এক
পার্শ্ববর্তী বরশিলা গ্রাম থেকে দাওয়াৎ খেয়ে নির্জন মাঠের মধ্য দিয়ে রাত্রে একা বাড়ি ফিরছেন ছিয়াম মল্লিক। বরশিলা গ্রামের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তাদের জোড়দহ গ্রাম। জোড়দহ গ্রামের ঠিক পূর্ব পার্শ্বেই বাঙ্গাবাড়িয়া নামে ছোট একটি গ্রাম আছে। বরশিলা ও বাঙ্গাবাড়িয়ার মাঝে কোন বাড়ি-ঘর নেই, আছে শুধু জমি। হাতে একটা হারিকেন নিয়ে এই বিশাল মাঠের ভাঙ্গাচোরা রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ছিয়াম মল্লিক।
বাড়িতে তার মা রাজিয়া খাতুন, স্ত্রী মোহসিনা বেগম, দুই ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তার বাবা বেঁচে নেই। ফরিদা পারভীন নামে এক বোন আছে ছিয়াম মল্লিকের। ভগ্নীপতি একটা মুদি দোকানের মালিক, সামান্য জমি-জমাও আছে তার।
ছিয়াম মল্লিকের সাংসারিক অবস্থা খুবই খারাপ। জমি-জমা কিছুই নাই। তিনি একজন সাধারণ গ্রাম্য ইমাম যিনি প্রধানতঃ বরশিলা গ্রামে ইমামতী করেন। কিন্তু শুধু ইমামতী করে সকলের পেটের ভাত জোগাড় করতে পারেন না। তাই হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগলও তিনি পালন করেন।
বেশ রাত হয়েছে। এখন অগ্রহায়ন মাস, সামান্য শীত পড়েছে। মাঠ বা চক-এর মধ্য দিয়ে অর্ধেকের মত পথ অতিক্রম করে খুঁটামারা নামক জায়গায় আসার পর হঠাৎ দু’জন লোক এসে ছিয়াম মল্লিককে বললো যে তাদের একটা বিয়ে পড়ায়ে দেওয়ার জন্য কাজীর দরকার। তিনি যদি একটু যেতেন তাহলে খুব উপকার হতো।
মল্লিকজী অবাক হয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কোথায়?’’
লোক দু’জন জবাব দিলো, ‘‘এই কাছেই।’’
কিন্তু খুঁটামারা থেকে ‘‘এই কাছেই’’ বলতে যেখান থেকে তিনি আসছেন সেই বরশিলা গ্রাম এবং জোড়দহ গ্রামের সঙ্গে সংযুক্ত বাঙ্গাবাড়িয়া গ্রামকেই বুঝায়। আর এই দুই গ্রামের সব লোকই ছিয়াম মল্লিকের পরিচিত। অথচ এই লোক দু’টো যে তার পরিচিতও নয় বা তারা যে স্পষ্ট করে তাদের গ্রামের নামও বললো না এ কথাটা ছিয়াম মল্লিকের খেয়ালই হলো না। তার খুবই অভাব চলছে বলে ওখানে গেলেই অন্ততঃ কিছু টাকা-পয়সা যে তিনি পাবেন এইদিকেই তার খেয়াল বেশী হলো নতুবা তার বুদ্ধি-খেয়ালই গোলমেলে হয়ে গেল, যে কারণে এই সব কথা তার মনেই এলো না।
মল্লিকজী রাজী হলেন এবং বললেন, ‘‘চলো।’’
লোক দু’টো আগে আগে চললো, ছিয়াম মল্লিক চললেন পিছে পিছে। হঠাৎ ছিয়াম মল্লিকের হাতের জলন্ত হারিকেনটা নিভে গেল অথচ অন্ধকারেও তিনি পায়ে চলা পথটি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না।
অল্প কিছুক্ষণ চলার পর তারা সত্যি সত্যি এক বিয়ের মজলিসে উপস্থিত হলো। সেখানে সুসজ্জিত অবস্থায় বর-কনে বসে আছে এবং তাদেরকে ঘিরে অনেক নারী-পুরুষও বসে আছে এবং সবাই যেন মল্লিকজী’র অপেক্ষায়ই ছিলো বলে মনে হলো। এটা কি কোন বাড়ির আঙ্গিনা নাকি কোন ঘরের মধ্যে তা যেন তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না অথচ জায়গাটায় যথেষ্ট আলো আছে।
একটা মুসলমানী বিয়ের অনুষ্ঠানে যা যা করতে হয় তা সবই মল্লিকজী করলেন। সবশেষে দোয়াও করলেন এবং উপস্থিত সকলেই সে দোয়ায় সামিলও হলো। তারপর মিষ্টান্ন বিতরণ করা হলো, অন্য কোন খাওয়া-দাওয়া হলো না। মিষ্টি বিতরণের পরে তারা ছিয়াম মল্লিককে গায়ে দেওয়ার জন্য একখানা পশমী কম্বল দিলো ও মাথায় একটা খুব সুন্দর পাগড়ি বেঁধে দিলো। আর আসার সময় পদ্মপাতায় জড়ানো কিছু মিষ্টি ও পকেটে বেশ কিছু পাঁচ টাকার কয়েন দিলো। ছিয়াম মল্লিক এগুলো নিয়ে বাড়ি রওয়ানা হলেন। সেই দু’জন লোকই তাকে এগিয়ে দিতে এলো।
গ্রামের মধ্যে জন-প্রাণীর কোন সাড়াশব্দ নাই। ছিয়াম মল্লিকের বাড়ির পাশেই হালট বা নীচু রাস্তা আছে। লোক দু’টো তাকে রাখার জন্য একেবারে বাড়ির নীচের সেই হালট পর্যন্ত এলো। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুই কদম এগিয়ে গেলেন তিনি।
হঠাৎ লোক দু’জনের ব্যাপারে কৌতুহল জাগলো ছিয়াম মল্লিকের মনে। তাই তাদের নাম, পরিচয় জিজ্ঞাসা করার জন্য কয়েক মুহূর্ত পর পিছনে ঘুরেই ছিয়াম মল্লিক দেখলেন যে তারা নেই! রাস্তায় যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর তাকিয়েও তাদের দেখা পাওয়া গেল না। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের পক্ষে এতখানি দূরত্ব অতিক্রম করে চলে যাওয়া তো একেবারেই অসম্ভব। তাই ছিয়াম মল্লিক খুবই অবাক হলেন। ভয়ের একটা স্রোত জেগে উঠতে লাগলো তার শরীরের ও মনের মধ্যে।
হঠাৎ হুঁ-উ-উ, হুঁ-উ-উ আওয়াজ কানে এলো। এরপর ধস্তাধস্তির মত শব্দ হলো। এই সময় পাশের তেঁতুল গাছের ডালপালা নড়ে উঠলো। ছিয়াম মল্লিক দেখলেন যে কে যেন তেঁতুল গাছের ডালে বসে আছে। এক লোক তেঁতুল গাছ বেয়ে দ্রুত নামছে আর উঠছে। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, মাত্র এক মিনিট সময়ের মধ্যেই কয়েকবার উঠা-নামা করলো সে। তারপর গাছের উপরে দু’টো আগুনের দলা দেখা গেল।
ছিয়াম মল্লিকের মনে সন্দেহ জাগলো, তাহলে কি ঐ দু’জন আসলে মানুষ নয়? তারা কি জ্বীন? ভয়ে শিরশির করে উঠলো তার শরীর। গায়ের লোমগুলি খাড়া হয়ে গেল।
বিয়ের মজলিসের সকলেই কি তাহলে জ্বীন ছিলো? তার মানে তিনি এত সময় জ্বীনদের সঙ্গে ছিলেন? এসব কথা ভাবতেই ভয়ে ছিয়াম মল্লিকের শরীর কাঁপতে লাগলো। বাড়ির মধ্যে গিয়ে তিনি এক চিৎকার দিয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে তার মা, স্ত্রী-পুত্রেরা এবং আশে-পাশের আঙ্গিনার সবাই ছুটে এলো; সারা রাত মল্লিকজী’র বাড়ি না ফেরায় সকলেই চিন্তিত ছিলো।
পানি ঢেলে ছিয়াম মল্লিককে সুস্থ করে তোলা হলো। ইতিমধ্যে রাতও শেষ হয়ে গেল। জ্ঞান হলে ছিয়াম মল্লিক সব কথা খুলে বললেন। সবাই বুঝলো যে জ্বীনরা তাকে ধোঁকায় ও মায়াজালে ফেলে তাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলো। দেখা গেল যে তার গায়ে একখানা ছেঁড়া চট পেঁচানো আছে, মাথায় আছে অনেকগুলো কলমীর লতা পাক দিয়ে পাগড়ির মত করে পেঁচিয়ে রাখা, পকেটে আছে ভাঙ্গা মাটির কলসের অনেকগুলো ‘খাপড়া’র টুকরা আর নিকটেই পদ্মপাতায় বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে গোবর, ঘুঁটে-এই সব।
দুই
অনেকদিন আগের কথা। রাজিয়া খাতুনের দরিদ্র স্বামীকে শীতের মওসুমে একদিন মেঘলা আবহাওয়ার মধ্যেও জমিতে কাজ করতে যেতে হয়েছিলো। এতে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর টাকার অভাবে যথাযথ চিকিৎসা না হওয়ায় দু’টি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে সহ তাকে অথৈ সাগরে ফেলে সে পরপারে যাত্রা করেছিলো।
আর সেদিন রাতে যা ঘটেছে তাতে রাজিয়া খাতুন পুত্রকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। জীবিকার প্রয়োজনে অধিক রাত অবধি বাড়ির বাইরে অবস্থান করার কারণে বিপদে পড়ে পুত্রও যদি মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহলে পুত্রবধূ এবং নাতি-নাতনীদের জন্য ভিক্ষার ঝুলি হাতে মানুষের দ্বারে দ্বারে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকবে না। তাই তিনি ছিয়াম মল্লিককে রাত্রে বাড়ির বাইরে থাকতে বারণ করে দিলেন।
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ছিয়াম মল্লিকের কপালে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তার স্ত্রী অসহায়ভাবে বললো, ‘‘তোমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার জীবনের সবকিছু কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। আমরা না হয় একটু কম করে খাবো এবং অন্যান্য খরচও কমিয়ে দিবো কিন্তু তুমি রাত্রে বাড়ির বাইরে আর থেকো না।’’
ছিয়াম মল্লিক স্ত্রীর চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার পরনের শাড়িটা একেবারেই পুরানো হয়ে গেছে। স্ত্রীর মাথায় এখন ঘোমটা দেওয়া নেই। চুলে খোঁপা বাঁধা আছে। স্ত্রীর জন্য খুব মায়া হলো ছিয়াম মল্লিকের।
স্ত্রী ছিয়াম মল্লিকের ডান হাত তার দু’হাতের মধ্যে চেপে ধরে কাতর কন্ঠে বললো, ‘‘আমাকে কথা দাও যে তুমি রাত করে আর বাড়ি ফিরবে না।’’
ছিয়াম মল্লিকের দু’চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো। তিনি স্ত্রীর হাত ধরে আলতো করে একটা ঝাঁকি দিলেন। কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলেন না।
সপ্তাহখানেক ছিয়াম মল্লিক রাত্রে বাড়ির বাইরে অবস্থান করা থেকে বিরত থাকলেন। কিন্তু ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ এবং মা, স্ত্রী, শিশু কন্যা সহ সকলের অন্নের প্রয়োজন তো আর থেমে যাবে না। তাই জোড়দহ গ্রামের প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরের চয়ড়া গ্রাম থেকে বিয়ে পড়ানোর দাওয়াৎ এলে ছিয়াম মল্লিক বাধ্য হয়ে সেখানে গেলেন। গ্রামটি হুড়োসাগর নদীর পশ্চিম ধারে অবস্থিত।
তাড়াতাড়ি সেখানে কাজ সম্পন্ন করে মাগরিবের নামাজ পড়েই তিনি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। নদীর ধার দিয়ে উঁচু রাস্তা আছে। সেই রাস্তার সাথে একটা বাজার আছে। ছিয়াম মল্লিক দেখলেন যে সেখানে ইলিশ মাছও বিক্রি হচ্ছে। কিছুক্ষণ দর কষাকষি করার পর তিনি দু’টো ইলিশ মাছ কিনলেন। মাছ দুটো নিয়ে তিনি বাজার পিছনে ফেলে হাঁটতে লাগলেন।
রাস্তায় লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম। নদীর ধারের শ্মশানের দিকে দৃষ্টি যেতেই ছিয়াম মল্লিকের মনের মধ্যে কিছুটা অজানা ভয় জেগে উঠলো।
এখানে একটা বড় প্রকল্প আছে। হুড়োসাগর নদী থেকে বড় বড় মেশিনের মাধ্যমে পানি সেঁচে পশ্চিমে একটা জলাশয়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে স্লুইস গেটের মাধ্যমে পানি পশ্চিম দিকে ইছামতি নদীতে নেওয়া হয়। সেই পানি পাবনা জেলার বেড়া থানার এবং পাবনা-বগুড়া সড়কের পশ্চিমের সাঁথিয়া থানার বিভিন্ন মাঠে সরবরাহ করে ধান চাষ করা হয়। পাবনা-বগুড়া সড়কে বেড়া বাস স্ট্যান্ডের উত্তরে ইছামতি নদীর উপর একটা ব্রীজ আছে।
ইছামতি নদীর ধারের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুদূর আসার পর নদীর ওখান থেকে যে ক্যানালটা শুরু হয়ে ছিয়াম মল্লিকদের গ্রামের পশ্চিম দিয়ে দক্ষিণ দিকে গেছে সেই ক্যানালের পূর্বের বাঁধ ধরে হাঁটতে লাগলেন তিনি।
পূর্ব পার্শ্বের দত্তকান্দি গ্রামের গোরস্থানের নিকট দিয়ে যাওয়ার সময় ছিয়াম মল্লিকের শরীর সামান্য ছম ছম করে উঠলো। তিনি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন।
বাস স্ট্যান্ড থেকে যে রাস্তাটা পূর্বে বেড়া বাজারের দিকে গেছে সেই রাস্তা পার হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর ক্যানালের বাঁধ থেকে বাম দিকে তাদের গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় গিয়ে হাঁটতে লাগলেন ছিয়াম মল্লিক। তার পিছনে ক্যানালের বাঁধ এবং এই রাস্তার সংযোগ স্থলে একটা ছোট বট গাছ আছে। আরেকটু এগিয়ে বাম পার্শ্বে ঈদগাহ মাঠ। মাঠের দক্ষিণেও অনেক পুরনো বিশাল একটা বট গাছ আছে। ঈদগাহ মাঠের পশ্চিম গাঁ ঘেঁষে গিয়ে মাঠের শেষে রাস্তাটি পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে। বট গাছ এবং মাঠের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটি গ্রামের ভিতরে চলে গেছে।
ঈদগাহ মাঠের পশ্চিমে যাওয়ার পর হঠাৎ ছিয়াম মল্লিক দেখলেন যে ধবধবে সাদা পোশাক পরা দু’জন লোক বট গাছ থেকে গাছের ডাল ধরে হুড়মুড় করে রাস্তায় নামলো। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার পূর্বে ঈদগাহ মাঠের উপর দিয়ে তারা হন হন করে ছিয়াম মল্লিক যেদিক থেকে এসেছেন সেদিকে যেতে লাগলো। তাদের শুধু মুখ দেখা যাচ্ছে, শরীরের বাকী অংশ দেখা যাচ্ছে না। মনে হলো, তারা শুন্যের ভিতর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত ছিয়াম মল্লিক তাদের যাওয়া দেখতে লাগলেন। তারা ছোট বটগাছটায় গিয়ে উঠলো।
ভয়ে ছিয়াম মল্লিকের কান, ঘাড় ও মুখমণ্ডল গরম হয়ে গেল। তিনি দ্রুত পা চালালেন। আচমকা পিছন থেকে একটা ভ্যান এসে তার পাশ দিয়ে সামনের দিকে যেতে লাগলো। ভ্যান চালককে তাদের গ্রামের কামরুলের মত মনে হওয়ায় ছিয়াম মল্লিক কিছুটা সাহস পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘কিরে কামরুল নাকি?’’
সঙ্গে সঙ্গে ছিয়াম মল্লিক দেখলেন যে ভ্যানটা নেই! উধাও হয়ে গেছে সেটা! ছিয়াম মল্লিকের গলা শুকিয়ে গেল। তিনি হাঁটা থামালেন না। ঈদগাহ মাঠের দক্ষিণে বট গাছের ডালের নীচে যেতেই হঠাৎ কে যেন ন্যাঁকা স্বরে বলে উঠলো, ‘‘মাছ দিয়ে যা।’’
চমকে উঠে ছিয়াম মল্লিক আশেপাশে তাকালেন। কিন্তু রাস্তায় বা তার কাছাকাছি কাউকে তিনি দেখতে পেলেন না। তাহলে কি বট গাছ থেকে কেউ কথাটা বললো? কিন্তু উপরের দিকে তাকানোর সাহস হলো না তার।
আবার স্বরটি শোনা গেল, ‘‘মাছ রেখে যা।’’
দিশাহারা হয়ে দৌড়ানোর মত করে ছিয়াম মল্লিক হাঁটতে লাগলেন। মনে-প্রাণে তিনি কামনা করছেন, কোন লোক বা পথচারী যেন এসে পড়ে। কিন্তু কোন লোকের দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। অন্ধকারও আজ যেন একটু বেশীই।
বামপাশে রাজা মিয়ার বিরাট পুকুর। পুকুরের পূর্বে উঁচু পাঁচিল ঘেরা তার বাড়ি। তিনি বেঁচে নেই। রাজা মিয়া এক সময় বেড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাড়ির ভিতরে তার কবর আছে।
হঠাৎ বাম দিকে পুকুরের পশ্চিমে প্রায় বিশ ফুট লম্বা একটা কঙ্কাল দেখতে পেলেন ছিয়াম মল্লিক। কঙ্কালটা পুকুরের পানির উপর দিয়ে অনায়াসে হেঁটে পুকুরটা পার হয়ে গেল! তারপর উঁচু প্রাচীর স্বচ্ছন্দে ডিঙ্গিয়ে বাড়ির মধ্যকার গাছপালার ভিতরে চলে গেল!
এরপর ছিয়াম মল্লিক রাস্তা বরাবর সামনের দিকে তাকিয়ে আচমকা দেখতে পেলেন যে পূর্ব দিক থেকে ঘোড়া নিয়ে একজন লোক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘোড়াটি তার কয়েক হাত সামনে আসার পর ঘোড়ার পিঠে বসা লোকটা রাস্তার উপরে চলে আসা একটা গাছের ডাল ধরে উপরে উঠে গেল। আর ঘোড়াটা তার পাশ দিয়ে পিছনে ঈদগাহ মাঠের দিকে চলে গেল।
ছিয়াম মল্লিক গ্রামের তিন রাস্তার সংযোগ স্থলে পৌঁছে ডানে মোড় নিয়ে দক্ষিণে প্রাইমারী স্কুলের দিকে গেলেন। এই রাস্তাটা দুই গ্রামের মাঝখান দিয়ে সোজা দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। স্কুলের কাছাকাছি যেতেই প্রচন্ড শব্দে একটা ঢিল এসে স্কুলের টিনের চালের উপর পড়লো। রাস্তার পূর্বপার্শ্বের উত্তর-দক্ষিণ লম্বা স্কুলের শেষ মাথায় গিয়ে ডানদিকের বাড়িগুলির মাঝের গলির মত রাস্তা দিয়ে পশ্চিমে একটু এগিয়ে বাড়ির নিকটে পৌঁছে তিনি বুক ভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন।
তিনি ধারণা করলেন যে হয়তো শ্মশান কিংবা গোরস্থানের ওখান থেকেই ভূত তার পিছু নিয়েছিলো।
ঘুমের মধ্যে তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে ভয়ঙ্কর দর্শন একটি ভূত খুবই রেগে গিয়ে হুঁঙ্কার ছেড়ে তাকে বলছে, ‘‘তোর কাছে মাছ চাইলাম, কিন্তু দিলি না। তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সামনে দিয়ে আর কোনদিন মাছ নিবি না। যদি নিস তাহলে কিন্তু তোর অনেক ক্ষতি হবে।’’
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর ছিয়াম মল্লিক টের পেলেন যে তার শরীর ঘেমে ভিজে গেছে। স্বপ্নটা নিয়ে অনেক ভাবলেন তিনি। বট গাছের ওখান থেকে যার কন্ঠটা তিনি শুনেছিলেন নিশ্চয়ই স্বপ্নেও সেই এসেছিলো।
মা এবং স্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু জানালেন না ছিয়াম মল্লিক। কারণ তাদেরকে জানালে তারা খুবই দুশ্চিন্তা করবে।
তিন
কিছুদিন পর মোহসিনা বেগম ঘরের বারান্দায় বসে কাঁথা সেলাই করছে। তার শাশুড়ী শিশু মেয়ে মিলিকে নিয়ে উঠোনের একপাশে কতবেল গাছের কাছে বসে আছেন। বড় ছেলে সাগর বেড়া বি. বি. হাই স্কুলে দশম শ্রেণীতে ও ছোট ছেলে সৈকত গ্রামের সরকারী প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তারা স্কুল থেকে এখনও ফেরে নি।
ছিয়াম মল্লিক বাইরে বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে ঘর থেকে উঠোনে নামার পর স্ত্রী বললো, ‘‘আসার সময় ময়দা নিয়ে এসো।’’
ছিয়াম মল্লিক বললেন, ‘‘আচ্ছা ঠিক আছে। একটা ব্যাগ দাও।’’
মোহসিনা বেগম সুঁই, সুতা ও কাঁথা রেখে উঠে গিয়ে ঘরের ভিতর থেকে একটা ব্যাগ এনে ছিয়াম মল্লিকের হাতে দিলো।
ছিয়াম মল্লিক তার মাকে বললেন, ‘‘মা, আমি আসি।’’
তার মা বললেন, ‘‘ফিরতে বেশী দেরী করিস না।’’
ছিয়াম মল্লিক পা বাড়ালেন।
হঠাৎ মিলি তার দাদীর কোল থেকে উঠে এসে ছিয়াম মল্লিকের কাছে গিয়ে বায়না ধরে বললো, ‘‘বাবা, ইলিশ মাছ আনবেন।’’
ছিয়াম মল্লিক দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, ‘‘আচ্ছা, আনবো মা।’’
তিনি আবার হাঁটা শুরু করলেন। আঙ্গিনা থেকে তিনি রাস্তায় পা দিবেন ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে মেয়ে আবার দৌড় দিয়ে ছিয়াম মল্লিকের কাছে এলো। বললো, ‘‘বাবা, যে মাছে বড় ডিম আছে সেই মাছ আনবেন কিন্তু।’’
ছিয়াম মল্লিক মেয়েকে আশ্বস্ত করলেন।
তার মা ও স্ত্রী মিলির কান্ড দেখে নিঃশব্দে হাসতে লাগলো।
ছিয়াম মল্লিক আর দেরী করলেন না।
বেড়া বাস স্ট্যান্ডের বেশ কিছুটা পশ্চিমে করঞ্জা গ্রামের এক বাড়িতে মিলাদ পড়ানো শেষ করে ছিয়াম মল্লিক রওনা হলেন। তিনি বাস স্ট্যান্ডের ওখানে আসতেই মাগরিবের আজান হলো। ওখানকার মসজিদে নামাজ পড়লেন তিনি।
মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর তিনি বগুড়া রোড ধরে উত্তর দিকে কিছুটা গিয়ে রাস্তার বাম পাশের বাজারে ঢুকলেন। পাঁচ কেজি ময়দা কিনলেন।
মেয়ের কথা মনে পড়লো ছিয়াম মল্লিকের। সে ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ নিতে বলেছিলো। এদিকে ইলিশ মাছকে ঘিরে দেখা ভীতিকর স্বপ্নটার কথা মনে পড়ায় তিনি দ্বিধা–দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। কিন্তু মেয়েটা যে আশা করে রয়েছে। তাই মাছ না নিয়ে বাড়ি ফিরলে তার ইলিশ মাছ খাওয়ার আশাটা তো ভেঙ্গে যাবে এবং কান্নাকাটি করবে সে। তার কচি মনে দুঃখ দেওয়া উচিৎ হবে না, এই কথা বিবেচনা করে মাছের বাজারে গিয়ে দেখেশুনে একটা ইলিশ মাছ কিনে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলেন তিনি।
বড় সড়ক থেকে বামদিকে গ্রামে যাওয়ার রাস্তায় গিয়ে পুলের উপর দিয়ে ক্যানাল পার হয়ে ছোট বট গাছটা অতিক্রম করে কিছুদূর হেঁটে ঈদগাহ মাঠের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেইমাত্র ছিয়াম মল্লিক বিশাল বট গাছটার সামনে এসেছেন ঠিক তখনই মস্ত বড় আকৃতির এক হিংস্রদর্শন ভূত অত উঁচু বটগাছটার উপরে এক পা এবং আরেক পা ছিয়াম মল্লিকের সামনে ফেলে তার পথ রোধ করলো। বড় বড় দাঁত বের করে আছে সে। তার মুখের চারপাশ থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে। ক্রোধে ভয়ংকরভাবে গর্জন করে যাচ্ছে সে।
তাই দেখে ছিয়াম মল্লিক শিউরে উঠলেন। প্রচন্ড ভয় তার অন্তরাত্মা পর্যন্ত পৌঁছে গেল এবং তিনি খুব ডরালেন। আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার ছেড়ে তিনি বললেন, ‘‘বাঁচাও, বাঁচাও।’’
তিনি জ্ঞান হারালেন।
বটগাছের দক্ষিণের গাছপালায় পূর্ণ মাটির বড় ভিটাটা ছাড়িয়ে গ্রামের যে প্রথম বাড়িটা আছে সেই বাড়ির লোকজন চিৎকার শুনে দৌড়ে এসে দেখলো যে ছিয়াম মল্লিক অচেতন হয়ে রাস্তার উপরে শুয়ে আছেন। পাশেই ময়দা ভর্তি ব্যাগ ও ইলিশ মাছটা পড়ে রয়েছে।
তাকে ধরাধরি করে পাশের ঐ বাড়িটাতে নিয়ে যাওয়া হলো। খবর পেয়ে ছিয়াম মল্লিকের বাড়ি থেকে সবাই ছুটে এলো। কিন্তু পানি ঢেলে ও অনেক ডাকাডাকি করেও তার জ্ঞান ফিরানো গেল না।
তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আপ্রাণ চেষ্টা চললো তাকে সুস্থ্ করে তোলার জন্য। কিন্তু তবুও মানুষটা বাঁচলেন না। আসলে ভয় একেবারে তার অন্তরে ঢুকে গিয়েছিলো। তাই সপ্তাহখানেক মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার পর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
১৮ আগষ্ট - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
২৭ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪