইচ্ছা পুরণ না হলে ‘যামুগা’ বলে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। মায়ের চোখের কোণ বেয়ে তখন অঝরে জল ঝরলেও সেই মমতার কোন আঁচড় পড়ে না হোসেনের মনের ক্যানভাসে। অভাগী কুলসুম ছেলে হোসেনকে ছাড়া দু’দন্ড একা থাকতে পারেনা। স্বামী মারা যাওয়ার পর এ ছেলেকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে কুলসুমকে গভীর চিন্তা গ্রাস করে ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে, পিতৃহীন হোসেন এভাবেই কি তবে পিতৃস্নেহের কাঙাল হয়ে অনাদরে অবহেলায় বেড়ে উঠবে? নিজেকে নিজে অনেক সান্তনা দেয় কুলসুম, সে ভাবতে থাকে ছেলের চাহিদা মতো তাকে হয়তো খাওয়াতে পড়াতে পারেনা কিন্তু আদরের ত কমতি নাই। এসব এলোমেলো ভাবনার মাঝে সন্বিত ফিরে পায় কুলসুম পাশে থাকা ছেলেটা যথন যামুগা বলে চিৎকার করে উঠে। যামুগা বলে সে যখন একদিকে দৌড়াতে থাকে মা তখন তার পিছু ধাওয়া করে না, যেখানে ছিল সেখানেই বসে পড়ে। চোখে ভর করে শুধু ছল ছল জল। কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা, কুলসুম এক জায়গাতেই বসে থাকে, তারপর কি হয় কে জানে। হোসেন আবার ফিরে আসে মায়ের কাছে।
-‘চল্ মাও, যামুগা’ আবার মায়ের হাত ধরে চলতে থাকা।
-এহানে কি মেলা অইব মা’ও?
মোমিন রোড পেরিয়ে ডি সি হিলের সামনে এসে দাড়িয়ে গেছে হোসেন। কাল থেকে পহেলা বৈশাখের মেলা শুরু হবে। দ্রুত গতিতে চলছে পূর্ব রাত্রির আয়োজন, সেটা দেখেই মায়ের কাছে জানতে চাইল হোসেন।
-হ বাজান ।
-কহন ?
-কি জানি কাইল না পরশু ।
-মা আইজগা আমি মেলায় থাহুম।
সারাদিনের ভিক্ষা শেষে ডি সি হিল থেকে রেললাইনের বস্তিতে আর ফিরে যেতে চায় না হোসেন।
-কাইলকা আবার আমু ত।
-না, আমি অহন থাহুম
আবার মায়ের কাছ থেকে ভোঁ দৌড়। কুলসুম মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে কড়ই গাছটার নিচে।ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও হোসেন ফিরে আসেনা। অগত্যা কুলসুমকে সারারাত ছেলের জন্য এভাবেই বসেই কাটাতে হয়েছে। দুরের এককোনায় সিঁড়ির ধাপে শুয়েছিল হোসেন শেষরাতের দিকে দেখতে পেয়েছে কুলসুম।
সকাল হতেই মেলার দোকানপাট সাজতে শুরু করেছে।আজ পহেলা বৈশাখ, মেলার বিশাল আয়েজন। আস্তে আস্তে করে লোকে লোকারন্য হয়ে যাচ্ছে মেলার চারপাশ। সিঁড়ির একটা ধাপে শুয়ে থাকা ছেলেকে দেখতে পেয়ে তার কাছে গিয়েই বসেছিল কুলসুম। ঘুমিয়ে পড়া ছেলেকে না ডেকে তার পাশে বসেই রাত কাটিয়েছে মা। সকাল বেলার কোলাহলে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলেও হোসেন ঘুম ভাঙতেই মাকে ছেড়ে আবার দৌড় মারে পাছে মা তাকে মেলা থেকে নিয়ে যায়। কুলসুম চিৎকার করে বলে
- যামু না তো বাজান , আমিও মেলায় থাহুম, আয় বাজান, আমি থাহুম তোর লগে।
প্রথমো কোমর বাঁকা করে দুরে দাড়িয়ে থাকলেও এবার মাও থাকবে শোনার পর আস্তে আস্তে আবার মায়ের কাছে ফিরে আসে হোসেন। কাছে এসে যেন খুব আদরে মায়ের আঁচলের সাথে একটা মোচড় খেকে আবদারের সাথে মা’কে প্রশ্ন করে
- সত্যিই থাকবা মাও, আমার লহে ?
- হ বাজান, কইছিনা থাহুম। ছেলের আবেগের সাথে মা’ও যেন গলে গলে পড়তে থাকে।
মা ছেলে যেখানটায় বসেছিল ঠিক সেখানটায় বাঁশ দিয়ে স্টলের মত করে রাখা হয়েছিল রাতের বেলায়। সকাল হতেই তারা দেখতে পেল ঐ দোকানের সামনের টেবিলে উপুড় করে সারি সারি মাটির সানকি রাখা হচ্ছে। এবার ছেলের চোখ পড়েছে সেইদিকে।দুই আঙুলে পুটলি করে চিবুতে থাকা মায়ের আঁচলটা মুখথেকে বের করে হোসেন জিজ্ঞেস করে
- মা’ও এহেনে মাইনসেরে ভাত খাওয়াইব নিহি?
কুলসুমের মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না, কাল সন্ধ্যায় হোটেল অলার ভিক্ষে দেওয়া রাবার হয়ে যাওয়া নানরুটিটার এককোনা ছিড়ে চিবুতে থাকে সে। আয়োজন দেখে একদৃষ্টিতে ঐ স্টলের দিকে চেয়ে থাকে হোসেন আর মা’র হাত থেকে আচমকা টান দিয়ে নানরুটির টুকরোটা নিয়ে ছিড়ে নেওয়ার জন্য দাঁত দিয়ে হেঁচকাতে থাকে। তীর্থের কাকের মত তখন থেকে মা-ছেলের দুজনার চোখ যেন ঐ স্টল থেকে আর সরে না।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় দিনের কর্মযজ্ঞ, সেই স্টলের সামনে অনেক লোক লাইন ধরে দাড়িয়ে গেছে। মা-ছেলে দেখতে পেল দাড়িয়ে দাড়িয়ে অনেকে সানকি ভরা ভাত খেতে শুরু করেছে(পান্তা ইলিশ)।যেভাবে লাইন দিয়ে মানুষ এগুচ্ছিল, ওরা মনে করলো একবার লাইনে দাড়াতে পারলে হয়তো এইবেলার ভাতের চিন্তাটা দুরে থাকবে। কিন্তু বিধি-বাম, লাইনের দিকে মা-ছেলে যখন এগুচ্ছিল তখন লাইনের কাছাকাছি আসতেই লাঠি হাতে দুজন লোক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তারা ভড়কে গিয়ে দাড়িয়ে গেল,
- অই বেডি, সর সর এহান থেইক্কা।
- অভাই, আমার পুলাডারে দুইডা ভাত দিবা? -কন্ঠে অনেক আকুতি ঝরে পড়ে মা’র।
- অই, অই বেডি, দেহস না দোকান খুইলছি, তরে কি মুফত খাওয়ামু নিহি?
দোকান কর্মচারীর রক্তিম চোখ দেখে আগেই কান্না জুড়ে দিযেছিল হোসেন। কুলসুমও বুঝতে পারলো এটা আসলে কেউ আনন্দ করে খাওয়াচ্ছেনা, ভাত নিয়ে ব্যবসা হচ্ছে এখানে। ইতিমধ্যে লোকজনের আসাযাওয়া বেশ জমে গেছে। হোসেন লক্ষ্য করছে সকলেই হাতে হাত মিলাচ্ছে আর বৈশাখ, শুভেচ্ছা, নববর্ষ ইত্যাদি কি যেন একে অপরকে বলছে। বৈশাখ শব্দটা শুনে হোসেন মা’কে জিজ্ঞেস করলো
- মা’ও হগলতেই ত বই-শাক, বই-শাক কইতাছে, বই শাকডা কী শাক মা’ও?
কুলসুম উত্তর দেয় না, দোকান কর্মচারীর হাতে ধরা ডান্ডাটা বারি মারার জন্য যেভাবে তুলেছিল সেই দৃশ্যটাই তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। মনে মনে সে আল্লাহকে নালিশ করে ‘ আমাগোরে আর কত কান্দাইবা আল্লাহ, আর কত দুঃখু সওয়াইবা, গরীব বইলা তুমিও কি তবে আমাগোরে অবহেলা কর্ ? এই দুনিয়ায় কি আমাগোর দুইডা ভাত খাওনের অধিকার নাই’ ভাবতে ভাবতে পার হয়ে যায় কয়েক মিনিট সময়, ছেলের হোসেনের প্রশ্নে এবার ধাতস্থ হয় সে
- মা’ও শাক দিয়া দুইডা ভাত দিব, হের লাইগা কি আবার লাইন ধরন লাগে? আমাগো লাইন ধরন লাগবো না মা?
- না বাজান, হেরা আমাগো ভাত দিব না । হেরা ভাত বিক্রি করে, পয়সা না দিলে…।
কথা শেষ করতে পারেনা কুলসুম, বলতে বলতে আনমনা হয়ে যায় সে। দোকানের কপালের উপর বড় একটা কাপড়ের(ব্যানার) লেখাগুলো বানান করে পড়ার চেষ্টা করে বর্ণ জানা কুলসুম। কিন্তু হঠাৎ ছেলেটা চিৎকার করে উঠে
- আমি ভাত না খায়া যামুনা, আমি তর লগে থাহুম না। আমি যামুগা… বলেই উল্টোদিকে দৌড়াতে থাকে হোসেন।
কুলসুম মাথায় হাত দিযে বসে পড়ে স্টলটার একুটু দুরে ধুলিমাখা মাটির উপর। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মায়ের মন। অন্তর ভেঙে বেরিয়ে আসে বিলাপ।
- যাইস না বাজান, ফিরা আয়, যাইস না, বাজান…
কুলসুমের মুখে কান্নার বিলাপ ধ্বণি বেরিয়ে এলেও চোখগুলো তখনও ঐ স্টলের ব্যানারের দিকে পড়ে আছে। বিলাপের সুরে সুরে চোখগুলো যেন বানান করে পড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে-
‘প হে লা বৈ শা খ/ আ জি ন ব আ ন ন্দে জা গো/ পা ন্তা ঘ র’…।
২৪ আগষ্ট - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
৪৯ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ এপ্রিল,২০২৫