বিয়ের আংটি বন্ধক রাখা

উৎসব (অক্টোবর ২০১৩)

ওয়াহিদ মামুন লাভলু
  • ৫৯
ঈদের দিন সকালে কোনমতে মুখে খাবার গুঁজে আজিমপুরের বাসা থেকে ডিউটিতে রওনা হলো মঈন। সময়মত পৌঁছাতে হবে। একটি শায়ত্বশাষিত প্রতিষ্ঠানে মাষ্টার রোল ভিত্তিক সিকিউরিটি গার্ড পদে চাকরি করে সে।

আজ আবাসিক এলাকায় তার ডিউটি। ডিউটিতে উপস্থিত হয়ে সে ঈদের নামাজ পড়তে গেল। ডিউটি স্থলে বেশি সময় অনুপস্থিত থাকলে কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়ত দেওয়া লাগতে পারে আশঙ্কায় নামাজ শেষ করে মোনাজাত না করেই সে চলে এলো।

একবার ডিউটিরত অবস্থায় জুমআর নামাজ পড়তে গিয়েছিল সে। এক সিনিয়র ও সম্মানীয় লোক তাকে ডিউটির পয়েন্টে না পেয়ে তার খোঁজ করে যখন জানতে পেরেছিলেন যে সে নামাজ পড়তে গেছে তখন তিনি মন্তব্য করেছিলেন “গরীব মানুষের আবার নামাজ”!

এই ঘটনার পর থেকে মঈন সতর্কতা অবলম্বন করে চলে।

এই এলাকার সকলেই অনেক মেধাসম্পন্ন, শিক্ষিত ও সম্মানীয় ব্যক্তি। অনেক ইনকাম তাদের। তারা সবাই পৃথকভাবে একটা করে গরু কোরবানী দিচ্ছেন। উপরন্তু কেউ কেউ খাসীও ক্রয় করেছেন।

মঈন প্রায় এক বছর পূর্বে এখানে জয়েন করেছে। আগে গ্রামের বাড়িতে থেকে নানান কাজ করতো। মাষ্টার রোলে চাকরি করার অনেক সমস্যা। ডিউটি করলে বেতন পাওয়া যায়, না করলে পাওয়া যায় না। কিন্তু মাষ্টার রোলে চাকরি করতে করতে সাধারণতঃ নিয়মিত পদে চাকরি হয়ে যায়। অবশ্য অনেকের দীর্ঘদিন ধরে মাষ্টার রোলের চাকরির নিদারুন কষ্ট ভোগের পর মধ্যবয়সে কিংবা প্রায় বৃদ্ধ বয়সেও নিয়মিত পদে চাকরি হয়। তবুও একটা নিয়মিত পদ পাওয়ার আশায়ই সে ধৈর্য ধরে লেগে আছে। ঈদের মধ্যে ছুটি নেয়নি। ছুটি নিলে ছুটির দিনগুলির বেতন পাবে না।

বাসায় বৃদ্ধ বাবা মা, বউ শিবা আর ছোট বোন মিলা আছে। ঈদ বোনাস হিসাবে দশ দিনের হাজিরার টাকা দেওয়া হয়েছে। তাই দিয়ে তাদের কাপড় চোপড় কিনে দিয়েছে। কিন্তু নিজের জন্য কিছু কিনতে পারেনি। শিবা গরীব ঘরের মেয়ে। চার মাস আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগে খুব কষ্টে দিন কাটাতো সে। কোরবানীর দিনও সে হয়তো ঠিক মতো গোশত খেতে পারতো না।

মঈন ভাবলো, কিন্তু এবার ঈদের দিন যে জায়গায় সে ডিউটি করছে সেখানকার সকলেই আস্ত গরু কোরবানী দিচ্ছে। শিবার জন্য অনেক গোশত নিয়ে যেতে পারবে।

ঈদের নামাজ শেষে আবাসিক এলাকায় গরু জবাই করা শুরু হয়ে গেল। একটা বড় ষাঁড় জবাই করার সময় মঈনকে ডাকা হলো গরুটা ধরায় সাহায্য করার জন্য। সে গিয়ে ধরলো। তারপর চামড়া ছাড়াতে বলা হলো। সেও লেগে গেল চামড়া ছাড়ানোর কাজে।

সুন্দর ফুটফুটে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা দেখছে। অনেকে মোবাইলের ক্যামেড়ায় ছবি তুলছে। ছেলে-মেয়েদের দেখে মঈনের মাথায় একটা আইডিয়া এল। চামড়া ছাড়ানো শেষ হলে আবাসিক ভবনের পিছন থেকে ভাঙ্গা মাটির কলসের মুখ কুড়িয়ে এনে ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে সে পর্দা দিয়ে ঢোল বানিয়ে দিল। তারপর রোদে শুকাতে দিল। তারা নতুন কিছু পেয়ে মহা আনন্দে মেতে উঠলো। তাদের আনন্দ দেখে মঈন খুব তৃপ্তি পেল।

এসবের ফাঁকে সে ডিউটিও পালন করতে লাগলো। এক সময় সে অল্প দূরে তার ডিউটির পয়েন্টে চলে এলো।

মাংস বানানো যখন শেষ হলো তখন ভাবলো, এখন বোধ হয় তাকে মাংস দেওয়ার জন্য ডাকা হবে। সে চোখ কান খোলা রাখলো।

কিন্তু মাংস গুছিয়ে নিয়ে একে একে সবাই বাসায় চলে গেল। ওকে কেউ মাংস নেওয়ার জন্য ডাকলো না।

এদিকে বেলা দুইটার সময় ওর ডিউটি শেষ হয়ে গেল। তারপরও কিছু সময় রইলো। ভাবলো, হয়তো বাসার ভিতরে মাংস নিয়ে যাওয়ার পর অপেক্ষাকৃত খারাপ মাংসগুলো থেকে ওকে মাংস দেওয়া হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ এলো না।

এদিকে ওর পরে যে লোকের ডিউটির সময় শুরু হবে সে চলে এসেছে। মঈন ধীর পদক্ষেপে ডিউটি স্থল ত্যাগ করলো।

ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলো যে কি করা যায়? বাসায় তো কেউ গোশত খেতে পারবে না।

পলাশীর মোড় পার হয়ে ইডেন কলেজ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল।

শিবা ওকে একটা ছোট-খাট খাসী কোরবানী দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু মাষ্টার রোলের চাকরি করে সবাই মিলে ঈদের পরে চলতে টানাটানি হবে ভেবে মঈন তা করেনি। বউকে বুঝিয়ে বলেছিল, যে এলাকায় আজ ও ডিউটি করবে সেখানকার সবাই আস্ত গরু কোরবানী দিবে। যারা কোরবানী দেয় তারা কিছু মাংস তো গরীব লোকদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ই। আর ওরা তো গরীবই। তাছাড়া ও তো ওখানকার লোকদেরকেই সেবা প্রদান করে। কাজেই সেখান থেকে নিশ্চয়ই গোশত পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন বাসায় গিয়ে বউকে কি বলবে সে? সে তো আশায় আশায় রয়েছে!

মঈনের সাথে সামছুল নামে এক ছেলে চাকরি করে। তার বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। সে একজন এতিম। তার আপন মামা এখানকার বড় একটা পদে আছেন। তিনিই সামছুলকে এখানে চাকরি দিয়েছিলেন। সে তার মামার ব্যক্তিগত অনেক কাজও করে দেয়। সামছুল মঈনকে এখানকার লোকেরা কেমন মানুষ তা বোঝাতে গিয়ে একটা ঘটনা বলেছিল।

এক কোরবানীর ঈদের দিন সামছুলের মামার বাসার সামনে ওর মামা গরু জবাই করেছিলেন। সামছুল সকাল থেকে মাংস বানানোর কাজ করছিল। তারাতারি যাতে খাওয়া যায় সেজন্যে কিছু মাংস প্রথমেই বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামছুলের চোখের সামনে দিয়ে কত লোক তার মামার বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু সামছুলকে খাওয়ার জন্য ডাকা হচ্ছিলো না। ওর মামা ওকে বলেছিলেন, “তোকে স্পেশালভাবে পরে খাওয়াচ্ছি”। এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেলেও, মাংস বানানো শেষ হয়ে গেলেও যখন তাকে খাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল না তখন সে ধৈর্য হারিয়ে বাসায় চলে গিয়েছিল।

এই ঘটনাটা মঈন যখন শুনেছিল তখন পুরোপুরি বিশ্বাস করেছিল না। কিন্তু আজ এখন মনে হচ্ছে সামছুল সত্যি কথাই বলেছিল।

এসব ভাবতে ভাবতে ধীর পদক্ষেপে চিন্তাক্লিষ্টভাবে এগিয়ে চলার এক পর্যায়ে এক স্বর্ণের দোকানের দিকে দৃষ্টি যেতেই একটা বুদ্ধি মাথায় এলো মঈনের।

ওর শ্বশুর দিনমজুর হওয়া সত্ত্বেও বিয়েতে ওকে একটা আংটি দিয়েছিলেন। সেই আংটিটা বন্ধক রেখে গোশত কিনে বাসায় ফিরলে তো ভালোই হয়। ওদের বাড়ির এলাকায় কোরবানীর ঈদের দিন গোশত বিক্রি না হলেও শুনেছে যে রাজধানী শহর ঢাকায় নাকি ঈদের দিনেও গোশত বিক্রি হয়।

আংটির ব্যাপারটা শিবা টের পেলে এবং আংটির কথা জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দিলেই হবে। আর গোশত কিভাবে এনেছে সে ব্যাপারে মিথ্যা কথা বললে তো বাসার কারো পাপ হবে না। পাপ হবে ওর নিজের। বাসার সকলের আনন্দের জন্য না হয় এই পাপটি সে করলোই!

সে দোকানে গিয়ে ওর হাতের আংটিটা বন্ধক রেখে তিন হাজার টাকা নিল।

তারপর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে গোশতের খোঁজ পেল। ও দশ কেজি গোশত কিনলো। তারপর বাসার দিকে রওনা হলো। কাছাকাছি গিয়ে নিজের মনটাকে শক্ত করলো যাতে কেউ ওর মনের কষ্টটা ধরতে না পারে।

বাসায় ঢোকার পর গোশত দেখে শিবার চোখ খুশীতে বড় বড় হয়ে গেল। বললো, এত গোশত এনেছো?
মঈন বললো, বলেছিলাম না, আমি যেখানে চাকরি করি সেখানকার সবাই ধনী লোক। সবাই আস্ত গরু কোরবানী দিচ্ছে। আমি তো ইচ্ছা করলে আরো গোশত আনতে পারতাম। কিন্তু এমনিতেই এত গোশত পেয়ে গেলাম, তাই আমি ইচ্ছা করেই আরও গোশত আনার কোন চেষ্টাই করিনি।

মঈন দ্রুত তার রুমে গেল। পানিতে চোখ ভিজে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পর শিবা রুমে প্রবেশ করলো। তার দিকে তাকালো মঈন। শিবা উজ্জল শ্যামলা। মাথা ভর্তি চুল। আজ চুলে শ্যাম্পু করেছে। আলগা চুলগুলি খুব সুন্দর লাগছে। নতুন শাড়ি পরেছে। তাকে সজোরে বুকে চেপে ধরে মনের সব দুঃখ দূর করার ইচ্ছা জাগলো মঈনের। সে এগিয়ে গেল শিবার দিকে। শিবা ওর দিকে তাকিয়ে দুষ্টামির হাসি হেসে একটু সরে গেল। ওর ঠোঁটের প্রসারণ-সংকোচন আর হাসি দেখে সব কষ্টের কথা ভুলে গেল মঈন।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মাসুম বাদল besh bhalo laglo...
অশেষ ধন্যবাদ ভাই।

১৮ আগষ্ট - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪