তার অপরাধ সে কেন লেখে?

ব্যথা (জানুয়ারী ২০১৫)

মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ
  • 0
  • ১৫

আজ মোটর সাইকেল চালানো শিখতে যাবে সিফাত। আগেও দু’বার গিয়েছিলো। তেমন সফল হয়নি। শিখার তেমন তাগাদাও ছিলো না তখন। তবে আজ বের হয়েছে এক নব উদ্দেগে। আজ নিয়ত করেছে যে করেই হোক সে শিখবেই। তাছাড়া এখন সে সব কিছুই শিখবে।
সে এই চালানোটা শিখে তার ছোট ভাই সায়েমের কাছে। সায়েম নিজে নিজেই শিখে গেছে।
সিফাত যে কী?! কোন কাজেই ভালো সফল হতে পারে না। যদিও পড়ালেখায় সবার শীর্ষে তবে এটা বাদে সব কিছুতে নীচে। অনেক নীচে।
অথচ সায়েম! কী পারে না ও?
বয়সে যদিও সিফাত সায়েমের চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু তাতে কী? পাঁচ বছর পরে জন্মালেও হয়ত ওর মত হতে পারত না সিফাত।
ছোট ভাইয়ের সাথে বের হতে একটু লজ্জাই লাগছে সিফাতের। আগে লজ্জাটা একটু বেশিই ছিলো। তবে তার কিছুই করার নেই। শত লজ্জা সয়েও তাকে এগিয়ে যেতে হবে সম্মুখ পানে।
আগের বার শিখতে এসেছিলো সাইকেল চালানো শিখা ছাড়াই। তাই আশে পাশে যারা ছিলো তাদের সবার ঝারি তো খেয়েছেই। সাথে খেয়েছে ছোট ভাইয়েরও ঝাড়ি। সায়েমের ঝাড়ি খেয়ে আর টিকে থাকতে পারে নি সিফাত। হন হন করে চলে এসেছিলো সেদিন। ফুপিয়ে কিছুক্ষণ কেঁদেওছিলো কাউকে না জানিয়ে। তখন তো বাবা জীবিত ছিলো। বেশি কিছু বলতে পারে নি সায়েম। তাছাড়া শিখার তেমন আগ্রহও ছিলো না সিফাতের। থাকতও না। বাবার মৃত্যু এবং তার শেষ অসিয়তগুলোই এখন তাকে সব কিছু শিখতে তাড়া করছে।

সিফাত আর যাই পারুক বা না পারুক মোটামুটি লেখালেখি করতে পারে। চেয়েছিলো এটাকেই সম্বল হিসেবে গ্রহন করবে, অভিষ্ঠ লক্ষ্য বানাবে। কিন্তু এতেই সে বাঁধার সম্মুখীন হলো। চরমভাবে। সবখানে। তখনই বুঝে নিয়েছিলো-
কেউ কবি-সাহিত্যিক হতেও ভালবাসে না যারা হয় তাদেরও ভালবাসে না।
সিফাতের স্কুলের হেড মাস্টার তো প্রতি পরীক্ষার পুরষ্কার দেয়ার সময়ই শুনিয়ে দেন চার-পাঁচ ঘা। গত পরীক্ষায়ও বলেছিলো-
‘কী কবি সাহেব! পুরষ্কার তো নিলেন। ভালো করে লেখা-পড়া কইরেন। এখনো কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
ও প্রতিবারই মিথ্যা উত্তর দেয় ‘জি না স্যার’ বলে।
স্যর যখন ‘কবি সাহেব’ বলে চেচিয়ে ওঠেন তখন উপস্থিত কেউই না হেসে পারে না। বেচারা লেখাপড়ায় এত ভালো হওয়া সত্ত্বেও পুরষ্কার নেয়ার সময় যখন এই বিভ্রান্তিতে পরে তখন প্রায়ই ‘আজম’ করে বসে-
‘যাহ, আর পড়বো না ভালো করে। প্রতিবার এমন লজ্জা আর ভাল লাগে না।’
(তবে কখনো ভুলেও তার এই চিন্তা হয় না যে, ধুর আর লেখালেখি করবো না।)
পরক্ষণেই বিবেক সান্তনাদাতা সেজে হাজির হয় এবং মনে করিয়ে দেয়-
‘আমার এতে লজ্জার কী আছে। যেই উপাধির ধারক হওয়া আমার স্বপ্ন স্যর তো আমাকে সেই নামেই ডাকছেন। তাছাড়া এখন আমি আল্লাহ তায়ালার রহমতে প্রতি পরীক্ষায় ফাস্ট হচ্ছি তারপরও এত সতর্কবানী; আর যদি পড়া-লেখায় ঢিল দেই এবং ভালো রেজাল্ট না করি তাহলে তো আমার উপর কারফিউ জারি হবে! সব দোষ চাপবে ওই লেখালেখির। বন্ধ হবেই।’
তখনও সিফাত জানে না যে, ফাস্ট বয় হয়েও তাকে লেখালেখি ছাড়তে হবে।


সিফাত শুধু কবিতাই লেখে না।তবে তবে কবি হিসেবে প্রসিদ্ধ হবার একটা কারণ আছে। গত বছর বাংলা নববর্ষে নিজের কয়েকটা কবিতা এবং ওর মত আরো কয়েকজনের কাছ থেকে কিছু কবিতা নিয়ে একটা ‘চটি বই’ বানিয়ে কম্পোজ করে পুরো স্কুলে বিলি করে। এতে প্রায় শিক্ষকই মনক্ষুন্ন হন। কেউ অবশ্য এমন দুঃসাহসের প্রশংসাও করেন।
শেষ পর্যন্ত সিফাতকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু প্রভাবশালী বাবার বারংবারের ক্ষমা চাওয়ায় সেবারের মত রক্ষা পায় সিফাত। তারপর থেকে সবাই চোখে চোখে রাখে ওকে। কেউই চায় না সিফাতের মত একজন ভালো ছাত্র ‘সাহিত্যিক’ নামক পাগল হয়ে যাক!!

এ ঘটনার পর থেকে ওর ওপর নেমে আসে কঠিন দুর্বিষহ জীবন। এমনিতেই ওর বেশি বন্ধু-বান্ধব নাই। সব সময় প্রায় এক একাই থাকে।
সহপাঠীদের নিকট ওর অবস্থা আগে থেকেই নাজুক ছিলো। কেউ হিংসায় জ্বলে ওর লেখা দেখে। কারো আবার পড়ার হিংসা। ও কেন বারবার ফাস্ট হবে?
পরীক্ষার সময় সবাই যেমন সুবিধা পায় ও তার সিকি ভাগও পায় না। স্যর নোট জাতীয় কিছু লেখে দিলে সবাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিলেও ওকে জানতেই দেয়া হয় নাযে স্যর নোট দিয়েছেন।
স্কুলে সবার আগে আসলেও বসতে হয় সবার পিছনে। কেননা সবাই নাকি বছরের শুরু থেকেই জায়গা কিনে রেখেছে!!

ক’দিন আগের ঘটনা। ওর একটু বই পড়া পছন্দ। (লেখকদের এটা স্বভাবগত গুণ) এই পড়াটাও কারো সহ্য হলো না। বাবারও না স্কুলের ছাত্র শিক্ষক কারো না।
তবে একজনই ভরসা ছিলো। আর তিনি হলেন তার মা। অনেক বলে কয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই কিনে। বাসায় তো পড়ার কোন সুযোগই নেই। কেননা ওর ছোট ভাই সায়েম। ক্লাসের বই ছাড়া অন্য কোন বই দেখলেই বিচার দিয়ে দিবে। আবার স্কুলে একটু পড়তে বসলেই কোনদিন ‘দেখি দেখি কী বই’ বলে সবাই হুলুস্থুল করবে। এবং শেষ পর্যন্ত বইটি ছিড়ে ছাড়বে। তারপর শুরু হবে একে অন্যের দোষ দেয়া। শেষে ক্লাসের ঘন্টা পড়ে যায়, কাহিনী ওখানেই খতম। আবার কোনদিন কোন লিডার টাইপের কেউ এসে বলে-
‘তুই হলি ফাস্ট বয় তুই যদি এমন ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে অন্য বই পড়িস তাহলে এলাকার মান রাখবে কে? দে আমাকে দে।’ এই বলে বই নিয়ে যাবে।


একদিন সবাই মিলে করল এক আজিব কান্ড। আর এই ঘটনাই তাকে সরিয়ে দেয় লেখার জীবন থেকে। স্কুল থেকে ফিরে সিফাত দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সেদিন বাবা ছিলো বাসায়। হঠাৎ সিয়াম এসে ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলল-
‘বাবা তোমাকে তার রুমে ডাকছেন।’
চিন্তা করতে লাগল- কী হতে পারে ব্যপারটা?
গিয়ে দেখে তার ক্লাসের সবাই বাবার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে। সাথে আছেন দু’জন স্যরও। সবার হাতেই একটা না একটা বই। তবে স্যরদের বইগুলো একটু অন্যরকম। মাসিক পত্রিকা টাইপের।
বাবার এক ‘শান্তঝাড়ি’ দ্বারাই বুঝে নিয়েছে সব। বাবা সবার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে সিফাতের দিকে তাকাল এবং বললো-
‘আজ থেকে তোমার ক্লাসের বাইরের কোন কিছু পড়া বা লেখা সম্পূর্ণরুপে বন্ধ। যদি এরপর আর কোন অভিযোগ পাই তাহলে আমি কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব।’
ওদিন এতটুকই ছিলো কথাবার্তা। তারপর সবাই আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলো। সবার মুখেই ছিলো হাসি হাসি ভাব। সবাই যেন মনে-প্রাণে তৃপ্ত হয়েছে।
পরে মায়ের কাছে সব শুনেছে সিফাত। ছাত্রদের অভিযোগ ছিলো- সিফাতের কারণে তাদের পড়া হয় না। ও প্রতিদিন সবাইকে একটা করে বই দেয় এবং তাদের পড়া ডিস্টার্ব করে!!
আর স্যার দুজন সিফতের লেখা ছাপা হয়েছে এমন দুটি মাসিক পত্রিকা নিয়ে আসে। তাতে ওর লেখা একটা উপন্যাস ও একটা কবিতা ছিলো। উপন্যাসটি ছিলো ওর নববর্ষের কার্যক্রম এবং তা ভন্ডুল হবার কাহিনী নিয়ে। আর কবিতাটি ছিলো ‘বাংলার প্রতি অনিহা’ শিরোনামে মোটমুটি এই স্কুলের স্যরদের বিরুদ্ধে। এতে এলাকা, প্রষ্ঠিান ও শিক্ষকদের মানহানি হয়। এটাই ছিলো স্যরদের অভিযোগ!!

তারপর সিফাত কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে। এমনিতেও সে কিছুই পারে না। সে নিজেও জানে শুধু লেখাপড়া ভালো জানলেই সব হয় না। যা পারে তাও না পারার মতই সমাজে এ পারার কোনই দাম নেই।
প্রতিবেশী, দূর-নিকটের আত্মীয়দের প্রায় কেউই তাকে তিরষ্কার করা থেকে বঞ্চিত নয়। যেমন কেউ বলে- স্কুলে পরিয়েও ছেলেটাকে পাগল বানাচ্ছো।
আবার কেউ বলে-ছেলেটা প্রেম করত নাকি?! প্রেমিকরাই তো সাধারণত ‘কবি’। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তার আশা ছিলো বাসায় অন্তত একটু নিস্তার পাবে। কিন্তু বাসায় যে অপেক্ষা করছিলো তার জন্য সবচে’ ভয়াবহ মুহুর্ত তা কি সে জানত? বাহিরের তামাম ঝক্কি-ঝামেলা শেষ হত এই বাসায় এসেই। সব পড়ত গিয়ে মা-বাবার উপর। তারাও দিন দিন খুব অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন।
প্রথম প্রথম তো কেউই তেমন জানত না। ও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু আধটু লিখত এবং সুযোগ বুঝে স্কুলের পাশের ডাক অফিস থেকে পাঠিয়ে দিত। ডাক অফিসের রহিম মিয়াও তার লেখা খুব যত্ন করে নিত। কোন পত্রিকায় ছাপা হলে সেই তদারকি দিয়ে একটি ‘লেখক কপি’ সংগ্রহ করে ওকে দিত। কিন্তু এখন সব বন্ধ। বিশেষভাবে স্যারদের দেয়া বিচারের পর। কোনভাবেই আর পারছে না লেখা পাঠাতে। ওদের বাসায় কম্পিউটার আছে। কিন্তু ওর চালানোর কোন সুযোগ নাই। সায়েম থাকলে পুরো টাইমই সায়েমের। বিভিন্ন ব্যবসা-বানিজ্য নাকি করে ও। তাছাড়া সুযোগ পেলে কী হবে ও তো টাইপই জানে না। ছোট ভাইয়ের অনুগ্রহে যতটুকু হয় আর কি। এখন তো বাবার নির্দেশে তাও বন্ধ। আগে টাইপ করাত কারণ হাতে লিখে পাঠানোর চেয়ে কম্পোজটা বি.স.দের কাছে দাম পায় বেশি। এখন আবার ই-মেইলের যুগ। উন্নত পত্রিকায় পাঠাতে ই-মেইল লাগে। আগের চেয়ে ওর এখন টাইপের প্রয়োজন বেশি। কিন্তু বাবার কড়াকড়িও যে আগের চেয়ে বেশি। যদি বলে আমারও তো চালানের অধিকার আছে তাতেও লাভ নেই। কেননা ব্যবসায়ী ক্লান্ত ভাই!! ভাইও আগের মত তেমন গরজ করে না। আর ওর তো সেই পুরোনো জিনিষ ‘ও কিছুই পারে না।’ না পারে টাইপ করতে না মেইল করতে। গেম খেলতে যদিও পারে। সাথে খাওয়া লাগে বাপ-ছেলের হাজারটা ঝাড়ি। এভাবে না ওভাবে, এখন গুলি কর, এটাকে আগে মার, এদিক দিয়ে যা, নইলে মরবি, শেষ অবধি উঠতে বাধ্য হয় ও। চটাং করে সায়েম বসে যায় খেলতে।
ও মাঝে মাঝে অনেক কাঁদে। অনেক। এত কাঁদে যে, বিশ্বের সবচে’ দুঃখি ব্যক্তিও হয়ত এত কাঁদে না। কিন্তু ওর এই ক্রন্দন কেউ দেখে না। এই দুনিয়ার কেউই না। ও চায় ওর এই দুঃখটুকু ওর প্রিয় সঙ্গির (কলম-খাতা) সাথে ভাগ করে নেবে। কিন্তু তাও পারে না। প্রকাশ হয়ে যায়। এটা করে ওর মা। সে জানে তার ছেলে লেখক। তাই সময় পেলেই চেক করতে লেগে যায়। কোথাও কিছু লিখেছে কিনা। কোন কিছু পেলেই পড়ে ফেলে। শুধু পড়েই না। বাপ-চাচা খালা-মামা সবাইকে তা শুনিয়ে ছাড়ে। তারপর শুরু হয় মন্তব্য। কেউ করে বাকা কেউ ত্যাড়া-
ছেলের ঢং দেখছো? এইটুকুন ছেলের আবার অভিমান? ছোট মুখে দেখছি খুব বড় গলা ঝুলিয়েছে।
উত্তরে ও কিছুই বলতে পারে না। পারে না আর সেই প্রিয় সিঙ্গীটিকেও বলতে। শুধু সয়েই যেতে হয় প্রথম প্রথম ইচ্ছে হত মাকে আচ্ছা করে বকে দিতে। কিন্তু মায়ের মুখে সেদিনের কথাটা শুনার পর আর কিছু বলতে পারে না। ইচ্ছাও নাই। সেদিন বলেছিলো-
‘তোর লেখালেখি কেউ দেখতে পারে না ঠিক আছে তবে আমি কিন্তু তোর অনেক বড় একজন ভক্ত। যেখানেই তোর লেখা পাই পড়ে ফেলি। খুব ভালো লাগে পড়তে। শেষ করার পর মনে হয় এটা অমুককে শোনালে ভালো হবে। অমুকের জন্য এতে শিক্ষা আছে। তাই তোর চাচা-খালাদেরও মাঝে মাঝে শুনাই। আমি তো আর জানি না তোর আত্মীয়রা এমন বিরুপ মন্তব্য করবে? বারবারই নিয়ত করি আর কখনোই বলব না। কিন্তু তোর লেখার এতই প্রভাব যে, আর থাকতে পারি না। নিজের অজান্তেই জানিয়ে দেয়া হয়ে যায় অন্যকে। পরবর্তীতে ঠাট্টা শুনে হুশ ফিরে।’
এখন আর সে সময় নেই। এখন তার উপর অনেক কড়াকড়ি। কেন যে এই চাপ সে অনেক সময় বুঝেই উঠতে পারে না। ডাক যোগে কিছু পাঠানোও বন্ধ। মেইল-টাইপ তো বহু দূর। খাতায়ও আর লেখা যায় না। এই সবই হচ্ছে বাবার কারণে। বাবার কেন যেন কবি-সাহিত্যিকদের প্রতি খুব ক্ষোভ। এরা যেন মানুষই না। নিজের ঘরে যখন আপন ছেলেকে তাদের পথে হাটতে দেখে তখন তো এই কড়াকড়িই স্বাভাবিক।
এভাবেই চলছিলো সিফাতের দিনকাল। না পারছিলো কাউকে কিছু বলতে না পারছিলো সইতে। মাকে বলে কোন লাভ হয় না। মা যে তার লেখা পছন্দ করে সেটা কেউই জানে না। সিফাতও চায় না তার কারণে তার একমাত্র ভক্ত মার কোন সমস্যা হোক। মার সামনে যখন বাবা ছেলেকে বকা-ঝকা করে তখন তাকে ছেলের সাথে তাল মিলাতে হয়। নইলে যে বিপদ। বাবা মনে করবে বউটাও কবি বনে গেছে।
সিফাত কেন্তু একটা কাজ প্রতিদিনই করে। আর তা হলো চাঁদ, তার, সূরযের সাথে কথা বলা! তাদের প্রতিদিনই সে জিজ্ঞাসা করে তার কী অপরাধ? সে কী পারবে না তার জীবনে সফল হতে? যাদেরকে জিজ্ঞাসা করে তারা কী উত্তর দেয়? দিলে দিতেও পারে।
ক’দিন আগের কথা। বাবা দুপুর তিনটায় ফিরলেন হঠাৎ করে। এত সকালে সাধারণত ফিরেন না। আজ ফিরলে সবাই বুঝে গেলেন কিছু হয়েছে হয়ত। সাবাই লক্ষ করলো বাবার হাতে একটা পত্রিকা। চেহারাটা একটু মলিন। সিফাত ভাবতে লাগল – তাহলে তার লেখা দৈনিক পত্রিকাতেও… না না এসব কী ভাবছি? বাবার হাতে পত্রিকা আর আমি কিনা ভাবছে তাতে আমার লেখা? এখনই হয়ত হামলে পড়বে আমার উপর। ঝাড়ির পর ঝাড়ি মারবে। তারচে’ বরং অন্য কিছু ভাবা যাক- হয়ত কোন বিশেষ কোন খবর বা আমাদের আত্মীয়দের কারো নাম পত্রিকায় এসেছে।
বাবা কাউওকে কিছু না বলে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। একটু পরে ডাক পড়লো সিফাতের। দুরু বুকে উপস্থিত হলো বাবার সামনে। দেখলো- বাবা পত্রিকার ছোটদের পাতা পৃষ্ঠাটি খুলে বসে আছে। তাতে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে লাল কালির বড় হরফে লেখা শিরোনামটি- “অজানা আশংকা”। সাথে সাথেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সিফাতের মন। নিজেকে একজন সার্থক লেখক হিসেবে ভাবতে লাগলো। নিয়ত করল- আজ আমার চোখে কোন অশ্রু নেই। আমার বাবা আজ আমাকে যাই বলুক আমি মাথা পেতে নেব। একটুও কাঁদব না। বিরক্তও হবো না। আমি আমার দুঃখের মাঝে সুখ খুজে পাচ্ছি। আমি...
হঠাৎ হাসি হাসি ভাব নিয়ে বাবা বলে উঠলেন-
‘বেটা আমার! শুধু লেখক হলেই হবে না। জিবনটা শুধুই লেখালেখির না। দুনিয়াকে চিনতে হবে। বুঝতে হবে দুনিয়া আমার থেকে কী চায়। দুনিয়ার সব কিছু ঠিক রেখেও লেখালেখি করা সম্ভব। তুই যদি শুধুই লেখালেখি করিস তাহলে কি তুই ভাবছিস আমি সফলতার পূর্ণ সীমায় পৌছে গেছি? না তা নয়। তুই কি ভাবিস তুই লেখালেখি নিয়েই সুখে থাকতে পারবি? না পরবি না। নিজেও সুখ পাবি না। কাউকে দিতেও পারবি না। এজন্মে তুই আমাদের জালাচ্ছিস। ভবিষ্যতে জালাবি বউকে এবং নিজ সন্তারদেরকে।
এতটুকু বলে আঃ রহমান সাহেব একটু বিশ্রাম নিলেন। তারপর আবার আবেগি কণ্ঠে বলে উঠলেন-
কোনদিন তোর কোন সফলতা আমাকে দেখাতে পেরেছিস? বলতে পেরেছিস? – ‘বাবা! এই বিষয়ে আমি সফল হয়েছি।’ পরীক্ষায় সিরিয়াল পাওয়া আর লেখালেখি করা কোন সফল মানুষের জীবনী নয়। হতেও পারে না।
তুই না পারস দোকান চালাতে না পারস অফিসটায় বসতে। তোর ছোট হয়ে আর কত করবে ও? আমি কি আর চিরকাল বাঁচব নাকি? আর মরে গেলে ভাবছিস তোর ভাই তোকে চালাবে? যদিও চালায়, তোর কি তাতে একটু লজ্জাও রাগবে না? অথচ দোকানে গেলে পারস না কথা বলতে বা বিক্রি করতে। অফিসে গেলে হিসেবে করস গড়মিল। না পারস কম্পিউটারটা চালাতে। সাঁতারও পারস না। বাইক চালাতে বা গাড়ি চালানোও শিখলি না। ইংরেজিতেও কাঁচা রইলি অংকও পারিস না।
কী.. কী করতে চাস তুই জীবনে? কী হতে চাস?
দুই কলম লিখলেই কী তোকে মানুষ ভাত দেবে ভেবেছিস? এখন তোদের কোনই দাম নাই। এক সময় ছিলো। লেখক-কবিরাই ছিলো রাজা-বাদশাহদের সবচে’ প্রিয়জন। এখন আর ওই দিন নেই রে বাবা! লেখক হতে হলে এখন সাথে সাথে অনেক কিছুই ঠিক রাখতে হয়। তোকে সাধেই লেখালেখি থেকে ফিরিয়ে রাখি নি। অনেক কারণ আছে এর পিছনে। আমিও তোর মত লেখক হতে চাইতাম। আর এই জন্যই আমি সবচে’ গরিব রয়ে গেছি অন্য ভাইদের থেকে। আমার এই বর্তমান অবস্থায় পৌছতে যে কত কষ্ট হয়েছে তা শুনলে জীবনেও লেখার দিকে পা বাড়াতি না……..
হঠাৎ ভাবনায় পড়ে গেলো সিফাত। আর কিছু ঢুকছে বাবার কথা। যা বোঝার বুঝে গেছে। আসলেই তাই। বাবা যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এত পড়ে কেন? তাহলে কি তিনিও এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন? হবে হয়ত। না। তাহলে তো এত কড়াকড়ি করতেন না আগে থেকে। হয়ত সমাজের চাপে করেছেন। এখন সিফাত কী করবে? ভাবে। শুধু ভাবে। পায় না। কোন কুল কিনারা পায় না।
তারপরের ব্যবস্থাগুলো বাবা থাকলে তিনিই করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি যে চলে গেলেন হঠাৎ করেই। এই সুবিশাল বয়ানটিই হয়ত ছিলো তার জন্য অসিয়ত।
এখন সে সব শিখবে। কিন্তু কে শেখাবে? সে যে অনেক দেরী করে ফেলেছে। তাকে কেউই আর এসব যাবতীয় বিষয়গুলো শিখনোর আগ্রহ করবে না।
নাস্তা সেরে সায়েমের সাথে বের হলো সিফাত। আধা ঘন্টার মত চেষ্টাও করল মোটর সাইকেল চালানো শিখতে। লাভ হয় নি। এবার যদিও সাইকেল চালানোটা কোন একভাবে শিখতে পেরেছে। কিন্তু তবুও সে পারল না। শুধু কয়েক গাদা ঝাড়ি খেলো ছোট ভাইয়ের কাছে। আগে বাবা থাকলে বেশি কিছু বলতে পারত না। এখন পুরোপুরিই পাল্টে গেছে ও। তেমন কথাই বলছে না সিফাতের সাথে।
নিজেকে আজ বড়ই অসহায় লাগছে। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো লেখা কোন কবিতার অংশ-
নিজেকে আজ কেন যে হায় দোষী মনে হয়
জীবন নামের যুদ্ধে আমার কবে হবে জয়?


শেষ কথা- সিফাতের মত আমাদের অনেকেই এখন এরকম ছোট-খাট অসহায়ত্বের শিকার। যাদের অপরাধ তারা গন্ড মূর্খদের মত কেন লেখালেখি করবে? জীবনটা কি শুধু লেখালেখির মত তুচ্ছ কাজ করে কাটিয়ে দেয়ার?
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
মনজুরুল ইসলাম অবশ্যই েলখক হতে হেল বতর্মান সমেয় অথর্ৈনিতক িনরাপত্তা থাকা খুবই জরুরী।সমেয়াপেযাগী িবষেয় েলখার জন্য েলখকেক ধন্যবাদ তোব অাবেগ অারো েবিশ হেল অােবা ভােলা লাগতগল্পটা। শুখ কামনা রইল।
ভালো লাগেনি ২৩ জানুয়ারী, ২০১৫
মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্ আসলে বাবাজী, কথাটাতো মিথ্যা নয় ! কিন্তৃু তোমার চমৎকার লেখা পড়ে আমিও যে তোমার ভক্ত হযে গেলাম ! খুব ভাল লাগল ।
ভালো লাগেনি ১৬ জানুয়ারী, ২০১৫
মিসির আলম lলেখা নিয়ে লেখাটা পড়ে বেশ ভালো লাগলো । আমারও এই প্রথম এই সংখ্যায় গল্প আছে ।সময় পাওয়ার পর আগ্রহী হলে পড়ে দেখবেন ।দুয়া রইল
জাতিস্মর বেশ ভালো লেগেছে। আমারো একটা ছোট্ট গল্প আর একটা ছোট্ট কবিতা আছে। সময় পেলে পড়ে দেখবেন।
Sumon Dey ভালো লাগলো । শুভেচ্ছা জানবেন ।
গোবিন্দ বীন ভাল লাগল,ভাই।আমার কবিতা ও গল্প পড়ার আমন্ত্রন রইল।
জুন অনেক ভালো । প্রতিটি পর্বই খুব গুছানো ছিল। আপনার জন্য শুভ কামনা।
মাহমুদ হাসান পারভেজ সিফাতের সাহিত্য চর্চা এগিয়ে চলুক সব বাধা ডিঙিয়ে। লেখকের জন্য শুভকামনা সবসময়।
সৃজন শারফিনুল কি বলবো বুঝতে পারছিনা। বাস্তববাদী গল্প... আসলে বাস্তবিক অর্থে বলতে গেলে-- লেখালিখি মানেই জীবন নয়, লেখালিখির পাসাপাশি জীবন গঠনের ব্যাপারটিও জরুরি। ভাল লাগল.. শুভ কামনা।।

১৫ আগষ্ট - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ৭ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪