আমাদের বাড়িতে স্থায়ী অতিথি বেশ ক'জন থাকতেন। তাঁদের মধ্যে আমার প্রিয় মানুষ ছিলেন আমার বড়চাচা। বাবার তিনি মামাতো ভাই। বিষম ফর্সা ফরেনারদের মতোন টকটকে গায়ের রঙ। চুলও একটু লালচে বাদামী ছিলো। আমার বেশ গর্বই হতো যে আমার এমন একজন দারুণ বড়চাচা আছেন। তাঁদের গ্রামের বাড়ি শহর কুমিল্লার অনেক দূরে ফেনীর শর্শদিতে। সেখানে প্রাইমারী স্কুলের পর হাইস্কুলের ভালো পরিবেশের অভাবে বাবার মামা তখন তাঁর ছেলেদেরকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বোনের বাড়ির বন্দোবস্তই করে দিতেন। বাবা ছিলেন তাঁর বাবার একমাত্র পুত্র। তো, সেইসূত্রে বাবার মামাতো ভাইরা ক্রমান্নয়ে আমার বড়চাচা, মেজচাচা, জিয়চাচা ও ছোটচাচা। আমরা ভাইবোনরা কেউই আমাদের দাদাকে চোখে দেখিনি। আমার বাবার বিবাহের আগেই তিনি প্রয়াত। তাই বাবার মামাকেই আমরা ভাইবোনরা দাদা জেনেছি। সেই দাদার একমাত্র বোনটি আমাদের দাদী ও তিনি দাদীর একমাত্র ভাইটি। এসব কারণ মিলিয়েই বাবার মামা ও তাঁর ছেলেরা ফুপুর বাড়িতে শুধুমাত্র অতিথি ছিলেন না। ছিলেন প্রিয় পরিজনের মতোন বন্ধনে বাঁধা। বড়চাচার ছিলো লেখালিখিতে হাতযশ। তরুণ বয়সেই যথেষ্ট পাকাহাত। এবঙ আমাদের প্রায়ই মজা করেই অনেক অচেনা বিষয়ের দারুণ সব নামকরণ করে চমকে দেয়ার কাজটি করতেন। তখন আমাদের শহর কুমিল্লায় বৈশাখে মেলা বসতো বিশাল সমারোহেই ডিগম্বরী তলায়। আমরা বাবা ও বড়চাচার সঙ্গে মেলায় গিয়ে পাতার বাঁশি, শোলার পুতুল, কাঠের ঘোড়া এবঙ মাটির খেলনাপাতি কিনতাম। বড়চাচার খুব বাতিক ছিলো মেলার হরেক মোয়ামুড়কি হাত বোঝাই করে কেনার। দূরদূরান্তের হরেক মন্ডামিঠাই ঠোঙ্গাভর্তি থাকতো। অনেক জিনিসই আমরা জীবনে খাইনি তেমনই অভূত যত রোমাঞ্চকর খাবারদাবার। সেসবের অনেক কিছুরই সঠিক বাংলা নামটি আমাদের অজানা। বড়চাচা বাড়িতে এসেই সেসব খাবারের নামকরণ করতেন। আমরা খাওয়ার আগেই তাঁর একেক নামকরণ জেনেই খেতে পেতাম। কিসব দারুণ মজাদার চমকে ওঠার মতোন নাম। যেমন ফকফকে চিনির দানা মেশানো খইয়ের ঠোঙ্গার মোড়ক খুলেই বলতেন -
- বলতো দেখি এটার নাম?
আমরা কেউ বলেছি -
- ওহ এটাতো খইয়ের মোয়াই হবে।
কেউ বা বলে বসেছে -
- এটা মোয়া না বোকা, খইমিঠাই।
অনেক ভেবেচিন্তে আমিও বললাম -
- আমার মনে পড়েছে এটি নকুলদানা।
বড়ড়চাচা সবার জবাবই নাকচ করে একদমই অজানা একটা নাম দিলেন -
- কেউ জানো না এই খাবারটির আসল নামটা, এটি ওকড়া।
আমরাতো বিস্ময়ে সে নাম মুখস্ত করে তবেই খেতে পেলাম। এমনতর কত যে স্মৃতি! কোনটা রেখে কোনটা বলি!
যেদিন আমাদের বাড়িতে বড়চাচার সবচে' ছোট ভাইটি এলো, সেদিনকার কথাটি বলছি, তাকে আমরা ছোটচাচা হিসেবে সমাদরে বরণ করলেও ছোটচাচার মুখ গোমড়া। তার তখন চোখ ফেটেই জল মায়ের তরে। যাহোক, তাকে সেদিন বড়চাচা ও আমরা মিলে অনেক মজার গালগল্পের মধ্য দিয়েই ভোলানোর প্রয়াস চালালাম। তারপরও তার মনখারাপ। এদিকে সকালে তার পাউরুটির অভ্যেস একদমই নেই। ভাত না হলে ছোটচাচার চলেই না। সে কথা বুক ফাটেতো মুখ ফোটেনা দশা। কেননা আমাদের বাড়িতে সদ্য নতুন এসেছেন। আমার দাদী অর্থাৎ চাচাদের ফুপুআম্মা কিংবা আমাদের মা অর্থাৎ চাচাদের ভাবীজান কি না কি ভেবে বসেন সেই সঙ্কোচেই তিনি তো পাউরুটি একটু নেড়েচেড়ে খানিক ছিঁড়ে গলাধকরণ করতে না পারার মনের কষ্টচাপা বেদনা নিয়ে প্রথম বাড়ির পাশের ইউসুফ হাই ইস্কুলে চলে গেলেন। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধের দিকে ছোটচাচার বাড়ি না ফেরা নিয়ে সবার চিন্তা চরমে। বাবা ও বড়চাচা দুজনে প্রায় ছুটেই গেলেন ইস্কুলে। ছোটচাচাকে ইস্কুলে না পেয়ে অবশেষে খেলার মাঠের বটতলায় পেয়ে একরকম ধরেবেঁধে বাড়িতে আনলেন। ছোটচাচার মুখে হাজার জিজ্ঞাসাবাদেও কথা ফোটে না। শুধু চোখের জল টপটপিয়ে ঝরছে এবঙ ছোটচাচা অনবরত হাতের উল্টোপিঠে চোখের জল নাকের পানি মুছেই চলেছেন। তখন এক পর্যায়ে বড়চাচা ধমকে উঠতেই পড়ার টেবিলের দেয়ালে বড়বড় হরফে ছোটচাচার লেখাটি প্রথম আমার নজরে আসে। আমি তা পড়ে হাসতেও পারছিলাম না, কেননা তাতে তো ছোটচাচা আরও মনোকষ্টেই বাড়িছাড়া হবেন। আমি কেবল ইশারায় বড়চাচাকে দেখাতেই তিনিও হাসি আটকে কোনওরকমে বললেন -
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।